কয়েকদিন আগে আরব্য রজনী পড়তেছিলাম। ‘নাইনটিন কিডস’দের কাছে আলিফ-লায়লা, সিন্দাবাদ, আলাদিনের গল্পের স্বাদ পুরনো হবে না কোনোদিন। প্রতিরাতে একের পর এক এক গল্প বলে শাহারজাদির বেঁচে থাকার লড়াই গল্পের আড়ালে পড়ে গেলেও এই লড়াইকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাটা জরুরী। স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা পারস্যের সম্রাট বাদশাহ শাহরিয়ারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ারহীন এক বুদ্ধিমতী নারীর লড়াই কোনো অংশে বিপ্লবীর চেয়ে কম নয়। তার গল্পের ভেতরে গল্পের ফাঁদে পা না দিয়ে পারেননি ঘটনাক্রমে নৃশংস হয়ে ওঠা বাদশাহও। কেননা গল্প এমন এক বিষয়, যা ধারণ করে আছে মানব সভ্যতার ইতিহাস, মিথলজি, বিজ্ঞানসহ অসংখ্য অসংখ্য উপাদান। রূপকথা কেবল আনন্দ-বিনোদনের খোরাক নয়; আতশ কাঁচে চোখ রেখে দেখা গেলে বুঝা যায়, লিখিত প্রতিটি বাক্য বা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ কেমন করে সমাজ-সভ্যতার নিগূঢ় রহস্যের দরজা খুলে দিচ্ছে। অর্থাৎ এক ইঙ্গিতবাহী চাবি লুকিয়ে আছে প্রতিটি রূপকথায়− প্রতিটি গল্পে।
বরফের ছুরি (২০২০) ১২টি গল্প। ৪৮ পৃষ্ঠা প্রচ্ছদ: মোশারফ খোকন প্রকাশক: উড়কি |
মাসুমুল আলমের গল্পের বয়ান রূপকথার আদলে এগিয়েছে তা নয়। তিনি বেছে নিয়েছেন সমকালীন ভাষা ও ঘটনাকে ব্যখ্যা করার চোখ। কোনো ঘটনা বর্ণনা দেওয়ার বেলায় তিনি শুরু করেন মাঝখান থেকে এবং তার ইতি নেই। ওপেন এন্ডিং। আবার শুরুটাও কল্পনা করে নিতে হবে পাঠককে। এতসব সত্ত্বেও মাসুমুল আলমের নাতিদীর্ঘ গল্পগুলোর রসদ আসলে উনার দৃষ্টিভঙ্গি। ডিটেইলে না গিয়ে কখনও অ্যাবসার্ড কখনও ডিরেক্ট ভঙ্গিতে তিনি সমস্তকে ইশারা-ইঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেন গল্পে। তার জন্য কখনও তিনি বেছে নিচ্ছেন পেন্সিল, কখনও তুলি। রঙেও রয়েছে হেরফের এবং তার চরিত্রগুলো, যাদের কাছে শারীরিক ও মানসিক ক্রাইসিস এক নৈমিত্যিক বিষয়। উনার ‘তাহারেই পড়ে (না) মনে’ গল্পটা এগিয়েছে তেমনই এক দাম্পত্য ক্রাইসিসকে কেন্দ্র করে। কথোপকথন ভঙ্গিতে লেখা গল্পটির কয়েকটা বাক্যের উদ্ধৃতি দেওয়া যাক—
-আমাদের ২০ বছরের দাম্পত্য।
-বাহ্, তা কি হলো! ভালোবাসেন তো?
-নাহ! ওর এখনো আমার প্রতি সমান আগ্রহ আছে। ভয়ংকর ভালোবাসা। রেগুলার ওটা হয়। যদিও আপাদমস্তক অপছন্দের মানুষ।
মাসুমুল আলমের গল্পের শক্তি এখানে যে, নিরেট সত্যকে কোনো রাখঢাক কিংবা বাহুল্যবর্জিতভাবে বলতে পারেন। তা যত অসহিষ্ণু-অসাহিত্যসুলভ বা রুক্ষ শোনা যাক না কেন। সচরাচর গল্পের যে আঙ্গিক, অর্থাৎ কথাসাহিত্যিকরা যেভাবে গল্প বলতে বসেন, সেই চেয়ার-টেবিলে তিনি বসেন না। লোকাল বাসে বা গ্রামের কোনো চায়ের দোকানে বসেও এসব গল্প বলে ফেলা যায়। কেননা তা আমাদের চারপাশের ঘটনাকে দৃশ্যায়িত করে। সমসাময়িক ঘটনাকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ বা বয়ান করার ক্ষমতা মজ্জাগত উনার। এই বিষয়ে ‘কামধেনু’ গল্পের কয়েকটা বাক্য তুলে দিচ্ছি— ‘আপনি জানেন, আসলে সব টাকা জনগণের। সেই টাকায় কালচারাল বাস্টার্ডগুলো যদি শিল্পসাহিত্যের নামে প্রতিবছর ক্যাওড়াপার্টি করে, ছোঁড়াছুঁড়ি বুড়োবুড়ি (দেশি-বিদেশি সাহিত্যিক) ‘কোলাবেরি-কোলাবেরি ডি’মৌজ-মাস্তি ডান্স করে পিছলা ড্রেসে, গাদাগুচ্ছের টাকা ওড়ায়, এ নামে সে নামের ইভেন্টে, তো, আপনি মনে করেন, ফাও অর্থাগমের এ সুযোগ আপনি কেন হাতছাড়া করতে যাবেন।’
আপাতদৃষ্টিতে এ গল্প যেন কাউকে তীব্র শ্লেষে গালি দেওয়ার মতো। কেননা বাক্যগুলো এসবকেই ইঙ্গিত করে। অবশ্য গল্পকার গল্পের নামের শুরুতে ব্রাকেটে (একটি উদ্দেশ্যমূলক রচনা) তা জানিয়ে দিয়েছেন।
মাসুমুল আলমের গল্পে ঘুরেফিরে এসেছে যুদ্ধ-যৌনতা-অবসাদ-হিপোক্রিসি। কথিত সুশীল শ্রেণীর প্রতি এক ধরণের কটাক্ষ অবলোকন। উনার ‘নজরবন্দী’ গল্পের বিষয়বস্তু এমনই। অবশ্য গল্পটার শুরু একটু ভিন্ন ধাঁচের। সেই ব্যখ্যায় না গিয়ে শুরুর কয়েকটি পাঞ্চ লাইন দিয়ে শেষ করি— ‘শোনা যায়, ইংরেজ আমলে সুধীর বুনো একটা বাঘ মেরেছিল। ভূবন সরকারের বাড়ির উঠানে বাঁশের খোঁটায় মরা বাঘ ঝুলিয়ে নিয়ে আসার সময় পেছন পেছন অন্যান্য বুনোরা পথে পথে এই বলে জকার দিচ্ছিল: আমার ভাই তোমার ভাই চুদির ভাই চুদির ভাই! শুনে ভদ্দরলোকেরা তখন মুখ টিপে হেসেছিল।’
মন্তব্য