কাঁটাবনে মাঝেমাঝে বই এর দোকনগুলোর সামনে একটা বই এর মেলা বসতো এখনও বসে কিনা বলতে পারবোনা। তো বই দেখতে দেখতে একটা বইএ চোখ আটকালো “Men in the Sun” লেখক ঘাসান কানাফানির অনুবাদ করেছেন মাসুমুল আলম। প্রচ্ছদ সুন্দর বইটা দেখতে দেখতে পড়ে ফেললাম, লেখক ঘাসান কানাফানির ছোটজীবনি। এবং মজার ব্যাপার উপন্যাস এর বিষয়বস্তু এবং লেখকের বৈচিত্রময় জীবন আমাকে আকৃষ্ট করলো। বইটা কিনে ফেললাম। তারপর সাথে সাথেই যে পড়ে ফেলেছি তাও নয়।
হঠাৎ একদিন পড়া শুরু করলাম এবং তার আগে থেকেই মানুষ পাচার, মানুষের ভেসে বেড়ানো, আর মৃত্যু, শত শত মানুষের সাগরে ভাসতে থাকা ছবি খবরের কাগজে আর টেলিভিশনে দেখতে দেখতে মন ব্যথিত হয়ে ছিলই। মায়ানমার, সিরিয়া, ইয়ামেন, মালয়েশিয়া, ইরাক, আরও কত দেশ থেকে চাকরীর সন্ধানে অথবা জীবন বাঁচাতে মানুষ পালাচ্ছে অথবা পরিবর্তনের আশায় ছুটে চলছে, “Men in the Sun” সেই মানুষগুলোর মুখপত্র। তিনজন ফিলিস্তিনি, যারা আলাদা বয়স ও প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী। সবাই ভাগ্য বিড়ম্বিত উদ্বাস্তু । বয়সের ভারে ন্যুব্জ আবু কায়েস, সুঠাম যুবক আসাদ আর ষোল বছরের এক তরুন মারওয়ান। এই তিনজনকে কুয়েত পৌঁছাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে আবুল খাইজুরান নামে চতুর্থ একজন, যে আসলে লরির ড্রাইভার। কুয়েত পযর্ন্ত পৌঁছাতে অন্য পাচারকারীর চেয়ে তার সাথেই দর কষাকষি করে একটা আপোষ রফা হয় বাকী তিনজনের ।
‘মেন ইন দ্য সান’ এর মঞ্চপরিবেশনা (১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯) |
একটা নাটক যখন আমরা মঞ্চে আনতে চাই তখন কিন্তু আমাদের মাথায় অনেককিছু কাজ করে। ইচ্ছা হলো আর করে ফেললাম বিষয়টা ওরকম নয়। কারো কারো ক্ষেত্রে হতে পারে কিন্তু প্রাচ্যনাট ওরকম ভাবনায় বিশ্বাসী নয়। ভাল লাগাটা মুখ্য অবশ্যই কিন্তু তারপর কেন করবো, কি বলতে চাই, আদৌ কোন দরকার আছে কিনা এসব কিছু মাথায় কাজ করেই। তাই কথা বললাম মনিরুল ইসলাম রুবেল এর সাথে এর নাট্যরূপ দেওয়া নিয়ে। উপন্যাস পড়ার পর তারও উপন্যাসটা আমার মতই পছন্দ হয়ে যায়। কাজ এগুতে থাকে নাট্যরূপের। ধন্যবাদ মাসুমুল আলমকে তার মাধ্যমেই ঘাসান কানাফানি আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠলো। তার কর্মকাণ্ড, জীবনযুদ্ধ, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাচেতনা আমাদেরকেও অনুপ্রাণিত করতে শুরু করলো। ভাবলাম বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী, যে ভ‚মি পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলো আবু কায়েস, কেবল পরিবারের সাহায্যের জন্য যে তরুণ মারওয়ান অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। এরা তো প্রতিনিধিত্ব করে উপমহাদেশীয় অর্থনৈতিক উদ্বাস্তুদের, যারা ক্রমাগত ভিড় করছে উন্নত বিশ্বে, তা হোক লন্ডন, প্যারিস, যুক্তরাষ্ট্র।
মাসুমুল আলমকে আমরা ডেকেছিলাম আমাদের মহড়া কক্ষে যখন আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম নাটকটা আমরা মঞ্চে নিয়ে যেতে পারবো। ততক্ষণে আমরা তপ্ত সূর্যের নিচে মরিয়া, দীর্ঘ মরুযাত্রায় বেরিয়ে পড়েছি। মাসুমুলও আমাদের সাথী হয়ে পড়েছিলেন। এই দুর্নীতিগ্রস্ত আরব শাসন ব্যবস্থা, যে শাসনতন্ত্র পৃথিবীর প্রান্তিয় বাসিন্দাদের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে একটা বায়ুহীন দমবন্ধ জীবনযাপনে বাধ্য করছে। সেই দমবন্ধ পরিবেশ আমরা মঞ্চে তৈরী করতে চাইছিলাম কিন্তু তারপরেও সবার মতোই আমাদেরও প্রশ্ন জাগছিল মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মৃত্যু পথযাত্রী ঐ তিনজন আবদ্ধ ট্যাঙ্কের ধাতব দেওয়ালে কেন আঘাত করলোনা? যে ভয়াবহতার মুখোমুখি হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন, এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আঘাত করা মানেই আরও অত্যাচার আর রক্তপাত নয় কি?
আমার বিশ্বাস কানাফানি তার কলম দিয়েই মোক্ষম আঘাত করেছেন। কিন্তু সেই অন্তর্নিহিত ইশারা কি কোথাও পৌঁছাবে? পরিশেষে আবারও ধন্যবাদ মাসুমুল আলমকে তাঁর এই অনুবাদ কর্মকাণ্ডের জন্য। অনেক অজানা কম চেনা লেখককে আমাদের মাঝে আলোকিত করার জন্য। তাঁর “Men in the Sun” অবলম্বনে নাটক “পুলসিরাত” তার চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে এই আশাবাদ ব্যক্ত করি।
লেখক: মাসুমুল আলম অনূদিত ঘাসান কানাফানির ‘মেন ইন দ্যা সান’ উপন্যাস অবলম্বনে প্রাচ্যনাট প্রযোজনা পুলসিরাত এর নাট্য নির্দেশক।
মন্তব্য