কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি হলেন কবি চঞ্চল নাঈম।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
চঞ্চল নাঈম: যতোদূর মনে পড়ে, আমি ৮ম শ্রেণিতে পড়ি তখন প্রথম ছড়া লিখি। সেই থেকে নিয়মিত ছড়া লিখতে শুরু করি। কিছুদিনের মধ্যে ছড়ার একটি পাণ্ডুলিপি তৈরী করে ফেলি। বইটি প্রকাশের জন্য বাড়িতে খুব তোলপাড় শুরু করি। শেষ পর্যন্ত বইটি আর প্রকাশ করিনি। তার কিছুদিন পর অনেকের সাথেই পরিচয় ঘটে, তখন কবিতা নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। সে সময় ছড়া লেখা বন্ধ করে কবিতা লেখা শুরু করি। এভাবেই প্রথম দিকে লেখালেখি শুরু।
২। কবিতা আপনার কাছে কী?
চঞ্চল নাঈম: কবিতা নিরন্তর চলমান সময়ের সুদৃশ্য, নতুন অভিসারে স্বপ্নাতুর সুনিবিড় চিন্তাচিহ্ন। স্বতঃস্ফূর্ত ও সুন্দর বাক্যরস নিয়ে কবিতা কি ভিন্নভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত? এমন প্রশ্ন আমাকে প্রতিনিয়ত জর্জরিত করে আর অন্তর্গত অন্ধকারে নান্দনিক অভিজ্ঞান হৃদয় সংক্রমণ! মৌলিক সৌন্দর্য বিনির্মাণে কবিতা ঐতিহ্যের বাহন। জলে ভাসা সরল সংখ্যাহীন দৃশ্যচিত্র। কবিতা গ্রহ থেকে খসে পড়া কোন চিত্রল প্রেম নয়, বিরহ নয় বা জলের অতল থেকে আমদানি করা কোন প্রকৃতি রঙ নয়। মাঝে-মাঝে মনে হয়, কবিতা সামাজিক পরিস্থিতির দুরন্ত গতি ও পরম্পরা। তদুপরি, বলে রাখা ভালো, সুনিপুণ বাক্য আর রস প্রয়োগে প্রচলিত ক্লান্তিকর কবিতা না লিখে বরং নতুন ফর্মে দগদগে নৈঃশব্দে কবিতা চর্চা প্রয়োজনীয়। কবিতা হৃদয়ের সচেতন অভিজ্ঞান এবং অবিনাশী স্বতন্ত্র সৌন্দর্য প্রচেষ্টা।
কবিতার বাক্যচর্চার পারস্পারিক সম্পর্ক কেমন? তা বোঝা আর প্রত্যেক কবিতায় সূক্ষ্ম ভাবে দৃশ্য প্রয়োগ বা বলা যেতে পারে নিজের চিন্তার প্রয়োগ স্বতন্ত্র বিনিময়ের মাধ্যম। আমি বর্তমান সময়ে কবিতার গাঠনিক নিয়মের ভেতর থাকি অথবা কোন নিয়মের নির্জন গঠনের ভেতর থাকি না। এটাই আমার কবিতার বাক্যধারা।
৩। কবিতা মানুষকে কী দিতে পারে?
চঞ্চল নাঈম: মানুষের কথা বলতে পারবো না। আমার কথা বলতে পারি, কবিতায় বেশি কিছু আশা করা ঠিক না, দীর্ঘশ্বাস বাড়ে বারবার তাই মনে হয়। কবিতা আমাকে যন্ত্রণা ও ভালোবাসা উভয়ই দিয়েছে।
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
চঞ্চল নাঈম: আমার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে এখনই কিছু বলতে চাইছি না, কেই যদি আমার লেখা পড়ে থাকেন তবে সে অনায়াসে বুঝে যাবে যে আমার লেখার পদ্ধতিটা কী।
কবিতা নিয়ে অনেক ভাবি আর অনেক ক্ষেত্রে কবিতার ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে অনেক কষ্ট হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ভাবনা থেকে খুব সাবলীল ভাবে কবিতা সৃজন পর্যায়ে চলে যায়। তাতে কিছুই করা লাগে না।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
চঞ্চল নাঈম: প্রথম দিকে আমাকে নির্লিপ্ত নয়ন (আলতাফ শাহনেওয়াজ), শিশির আজম, অতীন অভীক, মৃদুল মাহবুব, শায়ক মনি, সবুজ আরেফিন, শাজান শীলন, মাসুদ কৌণিক, কাজী গিয়াস আহমেদ, মিত্তৃক মাসুম, কাজী সোহেল, মনির জামান ইত্যাদি সকলেই খুব বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তার অনেক বছর পর প্রতিশিল্পের অনেকের সাথে পরিচয় ঘটে। সে সময় মারুফুল আলম, নাভিল মানদার, মোজাই জীবন সফরী, বিপুল বিশ্বাশ, লিটু রেজোয়ান, মিনু মিত্তৃক, মহিউদ্দিন মোহাম্মদ, সাহিদুর রহমান মিঠু, অসীত বিশ্বাস, সাগর নীল খান, মাসুমুল আলম, তিতাস অধিকারী, ‘দ্রষ্টব্য’ সম্পাদক কামরুল হুদা পথিক, শাহ মোহাম্মদ আলম খুব অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন আর একটা সময় মাহাবুব হাসান অনেক অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়েছেন।
তবে শোয়েব শাদাব, শান্তনু চৌধুরী, আহমেদ নকীব, সুহৃদ শহীদুল্লা’র লেখা পড়ে অনেক সময় অনুপ্রাণিত হয়েছি।
এই সময়ে বিশেষভাবে ‘গাণ্ডিব’ সম্পাদক, লেখক তপন বড়ুয়া (তপনদা), ‘অনিন্দ্য’ সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ (শিবলি ভাই), ইফতেখার হেলাল, শাহ আলম বাবুল আর সালমান ফারসী শশী খুব উৎসাহ দেয় ।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
চঞ্চল নাঈম: প্রথম দিকে আমি কবি সুকান্তের (সুকান্ত ভট্টাচার্য) দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম। আমার বাড়ির পাশে কবি শামসুজ্জামান লাবলু বসবাস করেন। আমি লাবলু কাকা বলি। একদিন ওনাকে আমার কবিতাগুলো দেখালাম। লাবলু কাকা বললেন তোমার লেখা ভালো কিন্তু তোমাকে অনেক বই পড়তে হবে। সে অনুযায়ী একটা লিষ্টও দিয়েছিলেন, তার প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই আমাকে উপহার দিয়েছিন। তখন তার কবিতা পড়ে খুবই মুগ্ধ হই। লাবলু কাকা বলেছিলেন কবিতা লিখতে হলে নিজেদের একটা প্রত্রিকা থাকা দরকার। যেখানে নিজেদের কবিতা ছাপা হবে। সেই মতে আমি একটা ভাঁজপত্র প্রকাশ করতে থাকি। ভাঁজপত্রটি কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ করে দিই। তার কিছুদিন পর নির্লিপ্ত নয়ন, শায়ক মনি, মৃদুল মাহবুব, অতীন অভীক (আমাদের দিলীপদা), মাসুদ কৌণিক, শিশির আজম, সবুজ আরেফিন ইত্যাদি সকলের সাথে পরিচয় হয় এবং ভালো বন্ধুত্ব হয়। তার পর থেকে সকলের সাথেই ঝিনাইদহের বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দিতে থাকি। কবিতা নিয়ে তুমুল আড্ডা হতো। সেই সময় অনেক বই পড়ি, তবে অনেকের লেখা মাথার উপর দিয়ে যেত, যেহেতু আমি কবিতা লিখতে চাই, সেহেতু অনেক বই জোর করে পড়েছি। আবার প্রায় প্রতিদিন কবিতা লিখে অনেককেই পড়ে শুনাতাম। কেউ কবিতা প্রসঙ্গে ভালো কথা বললে খুব লজ্জা পেতাম, আবার কবিতা প্রসঙ্গে খারাপ মন্তব্য করলে মনে মনে খুব রাগ হতো। মনে হতো সে আমার ভালো চাই না। তার অনেক পরে বুঝতে পারি কবিতা নিয়ে যদি কেউ নেগেটিভ আলোচনা করে, তা কবিতার জন্য ভালো। কবিতা উন্নতির দিকে যায়। আমাদের কবিতার কঠোর সমালোচক ছিলেন কবি অতীন অভীক। সে আমাদের কবিতার লাইন কেটে ছিঁড়ে ফেলতেন, তাই অনেকেই পরের দিকে কবিতা দেখাতেন না, অনেকে আবার রাগ করে তার কাছে আর যেতেন না। কিন্তু আমি গোপনে তার কাছে কবিতা নিয়ে যেতাম। কারণ কবিতার ভুল ধরতে উনি পারদর্শী ছিলেন। তখন আমি একটা কবিতা লেখে তা আবার অন্য ভাবে লিখতাম। আসল কবিতা অতীন অভীককে দেখাতাম না। সেই কবিতারই ভার্সন দেখাতাম। এভাবে নিজের কবিতার সমালোচনার হজম করতে থাকি। আর সে সময় অনেকেই ভালো বন্ধু হয়েছে, শত্রু কম ছিল।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস–মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়। আপনি কী করতে চান?
চঞ্চল নাঈম: এ এক দারুণ প্রশ্ন যে সাহিত্য দিয়ে আমি কী করতে চাই?
দারুণ অবরুদ্ধ সমাজ। সাহিত্য দিয়ে সমাজ গতিশীল করতে চাই। খুঁতখুতে পাঠক তৈরী করতে চাই। অবশ্যই স্বৈরাচারের পতন চায়, আমার সাহিত্য স্বৈরাচার পতনে যদি বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখে তাতে আমি খুব তৃপ্ত হবো।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
চঞ্চল নাঈম: যে জীবন যাপন করেছি তা সম্পর্কে এখনই কিছু বলবো না, কারণ অনেক ভাঙা গড়ার ভেতর দিয়ে জীবন দিন পার করেছি। এর ভেতর জীবনের অনেক স্ট্রাগল আছে। চরম শিক্ষাও আছে।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
চঞ্চল নাঈম: করোনা তথা মহামারীর সময় অনেকের বই পড়েছি এবং একটা কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরী করেছি। এটা পজেটিভ প্রভাব। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই করোনা তথা মহামারীর সময় আমার প্রিয়বন্ধু বাবাকে হারিয়েছি। আরও চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছি। তা কাটিয়ে উঠতে এখনো পারিনি। এটা নেগেটিভ প্রভাব।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
চঞ্চল নাঈম: আমি মনে করি পাঠকের মনন-চিন্তা গতিশীল, পাঠকের রুচি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। পাঠকের রুচি মাথায় নিয়ে আমি সাহিত্য করি না। পাঠকদের উদ্দেশ্যে আজ আর কিছু বলার নেই।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: চঞ্চল নাঈম জন্মগ্রহণ করেন ১ এপ্রিল, ১৯৮৬ সালে বাঙলাদেশের ঝিনাইদহ জেলায়। পেশাগত কারণে বর্তমান ঢাকায় থাকেন। ছোটকাগজে লিখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন। প্রতিশিল্প, জঙশন, দ্রষ্টব্য, সূর্যঘড়ি, ডানার করাত, কহন, করাতকল, মগ্নপাঠ, উল্লেখ, সময়কাল, বিন্দু, ডাক ইত্যাদি ছোটকাগজগুলোতে নিয়মিত লিখছেন। প্রধানত কবিতা লেখেন, কখনো-সখনো গদ্য লেখেন। প্রকাশিত কবিতার বই: ‘রাতপত্র’ (২০১৯)। প্রকাশিতব্য কবিতার বই: ‘ধু ধু’, ‘মৃত্যু’, ‘আবার রাতপত্র’।
লেখকের অনুভূতি জানলাম৷ ভাল৷ তবে মনে হল তার ভাষাজ্ঞানের বেসিক অসম্পূর্ণ৷ 'চাই' এবং 'চায়' নিয়ে সমস্যা আছে৷ যা হোক সম্পাদককে এমন আকর্ষণীয় সিরিজ চালানোর জন্য ধন্যবাদ৷
উত্তরমুছুন