কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি কবি জহির হাসান।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
জহির হাসান: কবিতার জঙ্গলে ঢুকি ক্লাস সিক্স থাকি। আব্বা আর আমি বিড়াল নিয়া একটা যৌথ কবিতা/পদ্য লিখছিলাম। প্রথমটুকু আব্বা লিখছেন, পরে আব্বা কেন জানি মেলাইতে পারতেছিলেন না। আমিই মিলাই দিলাম। বিজয় দিবসে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তা আবৃত্তি করলাম। সবাই কইল আবার পড়ো। এইটাই বোধ হয় প্রথম এপ্রিসিয়েশন। কবিতার গহীন জঙ্গলে। এইভাবেই পা বাড়াইলাম। আজও পা সামলাইতে পারতেছি কই! কবিতার কোনো পথ নাই পথ তৈয়ার করি করি পা বাড়াইতে হয়।
২। কবিতা আপনার কাছে কী? (কবিতা নিয়ে আপনার আইডিয়া/চিন্তার কথা বলুন।)
জহির হাসান: কবিতা হইলো এই সেই। এ রকম চিন্তা মাথায় কাজ করে না। নানা সময়ে কবিতা নানা অর্থ নিয়া হাজির হইছে আমার নিকটে। সেই পথ ধরি হাঁটছি। পরে দেখি যে আলেয়ার পিছে পিছে হাঁটছি এতদিন। এই হাঁটার পিছুফিরা নাই। কবিতা নতুন ইনসাইটের প্রতীতি দেয়।
ভাষা মেটাফরের জগৎ সেইখানে বাস্তবতা ও কল্পনা সীমারেখা আদানপ্রদান করে সতত। কবিতা যত না জগতের চিন্তা চেতনার ঘটনা তার চাইতে ভাষার যাতনা। সেই যাতনা সত্যের প্রসব বেদনার মতো। কবি তাই মা হওয়ার বাসনা পূরণ করে কবিতা লিখি।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
জহির হাসান: ভাষা ও চিন্তা কেমনে শ্যাম-রাধা হই লীলা করে শিখরে শিখরে তা ঝুঝিবার ইশারা দেয় কবিতা। আর কবিতা ভাতকাপড়ের ব্যবস্থাও করি দেয় যদি সেরকম কবিতা লিখেন, আর তা যদি মার্কেটিং করাইতে পারেন দেশে বিদেশে, হা হা।
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি৷ ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
জহির হাসান: এইটা একটা সিক্রেট। যা সত্যিকার সিক্রেট তা পাঠক ও কবি সবার কাছেই সিক্রেট। কবিতায় নানা রকমের কাঁচামালরে পাকানো হয়। অনুভূতি-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা-কল্পনা-বোধের পাচন লৈৗকিকতার আবহে অলৌকিকতা জারি হয় কবিতায়। এই অলৌকিকতা কবির একটা সীমালংঘনের ঘটনা। আর কবির হাতের মুঠায় তা না রয়। তাই কবি নবী বনে যান কভু কভু!
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
জহির হাসান: বাংলা কবিতার বিরাট ইতিহাস আমার বীক্ষার জগৎ। আগের যুগের কবিরা আমার ওস্তাদ। আর জীবজগৎ মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি আমার প্রেম কেমনে ভাষায় লীন হইয়া আমি যেন আমি হই উঠি । মানুষ, প্রকৃতিজগৎ ও প্রেমের কেমনে যে ভাষা হয়! ভাষাজগৎ হয় এই রহস্য একটা বড় প্রেরণা মনে হয়।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
জহির হাসান: মিডিয়ার বড় বড় ওস্তাদদের এড়ায়ে চলছি । আমি কাউরে কেয়ার করি নাই কইলে ভুল হইবে। আমার লিখার সমালোচনা যারা করেন তাদেরে সম্মান করছি। কারণ লিখার সমালোচনায় আমি বিশ্বাস করি। তবে নিজের মৌলিকতার জায়গায় কখনও ছাড় দিই নাই। সমালোচক ও পাঠকের পাঠের ও পাঠাভ্যাসরে পাত্তা দিই নাই। আমি চাইছি কবিতার নতুন একটা পাঠাভ্যাস তৈয়ার হোক । ভবিষ্যতের জন্য আমারে দিয়া কেউ কবিতা লিখাই নিতেছে – এইটা আমি মনে করি । আমার বন্ধু নাই, শুভার্থী আছেন। কবিদের বন্ধু হয় না! কবিতা লিখতে আইসা একাকীত্বই বড় বন্ধু। কারণ কবিতা ও কবিতার রাজনীতি আলাদা নয়। কবিতার জগৎ সর্পিল ন। সবযুগেই তলে তলে আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমান রহেন তলে তলে। আমি কবিতার রাজপথ ছাড়ি আইলপথেই হাঁটছি সদা। খুব কম লোক চিনে আমারে! এতে আমার কোনো কষ্ট নাই মনে। কারণ এইটা আমার একান্ত নিজস্ব রোড নট টেকেন।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস–মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
জহির হাসান: সাহিত্য পাঠ দরকার। তার জন্য সময় দরকার। পাঠকের জন্য সময়ের বরাদ্দ দরকার। এ জীবনে সময়ের বড়ই অভাব। সাহিত্য নানা পদের । কেউ সাহিত্য ও আদর্শ বিচ্ছিন্ন মনে করে না। কেউ কেউ মনে করে সাহিত্য ও আদর্শ আলাদা কিছূ। আমার পথ এতটা সরল নয়।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
জহির হাসান: মৃত্যু থাকি আমরা উঠি আসি জীবন পাইলাম। আবার মওতেই ফিরি যাবো।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
জহির হাসান: করোনার সময় মৃত্যুচিন্তায় আক্রান্ত ছিলাম। প্রথম ২ মাস কোনো কিছুই লিখতে পারি নাই। পরে নিজে করোনা আক্রান্ত হই। জীবনের কোনো অর্থ নাই যদি মাবুদ আপনারে কিছু অর্থ না দেয়। জীবনের পিছনে অর্থ বসানোর কাজ মাবুদের হাতেই!
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
জহির হাসান: পাঠক আপনারা লিখকের লিখায় আত্মাহুতি দিয়েন না। আপনার কড়া পাঠকত্ব তৈয়ার করতে হইলে ভাল ভাল কবির নতুন কবিতা আবিস্কার করেন। নিজের তৃপ্ত চেহারা আপনার জন্য ক্ষতিকর।
জহির হাসান। জন্ম ২১ নভেম্বর ১৯৬৯, যশোর জেলার পাইকদিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে। শৈশব ও কৈশোর কাটছে যশোর ও ঝিনাইদহের গ্রামে। লেখালেখির শুরু ৭ম শ্রেণিতে পড়ার সময়। আগ্রহ ধর্ম, ভাষা, দর্শন ও চিত্রকলায়। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে।
প্রকাশিত কবিতার বই: পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩), গোস্তের দোকানে (২০০৭), ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০), পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১২), খড়কুটো পাশে (২০১৪), আয়না বিষয়ে মুখবন্ধ(২০১৬), আম্মার হাঁসগুলি(২০১৭), বউ কয় দেখি দেখি (২০১৮), বকুলগাছের নিচে তুমি হাসছিলা(২০১৯), আম্মার আরও হাঁস(২০২০) ও আমি ও জহির(২০২১)
অনুবাদ: এমে সেজেরের সাক্ষাৎকার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রচনাসংগ্রহ (২০১১) ।
সাক্ষাৎকার পুস্তিকা: কথাবার্তা (কবি উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার) (২০০৬)
মন্তব্য