.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলমের সাক্ষাৎকার


[বিন্দুর পক্ষ থেকে আমরা মাসুমুল আলমকে ইমেইলে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। তিনি সময় নিলেন এবং লিখিত উত্তর দিলেন। আমরা শুধু বানানগুলো দেখলাম, আর সব হুবহু রইলো। আনকাট কথাবার্তা। খানিকটা কি ঝুঁকিপূর্ণও? আচ্ছা দেখা যাক। হ্যাপি রিডিং। -সম্পাদক]
অন্তর্গতভাবে আমি কোনো প্রকার গুরু, বা গুরুবাদী মনোভাব ধারণ করি না। গত ২৫/২৬ বছর ধরে এই তরিকায় আমি নিজের মতো করে চলেছি। একটা ঘুণপোকার মতো এবং এই লেখালেখি আমার সিংহাসন।
-মাসুমুল আলম

বিন্দু: আপনার গদ্যশৈলী, যা অর্জন করতে হয় নিরন্তর চর্চায় নিরন্তর সাধনায়। লেখক জীবনের শুরুতেই আপনি মাকড়শা এবং অন্ধকারের গান অথবা সমবেত হত্যাকাণ্ড বা নীলমন্থনের মতো গল্প লিখেছেন− এতোটা শুরুতেই আপনি এই গদ্যভাষা কিভাবে অর্জন করলেন? 
আপনার কি মনে হয় এই পরিণত বয়সের লেখালেখিতেও লেখক জীবনের শুরুর ভাষাকেই বহন করে চলেছেন?

মাসুমুল আলম: আসলে হাত মকশো করা বা চর্চার বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। মাকড়সা এবং অন্ধকারেরর গান আমার ঊনিশ বছর বয়সে লেখা যেটা ছাপা হয়েছিলো ১৯৯৪ সালের প্রতিশিল্পে। চর্চার কথা বললাম এজন্য তারও আগে আমার গল্প মুদ্রিত হয়েছিলো জাতীয় দৈনিকে। অন্যরা যেখানে ছোটকাগজকে প্লাটফর্ম হিশেবে ব্যবহার করে প্র্যাকটিস ম্যাচে খেলে ভালো স্কোর-টেস্কোর ইত্যাদি হয়েছে বুঝতে পেরে একসময় বড়কাগজে যায়, আমার ছিলো উল্টোযাত্রা। আজ বলছি, ইন্টারমেডিয়েট পড়াকালে  আমি ১৮ পরিচ্ছেদের একটা উপন্যাস ‘স্বপ্নের বসতবাড়ি’লিখেছিলাম  হুবহু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং সৈয়দ শামসুল হকের সিনট্যাক্স প্যাটার্ন অনুসরণ করে। এগুলো হাত মকশো করার কাহিনি। সেই উপন্যাসটি এবং দৈনিকে প্রকাশিত দুইটি গল্প হারিয়ে গেছে। কিন্তু তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি ওগুলোকে চর্চার স্মারক মনে করি। 

নীলমন্থন  গল্পটি ‘৯৫ সালের এক দুপুরে বসে লেখা। লিখে  সন্ধেবেলা আমরা যেখানে আড্ডা দিতাম, যশোরের দড়াটানা ভৈরবের পাড়ে ‘কালপত্রে’নিয়ে গেছিলাম। কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদকে পড়তে দিয়েছিলাম। কালপত্র বইয়ের দোকানে তখন মেঝেতে মাদুর পাতা থাকতো, আড়াইপাতার সেই গল্প পড়ে উনি প্রেডিকশন করেছিলেন, আমার হাতে নাকি উপন্যাস আছে। যাই হোক, আমার সামনে কেউ আছেন যাকে আমি গল্পটা বলছি এমন একটা ভঙ্গিতে আমি গল্প বলি বা লিখি, যদিও আমি মনে করি, এই লেখা সহজ এবং কমিউনিকেটিভ, তবুও অনেকেই বলেন বেশ কঠিন এবং তা এন্টেনার ওপর দিয়ে যায়, বুঝতে কষ্ট হয়, জটিল ইত্যাদি। 

‘পরিণত বয়সে’পৌঁছেছি কি না আমি নিজেই সন্দিহান। তবে, লেখালেখির ২৬ টা বছর পার হলো। মনে তো হয় ঐ ভাষাটাকেই বহন করে চলেছি, শুধু উপরিতলের স্ট্রাকচারাল ভাংচুরটা আর করি না। এখন আরো সরল, বৈঠকি চালে টেক্সট লেখার চেষ্টা করি, ঊনকথা, ট্যুইস্ট, তীর্যকতা মেশানো...অন্তর্গত, ইন-বিটুইন-দ্য-লাইন্স নিরীক্ষাটা থাকে আর কি। কোনো রকম নিরীক্ষা নেই–এমন লেখা আমি লিখি না, পড়ি না। 

বিন্দু: আপনার অধিকাংশ লেখায় যৌনতার উপস্থিতি আছে। আপনি সেটাকে বেশ ভালোভাবে হ্যান্ডেলিংও করতে পারেন। যৌনতার প্রতি আপনার এই নিবিড় আগ্রহ আরো বেশি জীবনঘনিষ্ঠ বলে মনে হয়। আরব্যরজনীর ঘোড়া উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে যেখানে সংকটের ঐক্য রূপে তিন নারীর জীবনকে কেন্দ্র করে যৌনতার ব্যতিক্রম প্রয়োগ দেখিয়েছেন। মার্কেজ যেমন বলেছেন, তাঁর সব লেখাই ব্যক্তিগত জীবন থেকে উঠে আসা। আপনিও কি তাই মনে করেন? 

মাসুমুল আলম: যৌনতা, আধ্যাত্মিকতা এবং রাজনীতি। এই তিন ডেটারমিনেটর দিয়ে চরিত্র, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ বা উপস্থাপনে যান অনেকে। কেউ কেউ সচেতনে ঐ তিনের যে কোন ২ টি নিয়ে ডিল করেন। যৌনতা নিয়ে ডিল করা বেশ একটু ঝুঁকির। বিতর্ক, কিংবা বিতর্ক না থাকলেও পর্ণোগ্রাফিক সম্ভাবনার বর্ডার লাইনটা নিয়ে রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে। যৌনতাকে, যৌন আচরণকে ধরার বিষয় শুধু না, যৌনতা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হলে আপনাকে রীতিমতো যৌনভাবনায় রত থাকতে হবে। ফুলের সৌন্দর্যও দেখি, পরাগায়ণও দেখি এরকম। শুরুতেই যদি এই দেখার দৃষ্টি মজ্জাগত থাকে, তবে আপনি ঐ ডেটারমেনিটের অর্থাৎ যৌনতাকে আলগোছে খেলাচ্ছলে নিয়ে ডিল করতে পারবেন এবং তা আরোপিত মনে হবে না। সেক্ষেত্রে, চেষ্টাও করতে হয় না। নিজের অন্তর্গত জীবনের বোঝাপড়া থাকলে লেখা তখন স্বত:স্ফূর্ত এগিয়ে যায়। 

আমার আরব্যরজনীর ঘোড়া উপন্যাস যৌনতা নিয়ে অনেকেই কথা বলে থাকেন। এখানে তিনজন নারীর যৌনতাই শুধু নয়, ক্যাটালিস্ট আরো সব পারিপার্শ্বিক পুরুষচরিত্রের যৌন আচরণ, সেই আচরণের মাধ্যমে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, সক্রিয়তা, নিষ্ক্রিয়তার আভাস এতে রয়েছে। প্রসঙ্গত গার্সিয়া মার্কেজই শুধু না, সব মহৎ সাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিকের লেখাপত্র আসলে ব্যক্তিজীবনেরই রিফ্লেকশন। যেখানে সরাসরি ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থাকতে পারে, আবার নাও পারে। বিষয়টা আসলে অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞানের। সব অভিজ্ঞতা আমার নাও থাকতে পারে, কিন্তু আমার আগ্রহ, কৌতূহল থেকে আপনার কাছ থেকে আপনার অভিজ্ঞতা, অমুকের অভিজ্ঞতার সারাৎসার আমাকে হুক করলে আমি তা লিখবো এবং তা আমার লেখাই হবে। ব্যক্তি মানুষের জীবনে তো সব অভিজ্ঞতা থাকে না। তবে, বাঙালি হিসেবে আমরা খুব সেরে খাওয়া লোক। নিজের অভিজ্ঞতাটুকুও, ভালোটুকু বাদে ‘মন্দ’ আমার বলতে চাই না, এই ভালো-মন্দের উপলব্ধিটুকু লিখতেও সাহস করি না। অনেকে অবশ্য অকপটে নিজের কথাটুকু লিখতেও পারেন না। সাহস লাগে। রুচি-টুচি না, যৌনতাকে নিয়ে ডিল করতে অনেকে স্বস্তিবোধ করেন না।  

বিন্দু: স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা− গল্পটি প্রকাশ পাওয়ার পর একটি মৃদু বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছিলো। যেহেতু একটি চেনাজানা ঘটনার উপর ভিত্তি করে এই গল্পটি লেখা হয়েছিলো। আপনার কি মনে হয় গল্পের শেষে গিয়ে রিমির প্রতি লেখকের এক ধরনের ক্রোধ ফুটে উঠেছিলো?

মাসুমুল আলম: লেখকরা চেনাজানা ঘটনার ওপর ভিত্তি করেই লিখে থাকে। চেনাজানা চরিত্রগুলো লেখায় আসে এবং লেখার মধ্যে আপনার চেনা চরিত্রগুলো হুবহু আর চেনা-ছকে তখন থাকে না। কিন্তু থাকে না যে, তা আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না আমাদের চেনা-জানার দেয়ালের জন্য। ফলে, জানা ঘটনা দিয়ে আমরা চরিত্রটিকে চিনতে পেরেছি বলে সীমাবদ্ধ হয়ে যাই। এটা হলো ফিক্সেশন। অথচ সাহিত্যে ঐ বাস্তব চরিত্রটি সাহিত্যিক কারণেই অ-বাস্তব বা তীর্যক বাস্তবতার অন্য চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা আর পাঠকের নজরে ধরা পড়ে না ঐ চেনা-জানার দেয়ালের জন্য। বরং অচেনা অজানা পাঠক, অন্য ভূগোলের পাঠক স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা  যেভাবে রসাস্বাদন করতে পারেন, কিন্তু ঐ চেনা-জানার  দেয়াল আপনাকে-আমাকে সেই বাঁধাটুকু দেয়। কিন্তু তা টপকে যাওয়াও সহজ পাঠক হিসেবে। স্বৈরিণীর  জন্য প্রতীক্ষা পড়ার পর কেউ কেউ টপকে সেই দেয়াল অতিক্রম করতে পারেন নি। তারা সদৃশতা খুঁজতে গেছেন। হ্যাঁ, মৃদু বিতর্ক তৈরি হয়েছিল সেই সময়। রিমি, ঐ চরিত্রটিকে, আমি আমার সমকাল থেকে বরং বিগত সামরিক শাসনকালে প্রতিস্থাপন করেছি তখন আমি নিজেই ১০/১১ বছরের কিশোর। গল্পে সময়টাই পাল্টে দিয়েছি এবং ঘটনাও। 

না, রিমির প্রতি নয়, বরং অন্যদের নগ্ন হাহাকারের বিপরীতে আমার নিষ্ক্রিয়তা ছিলো। শূন্যতা বোধ ছিলো। নির্জলা একটা অনুভব। শূন্যতানুভূতি। না হলে আমি লিখতে পারতাম না এই গল্প। 

বিন্দু: সম্ভবত একমাত্র ষষ্ঠীর খেলা  গল্পটি আপনার নিজস্ব এলাকার বাইরে গিয়ে লেখা। আমাদের মনে হয়েছে এই ধরনের আরো কিছু গল্প আপনি লিখতে পারেন। নারকেল গাছকে ঘিরে ষষ্ঠীচরণের জীবিকা। পুত্র কেলোচরণের মৃত্যু আর ছোটপুত্র ভূতোর লাপাত্তা। ফলে, অবসর ভেঙে ষষ্ঠীচরণ ফের জীবিকার তাগিদে গাছ বেয়ে উঠতে গিয়ে ভূপতিত হলো। সম্ভবত মৃত্যুও হলো− এমন একটি নিটোল গল্পের পেছনে আপনার কথাগুলি শুনতে ইচ্ছে করছে...

মাসুমুল আলম: “নিটোল গল্প” বলে একটা জিনিশ বহু দিন ধরে শুনে আসছি। তো, ভাবলাম, গ্রামজীবন নিয়ে এরকম একটা “নিটোল গল্প” লিখি। লিখলাম। গাছ থেকে পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা তো আপনি না দেখলেও এরকম সচরাচর ঘটনা তো আমরা জানি। বিবরণই তো কেবল গল্প না, তাই না? গল্পের শেষ প্যারাটা আমি দেখতে/পড়তে বলবো, যেখানে বুড়ো দেওয়ান দেখছে, নারকেল গাছ থেকে কেশবপুরের লুপ্তপ্রায় মুখপোড়া হনুমানের মতো ষষ্ঠীচরণ পড়ে যাচ্ছে। মুখটা ঘুরিয়ে সশব্দ সেই পতনশব্দ শুনে উঠে গেলেন বুড়ো দেওয়ান। ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। প্রথাচলতি ন্যারেশনের ভেতরেও প্যারালাল ভাবনা ও টেক্সটের ট্যুইস্ট, মন্তাজ কি ধরা যায়? নিটোল এই গল্পের মধ্যেও এই নিরীক্ষাটুকু কিন্তু রয়েছে। ঐ যে বললাম ঢেঁকি স্বর্গে যাক বা নরকে, ধান তো ভানবেই। পাঠক হিসেবে আমি নিটোল গল্প/গোল গল্প পছন্দ করি না। ফ্লাট ল্যাঙ্গুয়েজের তলহীন নিটোল কাহিনি আমার কাছে নসিয়া। আমি লিখতে চাই না সেরকম। ষষ্ঠীর খেলা আদতে কি হয়েছে সচেতন পাঠক বলতে পারবেন। গল্পখোর পাঠকদের কথা নিশ্চয়ই আমরা বলছি না। 

বিন্দু: আপনার মৌন ধারাপাত  উপন্যাসটি মাত্র ৫৭ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত। নামপুরুষ ও অন্যান্য  বইতে নামপুরুষ  নামে ৪৭ পৃষ্ঠার একটি বড় গল্প আছে, যা প্রায় মৌন ধারাপাতের সমান। ফিল্ডের দিক দিয়েও নামপুরুষ কে আমাদের কাছে উপন্যাসের সমতুল্য মনে হয়েছে। এতোদিন পরে এসে আপনারও কি তাই মনে হয়?

মাসুমুল আলম: নামপুরুষ ও অন্যান্য বইটা ২০১১ সালে বেরিয়েছিলো। এটা ছিলো মোট ২০টি গল্পের সংকলন। ১৭ বছর ধরে লেখা সবগুলো গল্প সেসময় ‘উলুখড়’ প্রকাশনীর সাগর নীল খান দীপ ১৬৯ পৃষ্টার এই বইটি করতে নিলে আমি যে ভুলটি করি তাহলো ‘নামপুরুষ’ নামে ৪৭ পৃষ্ঠার দীর্ঘ একটা লেখা অন্তর্ভুক্ত করা, যেখানে অবিভক্ত ভারতবর্ষ, দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষজনিত কারণে সেই সময়ে ভৌতিক গল্পের জন্ম, দেশভাগ পরবর্তী সময়ের গ্রামজীবন এবং আন্তর্জাতিকতাময় শহরে পুঁজির বিকাশের সাথে কতোগুলি চরিত্রের পরিভ্রমণ আমি টানা লিখি। এখন বুঝি, এর বিস্তার এমনই যে এটা গল্প নয়। 

আমি মনে করি, উপন্যাসের বিস্তার শুধু কলেবর দিয়ে চিহ্নিত করা এখন যাবে না। 

আর তা কোন কর্মঘন্টা, দিন-মাস-বছরের হিশেব দিয়েও বিবেচ্য নয়। রেফারেন্স, রিসার্চ দিয়েও নয়। সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করানোর মতো সহজতা এবং দক্ষতাও সমান বিবেচ্য।

বিন্দু: চরিত্র বা পরিস্থিতি ছাড়াই কীভাবে একটা গল্প হতে পারে? বরফের ছুরি  গল্পের বইটিতে মনে হয় সেরকম একটা ইন্ধন আছে। অনেক চরিত্র আছে বা পরিস্থিতি আছে তবু তারা যেন নেই, শুধু গল্প উঠে আসে। আসলেই কি তাই?

মাসুমুল আলম: বরফের ছুরি  আমার তৃতীয় এবং সবশেষ গল্পের বই। যে গল্পগুলো সব ২/৩ পৃষ্ঠায় শেষ। আগে থেকেই কিছু ইমেজ হঠাৎ আমাকে হন্ট করলে আমি ভূতগ্রস্তের মতো বসে গেছি লিখতে। বেশিরভাগ গল্পে চরিত্রের কোনো বিল্ড-আপ নেই, স্কেচি কয়েকটি বাক্যে বরং পরিস্থিতি বলার চেষ্টা। ব্যাপক আনন্দ থেকে এই গল্পগুলোর আকস্মিক জন্ম। এসব টেক্সটের। 

বিন্দু: তাহারেই পড়ে (না) মনে− এই পুরো গল্পটিই একটি সংলাপভিত্তিক গল্প। কোথাও লেখকের কোনো বয়ান নেই। সো টাফ। এই গল্পটি কি লিখতে লিখতেই এমন লেখা হয়ে গেলো? শুধু একেবারে শেষ লাইনে ‘অতএব’... নামক একটি শব্দ আছে...

মাসুমুল আলম: গল্পটিতে দু’টো চরিত্রকে সাপলুডো খেলতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে ছক্কাগুটির পরবর্তে আছে নিজেদের আলটপকা সংলাপ। তাই সংলাপগুলো থেকে একটা স্টোরিলাইন পাওয়া যায়। আর গল্পে অতিরিক্ত কিছু ভাবনার পরিসরে পাঠক যুক্ত করতে পারেন নিজেদেরও কিছু অন্তর্গত সংলাপ। শুধু সংলাপের প্রবাহ নাট্যমুহূর্ত যাতে তৈরি না করে, কারণ, এটা তো একাঙ্কিকা নয়, বরং একটা গল্পপাঠের অভিজ্ঞতা দ্যায়, সেই প্রচেষ্টাটুকু সংলাপ সাজানোর ওপর ডিপেন্ড করে। সংলাপের দ্বান্দ্বিক বিন্যাস ঠিক রেখে মনোটোনাস ভঙ্গিটাকে রোধ করাও একটা চ্যালেঞ্জ। পেরেছি কি না জানি না। তাহারেই পড়ে (না) মনে  গল্পের শেষ লাইনে এসে এই “অতএব” নামক শব্দটি আসলে স্টোরিলাইনের সেতুবন্ধ। একইসঙ্গে, পাঠকের ব্রিদিং স্পেস বা চিন্তার অবকাশ এবং শূন্যস্থান পূরণে নিজেদের স্বগত সংলাপ বসানোর জায়গা।

“মোটা দাগে ২২ পয়েন্ট বোল্ড করতে গিয়ে আরোপিত প্রবণতার জাড্য গদ্যশৈলীর টেক্সট আমি লিখি না। এবং একারণেই আমি আলাদা।”

বিন্দু: আপনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক গল্প লেখেননি, যদিও পলিটিক্যাল ইনটেনশনগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে আপনার লেখায় ঢুকে পড়ে। রাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্যে চলে আসাটা আপনি কি ক্ষতিকর মনে করেন?

মাসুমুল আলম: আমি কনটেম্পোরারি থাকতে চাই। কনটেম্পোরারি ইস্যুগুলো আমার লেখায় চলে আসে। ফলে, রাজনীতি বা অন্য আর কোন বিরাজমান দশা আমার লেখাপত্রে স্বাভাবিকভাবে আছে। আমি নিজেকে রাজনীতিসচেতন মনে করি মাত্র। কিন্তু রাজনীতিক ভাবনা’র সরাসরি প্রতিফলন লেখায় আসুক তা আমি চাই না। রাজনৈতিক আদর্শ তাড়িত লেখা লেখকের লেখাকে নিয়ন্ত্রিত করে বলে আমার ধারণা। স্বতঃস্ফূর্ততার কথা আর নাইবা বললাম। রাজনৈতিক দৈত্য বা রাজনৈতিক বামন চরিত্র তৈরি করলে, তার যতো মহৎ উদ্দেশ্যই থাকুক তেমন লেখা আমার পছন্দ না। অতএব, যা পছন্দ করি না, নিজে তো তেমন লিখবো না। 

বিন্দু: আপনার উপন্যাসগুলিতে অন্তর্জীবনের স্বগতোক্তি আছে। –আমি কি ভুল বললাম?

মাসুমুল আলম: না, ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করেছি। অন্তর্জীবনের বা অন্তর্জগতের নিশ্চিতি থাকে বলেই আমার লেখাপত্র স্বচ্ছন্দগতির বলে আমি মনে করি।

বিন্দু: আপনার প্রকাশিত তিনটি উপন্যাসের ভঙ্গিগত তফাৎ আছে। বিষয়গত তফাৎ আছে। ভাষাশৈলীর একটি অন্তর্গত মিল থাকলেও উপন্যাস তিনটি এতোটাই স্বতন্ত্র যা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। আপনার কি মনে হয় শুধুমাত্র কাহিনি ও পরিবেশ বর্ণনার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের প্রাণ ধরা যায় নাকি টোটাল ব্যাপারটাই একটা মনস্তাত্ত্বিক খেলা?

মাসুমুল আলম: শুধু কাহিনি বর্ণনা দিয়ে উপন্যাস লেখার দিন শেষ। শুধু পরিবেশের বর্ণনা দিয়েও না। এমনকি শুধু মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার বর্ণনাও না। বরং সবটা মিলে।এর সাথে সবকিছুই যুক্ত হতে পারে। নন-ফিকশনাল এটিটিউড, নিবন্ধ, রিপোর্টাজ, থ্রিলার, পর্ণোগ্রাফি, গান, কবিতা, মাল্টিমিডিয়া এপ্রোচের সবকিছুই এখন উপন্যাস আত্মসাৎ করে নিতে পারে। ঔপন্যাসিকরা, বিশ্বব্যাপী, তেমনটাই এখন লিখছেন। আর আমাদের এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক এখনো নিটোল ঘটনাবিবরণের পরিচ্ছেদ লিখে লিখে উপন্যাস ফাঁদেন। এদের মধ্যে আবার যাদের ভাষাটা ভালো, তাদেরকে আমরা একটু আলাদা করে দেখলেও, তারা ঐ পথেরই পথিক।এদের মূল প্রবণতাটা এখানে একজন স্মার্ট গল্পদাদুর এই আর কি। 

দ্যাখেন বিষয় এবং আঙ্গিকগতভাবে তিনটি উপন্যাসের মধ্যে পার্থক্য না হলে, সে ভাষাভঙ্গিতে হোক, বা, যাই হোক, ৩টি উপন্যাসের পর চতুর্থ নতুন উপন্যাসটি বা, না-উপন্যাসটির পান্ডুলিপি আমি রেডি করতাম না। আগের প্রকাশিত আমার ৩টি উপন্যাসই পরস্পর থেকে পৃথক। র‌্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো পরিচ্ছেদহীন টানা ন্যারেশনে লেখা। একটা মহল্লাকে কেন্দ্র করে পুঁজির বিকাশ ও বিশ্বায়ন, চরিত্রগুলোর স্বপ্ন ও অধ:পাতের কাহিনি। আর আরব্য রজনীর ঘোড়া তিনজন নারীর আত্মকথা, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান যৌনতার দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্ফুট, ল্যাঙ্গুয়েজ আরবান, র এবং মিশ্র।

মৌন ধারাপাত,-যেটা আপনি আগে উল্লেখ করেছেন, এই ছোট উপন্যাসটি আসলে প্রকৃতি পরিবেশের সাথে আর্কিটাইপ চরিত্রগুলোর স্কেচ। দেশভাগ, স্বাধীনতা এবং স্বাধীন দেশে আরো বহু বছর পরে প্রান্তবর্তী কিছু মানুষ, মৃত নদীর তীরভূমিতে গড়ে ওটা জনপদের কাহিনি। এইই তো। নিজের উপন্যাস নিয়ে এর চেয়ে বেশি আর কি বলা যাবে? 

বিন্দু: আমরা গত কয়েক বছর খেয়াল করেছি ফেসবুকে আপনি প্রায়শই টুকরো টুকরো গদ্য প্রকাশ করে চলেছেন। তাতে যেমন আছে স্যাটায়ার তেমনি এপ্রিসিয়েশন, আর আছে আপনার নিজস্ব স্টোরিলাইন ভিত্তিক নানা বৈচিত্র্যময় লেখা। প্রশ্ন হলো, এইসব লিখতে গিয়ে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কিনা?

মাসুমুল আলম: মূলত: লেখালেখি প্রসঙ্গেই এ ধরনের লেখালেখি। ছোট ছোট গদ্য। আর দেশ-বিদেশের সমসাময়িক লেখক-সাহিত্যিকদের বইপত্র নিয়ে আমার পাঠাভিজ্ঞতা অল্পকথায় প্রকাশ। আর আছে সাহিত্য নিয়ে কিছু চিন্তনকণা, যা উঠে এসেছে দেবী চৌধুরানী, মি. চৌধুরী, ওস্তাদ, বস... এসব সম্বোধনের হাত ধরে, এদের চোখের দিকে তাকিয়ে সমকালীন সাহিত্য ও সাহিত্যিক প্রসঙ্গ ছুঁড়ে দেয়া কিছু চিন্তাবীজ ও প্রশ্নমালা।ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকেই এগুলো আমি লিখেছি। এখনো এরকম লিখে চলেছি একটা স্বতঃস্ফূর্ত তাড়নায়। 

না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিনা তো। তবে, সারাউন্ডিংসের অনেক লেখক-সাহিত্যিকের মন খারাপ হচ্ছে। তাদের বিরূপতা টের পাচ্ছি। অনেকেই লেখাগুলোকে ভালো, অন্যরকম লেখা বলছেন,-কিন্তু মন জুগিয়ে চলতে  আমার করার কিছু নেই। 

বিন্দু: কথাপরিধি: ২২ পয়েন্ট বোল্ড ও অন্যান্য−বইটির আইডিয়া আপনার মাথায় কীভাবে এলো? যেখানে টুকরো টুকরো গদ্যের ভেতর আপনার সমকালের ক্যারেক্টার ধরা পড়েছে ভীষণ তীর্যক ভঙ্গিমায়। বিশেষ করে আপনার গদ্যভাষা যেন আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে একটি নতুন ধারা চালু করে দিলো...?

মাসুমুল আলম: হ্যাঁ, বইটিতে ফেসবুকের লেখালেখি সংক্রান্ত আমার পোস্টগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। এরকম ১০৫টি টুকরো গদ্য, এই গদ্যগুলোর ধরন আত্মগত এবং বৈঠকি। এছাড়া, বইটিতে সমসাময়িক বেশ ক’টি বই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা আছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ঘাসান কানাফানি, সেলিম মোরশেদ, তারেক মাসুদসহ আরো সমসাময়িক লেখকেদর সাহিত্যকর্ম নিয়ে। আর লেখার ভঙ্গিমাটা ‘দেবী চৌধুরানী, মি. চৌধুরী, ওস্তাদ, বা বসদের ভারবাহী হয়ে তীর্যক, তা আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, আপনাকে রক্তাক্ত করার জন্য, আপনাকে উস্কে দেয়ার জন্য, সর্বোপরি, যাদের চামড়াটা বেশ পুরু হয়ে গেছে, তাদের জন্য। আসলে আমি এই লেখাগুলো, এই টুকরো লেখার মধ্য দিয়ে নিজেই নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে চেয়েছি। সমকালীন বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য নিয়ে প্রশ্ন, উদ্বেগ, কখনো আক্রোশ হাল্কা ঠাট্টাচ্ছলে বলা, আসলে নিজেই নিজেকে বলা। আর আয়নায় নিজের মুখটা দেখে যদি কাল্পনিক দেবী চৌধুরানী বা মি. চৌধুরীকে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়। এই আর কি। বইয়ের মূল লক্ষ্য সেটাই।

বিন্দু: আপনি যখন অনুবাদ করেন, কেন জানি মনে হয় সেটা আপনারই মৌলিক সাহিত্য। বিশেষ করে ঘাসান কানাফানির উপন্যাস মেন ইন দ্যা সান। অনুবাদে যখন আপনার নিজস্ব গদ্যভাষা ঢুকে পড়ে আপনি কি নিজে ঐ শিল্পকর্মটিকে কখনো মৌলিক শিল্প ভেবে মিস করেন?

মাসুমুল আলম: অনুবাদিত সাহিত্যে ভাষার প্রাঞ্জলতা ও স্বচ্ছন্দ গতি এটা অনেকে আশা করেন। করতেই পারেন। কিন্তু সব অনুবাদ তো আবার সেরকম হবে না। উইলিয়াম ফকনারের মতো লেখকের সাহিত্যের অনুবাদ মূলানুগ রাখতে গেলে পাঠকের ‘তরতরিয়ে এগোনোর’অভ্যস্ত পূর্ব ধারনা হোঁচট খাবে। আন্দ্রেই তারকোভোস্কির সিনেমায় দর্শক যেমন জানেন, তাঁর চলচ্চিত্রে জমাট কাহিনির ন্যারেশন নেই, ইমেজ আফটার ইমেজ বিল্ড-আপ করে স্টোরিলাইন এগোয় না। কাফকাও তাই। কাজেই, লেখকের লেখার মৌল ধরণের সাথে অনুবাদ কর্ম সিংক করে–এটাই স্বাভাবিক। একটা লেখায় যদি কাব্যিক গুণ থাকে কিন্তু অনুবাদে সেটা না আসে, অর্থাৎ মূল লেখার যে সত্ত্বগুণ সেটা যদি লেখায় না আসে তাহলে অনুবাদ ব্যর্থ। আমি বোঝাতে চাইছি, আমি এযাবৎ কাল যা অনুবাদ করেছি আমার কথাসাহিত্য রচনার মতো মমতা নিয়ে। আমি তীব্র আনন্দ থেকেই সেটা করেছি। আমার গদ্যভাষায় অনূদিত সাহিত্যকে, যে বৈভব দেয়া উচিৎ- আমি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এবং আমি আবার বলছি, ব্যাপক আনন্দবোধ থেকেই আমার অনুবাদ প্রচেষ্টা। আমি সবচে বেশি আনন্দিত হয়েছি ফিলিস্তিনি লেখক ঘাসান কানাফানির মেন ইন দ্য সান-এর ভাষান্তর করে যা মূল উপন্যাসের মৌল স্বরের সাথে সংগতিপূর্ণ। সেই সংগতি, সেই সিংক অক্ষুণ্ন রেখেই মেন ইন দ্য সান-কে আমি আমার শিল্পকর্ম মনে করি। যা শুধু ট্রান্সফর্মড হয়েছে বাংলাভাষায় মূল উপন্যাসের গভীরতাসহ। 

“ম্যুভমেন্টের কোনো ইস্যুভিত্তিক মিছিলের শরিক আমি না। আমার সাহিত্যিক–সর্বস্ব পরিচয় নিয়ে আমি কুন্ঠিতও না। লেজ বা অবশিষ্টাংশের মতো তাদের সাথে আমি রয়েছি, চাইলে আমাকে তারা ছেঁটে ফেলতে পারতেন বাড়তি এ্যাপেন্ডিক্সের মতো।”

বিন্দু: সম্প্রতি ওয়াকিং ডিসট্যান্সে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন− “আমার নিজের কিছু জিজ্ঞাসা, নিজস্ব কিছু সংকট, নিজস্ব একধরনের সংশয় আমি আমার লেখায় এক্সপ্রেস করি। সে লেখার ধরনটা আলাদা। স্বতঃস্ফূর্ত। এটাই আমার কাছে শিল্প।”অবশ্যই আপনার লেখার ধরনটা আলাদা। এই “আলাদা”ধরনটা আপনার লেখালেখিতে কীভাবে হয়ে উঠলো?

মাসুমুল আলম: মানুষ লেখে কেন? ঐরকম কিছু জিজ্ঞাসা, সংকট অন্য লেখকদেরও আছে। যাদের অধিকাংশই ভালো লেখেন, যদি ধরেও নিই, (আসলে ভালো লেখেন কম সংখ্যক), সেটা আসলে তাদের আলগা দেখনসই স্মার্টনেস কিন্তু প্রচল গল্প বলার ধারায় কাহিনি বয়ান করাকেই তারা সাহিত্য মনে করে। 

আবার কেউ কেউ আছেন, সুভাষ ঘোষ, সুবিমল মিশ্রের মতো সারফেস লেভেলে স্ট্রাকচারাল কাঠামোর ভাঙচুর করাকেই নতুন এক্সপেরিমেন্টাল সাহিত্য করছি বলে আত্মশ্লাঘায় থাকেন। কেউ আছেন ভাষার দুর্গম প্রাচীর যাদের আরাধ্য। অথবা তাও না, তাদের গল্প নির্মিতি, ভাষাকাঠামো সহজাতভাবেই জটিল। না, পাঠক সহজবোধ্য গল্পের সমঝদার বলে কমিউনিকেটিভ গদ্যের রূপকার তারা নন। আমি বারবার বলি আমপাঠক নমস্য নন। নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠক ব্যতীত আমজনতার মতো আমপাঠক এখানে, এই দেশে, সক্রিয় অংশীদার না হয়ে বহুদিন হয় “গল্পখোর পাঠক”হয়ে উঠেছেন-তাদের মনোরঞ্জন আপনি করেন না বলে একটু ভেতর ভেতর নাক-উচুঁ হয়ে উঠেছেন। তখন আপনি হয়ে উঠতে পারেন উন্নতনাসা। আমি এতে দোষ দেখিনা। 

আর আমি নিজে একইসঙ্গে নিরীক্ষাপ্রকাশ এবং স্বত:স্ফূর্ত এই দু’টি ধারার একটা সমন্বিত অবস্থার মধ্যে রয়েছি বলে মনে করি। এর সঙ্গে আছে পাঠক ও লেখক হিসেবে আমার উন্মাদনা। স্বত:স্ফুর্ততার নামে  তলহীন গতিশীল ফ্ল্যাট ল্যাঙ্গুয়েজের গল্পশিকারী আমি না। আমার শিল্পের ভাষাও স্বত:স্ফূর্ত। নিরীক্ষাটাও তাই। মোটা দাগে ২২ পয়েন্ট বোল্ড করতে গিয়ে আরোপিত প্রবণতার জাড্য গদ্যশৈলীর টেক্সট আমি লিখি না। এবং একারণেই আমি আলাদা। 

বিন্দু: একজন লেখকের জীবনে লেখালেখিতে কম-বেশি বিরতি হয়। কিন্তু আমরা যতদূর জানি, আপনার লেখকজীবনে তেমন কোনো বিরতি নেই। আপনার নিজস্ব কায়দায় একধরনের ধারাবাহিকতা আপনি রেখে চলেছেন। কোন শক্তিতে আপনি এতোটা চলমান থাকেন?

মাসুমুল আলম: কারণ প্রতিদিনই আমার পড়ার অভ্যাসটা আমি জারি রেখেছি। নিয়মিত পঠনের ফলে কোনো কোনো লেখা থেকে আমি লিখতে বসার উদ্দীপনা পাই। যে প্রণোদনা আমি একসময় পেতাম তুমুল আড্ডা থেকে। এখন এই আড্ডাটা অনিয়মিত বা প্রায় নেই হয়ে গেছে। তবে, অনিয়মিত হলেও সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা থেকে লিখতে বসার উৎসাহ তৈরি হয়। এখন তো ভার্চুয়াল আড্ডারও সুযোগ রয়েছে। টেলিফোনে দ্বিপাক্ষিক লেখালেখি সংক্রান্ত আলাপও লেখার ইচ্ছাকে জাগ্রত রাখে। আলাপ-সংলাপ, আড্ডা, বা পাঠাভ্যাসের ফলে বই থেকে যে লেখার ইচ্ছা জাগ্রত হয়, সেই ইচ্ছা নতুন আইডিয়া নিয়ে আসে, মাথায় ঘুরতে থাকে। এমন না যে, যা আপনি/আমি পড়লেন/পড়লাম, অথবা আড্ডার বিষয় লিখবার বিষয় হিশেবে আসে। তা না, বরং, আইডিয়া খেলা করে, বিদ্যুচ্চমকের মতো, নতুন নতুন আইডিয়া। আর এই আইডিয়ারই রূপান্তর ঘটে পরবর্তী কোনো একসময়ের লেখায়। 

বিন্দু: সাহিত্যে আইডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু শুধুমাত্র আইডিয়া থ্রো করাই কি সাহিত্য? আপনার লেখালেখিতে ভাষার তলায় আইডিয়া কীভাবে লুকিয়ে থাকে?

মাসুমুল আলম: আইডিয়া হচ্ছে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতো। নানা উৎস থেকে আইডিয়া আসতে পারে। এবং প্রথমে এটা নিজেকে নিশ্চয়তা দিতে হয় যে, এটা নতুন। পরে, নার্চারিং। লেখার আইডিয়া নিয়ে ভাবা মানে একইসঙ্গে বিষয় ও আঙ্গিকের নতুনত্ব। শুধু বিষয়বস্তুই নতুন নয়, সঙ্গে তার ফর্মও। একজন লেখকের পঠন-পাঠন এই জন্য যে, তার পাঠপরিধি আইডিয়া গ্রহণ ও বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। রিপিটেটিভ হচ্ছে কি-না, কি লিখছি অথবা কি লিখবো না, এমন কি, নিজের লেখারও রিপিটেশন এড়াতে নতুন আইডিয়া গ্রহণের সক্ষমতা ও বাস্তবায়ন জরুরি।

আমার ক্ষেত্রে, এই প্রক্রিয়াটি এরকম: যদি আইডিয়াটাকে কনটেন্ট ও ফর্মসহ সামগ্রিকভাবে দেখি তবে তা সাহিত্য। কিন্তু আমরা অনেকে আইডিয়াটাকে খণ্ডিত করে নিয়েছি ফর্ম বাদ দিয়ে বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে। সুতরাং বলা যায়, আইডিয়া অবশ্যই সাহিত্য। আপনার স্বত:স্ফূর্ত নির্মিতির আড়ালে লুক্কায়িত আইডিয়া এবং লেখালেখি আসলে সামগ্রিকভাবে আইডিয়া-ই হয়তো কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু নিয়ে যাপন প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তারপর একটা সময় আসে, একটা মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন লেখাটা শুরু হয়, এবং ঐ আইডিয়া গোটা লেখার শৈলী ও গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকের মতো যুগপৎ স্টাইল এবং বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার মধ্যে আইডিয়াটা থাকে। আর বহু পুরাতন বিষয়বস্তুকে ধরে লেখা সমকালীন বা সমসাময়িক না হলে আইডিয়া যে নতুন না, এটা প্রমাণ হয়। সেই প্রচল লেখা বহু লোক পড়লেও, কাটতি হলেও, অনেকের কাছে এর গুরুত্ব নেই। আমি পড়ি না। আর সুগার কোটেড প্রচল বস্তাপচা লেখার রমরমা সব সময়ই কিন্তু বেশি। এক্সপেরিমেল্টাল লেখা ছাড়া ছুঁয়েও দেখি না। আইডিয়ার মধ্যে নিরীক্ষা প্রবণতা থাকবে, তবেই তা প্রচলের বাইরে যাবে। 

বিন্দু: অল্টারনেটিভ সাহিত্যের পাঠক সবসময়ই কম। এটা আমাদের দশা। কোন্ ধরনের গল্প বা উপন্যাসে আপনার ঝোঁক কাজ করে। নাকি এটা কোনো ঝোঁকের ব্যাপার না? লেখকের অভ্যন্তরীণ প্রবণতা থেকেই তাঁর ঝোঁকগুলি স্পষ্ট হতে থাকে। এদেশের দাবীকৃত অল্টারনেটিভ সাহিত্য আপনাকে কতোটা ভাবায়?

মাসুমুল আলম: অল্টারনেটিভ সাহিত্যের ধারায় লেখকরাই আসলে পাঠক। আমি আমার নিজের কথা বলি। বলেছি, এখন আমি আর গতানুগতিক লেখা পড়ি না। বরং কোনো কোনো লেখা খুবই শ্রমলব্ধ বুঝতে পারছি, মনে মনে ঐ শ্রমের মর্যাদা দিলেও একটু পড়তে পড়তে ফিরে এসেছি আল্টিমেটলি গতানুগতিক লেখা বলেই। হয়তো ভাষাটা চোস্ত, কিন্তু শুধু ভাষা দিয়ে পাঠককে তিনশ/চারশ পৃষ্ঠা তরানো কঠিন। যে পাঠক লেখকের লেখায় নতুন এটিটিউড খোঁজে-আমি নিজে কারো লেখায়, সে ইনার বা সারফেস, যে লেভেলেই থাক, এক্সপেরিমেন্ট না থাকলে আমি পড়ি না, এবং বিশ্বাস করি এ ধরনের পাঠকের কাছে তা কোনো অলটারনেটিভ সাহিত্যই নয়। আর অল্টারনেটিভ, নিরীক্ষাপ্রবণ ধারার সাহিত্যের পাঠক চিরকালই কম হবে। যে অবস্থা, ভবিষ্যতে আরো কমবে। 

দ্যাখেন, এই যে ‘খাইছি’, গেছি’ ‘দিলা না’‘গেলা না’... ইত্যাদি বলে কেবল মিশ্র নাগরিক ভাষার প্রয়োগে অলটারনেটিভ সাহিত্য হবে না। যেখানে বয়ান এবং বয়নশৈলী দুইটাই প্রচল।দৃ্ষ্টিভঙ্গিটাই তো প্রচল। 

“রাজনৈতিক দৈত্য বা রাজনৈতিক বামন চরিত্র তৈরি করলে, তার যতো মহৎ উদ্দেশ্যই থাকুক তেমন লেখা আমার পছন্দ না। অতএব, যা পছন্দ করি না, নিজে তো তেমন লিখবো না।”

বিন্দু: আপনার লেখার রুটিন সম্পর্কে জানতে চাই। দিনের কোন সময়টা লিখতে বসেন? বা লেখার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো নিয়ম আছে কি?

মাসুমুল আলম: কোনো রুটিন নেই আমার। যখন তখন লেখা হয়। তবে, বাসায় একা থাকলে, এবং সেটা খুব কমই হয়- তখন রাতটাকেই মূলত: লেখার জন্য বেছে নিই। সব জায়গায় লিখি।   

বিন্দু: আমরা যদ্দুর জানি আপনি সাধারণত এক সিটিংয়েই একটা গল্প লিখে ফেলেন। এটা কীভাবে সম্ভব?

মাসুমুল আলম: আইডিয়া নিয়ে ভাবতে ভাবতে পুরো লেখাটা নিয়ে ভাবি। প্রথমে থই পাইনা যদিও। একটা ঝাপসা অবয়ব, তারপর হঠাৎ শুরুর লাইনটা পেয়ে যাই। ব্যাস্! এটাই আসল। লিখতে লিখতে গোটা গল্পটা দাঁড়িয়ে যায়। ১৫/২০ পৃষ্ঠার নিচে কোন লেখা আমি একদিনে শেষ করার চেষ্টা করি। ৪/৫ পৃষ্ঠার লেখা এক সিটিং-এ বসেই। ঐ যে, বললাম, আইডিয়া, আইডিয়াজনিত ম্যুড থাকতে থাকতে বা শুরু হওয়া লেখার মেজাজ, ভরকেন্দ্রর, টেম্পো ধরে রেখে শেষ করতে গেলে এটাই আমার পদ্ধতি। একটা তাড়না থেকেই আমি লিখি। হয়তোবা কোনো একটা ইমেজ থেকে। 
আর উপন্যাস যখন লিখি, প্রতিদিনই লিখি। যাতে-তাল লয় না কাটে তার জন্য সংক্ষেপে সুত্র রাখি পরবর্তী সময় লেখার জন্য, মুসাবিদা করে রাখি ইংগিতে। 

বিন্দু: আপনার সাহিত্যিক জীবন বেড়ে ওঠার সাথে লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অথচ আপনি ঐ অর্থে একজন এক্টিভিস্ট নন, যতোটা আপনি কথাসাহিত্যিক। উদাহরণস্বরূপ সেলিম মোরশেদ একজন কথাসাহিত্যিক আবার একই অঙ্গে এক্টিভিস্টও। এই ব্যাপারটা আপনি কীভাবে দেখেন?

মাসুমুল আলম: হ্যাঁ, আমি এক্টিভিস্টদের সঙ্গে আছি আমার সাহিত্যিক কর্ম ও সাহিত্যিক জীবন নিয়ে। আছি তাদের সঙ্গে যারা ম্যুভমেন্ট করেছেন, এখনো করেন, তাদের সাথে লেখা দিয়ে আছি নিরীক্ষামূলক শিল্পসন্নিহিতি থেকে। কিন্তু কখনো এক্টিভিজমে আমি ছিলাম না, নেই। একটা স্বার্থপর, আত্মগত অবস্থানে আমি বরাবর ছিলাম বা থাকি। ম্যুভমেন্টের কোনো ইস্যুভিত্তিক মিছিলের শরিক আমি না। আমার সাহিত্যিক–সর্বস্ব পরিচয় নিয়ে আমি কুন্ঠিতও না। লেজ বা অবশিষ্টাংশের মতো তাদের সাথে আমি রয়েছি, চাইলে আমাকে তারা ছেঁটে ফেলতে পারতেন বাড়তি এ্যাপেন্ডিক্সের মতো। কিন্তু আমি কৃতজ্ঞ, কেননা, আমি যে ধরনের লেখা লিখি, এই লেখার জায়গাটি একমাত্র প্লাটফর্ম-ছোটকাগজ। আমি উজানস্রোতে কই মাছের কানকো ধরে চলে এসে রয়ে গেছি এখানে। আগেই বলেছি, আমার শুরুটা ছিলো জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী দিয়ে। আমার নিজের ইচ্ছাতেই সেখানে আমি আবার লেখা পাঠিয়েছিলাম। এবং আবার আমি আমার নিজের ইচ্ছাতেই, কোনো রকম সাহিত্য সংঘ-টংঘ না করে, লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছি। লিখছি। ইচ্ছাময়, স্বাধীন লেখকের জন্য, বিশেষত যা খুশি লেখার, যা খুশি নিরীক্ষার জায়াগাটি হলো – লিটল ম্যাগাজিন। আমি জানি, এর কোনো বিকল্প নেই।  

হ্যাঁ, সেলিম মোরশেদ। আমার অগ্রজ সাহিত্যিক, ঘটনাচক্রে, আমরা একই শহরের লোক। সেলিম ভাই   ‘৯৩-‘৯৪ সালে ঢাকা থেকে এসে প্রতিশিল্পের সাথে যুক্ত হন। তখন তাঁর ১টা বই – কাটা সাপের মুণ্ডু বেরিয়েছে। এটা ঠিক, সেলিম মোরশেদ একাধারে প্রতিষ্ঠান বিরোধী (এক্টিভিষ্ট) এবং সাহিত্যিক। 

তবে ম্যুভমেন্ট করতে গিয়ে সেলিম ভাইয়ের লেখার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠান বিরোধী নেতৃত্বের জন্য ওনাকে সাহিত্যিক-রাজনীতিতে জড়িয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু একজন সার্বক্ষণিক এক্টিভিস্টের কাছে লেখাই হয়তো সবটা না। আর আমার নিজের কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা আছে। এমনিতেই, পরিবার- সমাজে অনেক শৃঙ্খলা আমাদের মেনে চলতে হয়। কেউ কেউ হয়তো চোখ বন্ধ করে এসব এভয়েড করতে পারেন, আমি পারি না। এই যে আমি পারি না, এই না পারার অক্ষমতাকে আমি সাহিত্যযাপনের ক্ষেত্রে পুরো উল্টে দিয়েছি। এইখানে আমি, যে ধরনের শৃঙ্খলা-তা তত্ত্বের বা দর্শনের আকারে আসুক, বিতর্ক না করে, গোঁয়ারের মতো নীরবতায় এভয়েড করি। শুধু স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছা লেখার জন্য। অন্তর্গতভাবে আমি কোনো প্রকার গুরু, বা গুরুবাদী মনোভাব ধারণ করি না। গত ২৫/২৬ বছর ধরে এই তরিকায় আমি নিজের মতো করে চলেছি। একটা ঘুণপোকার মতো এবং এই লেখালেখি আমার সিংহাসন। এইখানে আমি স্বাধীন এবং নিরঙ্কুশ। আর ম্যুভমেন্ট-সর্বস্ব যারা, ম্যুভমেন্ট করতে গিয়ে যাদের লেখা বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে, তাদের প্রতি আমার লাল সেলাম। এবং এক্টিভিজমের নিরিখে ভঙ্গিসর্বস্ব কেবল মাথামোটা ২২ পয়েন্ট বোল্ড টেক্সট লিখিয়েদের এন্টেনা আরেকটু শার্প হোক-এটাই প্রার্থণা। 

বিন্দু: গত ২৫/২৬ বছর ধরে আপনি যে সাহিত্যজগৎ গড়ে তুলেছেন তার সবটাই বলা যায় লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। আমরা জানি লিটল ম্যাগাজিনের পাঠক সিলেক্টেড এবং সীমিত। ফলে আপনিও কি ঐ সীমিত পাঠক গোষ্ঠীর ভেতরেই শুধু পঠিত? নাকি এই সীমানার বাইরেও আপনাকে নিয়ে আগ্রহ রয়েছে?

মাসুমুল আলম: আপনি নিজেই একটু আগেই বলেছেন, অল্টারনেটিভ সাহিত্যের পাঠক সবসময়ই কম। বিকল্প চলচ্চিত্রের দর্শক যেমন কম। সকল বিকল্প মানেই, তীব্রতীক্ষ্ণ অথচ লঘিষ্ঠ একটা স্রোতধারা। একটা আন্ডারকারেন্ট। এইসব সাহিত্য, এইসব হাইপার টেক্সটের যারা রিডার, তারাও বোর্হেসের ভাষায়, লেখকের মতোই সক্রিয় এবং লেখকের সমান অংশভাক। ফলে, লিটলম্যাগের লেখক অল্টারনেটিভ লেখক এবং তার পাঠকও আসলে তাই। এবং একজন প্রকৃত লেখক, বিশাল উদ্গার-তোলা আত্মসন্তুষ্ট লেখকের অবস্থানের বাইরে যার বিচরণ, সেই লেখক, সংখ্যালঘু এবং লঘুত্বচেতনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে লিখে চলে, তার নির্দিষ্ট পাঠকের জন্য, যারা অনুসন্ধিৎসুপ্রবণ এবং লিটল ম্যাগের লেখা খুঁজে খুঁজে পড়েন। 

আমার এ যাবৎকালের ৪০/৪৫ টা গল্প, ৪টার মধ্যে প্রকাশিত তিনটি উপন্যাস, সবই ঐ নির্দিষ্ট পাঠকের জন্য। কিন্তু সত্য যে, অনেকের মতো আমিও বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠীর মনোযোগ চাই। কিন্তু বাস্তবতা হলো সে ধারার লেখক তো আমি না, ঐ গল্পখোর আম-পাঠকের মনোরঞ্জনের ব্যাপারীদের জগৎ থেকে আমার জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। আর এটা জানি বলেই হতাশাও কাজ করে না। পাঠকেরও উত্তরণের সুযোগ থাকতে হবে। এবং মিডিয়া যা করতে দেয় না। ফলে, কেবল পাঠকের দোষ দিয়েও তো কোন লাভ নেই। 

নির্দিষ্ট বা সীমিত পাঠকগোষ্ঠীর বাইরে আমার লেখাপত্র পাঠের খবর আমার জানা নেই। তবে, এই সীমানার বাইরে হাতে গোণা পাঠক হয়তো আমার আছে। কিন্তু এসব নিয়ে আমি একদম চিন্তিত না। আমি আমার কাজ করে চলেছি। 

বিন্দু: আপনাকে নিয়ে বাজার চলতি সাহিত্যপাতা কিংবা সাহিত্য পত্রিকার নীরবতার উদ্দেশ্য আমরা বুঝি। কিন্তু যা বুঝি না তা হলো লিটল ম্যাগাজিনগুলোও আপনাকে নিয়ে আশ্চর্যরকম নীরব। এই ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

মাসুমুল আলম: লিটল ম্যাগাজিনে লেখকের তুলনায় এক্টিভিস্টের সংখ্যা বেশি। পলিটিশিয়ানদের মতো ম্যুভমেন্টে আগ্রহীদের সংখ্যা বেশি থাকলে, সামহাউ লিখতে না পারলে এমনটা হয়। আর নীরবে কেউ কেউ লিখে গেলে, এডাম টিজিং বা ইভটিজিং-কে উপেক্ষা করে কেউ লিখে গেলে, লেখালেখির জগতের এক্টিভিস্ট সহচররা তার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমার ক্ষেত্রে বোধ করি এমনটা হয়েছে। দ্যাখেন, আমি ১৯৯৪ সাল থেকে  প্রতিশিল্পে লিখি। তারপর ধারাবাহিকভাবে দ্রষ্টব্য, দুয়েন্দে, শিরদাঁড়া, জঙশন, গাণ্ডীব, সূর্যঘড়ি-তে আমি লিখেছি। আর কোলকাতায় বাঘের বাচ্চা, ত্রিপুরার হারাকারি। গত ২৬ বছরে এই আমার লেখার ক্ষেত্রভূমি। এর মধ্যে প্রতিশিল্পে ‘৯৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত আমার ১২ টা গল্প ছাপা হয়েছে। অগ্রজ লেখক এবং এক্টিভিস্ট সেলিম মোরশেদ ছাড়া, ১০/১৫ জন যাদের সাথে ১৯৯৩ সাল থেকে আমার চলাফেরা, তাদের মধ্যে আমি আর অসিত বিশ্বাস ২ জনই কথাসাহিত্যের। আর সবাই কবি এবং তুমুল এক্টিভিস্ট। পরবর্তীকালে, জঙশন পত্রিকার নাভিল মানদার, বিপুল বিশ্বাশ, অভিজিৎ বসু, তিতাস অধিকারী, এঁরা এলেন। এঁরা যখন প্রতিশিল্পে এসেছেন তখন পাবলো শাহি বিদায় নিয়েছেন। ইতোমধ্যে অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়েছেন লেখালেখিতে, আর সৈকত হাবিব তো প্রতিশিল্পের প্রথম সংখ্যার পরেই নেই এবং সাদি তাইফ এক দশক পরে অভিমানে বিদায় নিয়ে বড়কাগজে গাঁটছাড়া বেঁধেছেন।

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে বোধয়। আমি আসলে বলতে চাইছি, তখনো আমারও বয়স কম, এই আড্ডার সময়কালে, যখন সেলিম মোরশেদ, অসিত বিশ্বাসসহ আমরা মাত্র তিনজন গল্পকার আর বাদবাকি সবাই কবি, তখন পারস্পরিক পঠন-পাঠনের প্র্যাক্টিসটা অন্তত ছিলো। হ্যাঁ, সংখ্যাগুরু কবিরাও পড়তো আমার লেখা। কিন্তু পরবর্তীকালে, তারা নিশ্চুপ হয়ে যান। 

আজ এখন বলছি, আমার ৪৪টি গল্পের ভেতরে, আমি বিশ্বাস করি, তারা ঐ শুরুর ১০/১২ টি গল্পই পড়েছে। আর না। পরবর্তীকালে না উপন্যাস, না আর কিছু। এমন তো না, পড়ে তারা মৌনীবাবা হয়ে আছেন। আমার ব্যাপারে তাদের অটল নীরবতার সুনির্দিষ্ট কারণ আমিও বলতে পারবো না।

একটা ঘটনা বলি, একবার মারিও ভার্গাস য়োসা পেরুভিয়ান টেলিভিশনের জন্য বোর্হেসের ইন্টারভিউ  নিয়েছিলেন । আবার অনেক পরে, যখন য়োসার ইন্টারভিউ নেয়া হয়, য়োসা বললেন যে, আমি বিশ্বাস করি, বোর্হেস আমার কোনো বই পড়েন নি। আসলে ৪০ বছর বয়সের পর বোর্হেস কোনো জীবিত লেখকের বইই আর পড়েন নি। তো, আমার লিটলম্যাগের সহচররা শুরুর দিকে আমার লেখাপত্র পড়ে টাউন হল মাঠে, লাইব্রেরির বারান্দায় একসময় কথা বলেছেন। পত্রিকা যতোই বেরোক লিখিত প্রতিক্রিয়া তাদের তখনো কুলায় নি। এবং এখনো না। পরে, আজিজ মার্কেটের করিডোরেও ঐ একই অবস্থা, দু’তলায় বিজয় ফাস্টফুডের সামনে অব্যাহত নীরবতা। তাদের চলমান নীরবতার মধ্যে দিয়ে আমি আমার কাজ করে গেছি। আমার বিচরণ ক্ষেত্রের পরিসরের মধ্য থেকেই বুঝতে পারছি, একসঙ্গে চললেও, আমি বিশ্বাস করি, এমন কি, কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ, লিটলম্যাগ প্রতিশিল্প এবং ঐ সময় গাণ্ডীবের লেখাসহ ১৩টি গল্প বাদে তিনি গত ১০ বছরের আমার কোনো লেখা পড়েন নি। যেমন, লিটলম্যাগের অন্যরাও পড়েন নি। আর পড়া না থাকলে তো নীরব থাকবেনই। এটাই স্বাভাবিক। হয়তো আমার বিচরণ তাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হলে তাও তো তাদের পক্ষে বলা (লেখা তো দূর অস্ত) স্বাভাবিক ছিলো। কেননা, এঁরা ম্যুভমেন্ট বিশ্বাসী, প্রবল এক্টিভিস্ট বলে আমাকে নন-এক্টিভিস্ট বলে ধুয়ে দিতে পারতেন। তা না-করে নীরবতা বজায় রেখেছেন। এই যা। এখন মনে হয়, এক্টিভিজম যখন লেখালেখির সময় এবং শিল্পযাপনকে পুরোপুরি খেয়ে ফেলে, তখন আর কেউ কেউ যদি সেই যাপনে সতত ক্রিয়াশীল থাকে, থাকতে পারে, তখন অন্তর্গতভাবে ব্যবধান তৈরি হতে পারে। আশ্চর্যরকম নীরবতার কারণ হয়তো আরো অনেক থাকতে পারে। আমার চরিত্রে বিপ্লবী, সংগ্রামী সত্ত্বার অনুপস্থিতি, প্রশান্ত দুর্বিনয় অনেকের চাপা বিরক্তির কারণ হতে পারে। তবে, মোটা দাগের এইসব এক্টিভিস্টবৃন্দ, ২২ পয়েন্ট বোল্ডের টেক্সট লেখকদেরকে নিয়ে আমি চিন্তা করি না। তাদের লেখা আমি পড়ি এবং এখনো পড়তে চাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা তাদের উচ্চণ্ড দ্রোহচেতনার চাপে, সাহিত্য-রাজনীতির এবং হতাশায় প্রায় বন্ধ্যা, রাইটার্স ব্লকের শিকার, আর কেউ কেউ গ্রাফোম্যানিয়াক। তদুপরি, আমার প্রতি তাদের বিশেষ মানসিক অবস্থা থেকে এই নীরবতা চলমান থাকুক। কোনো সমস্যা নেই। 

বিন্দু: সত্যিই কি একজন লেখক লেখালেখি করে প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকতে পারে? নাকি সেটা ভান? লেখালেখি বাদে আপনি নিজেকে কতোটা কল্পনা করতে পারেন?

মাসুমুল আলম: যে লেখককে আপনি স্মরণ করেন, প্রতিনিয়ত, আড্ডায়, রেফারেন্সে সেসব লেখকদের নামোচ্চারণ করেন, তা কেন করেন? তাদের লেখালেখির জন্যই তো। অন্য কোন কারণ তো নেই। তার মানে, বিগত কালের লেখকগণ অতিজীবিত হয়ে আছেন আপনার মননে তাঁদেরই শিল্পগুণে। অর্থাৎ তিনি বেঁচে আছেন, প্রকৃত অর্থেই। ভান কেন হবে?! বুঝলাম না।

প্রকৃত লেখক লেখালেখির ভেতরই থাকেন। কাগজে-কলমে হয়তো লিখতে পারছেন না বিভিন্ন কারণে। যেমন মাহমুদুল হক, উনি সিদ্ধান্ত নিয়ে লেখালেখির জগৎ থেকে সরে গেছিলেন। বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো ব্লকেজ হতে পারে কারো কারো। বা, উৎপলকুমার বসু-র মতো দীর্ঘ বিরতির পরে বিপুল সৃজনশীলতা নিয়ে আবার কেউ ফিরে আসতে পারেন। না-লেখালেখির এই দীর্ঘ বিরতিকাল একটা হাইবারনেশান। তবে যিনি আর ফিরতেই পারেন না, তিনি, লেখালেখির জগতে একটা এঁটুলি হয়ে থাকেন কেবল প্রতিবাদী বাণী-বিবৃতিদাতা এক্টিভিস্ট হিসেবে। If you can’t write the next line, well you’re dead. The past doesn’t matter.-এইসব ভূতপূর্ব ক্রিয়েটিভ বাট এক্টিভিস্টদের উদ্দেশ্যে চার্লস বুকাওস্কির এই কথায় কি গায়ে মরিচ লেগে যায়? তবে, এমন বললেও, অতীতের সৃজনকালীন সময়ের লেখা যদি কালের পরিক্রমায় টিকে যায়, তখন আমরা, পরবর্তীকালের পাঠকরা ঐ অনবদ্য সৃজনশীলতাকে প্রাত:স্মরণীয় করবো।  
লেখালেখি বাদে নিজেকে কল্পনা... এমনটা ভেবে দেখি নি।

বিন্দু: আপনার ব্যক্তিগত জীবন যাপন আর শিল্প যাপনের মাঝে কোনো ব্যবধান আছে কি? যদি থাকে তবে সেই ব্যবধানকে আপনি কীভাবে মোকাবেলা করেন?

মাসুমুল আলম: সারফেস লেভেলে পার্থক্যটা থাকলেও অন্তর্গতভাবে নেই। আমি আর আমার শিল্পযাপন এক। ব্যক্তিজীবনের স্মৃতি দিয়ে আমার লেখার জগৎ তৈরি। তার মানে এইটা তো আবার আত্মজীবনীও না, তাই না? শিল্পে এই ডিফারেন্সটা করতে পারাই হচ্ছে কঠিন এবং আসল মোকাবেলা। শুধু আমি তো না। আমার পরিপার্শ্বের নানা অংশ দিয়েই লেখালিখির জগৎ তৈরি। নিজের যে ভূবন যে অনুভূতিমালা আমি/আপনি অন্য মানুষের অনুভূতির সাথে শেয়ার করতে চাই এবং সেটা অবশ্যই শিল্পের মাধ্যমে। আমি নিজের জীবন শিল্পে রূপান্তরে কোনো ক্লেশ বোধ করি না। প্রকৃতপক্ষে, এটা নিয়েও ভাবি না, আদৌ এটা শিল্প হলো কি না। তবে, যদি হয় নিজেই কিন্তু টের পাওয়া যায়, লেখক নিজেই নিজের বিচারক। এবং তাই লেখাটা পরে অন্যদের জন্য প্রকাশ্য হয়। 

বিন্দু: এখানে যতো ভালো বই-ই লেখা হোক−চারিদিকে আশ্চর্য রকম নীরবতা বিরাজ করে। শুধু দুই একজন নিজেদের মধ্যে ছাড়া টু শব্দ হয়না। পশ্চিম বাংলায় কিন্তু এমন নয়। রেষারেষি থাকলেও ওখানে পারস্পরিক মূল্যায়নটুকু আছে। ঐসব গ্রুপিং লবিং বা রুগ্ন রাজনীতি বা সিন্ডিকেট থাকলেও আসলে এখানে মালের অভাব। ঈর্ষাবোধ তো ভালো জিনিস। তার জন্যে তো মালের দরকার হয়। মাল মানে তো ভাষা। কী বলেন?

মাসুমুল আলম: এ কথাটা আমি, আমার সীমিত আড্ডার পরিসরে বলে আসছি। বাংলাদেশে এই অবস্থা খুবই অস্বাস্থ্যকর। আপনি যাদের সঙ্গে চলেন না, বসেন না, আ্ড্ডা দেন না এবং লেখেন না, তারা স্বাভাবিকভাবে আপনার লেখা পড়বেন না। আপনি একঘরে। আর আমাদের এখানে লেখকই তো পাঠক। তো, তেমন মুষ্টিমেয় কিছু লেখক-কাম-পাঠক আমার লেখা যদি পড়েন, প’ড়ে আপনি কি হাতি–ঘোড়া লিখলেন সে-বিষয়ে কিছু বলবেন না। এমনভাবে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবেন যেন আপনার নামটা পর্যন্ত শোনেন নি। প্রতিক্রিয়া মুখে বা লিখিত ব্যক্ত করা তো দূরের কথা। কিন্তু কেউ কেউ পড়েন, যদি পড়েনও, তারা ও ঐ চুপচাপই থাকেন। হয়তো তারা জানেন আপনার কবিতা বা গল্পের বইটা ভালো, কিন্তু মুখ ফুটে বলবেন না। বলবেন তার পেরিফেরির মধ্যে যারা আছেন তাদের কথা। পেরিফেরির দুর্বলতম লেখককেও দলবেঁধে চলার স্বার্থে তাদের বহন করে নিয়ে যেতে হয়। 

কোলকাতায় এরকম বাস্তবতা কম। সিন্ডিকেট সেখানেও আছে। তবে সেখানে একজন শঙ্খ ঘোষ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এখন আমার কোন অসুখ নেই  উপন্যাসের খবর রাখেন, কীভাবে লেখা হলো জানেন, উল্লেখ করেন। সেই কাহিনি বলেন তাঁর ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ  বইটাতে। একই সাথে, যিনি দেবেশ রায়ের বই গিফট করেন সন্দীপনকেও। এইখানে প্র্র্যাক্টিসটা খেয়াল করেন। অমর মিত্র দূরদর্শনে গিয়ে সুবিমল মিশ্রের নামোচ্চারণ করে আসেন। আর এখানে? আমরা আমরা মামারা মামারা। আরো তো সমস্যা আছে: আমরা নিজেরাই কি এখন নিজেদের পেরিফেরির লেখা পত্র ঠিকঠাক পড়ি? যদি কারোটা পড়িও, পড়ি একপ্রকার বিনিময়চেতনা থেকে। মেইনস্ট্রিমে এই বিনিময়টা আসলে প্রবলভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আরো অনেক কিছু পাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর অল্টারনেটিভ বা অফট্রাকের কথা জাস্ট বললাম। আমার ছোট কাগজের সহচররাই তো আমার লেখা পড়েন নি। পারস্পরিক মূল্যায়নের কথা বলছেন? সেটা তো হবে পঠন-পাঠনের পরে, তাই না? যদি না-ই পড়ি তাহলে বলবোটা কি? অতএব, নীরবতা অবলম্বন।

বিন্দু: এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলেইতো বাংলা সাহিত্য। সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ হওয়ার পর আমাদের সাহিত্যও কি ভাগ হয়ে গেলো? সাহিত্য কি ভাগ হওয়া সম্ভব?

মাসুমুল আলম: সংরক্ষণশীল মনোভাব, জাতীয়তাবাদী বোধ, উগ্র স্বাদেশিকতা, সর্বোপরি, কূপমণ্ডুকের মতো চিন্তা, নিজের/নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে এই বিভাজনটা তৈরি ক’রে এমন কথা বলা হয়ে থাকে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যেমন এপার বাংলার তেমনি ওপার বাংলারও। বোর্হেস অর্হেন্তাইন সাহিত্যিক বা মার্কেস কি কলাম্বিয়ান সাহিত্যিক? না। সামগ্রিকভাবে এঁরা সবাই লাতিন সাহিত্যিক। সে কেউ হোন স্প্যানিশভাষী বা পর্তুগীজভাষী। মোট কথা, আর্হেন্তিনার হুলিও কোর্তাসার কিংবা বিপ্লব পরবর্তী কিউবার নবার্তো ফুয়েন্তস কি কার্লোস ফুয়েন্তেস সবাই লাতিন সাহিত্যিক। 
তেমনি এপার-ওপার সবটা মিলেই বাংলা সাহিত্য। 

বিন্দু: বিশ্ব সাহিত্যের প্রতিতুলনায় বাংলা সাহিত্য পিছিয়ে আছে− এরকম একটি প্রচল ধারণা ছড়িয়ে রয়েছে লেখক ও পাঠক উভয়েরই মধ্যে। আসলেই কি তাই? নাকি এটি সাহিত্যের রাজনীতিতে প্রবল ক্ষমতার আগ্রাসন? কাফকা ও অমিয়ভূষণের গল্প ঘরানা অর্থে পৃথক হতে পারে কিন্তু তাই বলে কে বড়ো আর কে ছোট সাহিত্যিক তা কি বলা যায়?

মাসুমুল আলম: কাফকা, বোর্হেস, টমাস মান, উমবের্তো একো, গার্সিয়া মার্কেজ...এরকম অনেক নামধাম সামনে রেখে আমরা এই কথাগুলি বলছি তো। এটা বলার দিক দিয়ে একটা কর্পোরেট কালচারাল ঢং প্রকাশিত। ভাষা নিয়ে, দেশ নিয়ে, একটা সাংস্কৃতিক আধিপত্যকামী অবস্থা তো থাকে। আর কিছু স্মার্ট, কর্পোরেট, ডায়াস্পোরা সাহিত্যিক এটা বলে থাকেন। এরা বাংলা সাহিত্য ধারাবাহিকভাবে কিছু পড়েন নি। জগদীশ গুপ্তের নাম এরা জেনে থাকতে পারেন কিন্তু পড়েন নি। লেখার সাথে পড়ার কোন সম্পর্ক নেই-এরকম একটা তত্ত্বেও এরা চলেন। ইদানীং এরাই এসব বলেন।
ফ্রানৎস্ কাফকা এবং অমিয়ভূষণ দু’জনেই বড়ো সাহিত্যিক। যেমন ১৮৮৩ এবং ১৮৯৯ সালে পৃথিবীর দুই প্রান্তে দু’টি নক্ষত্র উদিত হয়েছিলো− কাফকা এবং জীবনানন্দ দাশ, এই দু’জন যেমন আলাদা। দু’জনই প্রভাববিস্তারী এবং দু’জনই বড়ো সাহিত্যিক। 

বিন্দু: কাদের লেখা আপনাকে সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহযোগিতা করেছে? আপনি যখন পাঠক, তথাপি তাদের প্রতি কোনো সমালোচনা আপনার ভেতর জেগে ওঠে কি?

মাসুমুল আলম: অন্য ভাষার সাহিত্য বাদ দিয়ে বাংলাভাষার সাহিত্যিক বললেও তো একটা লম্বা তালিকা হয়ে যাবে। তবে, র্যা ন্ডম প্রচুর লেখা পড়তে পড়তে রেক্টিফাই হয়ে পড়ার রুচিও পরিবর্তিত হয়েছে। এটা একটা সিঁড়ির মতো। হয়তো সবার মতো পড়তে পড়তে, উদাহরণ দিচ্ছি, মাহমুদুল হক, তারপর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ–য় চলে গেছি। কিংবা জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ এভাবে সিঁড়িভাঙা অংকের মতো, যা এখনো চলছে। এই লেখকরাই আমি লিখতে গেলে আমার ঘাড়ের ওপর তাঁদের সৌগন্ধে আমোদিত নি:শ্বাস আমি টের পাই। পছন্দের লেখক তো অনেক।

হ্যাঁ, যতোই প্রিয় হোক, পাঠক হিসেবে সমালোচনাও জেগে ওঠে তাঁদের প্রতি। অনেকে প্রজেক্ট লেখা লিখেছিলেন কিন্তু ভালো লিখেছেন। প্রজেক্ট লেখা লিখতে গিয়ে জায়গ্যান্টিক মহত্ত্বের চাপে কারো কারো নিজের জীবনের সারাৎসার লেখার প্রতিফলিত হয়নি, অথচ তা হতে পারতো। প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও, যেমন দেবেশ রায়, বিশ্বকর্মার মতো কারিগরি দক্ষতা ও নিষ্ঠায় তাঁর ৫০০ বা হাজার পৃষ্ঠায় বই পড়া সম্ভব হয় না। আর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বা রশীদ করীমের ক্ষীণতণু বইগুলো সেক্ষেত্রে আমার মতো পাঠকের জন্য ঠিক আছে। দ্যাখেন, এই রশীদ করীম তো আবার আন্ডার রেটেড...  

বিন্দু: সব লেখকই কমবেশি তাঁর লেখালেখির সফলতা আশা করে। এই সফলতাকে আপনি কিভাবে দেখেন? পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা অর্থে নাকি ব্যক্তিলেখকের স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ অর্থে নাকি অন্যকিছু?

মাসুমুল আলম: সফলতা নিয়ে অনেক বড়ো বড়ো কথা বলতে শোনা যায়। কিন্তু কে তার লেখালেখির সফলতা আশা করেন না?

সফলতা পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা অর্থে তো অবশ্যই। কিন্তু কোন পাঠক? এর আগে বলেছি, পাঠক মাত্রই তো নমস্য নয়। প্রথমত, সফলতা আমার কাছে আমার চিন্তাধারার নিরঙ্কুশ প্রকাশ, আমার স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছে আমার লেখা। যদি আমি তা পারি তবে আমি সফল। লেখাটা, বা, বইটা তো লেখা হয়ে গেছে। এখন সেটা পাঠক সমীপে। এখানে আমার কোন কাজ নেই। পাঠকের অধিগম্য না হলে, পাঠকপ্রিয়, না হলে লেখালিখি ব্যর্থ হলো− এসব এভারেজ কথাবার্তা শুনলে বিরক্ত লাগে। জেনে-বুঝেই ঐটুকু মনের জোর নিয়ে আমি লিখি। কেউ চিনলো না, আম-পাঠক পড়লো না, তাতে আমার কি ছেঁড়া গেলো?   

বিন্দু: শুনেছি, আপনি প্রচুর পড়েন। খুঁজে খুঁজে পড়েন। বইয়ের খোঁজে চষে বেড়ান নীলক্ষেত থেকে মিরপুর ফুটপাতের দোকানগুলো। আর বইমেলা কিংবা ঢাকার বিভিন্ন বইয়ের দোকানগুলো তো আছেই। এমনকি যে তরুণ কবির প্রথম বইটি বের হলো− খুব যত্ন সহকারে পাঠ করেন। এতোটা সময় আপনি কীভাবে করে ওঠেন?

মাসুমুল আলম: শোনা কথা আর কি।
হ্যাঁ, আমার এরকম একটা অকাজের অভ্যাস আছে। চেষ্টা করি, তরুণ কবিই শুধু না, তরুণ কবি বা কথা সাহিত্যিকের নতুন বইটি খুঁজে পেতে পড়তে এবং তা নিয়ে আড্ডা দিতে আমার ভালো লাগে। পুরানা পল্টন, নীলক্ষেতে পুরনো বইপত্র খুঁজি। কিছু দুর্লভ বই, যেগুলো আমার সংগ্রহে আছে ফুটপাতেই পেয়েছি। নতুন, পুরাতন, দুর্লভ, ফুটপাতে সব পাওয়া যায়। বুকশেল্ফে আমার পুরনো বই এর কালেকশনই সবচে’সমৃদ্ধ,  অন্য বুকশেল্ফগুলোর নতুন বইয়ের তুলনায়। 
বিন্দু: আপনার সমসাময়িক কথাসাহিত্যিক ও কবিদের মধ্যে কারা আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করে?

মাসুমুল আলম: আমার সমসাময়িক কালকে ‘৯০ দশক থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয় দশক পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চাই। তার আগে একটা কথা, এই তালিকাও আসলে দীর্ঘ। এখন যাদের নাম মনে পড়ছে, র‌্যাপিড ফায়ারের মতো বলা যায় হয়তো, কিন্তু এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ পড়ে যাবে। বরং এটাই বলি যে, একটা-দুইটা কবিতা বা গল্প বা একটা উপন্যাসের জন্যও কেউ কেউ আমার প্রিয় হয়ে ওঠেন।  

বিন্দু: শুনেছি, আপনার একটি বৃহৎ উপন্যাস প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। আরো শুনেছি, এই উপন্যাসটি এতোটাই অভিনব যা ইতোপূর্বে বাংলা সাহিত্যে দেখা যায়নি?

মাসুমুল আলম: এটাও শোনা কথা। বৃহৎ না, কিন্তু আমার লেখার ধরণ অনুযায়ী এটাকে বড়ই বলা যায়। 
সংলাপ প্রধান একটা বই। একটা না-উপন্যাস। ২টি চরিত্রের কথোপকথন। ২টি চরিত্রের কন্ঠস্বরে অনেকের কন্ঠস্বর আরোপিত এই বইতে। রিস্ক আছে। একঘেয়ে হয়ে যেতে পারে। যেহেতু, নাটক তো না। বাংলা সাহিত্যে সংলাপ-প্রধান গল্প লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক, আব্দুল মান্নান সৈয়দসহ দুই-একজন। এবং উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্বর্গের নির্জন উপকূল এবং রাঘব বন্দোপাধ্যায় তাঁর মেধাবী ভূত ও মাধবীলতা বইটিতে। এবং হাল আমলে রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের দুখে কেওড়া বইটিতে। তবে, এসব বইয়ের সাথে আমার বইটির পার্থক্য হচ্ছে, কেবল সংলাপ নির্ভর না হয়ে সংলাপের  মধ্যে নানা ধরনের টেক্সট আত্মসাৎ হয়েছে। 

বিন্দু: প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কী?

মাসুমুল আলম: এটা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক্টিভিস্টদের মতো আমিও নিজেকে ভাবি, এ বিষয়ে বলার কোন রাইট নেই আমার। আমি বলতে চাই, এবিষয়ে বলার চেয়ে যদি আমি একটা বই যদি লিখে উঠতে পারি, তবে ‘না–লেখক–প্রতিষ্ঠান বিরোধী’তকমাটাকে ঐ বইটি দিব্যি অতিক্রম করে যেতে পারে বলে আমার ধারণা।   

বিন্দু: সেলিম মোরশেদ লোক পত্রিকার পুরস্কার নিয়েছেন। এ নিয়ে চারদিকে হৈ চৈ হচ্ছে। এই পুরস্কারপ্রাপ্তিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? আপনাকে যদি কোনো পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দেয়, নেবেন?

মাসুমুল আলম: লেখালেখিতে ’৮০-র দশকের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ আমাদের শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজ সহচর। নীলমন্থন গল্প পড়ার পর ১৯৯৫ সালে উনি আমাকে ‘ইউকিও মিশিমা’বলে ডাকতেন। নতুন ধরণের লেখালেখিতে উনি আমাদের উৎসাহ সঞ্চার করেছেন। তখন ১০/১৫ জনের গ্রুপে গদ্য লেখক ছিলাম আমরা মাত্র ৩ জন। 

যা হোক, লোক পুরস্কার গ্রহণ সেলিম ভাইয়ের ব্যক্তিগত অভিরুচি। আর ওটা যে ধরনের পত্রিকা, পুরস্কারটা নিয়ে উনি, লোক-কেই সম্মানীত করেছেন। আর ব্যক্তিগতভাবে যদি আমার কথা বলেন, তো বলবো এতে হৈ চৈ এর কি আছে। এই পুরস্কার প্রাপ্তিটা হচ্ছে ৪০ বছর পরে মূলধারার বিনোদনমুখী ‘গল্পখোর’পাঠক-কাম-লেখকের দরজায় কড়া নাড়ার মতো। এটা মোক্ষ থাকতে পারে। ধীরে ধীরে লক্ষাধিক পাঠকের টার্গেট থাকতে পারে কারো, যেখানে মিডিওকার লেভেলের লেখক-কাম-পাঠকরা নড়েচড়ে বসেছে বলে আশ্চর্য সুখ হতে পারে। 

এই পুরস্কার মিডিওকার একটা শ্রেণির কিন্তু মূলধারার সেতুবন্ধ ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, এভাবেই দেখি আমি। প্রাপ্যতা জিনিসটা খারাপ না। সাহিত্য-রাজনীতির এটাও একটা স্ট্র্যাটেজি হতে পারে। নচিকেতার এটা সেই গানের মতো: রেল লাইনে বডি দেবো মাথা দেবো না-র মতো। 

পুরস্কার/স্বীকৃতি নেবো না কেন? তবে, রুচির সম্পর্কটা আগে বিবেচনায় নেবো। আর পুরস্কার/সম্মাননা নিই যদি ব্যক্তিগতভাবে অরুচিকর মানুষের কাছ থেকে নয়। তবে, সব, সবকিছুকে  তো অমান্য করার জেদি সাহসটুকু থাকতে হবে। যদিও আমার এমন কোনো দর্শন বা আদর্শ নেই যে, যার জোরে “না, নেবো না” বলতে পারি। কিন্তু নেয়া বা, না নেয়া এটা আমার একান্ত ইচ্ছা-অনিচ্ছারও ব্যাপার, যা ডিপেন্ড করে, আমি ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কারদাতাদের পছন্দ করি কি না। পুরস্কার নিলে তাদের, যা যা আমি পছন্দ করি না, তার সবকিছুই আমাকে জাস্টিফাই করতে হবে কি-না, যে-কোনো কিছুতে ডাকলেই পড়িমরি ভদ্রভাবে দৌড়াতে হবে কি-না,-সেটাও ভাববো। তারপর পুরস্কার নিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান জানানোর উদার সিংহহৃদয় প্রদর্শন করলাম− এসবে আমি একদম বিশ্বাস করি না। হ্যাঁ প্রত্যাখ্যানও বড়োত্বের উদাহরণ। কিন্তু পুরস্কার গ্রহণ করে তার অর্থমূল্য, ক্রেস্ট ইত্যাদি ফিরিয়ে দেয়ার মধ্যে নায়কোচিত ভাব থাকলেও আমি এটিকে আল্টিমেটলি গুরুত্বহীন মনে করি। আসলে শুরুতেই যখন গ্রহণ করা নিয়ে বিতর্ক থাকে তখন গ্রহণ করে ফিরিয়ে দেয়াটা বাহবা কুড়োনোর মতো দেখনসই একটা পদক্ষেপ। এতে কেউ কেউ হয়তো মহত্ত্ব আবিষ্কার করবেন। 

আর জড়ভরত মেইনস্ট্রিম, দলবেঁধে চলা গাণ্ডু অর্ধ-মনস্ক পাঠক–কাম–লেখকদের কাছে এসব মুগ্ধ ঘটনা হতে পারে এবং তা সাহিত্য-রাজনীতির টিপিক্যাল একটা জ্ঞানকাণ্ড হতে পারে। আর যেহেতু আমার কোনো সাহিত্য-রাজনীতি নেই, কিন্তু তীব্র পছন্দ-অপছন্দটা আছে। আমি আমার স্বাধীন, ভালোমন্দ ইচ্ছা যাই হোক, তা বজায় রেখেই আমি আমার সিদ্ধান্ত নেবো। 
আমি পুরস্কার গ্রহণের পক্ষে। 

বিন্দু: বর্তমান বাঙলাদেশের লিটলম্যাগ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।  

মাসুমুল আলম: এ বিষয়ে আমি বলার কেউ না। নতুন ধরনের যে কোনো এক্সপেরিমেন্টাল লেখালেখির প্লাটফর্ম একমাত্র ছোটকাগজ− আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি। আমি কৃতজ্ঞ যে, আমি ছোটোকাগজে লিখেছি। এখনো লিখি।   

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,25,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলমের সাক্ষাৎকার
কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলমের সাক্ষাৎকার
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhMiuiXxUNi1X5-kIbuHkiHb-IubessafrwxoHblc7jG8Iy2bRIqM1VmMkjMI4LtiL6sWcRznG-SUOy7erruDDC5FM0uLU0kpsxSHGdedmjWXlbQCrMaZlfV3V5nz5fzcY3sAP1SjM-YGE/w360-h180/%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BE%25E0%25A7%258E%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B0.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhMiuiXxUNi1X5-kIbuHkiHb-IubessafrwxoHblc7jG8Iy2bRIqM1VmMkjMI4LtiL6sWcRznG-SUOy7erruDDC5FM0uLU0kpsxSHGdedmjWXlbQCrMaZlfV3V5nz5fzcY3sAP1SjM-YGE/s72-w360-c-h180/%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BE%25E0%25A7%258E%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B0.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/01/blog-post_25.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/01/blog-post_25.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy