মাসুমুল আলমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ২০১৬ সালে শাহবাগের ফুটপাতে− বইমেলার সময়। তাঁর গল্পের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে জঙশনে প্রকাশিত ‘ভৈঁরো’ গল্পটি পড়ার মাধ্যমে। গল্পটির ভেতর আছে ঘুম থেকে জেগে উঠে টুকরো টুকরো স্মৃতির ভেতর দিয়ে দৃশ্যের হেঁটে যাওয়া... হেঁটে হেঁটে কোথায় মিলিয়ে গেলো তারা? তাদের কখনো ফ্রেমবন্দি কি করা যাবে? কিছু ভুলে যাওয়া স্মৃতিরাও কি মনে পড়ে আবার বিস্মৃত হয়ে যাবে দ্রুতগামী ট্রেনের জানলায়?− এইসকল প্রশ্নই যেনো ‘ভৈঁরো’ গল্পের দৃশ্য ও স্মৃতির ভেতর দিয়ে উত্তর খুঁজে চলে... আর এইসব স্মৃতির ভেতর দিয়েই আসে− সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দুঃস্বপ্ন।
এই যেমন এক সন্ধ্যায়, তখনো সে নিয়ম করে পড়তে বসে, রেডিও শুনতে-শুনতে অংক করে; সে মনোযোগ দিয়ে শোনে কি শোনে না; এক প্রতিবেশী আসে রেডিও শুনতে; ভলিউম বাড়িয়ে দেয় সে: ভারতের অযোধ্যায় না কোথায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলেছে উগ্রপন্থি হিন্দুরা...।খবর শুনতে আসা লোকটি ভারতের চৌদ্দ গোষ্ঠী তুলে ব্যাপক নিন্দামন্দ করে। চলে যাওয়ার পর মাদুর বিছিয়ে তারা এক সঙ্গে খেতে বসে; তখন, রাত্রে, উচ্চৈস্বরে অনেক মানুষের কোলাহল দূর থেকে ভেসে আসে।(গল্প: ‘ভৈঁরো’)
এবং এইসকল চিৎকারে হিন্দু বিরোধী শ্লোগানে গোটা পাড়ায় আতংক ছড়িয়ে পড়লে গ্রাস তুলতে ভুলে যায় তারা। আর একদিন সবিস্ময়ে সে হঠাৎ আবিষ্কার করে: শ্রেণীকক্ষে নাম ডাকার সময়−
জয়দেব নাথ, বুলুরাণি সরকার, কৃষ্ণচন্দ্র আইচ, দীপক চন্দ্র সাড়া নেই কারও। এই বিস্ময়কর অনুপস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে যেমন ঘটেছিলো ১৯৪৬-এর দাঙ্গায়− তার মা যখন মধুমতি তীরের এক গ্রামের স্কুল ছাত্রী ছিলো। সেও হঠাৎ আবিষ্কার করেছিলো− চম্পকরাণি পোদ্দার, ঊষারানি পাল, শেফালিকা ঘোষদের বিস্ময়কর অনুপস্থিতি!
সকল সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পুনরাবৃত্ত ইতিহাস তাদের স্মৃতিতে অক্ষয়ভাবে লিখে রেখেছেন মাসুমুল আলম। এভাবে দৃশ্য এবং স্মৃতিকে একইসঙ্গে ফ্রেমবন্দি করেছেন তিনি তাঁর ‘ভৈঁরো’ গল্পে।
‘মৌন ধারাপাত’ উপন্যাসটি পড়েছি। এমনকি পুনঃপাঠও করেছি। অদ্ভূত এক রিডিং প্লেজার আছে। শুধু তাই না আছে এক অন্তহীন অভিযাত্রা। মাসুমুল আলমের ভাষা টেকনিকের ভেতর দিয়ে উপন্যাসের দেহটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ‘লাউ গড় গড় লাউ গড় গড়’− এইরকম একটি অভিনব ধ্বনি দিয়ে উপন্যাসের শুরু হয়। আলেকজান বুড়ির অনির্ধারিত হেঁটে যাওয়ার মধ্যে আমাদের জীবনের অনির্ধারিত জার্নির শব্দ শুনতে পাই... যেনো সেই একই শব্দ ‘লাউ গড় গড় লাউ গড় গড়’। আলেকজানের হাঁটা দিয়ে শুরু হওয়া উপন্যাসটি শেষ হয় আলেকজানের হাঁটার মাধ্যমেই। আগে টুকরো টুকরো ভাবে তাঁর লেখা পড়া হলেও ‘মৌন ধারাপাত’ পড়ার মাধ্যমেই মূলত মাসুমের লেখার অল্টারনেটিভ গভীরতা অনুভব করেছি।
পরবর্তীতে তাঁর আরো আরো বই পড়ার সুযোগ ঘটেছে। তাদের মধ্যে ‘আরব্য রজনীর ঘোড়া’ অন্যতম− উপন্যাসটি দীর্ঘদিন আমার ভেতরে শব্দ তুলে তুলে জাগিয়ে রেখেছে। তিন নারীকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসে তিনি যে বিকল্প যৌনতার ঘনিষ্ঠ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তা ভাষাভঙ্গীর ব্যতিক্রম সংযোজন।
মুসুমুল আলম ‘পানির সহজ সংকেত’ গল্পটি আমাকে পাঠিয়েছিলেন ওয়াকিং ডিসট্যান্সের জন্য। এই গল্পটি তাঁর সাহিত্যকর্মে নতুন ধারা রূপে যুক্ত হয়েছে। পরবর্তীতে এরকম আরও ১২ টি অন্যরকম গল্প নিয়ে ২০২০ বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘বরফের ছুরি’। বইটি পড়ার পর আমি কিছু বলার তাগিদ বোধ করতে শুরু করি। এবং এই বইটি নিয়ে আমি একটি আলোচনাও লিখে ফেলি যা প্রকাশিত হয় গ্রন্থগত ওয়েব ম্যাগাজিনে। আর এটাই কোনো বই নিয়ে লেখা আমার প্রথম আলোচনা। মাসুমুল আলমের অন্যরকম গল্পগুলো নিয়ে লিখতে পারাটা আমাকে ব্যাপক আনন্দিত করেছে। সত্যি বলতে মাসুমের লেখা কখন যে আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে− তা আমি নিজেও জানিনা! আর এটাই মুসুমুল আলমের লেখার সম্মোহনী শক্তি। একবার যে পড়ে সেই ডোবে। আর এই ডুবে যাওয়ায় থাকেনা কোনো ক্লান্তি, থাকেনা উঠে আসার ছটফটানি। পাঠক তখন কেবলই আস্বাদন করে যান তাঁর লেখা।
বরফের ছুরি প্রচ্ছদ: মোশারফ খোকন |
মাসুমুল আলম দীর্ঘদিন ধরে শুধুমাত্র লিটল ম্যাগাজিনেই তাঁর লেখালেখি প্রকাশ করে আসছেন। তিনি অক্লান্তভাবে সৃষ্টি করে গেছেন তাঁর অনন্য লেখাগুলো। আর তাঁর লেখার মাধ্যমে লিটল ম্যাগাজিনগুলো হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধশালী। গর্ব করেই এটা বলতে পারি লিটল ম্যাগাজিনের একজন শক্তিশালী কথাসাহিত্যিকের নাম মাসুমুল আলম। যাঁর লেখালেখিই যাঁর আন্দোলন।
মাসুমুল আলম শত শত ব্যস্ততার মাঝেও লিখে চলেছেন... এ এক অপরিসীম ক্ষমতা। তিনি শুধু একজন লেখকই নন, তিনি একজন নিবেদিত পাঠকও। কি করে পারেন আপনি মাসুম? একজন লেখকের ভেতর কতোটা ক্ষুধা থাকলে আপনার মতো হওয়া যায়? এটা খুব জানতে ইচ্ছা হয়...
আর পাঠক হিসেবে আমি কেনো মুসুমুল আলমের ডাইহার্ড ফ্যান হয়ে উঠলাম তা বলা যেতে পারে। তাঁর গল্প পড়ে আমারও গল্প লেখার হাতটা খুলে যেতে চায়... ‘বরফের ছুরি’ নিয়ে আলোচনার সময় আমি লিখেছিলাম-
গল্পের ভেতর দিয়ে মাসুম কেবল কোনো চরিত্র আর শুধু ঘটনারই বর্ণনা করে যান না বরং তিনি তাঁর অন্তর্গত চেতনা উন্মোচন করেন। এবং এই চেতনাগত উপস্থাপনায় পাঠকের মনে স্বয়ং মাসুমুল আলম ঢুকে পড়েন। আর অতি সন্তর্পনে প্রজ্জ্বলন করেন একটি দেশলাইয়ের কাঠি।
মন্তব্য