সময়ের চঙ্ক্রমণটা ধরতে প্রান্তরের একটা ঘোড়ার মতো মমতাময় এই অপেক্ষা রেখে যাচ্ছি আমি।যদি কখনো দিগন্ত ফুঁড়ে উচ্চকিত হ্রেষা শোনা যায়...
বস্তুত, লাগাম ছেঁড়া আরব্যরজনীর ঘোড়ার হ্রেষা আমাদের সমাজ-বাস্তবতার ফাঁক-ফোঁকরে শুধু ঢুকেই পড়েনি, তার উচ্চকিত কলরব কান পাতলেই গমগম আওয়াজে চারপাশে ফেটে পড়ছে; ‘সাগরের নীল জলরাশির মধ্যে জাহাজের মাস্তুলের মতো’ কিশোয়ার-বীণা- সোনিয়া বৃত্তান্তে’র ঘূর্ণাবর্তে আমরা তারই বিপদজনক প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। ‘উচ্চকিত’কেননা কৌশলে তাকে এড়িয়ে চলতে চলতে আবহমান অবদমন-কবলিত আত্মার বিস্ফোরন ঘটেছে। অবদমন- কিসের? স্রেফ যৌনতার? নারীর যৌনতার?
তিন পরিচ্ছদে তিন নারীর যৌন জীবনের বিবৃতিতে কোনো রাখঢাক নেই, বিভ্রম নেই, না- এটা কনফেশনও নয় তাদের; স্বত:স্ফূর্ত আকাঙ্খার উদযাপনে সমাজ-প্রথার সমস্ত দেয়াল টপকেই ওরা স্বকৌতুকে বিপদজনক খেলায় মেতে উঠেছে।
অর্থ-শান্তি-সংসার-সন্তানে ঘাটতি নেই কিশোয়ারের। প্রথাগত যৌনতায়ও আলতাফের মর্দামী নিয়ে কিশোয়ারের কোনো দ্বীধা নেই। তবু কেন কিশোয়ার বিবাহ-বহির্ভূত পাঁচ/ছ‘টি যৌন সম্পর্কে ঢুকে পড়লো? স্রেফ ফ্যান্টাসি? সেক্স ফ্যান্টাসি? কিশোয়ারের বিবৃতিতে শব্দটি বেশ কয়েকবার এসেছে। মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক তাও নয়। বীণা কিংবা সোনিয়ার চেয়ে কিশোয়ারের সামাজিক যাপনের অবস্থানটা অনেক বিস্তৃত এবং ব্যাপক। সংসার-সন্তান-বাবা-মা-শ্বশুর-শ্বাশুড়ি-ভাই সব মিলিয়ে একটা দায়িত্বশীল সম্পর্কে সে জড়িত। তবু, তারপরও?
আরব্যরজনীর ঘোড়া (২০১৬) উপন্যাস প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর প্রকাশক: উলুখড় দাম: ১৫০ টাকা |
লক্ষণীয়, প্রবাহমান যাত্রার এক পর্যায়ে পুরুষচরিত্রগুলোকেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল, অসহায়, ছেড়ে দে মা.. বিভ্রমাক্রান্ত হিসেবে আমরা আবিষ্কার করি। জেলা শহরে সঙ্গীতে স্বনামধন্য মঞ্জুর হোসেন, নৃত্যশিল্পী চিরঞ্জীব দাশের ওপর ঈর্ষাকাতর হয়ে বীণাকে যখন বলে, ‘তুমি একটা বেশ্যা’... কত্থক জানা, ওড়িশি জানা, ভারতনাট্যম কথাকলি জানা নাচের শিল্পী বীণা নিঃসঙ্কোচে বলে ওঠে, ‘আরে বারোচোদা, আমি যদি বেশ্যা হই তুই তা’লি কী?’
