.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

মাসুমুল আলমের ‘নামপুরুষ’: নিরবচ্ছিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন পাইন গাছ | ইশরাত তানিয়া


জানলা দিয়ে তাকালে কত কিছুই দেখি। চোখের ওপর ছায়া ফেলে ওপাশের বাস্তবতা। সেখানে কখনো বা একটা ঝিরিঝিরি পাতার পাইন গাছ। শীতপ্রধান দেশের গাছটি কী করে যেন প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় প্রায় বছরভর গ্রীষ্মের এই ঢাকায়। আর আমি বিস্মিত হয়ে পাইনের দৃঢ় কান্ড আর পাতার নান্দনিক বিন্যাস দেখি। হাতের ওপর তখন মেলে রাখা কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলমের ‘নামপুরুষ ও অন্যান্য’ গল্পবই। 

বইয়ের নামগল্প অব্দি পৌঁছতে গিয়ে পাঠযাপন কিংবা উদযাপন হয়ে যায় বাকি গল্পের সাথে। এই বইয়ের শেষ এবং দীর্ঘতম গল্প ‘নামপুরুষ’। গল্পটি পড়ার পর মনে হয় কোনো পাঠকের মস্তিষ্কে ভাবনাচিন্তার অনুরণন যদি সুখানুভব জাগায় তবে কেন সেই পাঠ সুখপাঠ্য হবে না? সুপাঠ্য তো বটেই! অন্তঃকরণে অপারগ পাঠকের কাছে মাসুমুল আলমের লেখা আপাত বিবেচনায় দুষ্পাঠ্য হয়ে উঠতে পারে। বলতে দ্বিধা নেই ক্রমশ এই গদ্যশৈলীর সাথে পরিচিত হয়ে গেলে সৌন্দর্য স্বীকার করে নিতে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না। মাসুমুল আলমের গল্প আমার পাঠ অভিজ্ঞতায় একই সাথে সুখপাঠ্য ও সুপাঠ্য।

কথাশিল্পী মাসুমুল আলমের লেখার রীতি ভিন্ন এবং সেরিব্রাল। যে কোনো ক্ষেত্রেই ভিন্নতা একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যা দুর্লভও। কথায় আছে ‘ভালো’ যা কিছু সেটা যদি খুব বেশি মেলে তাহলে নিজের ভিড়েই সেটা ‘মাঝারি’ হয়ে যায়। তাই ভিন্নতার সাথে দুর্লভ শব্দটি ধনাত্মকভাবেই সম্পর্কিত। স্বতন্ত্র রীতিই সাহিত্যের ঊষর ভূমিতে জলের ছিটে দিয়ে সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখে। এই ছিটেফোঁটা জল শুষেই আঙ্গিক, ভাষা, বিষয়ের ভিন্নতায় সাহিত্য আগামীর দিকে প্রবাহিত হয়। একটা সময় এই বিকল্পধারা সাহিত্যের মূলধারা হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে যেখানে ছিটেফোঁটা বিকল্প সাহিত্য ‘সঞ্জীবনী’ জলতুল্য হয়ে উঠছে সেখানে ছকভাঙা লেখাকে সার্থক বা অসার্থক হিসেবে দেগে দেয়াই মূর্খামি। সময়ের হাতে রইল এই ‘অ-নিটোল’ গল্পের মূল্যায়নের দায়। তাহলে আমি ঠিক কী লিখতে বসেছি? আসলে লিখি না কিছুই। লেখার মধ্য দিয়ে পুনর্পাঠ করি যা বার বার পাঠযোগ্য। আরেকটু যেন বা কাছাকাছি গিয়ে লেখাটা দেখা। এ আমার দায় নয় বরং বিশ শতকের নয় দশকের এক ভিন্নধারার লেখককে ব্যক্তিগত আবিষ্কার। তাই উল্লাস! এই লেখা বিশ্লেষণের অধিক হয়ে ওঠে আমার একান্ত পাঠঅনুভব।

নামপুরুষ ও অন্যান্য
গল্পের পাতা উল্টাই। নামপুরুষ গল্পের শুরু এক ট্রাফিক লাইট দিয়ে। সেই ট্রাফিক লাইটকে রঙ বদলাতে দেখছে বয়স ২৪ এর ‘সে’। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘সে’ দেখছে জীবন ও সময়ের পরিবর্তনে বদলে যাওয়া ভাষা, সম্পর্ক। বদলে যাচ্ছে শহর। আন্তর্জাতিকতাময় যে শহরে গোলাপখামার খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই গোলাপখামারের সন্ধানে গল্প এগিয়েছে নির্লিপ্তভাবে। সহচরী রজনী কখনো বা জীবনানন্দ দাশের সরোজিনী। ‘সে’, অপ্রচলিত এক কৃষিপণ্য- গোলাপ, কিনে ফেলে। হয়তো কাব্যচেতনায় আচ্ছন্ন রজনীর জন্যই। কিন্তু কালো চশমা চোখে ফুল হাতে এক রাষ্ট্রনায়কের কথা মনে হতেই নিজেকে কুৎসিত কল্পনা করে হাত থেকে গোলাপদণ্ড ছুঁড়ে ফেলে সে।  

ঘটনাচক্রে এক সকালে ‘সে’র সাথে দেখা হয় ‘তার’। যার নাম দেয়া হয়- মুখপাত্র। দুজনে মিলে গোলাপখামারের দিকে যায়। বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে গোলাপখামারের ভেতরে আর বাইরে। সেখানে প্রবেশাধিকার পায় ‘সে’ আর লুপ্ত হয়ে যাওয়া এক গোলাপরাষ্ট্রের কথা জানতে পারে পাঠক। গোলাপখামারের পরিচর্যাকারিণী এক বেশ্যা। ‘নারী তো দুর্দান্ত প্রেমিকা, তাই কেবল বেশ্যাবৃত্তির অভিযোগে কর্তৃপক্ষ তাকে অপসারিত করতে পারে না; শহরের নারী-পুরুষ কেউই তা চায় না; কেননা তারা আজীবন তাদের আকাঙ্ক্ষার নীল গোলাপের কথা শুনে এসেছে, যা কেবল ঐ নারীস্পর্শেই ফুটে থাকে।’ আমার মনে পড়ে বৈশালীর অনিন্দ্য সুন্দরী আম্রপালীর কথা; প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে রাষ্ট্র যাকে নগরবধূ বানিয়েছিল। আম্রপালী যেন গোলাপ ফোটানোর পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে গল্প এগিয়ে যায়। সেই নারী- যে এক হলুদ বিকিরণ, পেছনে এতজনের ক্রুদ্ধ উপস্থিতি সত্ত্বেও নির্বিকার। গোলাপের পরিচর্যা করে যায়।    

‘নামপুরুষ’ গল্পে ‘আদি-মধ্য-অন্ত’ কাঠামো নেই। একে ‘গল্পহীনতার গল্প’ও বলি না। কারণ গল্প আসলে গল্পহীন হয় না। গল্প কখনো প্রত্যক্ষে না থেকে আড়ালে থেকে যায়। পাঠকের গোচরীভূত হবার অপেক্ষায়। ‘নামপুরুষ’ গল্পটির অক্ষরে, শব্দে, বাক্যে একেকটি অনুচ্ছদে গল্পের কোনো স্পষ্ট অবয়ব নেই। আধুনিক গল্পের মতোই এ গল্পে আখ্যান গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিবেশ আর পরিপার্শ্বের বিবরণ আর বিশ্লেষণে বাস্তবতার রূপায়ণ। নামপুরুষ গল্পকে আমি বলি- গদ্যগল্প। জানি না এমন শব্দ আদৌ আছে কি না। এই গল্পে কোনো ‘ব্রেক’ নেই। যেন বা গদ্যের ধারা বয়ে যাচ্ছে। স্রোতে ভেসে ভেসে চিহ্ন ধরে ধরে পাঠককেই গল্প তৈরি করে নিতে হচ্ছে। এই নিরন্তর পাঠ লেখকের সৃষ্টি গল্পজগতে পাঠকের এক অবিরাম পরিভ্রমণ। পাঠক ক্রমাগত গল্পকে আবিষ্কার করতে থাকে।   

আমার মনে পড়ে কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘লেখা, যতদূর জেনেছি, এক ধরণের কনফেশান এবং ক্যাথারসিস। সত্যিকার ‘লেখা’ আয়নার মতো আমার সামনে এসে দাঁড়ায়- আমি তখন আমার রুগ্নতা চিহ্নিত করতে পারি, আমি আমার সম্ভাবনাকে দেখতে পাই, আমি আমার পাপমুক্তি ঘটাই এবং বাঁচার প্রণোদনা খুঁজে পাই।’ ‘নামপুরুষ’ গল্পটিও যেন মাসুমুল আলমের অজান্তেই আয়না হয়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে আত্মচেতনা। লেখা জুড়ে একের পর এক নতুন রূপ সংযোজিত হওয়া যেন লেখককের স্বীকারোক্তি আর বিশোধন প্রক্রিয়ার যুগলবন্দী।

গল্পের প্রোটাগোনিস্ট ‘সে’। লেখকের ভাষ্যে ‘সে পর্যটন-অভিজ্ঞ এক বালক, যে সে নেহাৎই ‘বালক’, তার ঘোরবর্ণ লাল সোয়েটার সমেত, সব কিছুই, এই সমগ্র শহরটিকেই সে দ্যাখে ভেসে যায়, হলুদ উদগীরণে ক্রমশ ভে সে যা য়...’। সে ধারণ করছে সময়, সকাল-বিকাল-সান্ধ্যপ্রহর। ‘সে’ ধারণ করছে বিভিন্ন চরিত্র। সেই অর্থে গল্পের ‘নামপুরুষ’ নামটি দ্ব্যর্থবোধক। ‘সে’ একদিকে নামপুরুষের সর্বনামের রূপ। আবার অন্যভাবে বলা যায়, অনুপস্থিত কোনো ব্যক্তি বা দূরের বস্তুর সম্বন্ধে কিছু বলার সময় সেই ব্যক্তি বা বস্তুর নামের পরিবর্তে যে সর্বনাম বা বিশেষ্য ব্যবহার করা হয় সেটাও নামপুরুষ। কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘সে’কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে গল্পের অন্যান্য চরিত্র। বলা ভালো ‘সে’ই বাস্তবে কিংবা পরাবাস্তবে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছে। এই চরিত্রগুলো বক্তাও নয় শ্রোতাও নয়। কারণ আমি-তুমির বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ‘সে’।

এই গল্পে অসংখ্য চরিত্র এসেছে। চরিত্রগুলো কারা এবং এদের পরিণতি কী হলো সেটা নিশ্চিত বলা যায় না। বাখতিনের ‘বহুস্বর’ ধারণাটি এ গল্পে প্রতিষ্ঠিত। ‘সে’র যৌথ অবচেতনে এসেছে শিক্ষক পিতা। মা, মামা, মাতামহও অন্যান্য আত্মীয়, বিপ্লবী, প্রগতিশীল রাজনীতিবীদ, শাসকশ্রেণি, বামপন্থী ভাবুক, নাট্যসরণির তারকা-অভিনেত্রী, টিকেট বিক্রেতা কাম পকেটমার সর্দার মুক্তিযোদ্ধা। এসেছে বোর্হেস, বুনুয়েল, হেগেল, কান্ট। আছে শিল্পসাহিত্যজীবী রোকেয়া মহলানবীশ। গজনীর শালবনে ‘সে’ যাকে মনে করেছে এক গোষ্ঠীকন্যা। সেই রোকেয়ার ধোঁয়া নির্গত মুখ হয়ে যায় মেরিনা আখতার। বালক বয়সের সেই তীব্র প্রেমানুভব এখন মৃত। রজনীর মুখ কখনো বা রোকেয়ার। লেখক কিছুটা বিভ্রান্তির ধোঁয়াশায় মানব চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন।

বর্ণনার ক্ষেত্রে ডিটেইলিং মাসুমুল আলমের বৈশিষ্ট্য। কাহিনী নয় বর্ণনার বিস্তৃতি দিয়ে দৃশ্য এঁকে ফেলেন। দীর্ঘবাক্যের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গল্পে তিনি প্রবলভাবে সমসাময়িক প্রসঙ্গ এনেছেন। সময়ের সম্ভাবনা আর সঙ্কটগুলোর কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা গেল-

জনতা উৎসবের আমেজে দুটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে। দাঁড়িয়ে থাকে সে; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমনিই চোখটা মেলে রাখে জনস্রোতের দিকে...

দুইটা পক্ষ, দুইটা দল, মনে মনে সে বলে, কোন দলে যাবে তুমি, তুমি কোন দলের? বাসের গেটে ঝুলে আছ তুমি, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, যে কোনো মুহূর্তে হাত ফস্কে চাকার নিচে থেঁতলে যাবে, তোমার হাতটি ধরে নিয়ে বাঁচাতে পারে দু’দলের যে-কেউ, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- তুমি কোন দলে? কোন দলের?  

বেশ্যাপট্টি উঠে যাচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল খিলাড়ি; এক হাতে গড অফ স্মল থিংস আরেক হাতে রমণীস্তন; দেশে দেশে লাফিয়ে বেড়ানো আগুনের দৈত্য; উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক বসেছে প্যারিসে; গায়ক জেমসের ব্যাতিক্রমী চেরাকণ্ঠ;  আই এম এফ এর বিশেষজ্ঞ দল আসছে; সংস্কার করো সংস্কার...

একটা মাইনর গার্ল রেপ ভাবা যায়? হ্যাঁ যায়, ভাবা যায়; সে তখন বলেছিল, আসলে সাধারণ মানুষের ভেতর যখন এই প্রবণতা দেখা দ্যায়, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্র এবং সমাজের টপ ডগস, সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে যারা এই প্রবণতা বহু আগেই, তাদেরকে গ্রাস করেছে...

গল্পের আলোচনায় ফিরি। ‘নামপুরুষ’ গল্পের অবয়বে রূপকের শিকড় বিস্তার ঘটেছে। চরিত্রের মতো বর্ণনাশৈলীও রূপকাশ্রয়ী। সঙ্গত কারণেই কাব্যিক ন্যারেশান এই গল্পের সাথে মানানসই। রূপকের মাধ্যমে ব্যক্তি এবং ঘটনার ইঙ্গিতে কখনো পরাবাস্তবতা কখনো বা জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ ঘটেছে শিল্পিত পরিমিতিবোধে। তাই মঙ্গলহাটার বেহারাদের গানে মিশে থাকা কান্নার বিলম্বিত সুর মিথ ছাড়িয়ে জাদুবাস্তবতায় অভিশপ্ত গ্রামের কুমারী নারীদের আর্ত হাহাকার হয়ে ওঠে। জাদুবাস্তবতার আরেকটি প্রয়োগ উল্লেখ করা যায় গোলাপখামার প্রসঙ্গে- ‘কেবল শুনে শুনে নীল বা নীলাভ গোলাপের সন্ধানে যেসব যুবকেরা এখানে আসে একে একে তারা সবাই ঐ হলুদ বেশ্যার প্রেমে পড়ে শাদা হয়ে যায়; আর সে হলুদ বেশ্যা সে কিন্তু তেমন স্বাভাবিক হলুদই থাকে, হলুদ সুন্দরীই থাকে...’

কোনো এক মধ্য দুপুরে জনতার ক্ষোভ প্রশমিত হলে তার নজর আটকে যায় এক জোড়া রক্তাক্ত পায়ের ওপর। পরাবাস্তবতার ঘোরে পাঠক অনুভব করে ‘... সেই পায়ের পাতা ফাটিয়ে দিয়ে বেড়ে উঠেছে এক অশ্বত্থ বৃক্ষ; ছায়া-ছায়া কিছু মানুষ সেই খণ্ডিত রক্তাক্ত পায়ের ওপর সাষ্টাঙ্গে প্রণতি জানায়; অনেকক্ষণ তাদের ঠোঁট শব্দহীন বিড়বিড় করে; কোনো গুপ্ত উচ্চারণ শেষে বয়ে যাওয়া ক্ষীণ রক্তস্রোত রেখায় তৃষ্ণার্ত জিভ ছোঁয়ায় তারা; বিদঘুটে হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠলে আচমকা কিছু বাদুড় পাখা ঝাপটে উড়াল দ্যায়; চতুর্দিকে চন্দ্র-সূর্যহীন আলোক উদ্ভাসে বনসাই অশ্বত্থ সচল হলে সে এক অভাবিত দৃশ্য।’

চাঁদ বা সূর্যের আলোহীন সেই প্রভা যা কিছু সৃষ্টি করে পাঠকও ‘সে’ এর সাথে সেই মগ্নচৈতন্যে সমাচ্ছন্ন হয়ে যায়। ‘অশ্বত্থতলে গোলীয় বৃত্তে বসে থাকে গোষ্ঠী পরিবার; গোষ্ঠীপুরুষ আর গোষ্ঠিকন্যা; বিপ্লবী পুরুষ আর বিপ্লবী নারীচেতনা; প্রতিবিপল্বী পুরুষ আর প্রতিবিপ্লবী নারীচেতনা...’ পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে যায় বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাচীন রূপ। তাদের ধর্মচিন্তা, আচার-প্রথা, শিল্পকলা। আর্যদের আগমনের আগে বাংলার প্রাচীন মানুষেরা মিলেমিশে এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গড়ে তুলেছিল। প্রাচীন বাংলার রাষ্ট্রবিন্যাসের কথা বলতে গেলে এই অস্পষ্ট স্বল্পজ্ঞাত কৌম সমাজ ও তাদের শাসনযন্ত্রের কথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকার করতে হয়।

গল্পের ঘটনা পরিক্রমণে পাঠক কৌম সমাজবিন্যাস থেকে গোলাপরাষ্ট্রে পৌঁছে যায়। ‘সে’ দ্যাখে- ফুলের সাম্রাজ্যে সমবেতজনের মধ্যে- দর্শনধারী মুখপাত্র, আয়নায় বসবাসকারী বিপ্লবী আর প্রতিবিপ্লবীপুরুষ ও নারী চেতনা, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার স্বয়ঙচেতনা, উঠতি সংগীত তারকা, নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন, সেই যে ম্যাজিক স্ক্রীন ভেঙে বেরিয়ে আসা নিম-পিকাসোগণ, রজনী, তিব্বতী হুলো... এক পর্যায়ে বিশেষ বাহিনীর কয়েকজন তাকে গ্রেফতার করে। রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে ‘সে’কে নিয়ে গাড়িটি তখন বধ্যভূমিতে।

‘নামপুরুষ’ ফুরায়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে ‘সে’ জেনে যায় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ। ‘সে’ তাদের আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করেছে। আন্তর্জাতিকতাময় শহরের সমস্ত সমস্ত ক্লেদ, সংশয়, মালিন্য আর ব্যর্থতায় দায়ভার নিয়ে কাউকে হয়তো অপরাধী হতেই হতো! ‘সে’ই সে।    

মাসুমুল আলম সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে একজন নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী এবং ধ্যানমগ্ন লেখক। ভাবীকালের পাঠকের কাছে ‘নামপুরুষ’ গল্পটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে সে কথা এখন বলে রাখা অতিশয়োক্তি হবে না। আলোচনাটি শেষ করব একটা ছোট গল্প দিয়ে। মপাসাঁর সাহিত্যিক হবার পেছনে যার অবদানের কথা বলতেই হয় তিনি ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম লেখক গুস্তাভ ফ্লবেয়ার। মপাসাঁর মা লরা। তিনি ফ্লবেয়ারের বন্ধু ছিলেন। লরা ছেলের শিল্প-সাহিত্যে ভালোবাসা দেখে ফ্লবেয়ারের কাছে পাঠান। তরুণ মপাসাঁ মায়ের চিঠি নিয়ে ফ্লবেয়ারের কাছে গেল। তখন ফ্লবেয়ার এক পেল্লায় অভিধান মপাসাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলেন- এই বইটা ঠিক মতো পড়লেই তুমি লেখক হতে পারবে। ফ্লবেয়ার ভেবেছিলেন ছেলেটি অভিধান পড়ে শেষ করতে পারবে না। কিন্তু তাঁকে চমকে দিয়ে মপাসাঁ গোটা অভিধান মুখস্ত করে ফেলে। তখন ফ্লবেয়ারের মনে হয়, ছেলেটার অধ্যবসায় আছে। কথায় কথায় তিনি মপাসাঁকে জিজ্ঞেস করেন, বলো তো ওই জানলা দিয়ে কী দেখতে পাচ্ছ? মপাসাঁ বলে- একটা পাইন গাছ।

শুধুই একটি গাছ? ফ্লবেয়ার জিজ্ঞেস করলেন। মপাসাঁ একটু দেখে ফের বলে- গাছের সাথে একটি বাড়ি, বাড়ির মানুষ, ওপরে নীল আকাশ, সেখানে পাখিরা উড়ছে। উত্তরে ফ্লবেয়ার খুশি। মপাসাঁকে বোঝালেন, সব মিলিয়েই পাইন গাছটা। যা দেখা যায় সেটা কখনোই বিচ্ছিন্ন কিছু না, চারপাশটা নিয়েই প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্ব। শিল্প-সাহিত্যও তেমনই।  

কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলমের গল্প সেই চিরসবুজ পাইন গাছ। সমস্তকে ধারণ করেও নিজস্বতা নিয়ে আশ্চর্য সহনশীল। ঋজুতায় দাঁড়িয়ে।

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,304,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: মাসুমুল আলমের ‘নামপুরুষ’: নিরবচ্ছিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন পাইন গাছ | ইশরাত তানিয়া
মাসুমুল আলমের ‘নামপুরুষ’: নিরবচ্ছিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন পাইন গাছ | ইশরাত তানিয়া
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj-hfjRnDNa7ROmDJcHCnFbVrfO2XfPpDI8xgzj8PPLM-AUXORuc6FKIgpyNEcThRey5zEUC56luHvoxnLWChVGUQreLm2HBqiMHyhTwofd3-bF9tBRU-egOv_UZm-4Ogb4IruN7_2xT3g/s320/%25E0%25A6%2587%25E0%25A6%25B6%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A4-%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%259F%25E0%25A6%25BE-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj-hfjRnDNa7ROmDJcHCnFbVrfO2XfPpDI8xgzj8PPLM-AUXORuc6FKIgpyNEcThRey5zEUC56luHvoxnLWChVGUQreLm2HBqiMHyhTwofd3-bF9tBRU-egOv_UZm-4Ogb4IruN7_2xT3g/s72-c/%25E0%25A6%2587%25E0%25A6%25B6%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A4-%25E0%25A6%25A4%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%259F%25E0%25A6%25BE-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/01/blog-post_77.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/01/blog-post_77.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy