মাসুমুল আলমের ‘বিশেষায়নের প্রতিবেদন’ গল্পটিতে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, প্রেম এবং কিছু খণ্ডময় ঘটনাকে সামনে নিয়ে এগোবার প্রয়াস।
গল্পের মূলকাহিনীটির দিকে একবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক− গল্পের মূখ্য চরিত্র লেখক নিজেই। লেখক এবং তার দশজন বন্ধু একসময় অবসর সময়গুলো গল্প করেই কাটিয়ে দিত কিন্তু তারুণ্যদীপ্ত ভরা কন্ঠ থেকে একজন প্রস্তাব দেয় আগুন জ্বালানোর কথা। দশ বন্ধু আগুন জ্বালানোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে দশদিকে ছুটে যায়। এ থেকেই মূলত ঘটনার শুরু। আগুন জ্বালো ব্যাপারটি এখানে মনে হয়, লেখক প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছেন। দশ যুবকের আগুন জ্বালানোর অর্থ ধরে নেয়া যায় কোন নতুন সৃষ্টিশীল কর্মের অগ্রদূত হিসেবে।
লেখক গিয়েছিলেন দক্ষিণের দিকে। সেখানে সুকুমার নামক একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচয় ঘটে। সুকুমারের পরিবারের মধ্যে শুধু এক স্ত্রী। লেখক সেখানে আশ্রয় পান। সুকুমার পারস্পরিক আলোচনায় বড় হলেও লেখক এতে কোন স্বতঃস্ফূর্ততা পাননা। এর অন্যতম কারণ নীলুফার বানু নাম্নি মহিলার সংস্পর্শে। আর এই নীলুফার বানুই হচ্ছে সুকুমারের স্ত্রী। লেখক এবং নীলুফার বানুর ভিতরে ভিতরে প্রেমের অবয়ব জন্মেছিল।
যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে দশজন দশ দিকে আগুন জ্বালাতে গিয়েছিল এখন লেখকের কাছে তা অবভাস মনে হয়। লেখক একসময় বলেন-
আমরা দশজন দশ দিকে ছুটে গেছি, আমাদের সকলের সমবেত কন্ঠস্বর ধ্বংস এবং সৃষ্টির মহাঘোর-মহাপরিবর্তনের একটা আইডিয়াল এক্ষণে আমার কন্ঠে বজ্র আরোপিত হতেই নীলুফার বানু আমাকে বাঁধা দেয়।
বস্তুত লেখক নীলুফার বানু নামক রহস্যের কাছে হেরে যায়। এ দু’জনের পরস্পরের অন্তর্মিলনের পর লেখক সুকুমারকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। পাপী, সংশয়বাদী, দেখতে বামন বলে নিজেই নিজেকে কটাক্ষ করছিল। কিন্তু লেখক আদিম আকর্ষণের লোভ ও জীবনের স্থবিরতার চাপে মানসিকভাবে সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে দিনাতিপাত করছিল। সুকুমারের কথাগুলো তার কাছে ধূরন্ধর মনোভাবাপন্ন মনে হয়। কথার পৃষ্ঠে কোন উত্তর না দিয়ে বিলপাড়ের কর্দমাক্ত মাঠে সুকুমারকে খুন করে। খুন হওয়ার রাত্রে লেখক সুকুমারকে স্বপ্নে দেখে। লেখকের মনে হচ্ছিল এই প্রথম সুকুমারদা-র এত কাছাকাছি এসেছি।
পরদিন ভোরে লেখক নিজের মফস্বল বাড়িতে ফিরে আসে। আগুন জ্বালানোর যে প্রতিজ্ঞার মধ্যে তারুণ্যদীপ্ত প্রভা ছিল তা আবার পরিবারের গণ্ডিবদ্ধতার বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে।
পরিবারের গতানুগতিকতার মাঝে একদিন হঠাৎ পূর্বপরিকল্পনাবিহীনভাবে অনেক বছর পর সেই দশজন বন্ধু একত্রিত হয়। তারা তখন যৌবনের উত্তরণ শেষ করে, বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে। গল্পের শেষ প্রান্তে এসে গল্পকার বলেন-“দক্ষিণের জনপদ থেকে একদিন আমি শূন্য হাতে ফিরেছিলাম ... আর ৯ দিক থেকে প্রত্যাগত বন্ধুদের কথা আমি বলতে পারবো না। আমি আদৌ তাদের কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। অবশ্য পরবর্তীকালে দক্ষিণের জনপদগুলো ঘুরে ঘুরে ৯টি পৃথক পরিভ্রমণের পর ১০টি মহাপ্রতিবেদন আমি লিখতে পেরেছিলাম যেগুলো, ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন কাগজে খুব গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল”।
গল্পে বেশ কিছু প্রতীক অর্থ বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষের জীবনের প্রতিমুহূর্তে যে পরিবর্তন এবং স্থবিরতায় অসংযমী আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে গল্পের শিল্পগত দিক মেঘে ঢাকা তারার মত মনে হয়েছে।
সুকুমার খুন হলো, খুন হওয়ার পর লেখক নীলুফার বানুর দরজায় টোকা দেওয়ার পরও নীলুফার বানু দরজা খুললনা তাহলে কি নীলুফার বানু অধ্যাস?
ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভাবের একমুখিতা; অনাবশ্যক কিছু বেহিসেবি বিস্তৃতিতে ঢাকা পড়েছে। সর্বোপরি বলতে হয় লেখকের কথা যদি একান্ত ব্যক্তিগত জটিল সংমিশ্রণেও হয় তবুও পাঠককে সহজভাবে না বোঝাতে পারলে তাতে লেখকের ধ্যান-ধারণা দর্শন বিকশিত হয় না।
[২০০২ সালের জুলাই মাসে তানভীর তজিব সম্পাদিত ছোটকাগজ দুয়েন্দে-র ২য় সংখ্যায় গল্পটি প্রকাশের পর ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শহিদ ইকবাল সম্পাদিত ছোটকাগজ চিহ্ন-র (রাজশাহী) ষষ্ঠ সংখ্যায় রিভিউটি প্রকাশিত হয়]
মন্তব্য