তৃতীয় কিস্তির সোনিয়া বাইক রেসার রঞ্জু’র পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে ফ্ল্যাটে গিয়ে ফাটাফাটি গ্রুপ সেক্সে মেতে উঠলেও মনে তার ‘ক্র্যাশ হওয়ার মতো ফিলিংস নাই।’ ‘রঞ্জুর এক্সপ্রেশন কম, কু-উ-ল, অ্যাকশন বেশি। নৌফেল আবার দুইতেই ওস্তাদ। বিভিন্ন ফ্ল্যাটে আমরা যখন যাই, দেখছি রঞ্জু সাইলেন্টলি সেক্স করে চলেছে; সামিয়া আর নৌফেল হঠাৎ পজিশন চেঞ্জ করতে গিয়ে হয়তো আমার মোনিং শুনতে পেয়ে উঠে এসে নৌফেল তখন ললিপপ ঢুকিয়ে দ্যায় এবং তক্ষুণি এক্সপ্রেশনলেস রঞ্জু উঠে গিয়ে সামিয়াকে কলসের মতো নিঃশব্দে উল্টে দ্যায়। সিসা-ব্রিদিং, ইয়াবা ইত্যাদি আমাদের ফাইনাল পিক-এ নিয়ে যায়, একেকটা কিক্ আর আমাদের শাউটিং-এর নিচে সকল প্রতিশ্রুতি, সোশ্যাল ভ্যালুজ-ট্যালুজ সব চাপা পড়ে যায়, যেতে থাকে।’ তো, এক পর্যায়ে উদ্দামতা শেষে স্বাভাবিক জীবনে থিতু হতে সে একটা ‘সিকিউরিটি সার্ভিস এজেন্সি’তে চাকরি নেয়। কিন্তু এখানকার বস এক্স-আর্মি অফিসার একদিন মেয়েদের ছবিয়ালা একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন ধরিয়ে দিলে সোনিয়ার ধারণা হয়, ‘এই বুইড়া মনে হয় রাশিয়ান ভদকার ভালো সমঝদার, স্লো-কিক্ পছন্দ আর একটু পুরাণপন্থী, গোপনে পর্নো সিডি-পত্রিকা নিয়ে ঘোরা পাবলিক।’সোনিয়া বুঝে ফেলে ‘সুস্থ স্বাভাবিকতার আড়ালে ঠিকই বিনষ্টের ছদ্মবেশ থাকে’। সোনিয়া আবার নেচে ওঠে ‘বাল্ পাকা’বসকে নিয়ে। এবং অফিস ছুটি নিয়ে তারা সেন্টমার্টিন ভ্রমণে বেরোয়, ‘সিইও তো আমারে নিয়া সাধুসঙ্গ করতে বের হয় নাই- তাইলে তো সে তীর্থস্থান ভ্রমণে যাইতো; আনন্দ আশ্রম, মাজার-দরগা, বা কোনো আখড়াবাড়িতে যেতো। বাট, আমরা যাচ্ছি সেইন্টমার্টিন, মনটাকে বশে আনতে চেষ্টা করি, ভাবি যে, ক্যারিবিয়ান উপকূল পেরোবো আমরা, নীল জলরাশি, অ্যান্ড দেন উই উইল মেক আ প্লেজার... এই যৌন-অভিযাত্রায় ‘মন’তোমারে স্বাগত জানাই...’
এই আখ্যান তিন নারীর চোখ দিয়ে দেখা পুরুষ-বিশ্ব যেমন, তেমনি আপন অবদমিত ইচ্ছার বিন্যাসও বটে। প্রতি কিস্তির পরিশেষে প্রতিবেদকের উপস্থিতি উপন্যাসের কাঠামোকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মজবুত করেছে। পুরুষ-প্রধান বিশ্বে, পুরুষ-শাসিত বিশ্বে পুরুষের অসহায়ত্ব যেমন ধরা খেয়েছে; সমানে-যাওয়া নারীর সামনে তার কপট রূপটাও গোপন থাকেনি। আমাদের এই রোগা-পটকা আধা-আধুনিক আধা-সামন্ত থেকে উঠতি-পুঁজির বিকাশমান সমাজে নারী আগাইলে পুরুষ বিপাকে পড়ে, ভিমড়ি খায়; দ্বীধাহীন গলায় ‘চোপ রাও’জাতীয় সনাতন মন্তব্যে নিজের ভঙ্গুর অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে।
সোনিয়া সম্পর্কে প্রতিবেদকের মন্তব্য ‘একটা বখে যাওয়া মেয়ে সন্দেহ নাই।’বীণা সম্পর্কে বলছে, ‘অতিশয় বাকপটু,... মঞ্জুর হোসেন কিংবা নৃত্যপ্রতিভা চিরঞ্জীব দাশকে নিয়ে যে কলুষতা সে দেখিয়েছে তা অমার্জনীয় ঘৃণ্য অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।’আর কিশোয়ারের সঙ্গে নিজের সম্পর্ককে তো প্রতিবেদক স্বীকার করেই নিয়েছেন, উপরন্তু তার হাত থেকে রেহাই পেতে যে ব্রহ্মাস্ত্র সে প্রয়োগ করে, ‘তুমি কিসের অ্যাতো লেখাপড়া জানা মেয়ে, হ্যাঁ? শরীর নিয়ে মাতামাতি অথচ ‘শরীর’শব্দটাই ঠিকমতো বলতে পারো না। বারবার কেবল ‘শরীল, শরীল, শ-রী-ল’শুনে কান আমার পচে গেলো।’অথচ প্রতিবেদকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ‘ছামনে’, ‘ছামনাছামনি’উচ্চারণের এই ত্রুটি রয়েছে তারও।
বলতে চাচ্ছি, যদি সচেতন প্রয়াসে হয় এবং সেটাই সঙ্গত, তাহলে মাসুমুল আলম-এর এই আখ্যান কৌশল মারাত্মক, তিনি সনাতন পৌরুষের কপট চেহারা প্রকাশ্যে এনে তাকে চবকাতেও কসুর করেননি। আদি-মধ্য-অন্ত বলেও এই আখ্যানে কিছু নেই; যাপনের কিছু মুহূর্তের বেপরোয়া ন্যারেশন এবং আপনার আত্মাকে যা শান্তি এনে দেবে না। প্রথার শেকলভাঙা মানুষ যখন প্রবাহে গা ভাষায়, সে তখন কূল-কিনারা দেখে না, সামনে শূন্যতায় চোখ রেখে অসীমে ঝাঁপ দেয় কেবল। তাই দেখি, আগামীতে এই তিন অশ্বের মতো আরো দুর্দান্তদের নিয়ে দিগন্ত ফুঁড়ে উচ্চকিত হ্রেষা শোনার অনন্ত সম্ভাবনা জাগিয়েই আখ্যানটি শেষ হয়েছে।
মন্তব্য