কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন গল্পকার শামসুল কিবরিয়া।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে
শামসুল কিবরিয়া: আমি যখন ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি তখনই আসলে আমার লেখার হাতেখড়ি হয়। এর কারণ ছিল আমাদের গ্রামের বাড়িতে কিছু পত্রিকা নিয়মিত আসতো। আব্বা পত্রিকা পড়তেন। এগুলোতে প্রকাশিত ছড়াগুলো আমার ভালো লাগতো। পাঠ্যবইয়ের ছড়াতো ছিলই। আর আমার বড় ভাই লেখার সাথে জড়িত থাকার ফলে শৈশবেই কিছু বই বাড়িতে পেয়ে যাই। এসব অনুকূল পরিবেশ লেখতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। এসময়ই আমি কিছু ছড়া লেখার চেষ্টা করি। যদিও এগুলো শেষপর্যন্ত ছড়া হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। স্কুল শেষ করে কবিতা লেখা শুরু করি। আর গল্প লেখা শুরু হয় ২০০৬/২০০৭ এর দিকে। এখন এই গল্পতেই থিতু হয়েছি।
২। ‘ছোটগল্প’ আপনার কাছে কী?
শামসুল কিবরিয়া: মানুষ বরাবরই গল্প শুনতে পছন্দ করে। আর বাস্তবতার সাথে যদি অলীক কিছু মিশিয়ে দেয়া হয় তাহলে তা আরও মুখরোচক হয় শ্রোতার কাছে। তো সাহিত্যের ফরমেটে ফেলে যখন গল্পকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এতে কিছু নিয়ম কানুন আরোপিত হয়ে যায়। এসব মাথায় রেখেই বলি গল্প আমার কাছে মানুষকে চেনার অন্যতম একটি উপায়। জীবনের গভীর ব্যঞ্জনাগুলো ছোটগল্পে যেভাবে ধরা দেয় তা মনকে আলোড়িত করে। ফলে গল্পের বিষয়নির্বাচন, ভাষাপ্রয়োগ ও উপস্থাপনভঙ্গিতে একটি অভিনবত্ব থাকা দরকার। গল্পের একরৈখিক পরিণতির চিন্তা না করে গল্পকে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে বহুমাত্রিক পরিণতির দিকে।
৩। কথাসাহিত্য মানুষকে কী দিতে পারে?
শামসুল কিবরিয়া: যদি একেবারে ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করি তাহলে শুধু কথাসাহিত্য কেন বৃহত্তর অর্থে সাহিত্যই বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু নয়। তবু কালে কালে কিছু মানুষ সাহিত্যের সাথে জড়িত হয়ে যায়। আমি মনে করি এখানেই সাহিত্যের মূল রহস্যটি লুকিয়ে আছে যা ব্যবহারিক প্রয়োজনের অনেক উর্দ্ধে অবস্থান করে। কথাসাহিত্য মূলত মানুষের কথা বলে। একটি গল্পে বা উপন্যাসে মানুষকে যেভাবে তুলে ধরা হয়, যেভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তা আর কোন মাধ্যমেই সম্ভব নয়। ফলে গল্প বা উপন্যাসের কোন একটি চরিত্র বা কোন একটি ঘটনা মানুষের চিন্তার জগতে নাড়া দিতে সক্ষম। তার নিয়ত যাপিত জীবনকে নতুনভাবে অনুভব করাতে সক্ষম। আমাদের চেনা বাস্তবতাকে যখন একজন কথাসাহিত্যিকের চোখে দেখি তখন চেনা জগতটাই যেন অন্যভাবে আমাদের সামনে ফুটে উঠে। এতে একজন পাঠক হিসেবে আমরা কখনো বিস্মিত হই, কখনো আনন্দিত হই, কখনো ব্যথিত হই। এটাই কথাসাহিত্য থেকে আমাদের প্রাপ্তি।
৪। “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এরকম শর্ত বা নির্মাণ বৈশিষ্ট্যকে কতখানি সমর্থন করেন?
শামসুল কিবরিয়া: রবীন্দ্রনাথ যখন ছোটগল্পকে সংজ্ঞায়িত করেন তখন যে বাস্তবতা ছিল এখন সে বাস্তবতা নেই। বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ছোটগল্প আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। ছোটগল্পের পরিণতির যে উপায় তিনি দিয়েছিলেন এর পরে লিখিত বিস্তর ছোটগল্প লেখা হয়েছে। অনেক গল্পেই দেখা যাবে এই শর্ত ঠিক থাকেনি। একেকজন লেখক একেকভাবে ছোটগল্পের পরিণতি টেনেছেন। ফলে এই শর্ত মেনে ছোটগল্প লেখা যেতে পারে না-ও লেখা যেতে পারে। তবে ছোটগল্প পাঠ শেষে অনুনোমিত ব্যঞ্জনা যেন তৈরি হয় সেদিকে গল্পকারকে সতর্ক থাকতে হবে।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
শামসুল কিবরিয়া: মূলত আমার লেখার অনুপ্রেরণা আমার নিজের ভেতর থেকেই আসে। একটি লেখা শেষ করার পর আরেকটি লেখা শুরু করার তাগিদ অনুভব করি। এছাড়া সাহিত্য জগতে এবং এর বাইরে আমার যারা সুহৃদ আছেন তারা আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেন।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
শামসুল কিবরিয়া: আমি সিরিয়াসলি লেখার জগতে প্রবেশ করি তখন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যাই ছোটকাগজ ‘চারবাক’ এর সাথে। এ পত্রিকার সম্পাদক রিসি দলাই, আরণ্যক টিটো, মজিব মহমমদ -এঁদের সাথে হৃদ্যতা গড়ে উঠে। এরা সকলেই বয়সে আমার বেশ বড়। তবু এঁদের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ঢাকার পরিবাগের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের পাঠচক্রের মাধ্যমে এবং চারবাকের অন্য আরেকটি আয়োজন ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়। আমার উত্থানপর্বে এঁরা জড়িয়ে আছেন। যেহেতু আমার বিচরণের জগৎ সীমিত, তাই সে অর্থে শত্রু তেমন গড়ে উঠেনি। আমার লেখা কারো অপছন্দ হতেই পারে। তবে এজন্য আমাকে নিন্দুকের মোকাবিলা করতে হয়নি। কোন কোন জায়গায় আমার গল্প একটু দুর্বল হচ্ছে সেটা অনেকে বলেছেন। আমি এটা ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি।
৭। লেখালিখির ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ তত্ত্ব বা রাজনৈতিক দর্শন কতোটা জরুরী বলে আপনি মনে করেন?
শামসুল কিবরিয়া: সাহিত্যের জগৎ ঘেঁটে ইতোমধ্যে অনেক তত্ত্বই হাজির করা হয়েছে। আবার অনেক তত্ত্বের উপর সাহিত্যের ভিত দাঁড়িয়েছে। তাই তত্ত্বের সাথে সাহিত্যের একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে যায়। কিন্তু বিশেষ কোন তত্ত্ব যদি সাহিত্যের উপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে তাহলে সেটা আর সাহিত্য থাকে না, হয় তত্ত্বের নির্যাস। সাহিত্যের রস আস্বাাদনে তত্ত্বের প্রতিবন্ধকতা মেনে নেয়া যায় না। আর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনকে আঁকড়ে ধরা একজন সাহিত্যিকের জন্য অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে, তিনি শৃঙ্খলিত হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সাহিত্যিককে অবশ্যই রাজনীতি সচেতন হতে হবে।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
শামসুল কিবরিয়া: আমার যাপিত জীবন নানাবিধ অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। এর কোনটি সুখদায়ক কোনটি আবার খুব দুঃখপ্রদায়ী। এসব অভিভজ্ঞতা থেকে আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো মানুষ ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে খুব সরলভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। নানান জটিলতার মুখোমুখি হয়েই বেঁচে থাকতে হবে। তবে যতো জটিলতাই থাকুক শেষ পর্যন্ত আসলে মানুষের সাথেই থাকতে হবে।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
শামসুল কিবরিয়া: গতবছর মার্চের শেষার্ধে যখন করোনা মহামারী আমাদের দেশে আঘাত হানে তখন আমার মনেও এক ভীতিসংকুল পরিস্থিতি তৈরি হয়। লেখাতে কনসেন্ট্রেট করতে পারিনি। মাসখানেক এভাবে কেটে গেলে কিছু কিছু লেখা শুরু করি। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে একটু গল্প লিখেছি। এ সময়ে কয়েকটি বইয়ের আলোচনা লিখেছি। তবে করোনাকালে লেখার চেয়ে পড়াই হয়েছে বেশি।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
শামসুল কিবরিয়া: সাহিত্য থেকে রসাস্বাদন অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও পাঠক যেন শুধুমাত্র এ উদ্দেশ্য নিয়েই বই না পড়েন। বই পড়া যেন তার চিন্তা চর্চারও উৎস হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। শুধু বাজারসর্বস্ব বা তথাকথিত জনপ্রিয় লেখকদের লেখার দিকে না ঝুঁকে নিরীক্ষাধর্মী লেখাগুলোও যেন তারা পড়েন।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: শামসুল কিবরিয়া জন্মগ্রহণ করেন ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে, বাঙলাদেশের হবিগঞ্জ জেলায়। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বৃত্তাবদ্ধ জীবনের প্রতিবিম্ব। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ: কতিপয় স্মৃতির আর্তনাদ
সম্পাদিত পত্রিকা: বইকথা (২০২০, প্রকাশিত সংখ্যা: ১)
দশকথা খুব ভালো লেগেছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। লেখকদের ব্যক্তিজীবন ও সৃষ্টিজীবন অনুধাবন করতে পারছি।
উত্তরমুছুনসিরিজটি ভাল হচ্ছে। সম্ভবত সাক্ষাৎকার বিষয়ক এরকম সিরিজ বাংলাদেশে এই প্রথম। ঠিক কি? বর্তমান সাক্ষাৎকারের এই অংশটুকু মর্মস্পর্শী "এর কোনটি সুখদায়ক কোনটি আবার খুব দুঃখপ্রদায়ী। এসব অভিভজ্ঞতা থেকে আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো মানুষ ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে খুব সরলভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়।" আসলেই তো! অন্তত এই কথাটুকুর জন্য লেখককে জানাই ভালবাসা
উত্তরমুছুনমানুষ ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে খুব সরলভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। নানান জটিলতার মুখোমুখি হয়েই বেঁচে থাকতে হবে। তবে যতো জটিলতাই থাকুক শেষ পর্যন্ত আসলে মানুষের সাথেই থাকতে হবে।-- ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন