কবি, কথাসাহিত্যিক, লিটলম্যাগ সম্পাদকের মুখোমুখি হবার বিশেষ বিভাগ ‘দশকথা’। দশটি প্রশ্ন বনাম দশটি উত্তর। আপাতভাবে সংক্ষিপ্ত এই সাক্ষাৎকার সিরিজ আশা করি পাঠকের ভালো লাগবে। আজ এই বিভাগে বিন্দুর মুখোমুখি কবি আহমেদ নকীব।
১। আপনার প্রথম লেখা কবে এবং কীভাবে?
আহমেদ নকীবঃ প্রথম লেখার কথা সেভাবে মনে নাই। তবে ডাইরিতে আখ্যান টাইপের কিছু কাব্যিক লেখা লিখতাম। যদি সময়-কাল ধরা হয়, ওই লেখাগুলি ৭৯ কি ৮০ সালের দিকে হবে। আর লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম ৮৭/৮৮ দিকে।
২। কবিতা আপনার কাছে কী? (কবিতা নিয়ে আপনার আইডিয়া/চিন্তার কথা জানতে চাচ্ছি)
আহমেদ নকীবঃ কবিতা আমার কাছে দৈনন্দিন অনেক কাজের মতোই একটা ব্যাপার। কবিতা লিখতে গিয়ে কোনো আইডিয়া কাজ করে না। আমাদের সময়ে আমরা কবিতা থেকে আইডিয়া বর্জন করেছি। আপনি আইডিয়া বলতে যদি সাব্জেক্টিভ কোনো কিছু বুঝিয়ে থাকেন, তবে কবিতায় আমি সাবজেক্ট কিংবা আইডিয়া'র বিরোধী। হ্যাঁ, আমার অনেক কবিতায় সাবজেক্ট এসেছে, যেমন বৃষ্টি কিংবা বিড়াল এ-দুটোকে যদি সাবজেক্ট কিংবা কবিতার আইডিয়া হিসেবে ধরি তবে সে-গুলো আসলেও তা এন্টি হিসেবেই এসেছে ৷ মানে বৃষ্টিকে আর বৃষ্টি হিসেবে রাখতে চাই নি। এই বিষয়গুলি আইডিয়া কিংবা সাবজেক্ট না হয়ে তা অনেকটা মেটাফোর হিসেবেই কাজ করেছে। আর কবিতা নিয়ে আমার যে চিন্তা তা হচ্ছে, কবিতা শুধুমাত্র আবেগ চরিতার্থের জায়গা না। অতিমাত্রায় কাব্য-পণা ও অতিকথন থেকে কবিতাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
কবির সাক্ষাৎকার নিলো বিন্দু লিটলম্যাগ
৩। কবিতা মানুষকে কি দিতে পারে?
আহমেদ নকীবঃ খুব মোটা দাগে যদি বলি, কবিতা মানুষের মধ্যে আনন্দ আর বেদনা দুটোই সৃষ্টি করে। তবে আরো গভীরভাবে যদি বলি, কবিতা মানুষের চিন্তা-শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।
৪। আপনার কবিতা লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে নিয়ে যেতে কী করেন?
আহমেদ নকীবঃ পদ্ধতি তো মাপ-ঝোঁকের মতো শোনায়। সে-রকম কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে লিখি না। তবে যা দেখি, যা শুনি বা জানি তার বাইরে কবিতা বলে কিছু নেই বলেই আমি বিশ্বাস করি। কবিতার জন্য কিছু ঘটতে হয়, দৃশ্যমান হতে হয়, জাগতিক কোনো না কোনো কিছুর সংস্পর্শে আসতে হয়। তারপরই কবিতার শুরু। জানার বাইরের যে ব্যাপারটা ঘটে তা হচ্ছে কল্পনাকে বাস্তব একটা জগতের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। বাস্তব জগতের মতোই একটা প্যারালাল জগত হচ্ছে কবিতার জগত। প্রথম যে অনুভূতিটা মনের মধ্যে কাজ করে তাকে ইমপ্রোভাইজ করতে করতেই কবিতা আকার পেতে থাকে। তবে পুরো কবিতাটা একবারে মাথায় আসে না। যে কোনো অবস্থায় বা যে কোনো মুহূর্তেই কবিতার রিফ্লেক্স কাজ করতে পারে। কবিতা লিখতে গিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা কিংবা প্রস্তুতি থাকে না । কবিতা তো আসলে অন্যান্য সাহিত্য কিংবা শিল্প-কর্মের মতোই একটা চর্চার ব্যাপার। শুধু অনুভূতি কিংবা আবেগকে প্রধান হিসেবে ধরে নিয়ে কবিতা লিখলে তা দুর্বল কবিতারই নামান্তর। অনুভূতি শূণ্য করে যদিও কবিতা লেখাটা কঠিন। অনুভূতির বাইরেও কবিতার মধ্যে কোনো চিন্তাশীলতা কাজ করছে কি না এটা বোঝাটা জরুরী। ভাবনা থেকে সৃজন পর্যায়ে কবিতাকে নিয়ে যেতে আমি আমার শরীরকে বেশি কাজে লাগাই। সত্যিকার অর্থে কবিতা আমার কাছে যতো না আবেগিক তার চেয়ে বেশি শারীরিক ।
৫। আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে বা কারা?
আহমেদ নকীবঃ প্রেরণাটা নিজের কাছ থেকেই বেশি আসে। প্রথমে তো নিজেকে তৃপ্ত করার জন্যই কবিতা লিখি। পরে ভালো-মন্দের ব্যাপারগুলো নিয়ে যখন আলোচনা আসে, বন্ধুরাই বেশি অনুপ্রেরণা দেয়। পরিবারের লোকজন তো আছেই। আর কবি হিসেবে আমি বিনয় মজুমদারের ভক্ত। আর বাইরে আঁরি মিশো।
৬। আপনার উত্থান সময়ের গল্প বলুন। সে সময়ের বন্ধু, শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক— এসব কীভাবে সামলেছিলেন?
আহমেদ নকীবঃ ৮৭/৮৮’র কথা বলছি। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি যখন ধীরে ধীরে অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় হলো, সাহিত্যে প্রথিতযশা ব’লে তাদের কেউ-ই ছিল না। এটাই আমাদের সময়ের বড় টার্নিং পয়েন্ট। যাদের সাথে বিশ্ব-সাহিত্য কেন্দ্রে কিংবা শাহবাগে দেখা হতো, তাদের কারো কারো সাথে তখনকার প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় থাকলেও আমার যোগাগাযোগটা একদমই ছিলো না, এখনো নাই। সেই যে ৮০ দশকের শেষে এসে, এখন যাদেরকে ৮০ কিংবা ৯০ দশকের কবি-সাহিত্যিক হিসেবে ধরা হয় আর পরবর্তীতে যারা সাহিত্য করতে এসেছে, তাদের ছাড়া আগের কোনো দশকের লেখক-সাহিত্যিকদের সাথে আমার যোগাযোগটা গড়ে ওঠে নি। সেই সময়ে আমার চেয়ে তিন থেকে চার বছরের বড় কিংবা দু-এক বছরের ছোট অপ্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকদের সাথেই ভাই ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। শুরুতেই যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিক পরিমণ্ডলের সাথে যুক্ত থাকি নি সেক্ষত্রে নূতন একটা কিছু করতে হবে এই তাড়নাটাই বেশি কাজ করতো। কবিতা আর পত্রিকা করা নিয়ে এতো বেশি ধ্যানস্ত ছিলাম, তাই কোথায় কি ঘটছে, কারা শত্রু কিংবা মিত্র এগুলো নিয়ে ভাবিত হওয়ার মতো জটিল চিন্তাধারা কখনোই আমার মধ্যে কাজ করে নি। সরাসরি বললে সাহিত্যের পলিটিক্স থেকে যোজন যোজন দূরে ছিলাম, এখনো আছি । আর যেখানে সাহিত্য ক’রে কিংবা কবিতা লিখে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কোনো পিছুটান নাই, তাই শত্রু, নিন্দুক, সমালোচক এদের মুখোমুখি হতে হয় নি আমাকে। বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্যই এখনো লিখে যাচ্ছি। তবে কিছুটা অন্তর্মুখী চরিত্রের হওয়ার কারণে সাহিত্যিক বন্ধু-সংখ্যা কম। যেহেতু সাহিত্য আন্দোলন করেছি, সেই-ক্ষেত্রে নানারকমের চাপ তো কম-বেশি নিতেই হয়েছে। লিটল ম্যাগাজিন করার কারণে অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা প্রতিষ্ঠানমূখী সাহিত্যিকদের কাছে আমরা একসময় চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।
৭। সাহিত্য দিয়ে কেউ দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, কেউ স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে চায়, কেউ সন্ত্রাস–মৌলবাদ ঠেকাতে চায়, আরো নানাকিছু করতে চায়৷ আপনি কী করতে চান?
আহমেদ নকীবঃ সাহিত্য বলতে আমি তো কবিতাটাই বেশি চর্চা করি। এখন এসে মনেহয় নিজের প্লেজারের জন্যই কবিতা লিখি। কখনো কখনো কবিতায় রাজনৈতিক মনস্ক একটা বোধ কাজ করে কিন্তু এই বোধটা কোনো ইস্যুভিত্তিক নয়। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে বিশ্বাস করলেও সেই বিশ্বাস যে সাহিত্য কিংবা কবিতা বাহিত হয়ে আসবে সেটা সবসময় কাজ করতে নাও পারে। আবার কাজ করলেও তা যতটুকু নান্দনিকভাবে আর চিন্তাশীলতার মধ্যে দিয়ে আসে তাতে কবিতাই মুখ্য থাকে।
৮। যে জীবন আপনি এত বছর যাপন করলেন, তা আপনাকে আলটিমেটলি কী শিক্ষা দিলো?
আহমেদ নকীবঃ যদি বৈষয়ীক জীবন-যাপনের কথা বলেন আমি একজন সচ্ছল মানুষ। সাহিত্য ক’রে কিংবা কবিতা লিখে আমাকে সংসার চালাতে হয় না। আর সাহিত্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা যে যৌথতার কথা বলি তা খুব আপেক্ষিক। আমার ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে আমি যৌথ পরিমণ্ডলের মধ্যে সাহিত্য চর্চা করলেও, এই যৌথতা আমি শুধুমাত্র সাহিত্যিক কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখিনি। সামাজিকভাবে অন্যান্য মানুষজনের মানসিক ও ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আমরা এতোদিন ধরে সাহিত্য আন্দোলনকে যে যৌথতার একটা মাত্রা দিতে চাচ্ছিলাম,আমার কাছে এই জায়গাটা কিছুটা সীমাবদ্ধ মনে হয়েছে। তখনই যৌথতা আরো বড় মাত্রা পায়, যখন শিল্প-সাহিত্য ছাড়িয়েও তা আরো অন্যান্য সামাজিক ক্রাইসিসগুলিকে উপলব্ধি করতে পারে। এখানে যেহেতু কবি কিংবা সাহিত্যিক হিসবেই আমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে আর পত্রিকা সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলাম, অল্পকথায় বললে ব্যাপারটি এভাবে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি,যেখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়াই সমমনা বন্ধুরা মিলে পত্রিকা বের করতাম, সেক্ষেত্রে সামষ্টিক একটা উদ্যোগ তৈরি হয়েছিলো। এক্ষেত্রে কেউ যদি ঘোষণা দেয় আমি ইন্ডিভিজ্যুয়াল, তবে এটাও আপেক্ষিক। লেখক নিজে যখন তার কাজটা করে তখন সে ইন্ডিভিজ্যুয়াল হতে পারে। কিন্তু কাজটা শেষ হওয়ার পর মুহূর্তেই তা কালেকটিভ হয়ে ওঠে। মানুষ তো মানুষকে ছাড়া চলতে পারে না।
৯। করোনা তথা মহামারী আপনার লেখালিখিতে কোনো প্রভাব রেখেছে কি?
আহমেদ নকীবঃ প্রথম দিকে অনেকটুকুই প্রভাব ফেলেছিলো। মার্চের দিকে প্রায় প্রতিদিনই যে-লেখাগুলো লিখতাম তা মহামারীর চাপ-জনিত কারণ থেকেই সৃষ্টি হয়েছিলো।
১০। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
আহমেদ নকীবঃ কবিতার সিরিয়াস পাঠক এমনিতেই কম। তবু কবিতার পাঠক সংখ্যা বাড়ুক এটা মনে-প্রাণে চাই। শুধুমাত্র অনুভূতি কিংবা আবেগ দিয়ে কবিতা পাঠ না করে , কবিতা পাঠে মাথা খাটানোটাও খুব জরুরি।
পেশা: এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার, সাপ্লাই চেইন, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ঢাকা।
সম্পাদনা: দীর্ঘদিন ‘শিরদাঁড়া’ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীতে যুক্ত ছিলেন।
প্রকাশিত বইয়ের নাম:
কাব্য-গ্রন্থ: শিশু ও হারানো বিড়ালের কথা (১৯৯৬, ধানসিঁড়ি ), মহাপুরুষের জোব্বা(১৯৯৯, ধানসিঁড়ি ), ওরা আমাকে ঘিরিয়া ঘিরিয়া নাচে আর গুলি করে (২০০২, ধানসিঁড়ি ), আ মরি ক্ষুদ্রত্ব (২০০৫, গাণ্ডীব ), শুরু থেকে সম্প্রতি (কাব্য-সংগ্রহ: ২০০৯, উলুখড়), শব্দ-দ্বন্দ্ব-ভেদ (২০১১, শিরদাঁড়া ), নখের টুকরা (২০১১, প্রতিশিল্প), কালো কাচের বাইরে কিছু আর ঘটে না (২০১৬, উলুখড় ), তোমার নেচে নেচে চলা (২০১৬, শিরদাঁড়া ) মিসেস নিতিয়ার সাথে বৃষ্টি আসলো যেদিন (২০১৮, উড়কি), গান গাবো বিজয়নগরে(২০১৯, উড়কি), যে ব্রিজ দৃশ্যত নেই (২০২০, উড়কি)
গদ্য-গ্রন্থ: ঘষা খাইতে খাইতে চলে নয়া চক্রের খেইল (২০০২, দুয়েন্দে)
গল্প-গ্রন্থ: টেক্সট ম্যাসেজের মৃত্যু (২০১২, উলুখড়)
প্রকাশিতব্য কবিতার বই: তাল তাল মেঘ ভেঙে পড়ছে (২০২১, উড়কি)
ভাল লাগল। কবির চিন্তাশৈলী ও জীবনভাবনার নানাদিক জানলাম। বিন্দু সম্পাদক সাম্য রাইয়ানের জন্য ভালোবাসা। সিরিজের পরবর্তী সংখ্যা কবে কাহাকে নিয়ে বের হইবে, তার অপেক্ষায় রইলাম।
উত্তরমুছুনএ তো অভিনব আইডিয়া। সাক্ষাৎকার যে এরকম হতে পারে, তাই তো ভাবি নাই। কবির মননের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন