যশোর, সবুজ ট্রেন, তুমি কি এখনঅন্য কোনো বালকের মর্মে এসে পড়ো?যখের গহনা আগলায় আজ এইউত্তর-বালক, জড়-স্মৃতি করে জড়োঅপারগ আচার্যের আঙুলে উন্মনউপবীত যেন, যার ব্যবহার নেই।শৈশব, সবুজ ট্রেন, ট্রেনের সততশৈলজল অগ্নিশব্দ, তমসাজীবিতা. . .যশোরেশ্বরীর ভূমে শয়ান কবিতাআমাকে জানায় কীর্তিনাশা-দূরদেশেআর্ত পারাপার আজো। ইন্দ্রিয়সঙ্কুলঅতীতে। সবুজ ট্রেন, তরুর অমূলঅন্য বালকের ঘুমে, চুলে ওঠে ভেসে।(ট্রেন, রাত্রি চতুর্দশী, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল)
শিল্প-সাহিত্যে যে যত বেশি স্থানিক সে তত বেশি বৈশ্বিক। আবার এভাবেও বলা যেতে পারে যে যত বেশি বৈশ্বিক সে তত বেশি স্থানিক। যেভাবেই বলি না কেন-- কথাটায় অনাবশ্যক গায়ের জোর আছে হয়ত কিন্তু মিথ্যা নেই একবর্ণও । স্থানিকতাকে অবহেলা ক’রে শিল্প-সাহিত্যকে বৈশ্বিক করে তোলার চেষ্টা আসলে অপচেষ্টা এবং তা অনিবার্য ভাবে ব্যর্থ হয়। সাহিত্যের ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে আছে। তবে আন্তর্জাতিকতা অর্জন কোনো সাহিত্যকর্মের প্রধান লক্ষ হতে পারে না। কিন্তু সকল মহৎ সাহিত্যকর্মই কোনো না কোনোভাবে বিশ্বমননের সংবেদনশীলতাকে স্পর্শ করে। তার জন্য কাহিনিকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ফাঁদার দরকার হয় না। বরং অতিস্থানিক হয়ে ক্ষুদ্রাণু পরিসরে বিশ্ববীক্ষা সৃষ্টি করতে পারা বা না-পারার ক্ষমতা দিয়ে একজন লেখকের প্রতিভার জোরকে আমরা বুঝে নিতে পারি। মহৎ সাহিত্য বিশেষ করে কথাসাহিত্য তাই সবসময় গড়ে উঠেছে লেখকের বেছে নেয়া কোনো সুনির্দিষ্ট ভূগোলকে ঘিরে। অধিকাংশই হয়তো লেখকের জন্মের স্থান বা শহর। আবার সরাসরি তার সাথে সম্পর্কিত নাও হতে পারে। ভূগোলের ’অযোধ্যা’কে দূরে সরিয়ে রেখে লেখক তখন নিজের মনে মনের মতো ক’রে এক ’রামজন্মভূমি’ বানিয়ে নেন। আমাদের মনে পড়বে মার্কেজের মাকোন্দার কথা। যা আসলে তাঁর বেড়ে ওঠার গ্রাম আরাকাটাকা। জন্মভূমি না হয়েও হুয়ান রুলফোর যেমন ছিল কাল্পনিক ভৌতিক শহর কোমালা যে নামে সত্যিকারের একটি শহর আছে মেক্সিক্যান স্টেইট অভ কোমিলার রাজধানী শহরের কাছেই। উইলিয়াম ফকনারের আবার যেমন বোকনাপাটাওয়াফা কাউন্টি যার আদল তিনি গড়েছেন মিসিসিপির লাফায়েত কাউন্টিকে মনে রেখে। ফকনার বলতেন বোকনাপাটাওয়াফা ‘আমার সংশয়পূর্ণ কাউন্টি’ যে অর্থে ওল্ড টেস্টেমেন্টের কোনো কোনো অংশের অস্তিত্বের সত্যতা ইহুদীরা মনে করেন সংশয়পূর্ণ। ইয়োকোনা নদীর নামের সাথে মিল রেখে এই যে নামটি তৈরি করলেন, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় ফকনার সে-নামের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ‘সমতল ভূমির উপর দিয়ে পানি বয়ে যায়’। বাঙালি পাঠকের কি মনে পড়ছে উত্তরবঙ্গের এমনই এক কাল্পনিক এলাকার কথা? জলেশ্বরী। এই নাম নিয়ে সত্যি সত্যি একটি এলাকা হয়ত আছে কুড়িগ্রামে কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক এর জলেশ্বরী আসলে তাঁরই কল্পনার পলি দিয়ে গড়া। ওরহান পামুকের ইস্তান্বুল যেমন গড়া তাঁর শৈশবের স্মৃতির মমতা দিয়ে।
মাসুমুল আলমকে আমি সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক বলে মানি। কেন মানি সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য চোখে পিচুটি নিয়ে এক অজর অধ্যাপকসুলভ দায় আমার নেই। কিন্তু মহৎ লেখকের যে গুণগুলো আমি তাঁর মধ্যে খুঁজে পাই সেগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি। সেই ভাবনা থেকেই দেখতে পাই অন্যান্য মহৎ কথকের মতো মাসুমুলের আছে এক নিজস্ব ভূগোল। বাস্তবিক মাটিতে তৈরি সেই ভূগোলের নিচে আছে মাসুমুলের অবচেতনের জলীয় স্তর আর উপরে রয়েছে তাঁর কল্পনার জটিল টেক্সচার। স্থানিকতার বৈশিষ্ট্যে ভরা সেই ভূগোলকে কেন্দ্র করে মাসুমুল তৈরি করেছেন তার কথনবিশ্ব। সেটি করতে গিয়ে মাসুমুল কখনও পুরাতাত্ত্বিকের মতো খুঁড়ে দেখেছেন ‘মরানদী’র পাঁজর; বুঝতে চেয়েছেন কোথায় সেই গুপ্তধন, জমিনের আদিরস যা মানুষের রক্তে মিশে তারই অজান্তে গড়ে তুলে তার দেহ ও মানসকাঠামো। কখনও বা নৃতাত্ত্বিকের ধ্যানে তিনি স্থানীয় মানুষগুলোর আচরণের রসায়ন বিশ্লেষণ করে দেখতে চেয়েছেন কোথায় সেই মরানদীর জল ও যৌবন যা মানুষগুলোকে অমনভাবে ডোবায়, ভাসায় আর আছড়ে ফেলে জীবন ও যাপনের ঘাটে আঘাটে। তাই মাসুমুলের সেই ভূগোল আমাদের চেনা হলেও তার গলি-উপগলিতে লুকিয়ে থাকে পরিচিতের মুখোশ-পরা অনেক অচেনা আগুন্তুক। আপাত বাস্তবের রূপ ধরে সেখানে আছে কল্পনার অনেক কলোনি, মরানদীর দৃশ্যমান বাঁক ও অদৃশ্য ব্যাকুলতা, বৌবাজার, কেন্দ্রশহর, রাজধানী আর সময় ও স্থানকে মিলিয়ে-মিশিয়ে তৈরি করা মাসুমুলের একান্ত সময়-ভূগোল—চন্দ্রাভিলাষের ফ্যান্টাসিল্যান্ড।
ভৈরব নদীর মানচিত্র |
মাসুমুল আলম এ পর্যন্ত উপন্যাস লিখেছেন চারটি কিন্তু প্রকাশ করেছেন তিনটি। প্রকাশের ক্ষেত্রে সেগুলো লিখিত হওয়ার সময়রেখা অনুসরণ করেনি। মাসুমুলের প্রথম লিখিত উপন্যাস ’মৌন ধারাপাত’ প্রকাশিত হয়েছে তৃতীয় বা এপর্যন্ত সর্বশেষ হিসেবে। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘র্যা ম্প, বারবি-কিউ আর কানাগলির হুলো’ লিখিত দ্বিতীয় উপন্যাস আর দ্বিতীয় হিসেবে প্রকাশিত উপন্যাস ’আরব্যরজনীর ঘোড়া’ লিখিত হয়েছিল তৃতীয় উপন্যাস হিসেবে। মাসুমুলের কাহিনি বর্ণনা যেমন সরল সময়রেখা ধরে চলে না তেমন একই প্রবণতা প্রকাশনার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয়ে মাসুমুলকে আমরা বেশ ধারাবাহিক দেখছি তাহলো তাঁর উপন্যাসগুলোর কেন্দ্রীয় যে ভূগোল তা থেকে যাচ্ছে মোটামুটি এক। যশোর। আরেকটু স্থানিকতা দিয়ে আমরা বলতে পারি যশোরের মরা ভৈরব ঘিরে যে লোকালয় সেই ভূ-খণ্ডটুকু। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের শুরুতেই মাসুমুল সেই ভূ-খণ্ডের ব্যাপারে আমাদের জানিয়ে রাখছেন:
শহরের (যশোর) পূর্ব-পশ্চিমে একদা প্রবাহিত ভৈরব নদ এইখানে মৃত। হয়তো অন্যত্র তা ক্ষীণতোয়া, ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণদায়ী, আর দূরবর্তী কোথাও এই নদ নিজ নামের মাহাত্ম্য হারিয়ে অন্য নাম-পরিচয়ে বয়ে চলেছে এখনো। তবে এইখানে বৃত্তচাপের মতো সামান্য বেঁকে গিয়ে মজা-গাঙ গোটা এলাকাটিকে তার কোলে নিয়ে কাস্তের মতো ঘিরে রেখেছে। এই একটুকরো ভূ-খণ্ডের স্ফীতোদর উত্তরাংশ—যেটা আসলে মরা ভৈরবের তীরে গড়ে ওঠা কলোনি—অনেক আগে থেকেই সেখানে অভিবাসিত বহু ছিন্নমূল মানুষের বাস। আর বাদবাকি এলাকা জুড়ে যারা তাদের অনেকেই নিজেরা নিজেদেরকে আদিবাসিন্দা ব’লে শ্লাঘা বোধ করলেও অন্যরা আদৌ তা মনে করে না। বরং, জনমিতিতে মানুষের জীবনপর্বে অভিপ্রয়াণ বা স্থানান্তরের ধারণাটি তো বেশ পুরনো: মূলত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক কারণগুলো এক্ষেত্রে সামনে চলে আসে।
মাসুমুলের উপন্যাসসমূহের (এবং ছোটগল্পের প্রথম বইটিরও) অন্তসার এই ছোট অনুচ্ছেদে তিনি ভরে দিতে পেরেছেন। মরা ভৈরবের তীরে গড়ে ওঠা কলোনি, অভিবাসিত ছিন্নমূল, স্বঘোষিত আদিবাসিন্দা এবং অভিপ্রয়াণ বা স্থানান্তরের ধারণাটির সাথে জড়িত কারণসমূহ—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রাকৃতিক। তাঁর আখ্যানগুলোতে এই ভূ-খণ্ডটুকুকে সম্প্রাসরিত করেছেন, দিয়েছেন পূর্ণ ভূগোলের মর্যাদা-- মাঝে মাঝে তা রাষ্ট্র বা গোটা জগতের প্রতীক হিসেবেও নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছে। প্রথম উপন্যাসে বিহারী সম্প্রদায় তো বটেই, দ্বিতীয় উপন্যাসে টুকরো চরিত্র এবং তৃতীয় উপন্যাসের প্রান্তিক সব চরিত্রই ছিন্নমূলের মানসিক টানপোড়েন শিকার এবং তাকে ঘিরে চরিত্রগুলোর নিরাপত্তাহীনতা তাদের আচরণকে প্রভাবিত করেছে। আদিবাসিন্দা (আদিবাসী নয় কিন্তু)দের অহঙের তেজ এবং তথাকথিত অভিবাসীদের প্রজন্ম ধরে মানসিক দ্বন্দ্ব আর সর্বোপরি এসবকে ঘিরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রাকৃতিক লড়াই ও পাল্টা-লড়াই চরিত্রগুলোর মিথস্ক্রিয়াই তৈরি করেছে শৈল্পিক বাঁক ও রহস্য। যা সমসাময়িক হলেও আদি এবং অসীম ভবিষ্যতের , স্থানিক হয়েও আন্তর্জাতিক। তাঁর তিনটি উপন্যাসেরই প্রধানচরিত্রগুলো উপরোক্ত ভৌগোলিক বাস্তবতা দ্বারা আমূল প্রভাবিত।
র্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো: বৌবাজার থেকে আধুনিক পুঁজির উপনিবেশে
প্রথম উপন্যাসটির চরিত্রগুলোর আবর্ততিত হয়েছে তাদের ভূমিচেতনার বৃত্তেই। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মোশিউর রহমান বা বেড়ে মোশির দুই দুইবার পুনর্জাগরন ঘটে এই ভূমিচেতনা থেকেই। এমনিতেই মোশি কারো সাতে-পাঁচে থাকত না। না, নিজের পরিবারেও নয়। সংসারের একমাত্র অপদার্থ সন্তানের দায়িত্বহীনতা নিয়ে সে ঘোরাফেরা করত কেন্দ্রশহরে (যশোর) তারই মতো আরো কিছু ভ্যাগাবন্ড চরিত্রের সাথে। গাঁজা খাওয়া, সাহিত্যের ছুটকো আড্ডায় যোগ প্রভৃতি শেষে যখন সে বাড়ি ফিরত গোটা পাড়ায় সে থেকে যেত অনাবশ্যক অতিথির মতো। তার অস্তিত্ব কাউকে বিরক্ত বা আনন্দিত করত না সেভাবে। সেই মোশিরই যেন পুনরুত্থান হলো তাদের বাড়ির বাইরের জমিতে পাড়ার ডিফেন্স পার্টির গেড়ে দেওয়া ‘ বৈকালি যুবস্মৃতি সংঘ’ এর সাইনবোর্ড দেখে। নিজ ভূমিতে এই আগ্রাসন সে মেনে নিতে না পেরে যখন সাইনবোর্ড উপড়ে ফেলে তাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয় তখন তাকে ঘিরে সবার যে বিস্মিত চোখ সেই সব বিস্মিত চোখের সামনে পুনর্জন্ম হয় বেড়ে মোশির। সে হয়ে উঠে সত্যিকারের মোশিউর রহমান। লেখক আমাদের সফলভাবে জানান দিতে থাকেন যে শুধু নিজ ভূমির রক্ষা নয় বরং ছোট এই ভূমিরাজ্যে এবার নতুন রাজার আগমন হতে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যের সূত্র মেনে ভেঙে ফেলা সাইনবোর্ডকে নতুন রূপ দিয়ে রাজ্য বিস্তার শুরু করে মোশি। সাম্রাজ্য শিখরে উঠে; পুঁজি ফুলে-ফেঁপে উঠে মোশিকে দেয় সাম্রাজ্যের অধিকার। আবার পুঁজির নিজস্ব নিয়ম মেনে যখন তা ভেঙে পড়ে প্রবল পরাক্রমশালী মোশি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় ভূতের বাড়িতে; প্রায় অদৃশ্য হয়ে পড়ে সে। এহেন মোশির আবার অস্তিত্ব দেখা দেয় একদিন, যখন সে দেখতে পায় বিদেশী তাবলীগ জামায়াতের এক মেহমান তাদের বাড়ির জমিতে পেশাব করছে। মোশি মেজাজ হারিয়ে তাকে মেরে বসে। এই যে ভূতগ্রস্ত মোশি সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার আগে আবার দপ করে জ্বলে উঠে তার জন্য সে প্রয়োজনীয় দাহশক্তি পায় নিজেরই অবচেতনায় ঘুমিয়ে থাকা ভূমিচেতনা থেকে।
র্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো প্রচ্ছদ: শাহীনুর রহমান |
একই কথা খাটে মোশির বোন চায়নার বেলাতেও। অবিবাহিত ‘শরীরডা’ যার ’একডু বেশিই গরম’ সেই চায়না যতদিন প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক পরিসর পেয়েছে ততদিন জীবন্ত থেকেছে। তাকে দেখা গেছে বাগানের গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। ছাদে উঠে পায়চারি করে পথচলতি পুরুষদের বিপদে ফেলতে। কিন্তু ভৌগোলিক পরিসর যখন হারিয়ে ফেলেছে সে (ওই মোশিরই কাছে) তখন ধীরে ধীরে গল্প থেকে হারিয়ে গেছে তার জীবন্ত উপস্থিতি। একসময় ঘরে ঢুকে পড়েছে, হিজাব পরেছে তারপর এমন সময় এসেছে যে চায়না বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না কেউ।
মোশি এবং চায়নার গল্পে সর্বশেষ বিনাশ হয়েছে ভূতের মতো তাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর। তখন তাদের আর মানুষ বলে মনে হয় নি। ভূমি হারিয়ে তারা ‘আমি’কেও হারিয়ে ফেলেছে ততদিনে।
ভূমি সংলগ্নতাকে মাথায় রাখলে এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে মোট তিন সেটে ভাগ করা যায়।
প্রথম সেটের চরিত্রগুলো কেন্দ্রশহর কেন্দ্রিক। তারা হয়ত সবাই কেন্দ্রশহরে স্থায়ী নয় কিন্তু তাদের জীবন ও জীবিকায় কেন্দ্রশহরের প্রভাব অনেক। কেন্দ্রশহরের প্রতিনিধিত্ব করা চরিত্রগুলোতে দোলাচল বেশি। বিচক্ষণ মোনায়েম রশীদ রাজনীতিক না সমাজ কর্মী, কবি খসরু স্বপন সত্যিই শিল্পের পূজারী নাকি মালা ভাবীর দাসপ্রেমিক, আবার আপাতভাবে মালা ভাবী সাংস্কৃতিক পরিচয় পেতে উন্মুখ মনে হলেও আসলে তার চাওয়া জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি। ভালোবেসে বিয়ে করে মোনায়েমকে কিন্তু প্রেম করে বাড়ি ছাড়ে খসরু স্বপনের সাথে।আবার এলাকার মেয়র যিনি এলাকায় না থেকে থাকেন কেন্দ্রশহরে দেখা যাচ্ছে ‘এলাকা’ নিয়ে তার কোনো হেলদোল নেই। এদের সাথে সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব স ম আলী সবুজও আছেন। পাড়ার ছোটলোকি ব্যাপার-স্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে তিনি নিজস্ব ব্রান্ডের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে কেন্দ্র শহরে চলে যান। ফিরেন অতিথির মতো। নিজ ভূমির সাথের সম্পর্কের মতোই কাহিনিতে চরিত্রগুলোকে আমরা উৎকেন্দ্রিকের মতোই দেখতে পাই। কোথাও কোনো শেকড় নেই যেন। তাই কাহিনির জীবনচক্রে এই চরিত্রগুলো এমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না যা কাহিনিতে কোনো অভিঘাত তৈরি করে। বরং বাকী দুই সেটের চরিত্রগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতেই পার্শ্ব-চরিত্র হিসেবে থেকে যায় তারা। নির্বিকার মধ্যবিত্তের আকাঙ্খাহীনতা ও জেদহীনতায় তারা ঘুর-পাক খায় মূলঘটনার পরিধির বাইরে ছায়া-বৃত্ত ঘিরে। এই অতিথির মতো অভ্যন্তরীণ অভিবাসী (ইনার ইমিগ্রি)র সফল প্রতীকায়ন ঘটে অনাবাসী মেয়রের বাড়িতে ফিবছর বেল এর জন্য একটি হাতির আগমনের মধ্য দিয়ে। সোভান আলীর মনের মতো পাঠকের মনেও সেই হাতি প্রশ্ন রেখে যায়, আস্ত বেল খেয়ে সে যে আস্ত বেলই হাগে, সেই বেলের মধ্যে ফাঁপা হয়ে যায় কী করে? বেল না ভেঙেও বেলের সারবস্তু সাবাড় করে দেয়ার এই ভোজবাজি কি দেশে থেকেও না থাকা ক্ষমতাকাঠামোর দেশটাকে না-ভেঙে আস্ত হজম করে ফেলার ভোজবাজিকে মনে করিয়ে দেয় আমাদের।
এই সেটের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী চরিত্র শিল্পপতি আব্দুল মজিদ। যে এলাকায় বা কেন্দ্রশহরে থাকে না। থাকে ঢাকায়। শহরে সপ্তাহান্তে উড়ে আসে ‘এট্টু ঘুমাতি’। কিন্তু তার এই আপাতত ভূমি-বিচ্ছন্নতায় গল্পে তার প্রভাব কম পড়েনি। বরং মোশির সাম্রাজ্যের উত্থানে-পতনে তার ভূমিকা থেকে গেছে নিয়ন্ত্রকের। অনেকটা নতুন রাষ্ট্রের জন্ম ও মৃত্যুতে যেমন নয়া-উপনিবেশিক প্রভুর নিয়ন্ত্রণ থাকে; দূর থেকে। এই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য প্রভুকে সেই রাষ্ট্রসীমায় থাকা লাগে না বরং সে নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় এজেন্ট দিয়ে। এখানে ‘কলোনিয়াল প্রভু’ মজিদের স্থানীয় এজেন্ট মোশি।
দূর্ভাগ্যজনকভাবে মজিদের অন্তর্ধান ঘটে গল্পে। কিন্তু তার মৃত্যু নিয়ে কেউ নিশ্চিত হতে পারে না। বহুদিন পর পার্বত্য অঞ্চলে একজন মানুষের হাড়-গোড় খুঁজে পাওয়া গেলে অনেকেই মনে করে তার মজিদের দেহের ধ্বংসাবশেষ। এভাবে এক কলোনিয়াল প্রভুর অস্তিত্ব শেষ হয়েও শেষ হয় না।
এই উপন্যাসের দ্বিতীয় সেটের চরিত্ররা বাস করেন মরানদীর পাড়ের প্রান্তিক অঞ্চলে; কলোনিতে আবার কেউ কেউ কলোনি থেকে একটু আলগা হয়ে আদিবাসিন্দাদের গা ঘেঁষে কিন্তু তাতে তাদের পরিচয়ের হেরফের হয় না কোনো । কালাচানের বাপ বিহারী ফোরম্যান হারেস মিয়া যেমন। তার এই আক্ষেপ
. . .আমার বোল আলাদা।আমি আপনাদের কেউ না। আমার দেশ আলাদা, সুদু আমিন ভাই-এর কেলাগাছের কাঁদি হামার জমিনে এসে পড়লে উটা আমার হয় কি—না, সেই কথা বুলতে দিলেন না, হাজেরানে মজলিশ, বিচার হইলো না।
জীবনে এই বিচার না পাওয়ার জন্য কোনো অফিসিয়াল অভিযোগ দায়ের করার মতো ভূমিচেতনা বা সাহস তাদের হয় না। অভিযোগের নামে তাই হাজেরানে মজলিশের কাছে তারা শুধু প্রকাশ্য আক্ষেপ আর অপ্রকাশ্য বেদনা রেখে যায় তারা। এই নড়বড়ে মানসিকতা নিয়েও এই প্রান্তিক ভূগোলের মানুষগুলোর মধ্যে আমরা দেখি প্রচুর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থেকে গেছে। আর তৈরি হয়েছে গভীর আধ্যাত্মিকতাবোধ-- নিয়তিকে অনড় মেনেই। বালক সোভান আলীও তাই জানে ’ব্রেন শট’ তার বাপ নেছার আলী ও দুই ভাইয়ের মতো তারও একদিন ’ব্রেন শট’ হবে আর তার ঝগড়াটে মা রিকশায় চাপিয়ে তাকে নিয়ে যাবে পৌরসভার পুকুরে নামিয়ে মাথা ঠান্ডা করার জন্য। কলোনিয়াল প্রভুর ভুলে যাওয়া ভূগোলের বিচ্ছিন্নতা আছে সেখানে। কখনও কখনও মূল ভূগোলের সাথে সংযোগ তৈরি হয় তাদের কিন্তু তা সেই সম্পর্ক আস্থার গভীরতা পায় না। একসময়ের প্রতিপক্ষ টেনিয়া বা কালাচান যেমন পরিণত হয় হুন্ডি মোশির ক্যাডারে। তবে সবচেয়ে বড় সংযোগ হয়ে থাকে সোভান আলী। কলোনির একমাত্র চরিত্র যে প্রবেশিধাকার পায় মোশির অফিস ঘর থেকে উঠোন অবধি। বাবা আমিনুর রহমানের শিকার সঙ্গী হওয়ার অধিকার সে যেমন অর্জন করে তেমনি কৈশোরের তপ্ততা নিয়ে স্নানরত চায়নার পিঠ ঘষে দিতে পারে কাঁপা কাঁপা হাতে। কিন্তু কাহিনি শেষে নিয়তিকে এড়াতে পারে নি সে। মোশির সাম্রাজ্যের পতনের পর তাকে ফিরে যেতে হয় নিজ কলোনিতে। আসলে নিজের ভাগ্যের কাছে। তাকে দেখা যায় রিকশায়; মা ’ব্রেন শট’ সোভান আলীকে নিয়ে ছুটছে পুকুরে চোবাতে। এই কলোনির ঝুপড়ির ঘরগুলো আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে দেখা যায় এক পাখা বাবাকেও। যার জন্মের স্থানের হদিস দিতে পারে না কেউ। কিন্তু কলোনির মানুষগুলো তাকে দিয়ে রেখেছে ‘দরবেশ বাবা’র সম্মান। নিজেদের অভাব, সংস্কৃতি আর অস্পষ্ট ভূমিচেতনায় নিয়ে মানুষগুলো থেকে যায় ঘেরাটোপে বন্দীর মতো। হুন্ডি মোশির ঋণ সহায়তা তাদের সুন্দর দিনের আশা দেখায় বটে কিন্ত তা বেশিদিন টিকে না। মানুষগুলো আবার ফিরে যায় তাদের চেনা পরিসরে। আর তাতেই যেন স্বস্তি মেলে তাদের। এই চেনা ছন্দের মধ্যে দলছুট হয়ে এসে পড়ে ছন্দাদের পরিবার। নিজেরা বিহারী না হয়েও কেন যে ছন্দার বাবা কলোনির এক কানাগলিতে বাড়ি ভাড়া নেয় তার ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না কেউ।
তবে কাহিনির চরিত্রগুলোর কোনো সেটে না থেকেও ছন্দা এজেন্ট হিসেবে যেন হাজির হয় নায়ক মোশির পতনের পরোক্ষ কারণ হিসেবে। প্রধান চরিত্র মোশির পুরুষালির পতন ঘটে এই প্রান্তিক ভূগোলেরই এক কানাগলিতে যা আসলে ছন্দাদের ভাড়া বাড়ির গলি। বৌবাজারের ব্যাঘ্রসম্রাট ওই কানাগলিতে থাকতে আসা এক দলছুট পরিবারের মেয়ের একতরফা প্রেমে পড়ে হারিয়ে ফেলে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিলাষ। নায়কের পতনের জন্য কেন লেখককে এই আয়োজন করতে হয় সেই প্রশ্ন পাঠকের মনে তৈরি হতে পারে। তবে নায়ক মোশি যখন এই মরানদীর পাড় ধরে কলোনিটা ঘুরতে যায় তখন তার চোখ যেন অনেকটাই তরুণ বুদ্ধের চোখ যে এতদিন পর নিজের রাজমহেলর বাইরে এসে রুঢ় জগৎটাকে দেখছে। আর জীবন সম্পর্কে তার নতুন বোধের উদয় হচ্ছে। উপন্যাসে মোশির চরিত্র বুদ্ধের সেই মাহাত্ম্য পায় না কিন্তু কলোনির গলি-উপগলি ঘুরে যখন ফিরে আসে মোশি-- তার সাগরেদ সোভান আলীর চোখে এ-যেন নতুন মোশি। আর সেদিন থেকেই মোশি চরিত্রের ভেতর দেখা দেয় সেই মহাজাগতিক উদাসীনতা যা তার সাম্রাজ্য পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার ছন্দাকে পাওয়ার হন্টন অভিযান যে পূর্ণতা পাবে না তা যেন ছন্দাদের বাড়িটাকে কানাগলির মাথায় স্থাপন করে লেখক আমাদের বুঝিয়ে দেন।
তৃতীয় এবং প্রধান সেটের চরিত্রগুলো আবর্তিত হয় নায়ক মোশিকে ঘিরে। গল্পের মূল পরিসরেই তাদের রাজত্ব। এই ভূগোল একটি রাজ্যের রূপক হয়ে উঠে আসে। সেখানে মোশি রাজা। সেখানে কাজী মালেক, প্রাক্তন বিডিআর সামাজিক শক্তির এজেন্ট, ডিফেন্স পার্টির ছেলেরা যারা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সমান্তরলে বেড়ে উঠতে চায়, স্থানীয় রাজনীতিবিদ (মেয়রের ভাই ও অন্যান্যরা) যারা সরাসরি ক্ষমতার মালিক নন কিন্তু ক্ষমতার এজেন্ট, একটি ঋণকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রশহর থেকে যায় ডিসটেন্ট রাজধানীর মত। অনেকটা নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেনের মতো সে ভূমিকা রাখে বৌবাজারের ক্ষমতার খেলায়।
সবচেয়ে বড় অভিঘাত কেন্দ্রশহর রাখে নায়ক মোশির আত্মসম্মানে ধাক্কা দিয়ে তাকে নায়কে উত্তরণ ঘটিয়ে। কেন্দ্রশহরের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হলে আরো অনেকের মতো মোশিও যায় আহতদের জন্য রক্ত দান করতে কিন্তু। রক্ত সংগ্রহের জন্য জরুরি ভিত্তিতে খোলা সামরিক মেডিক্যাল ক্যাম্পের লাইনে দাঁড়ালেও সামরিক মেডিকেল ডাক্তার তার রক্ত নিতে অস্বীকার করে ‘সিভিল’ এর লাইনে দাঁড়াতে বলে। মোশি তর্ক তুললে নেশায় আসক্ত সন্দেহ করায় তার রক্ত না নিয়ে বিদায় করে সামরিক ডাক্তার। এই ঘটনার পর মোশি কেন্দ্রশহরের সাথে মানসিক সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং মনোযোগ দেয় নিজের সাম্রাজ্য বানানোতে। ক্ষমতার কেন্দ্র বলয়ের সাথে গ্রামের এই অভিমান-পর্ব আমাদের ভৌগলিক রাজনীতির একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ হয়ে থাকে।
এই মূল ভূগোলের চরিত্রগুলো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অন্য দুই সেটের চেয়ে তারা বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং পরিবার কেন্দ্রিক। নিজেদের আদিবাসিন্দা হওয়ার নিরাপত্তা হয়ত তাদের মানসকাঠামো এমন শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু নায়ক মোশির চরিত্রের যে উত্থান-পতন তার সাথে মূল ভূখণ্ড (বউবাজার) বেড়ে ওঠা মোশির প্রথমত কেন্দ্রশহরের প্রতি তার পিছুটান ও ঘৃণাজনিত আকর্ষণ এবং দ্বিতীয়ত কলোনির কানাগলিতে তার মন হারিয়ে ফেলার একটি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। মূলত বিপরীত দুই ভূখণ্ডের টানাটানিতে মোশি শেষ পর্যন্ত সে চারিত্রিক দৃঢ়তা বা শেকড় খুঁজতে ব্যর্থ হয় যা তাকে বৌবাজারের স্থায়ী শাসক করে তুলতে পারত।ভৌগলিক ও পুঁজির রাজনীতির ছকে নতুন রাজা মোশি বরং পরাস্ত হয় প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকাঠামোর কাছে। মোশির পুঁজি ও দাপট যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতাকাঠামোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হচ্ছে তখন তাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। বরং সবাই আসে তার কাছে নিজ নিজ সুবিধা নিতে। কিন্তু মোশির টাকার ও অস্ত্রের দাপট যখন কিংবদন্তীর পর্যায়ের চলে যায় (গ্যারিসন-ওয়ালা শহরকে সে ঠেকিয়ে দিতে পারবে) তখন তাকে নিয়ে ক্ষমতাকাঠামো নড়ে-চড়ে বসে। ক্ষমতা-কাঠামোর অভিযানে ভেঙে পড়ে প্রান্তিক এক মফস্বলের নিজস্ব পুঁজিব্যবস্থার ক্ষমতার বহর।
পুরো উপন্যাসটিতে কথক এক নাম-না জানা চরিত্রকে (লেখকের অল্টার ইগো?) গল্পগুলো বলে যায়। এই চরিত্র ঘটনার কোথাও হাজির থাকে না। কথকের মুখ দিয়ে চরিত্রটি তার বালকবেলার যশোর থেকে শুরু করে বর্তমানের যশোরের বর্ণনা পায়। একসময় জানা যায় এই নাম-না জানা চরিত্রই ছন্দাকে ভাগিয়ে এনে বিয়ে করে। তার মানে এই পুরো গল্পের জমিনে সে কোথায় ছুপা-রস্তম হিসেবে লুকিয়ে থাকে। আর এখন দূরের সফল এক ব্যাংকার হিসেবে সে আবারও দেখে নিতে চায় সেই বালকবেলার যশোরকে। যেন স্মৃতির ট্রেনে সে যশোর এখন কোমল সবুজ। এই নাম-না জানা চরিত্রটি পুরো ন্যারেশনে চমকে দেয় যখন আমরা তাকে হুণ্ডি মোশিরই এন্টি-থিসিস হিসেবে আবিষ্কার করি। আমাদের মনে পড়ে হুণ্ডি মোশির অর্থব্যবস্থা দেখে প্রথম যৌবনের ছন্দা কেমন মুগ্ধ হয়ে বলেছিল, এযে পুরোপুরি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। কিন্তু গভীরভাবে ছন্দাকে চেয়েও বৌবাজারের ব্যাংকার মোশি ছন্দাকে পায় না। ছন্দাকে পায় রাজধানী শহরের বহুজাতিক করপোরেট ব্যাংকার এই নাম-না জানা চরিত্র। বৃহত্তর ভূগোলের ক্ষমতাকাঠামের কাছে আরো একবার পরাজিত হয় ছোট ভূগোলের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবলয়।
শৈশব, সবুজ ট্রেন, ট্রেনের সততশৈলজল অগ্নিশব্দ, তমসাজীবিতা...যশোরেশ্বরীর ভূমে শয়ান কবিতাআমাকে জানায় কীর্তিনাশা-দূরদেশেআর্ত পারাপার আজো।...
আরব্যরজনীর ঘোড়া: রক্তের অধীনতা থেকে প্রাইভেসির উদোম ক্যানভাসে
তিনটি আখ্যান মিলে তৈরি হয়েছে ’আরব্যরজনীর ঘোড়া’ উপন্যাসটি। তিনজন নারীর স্বগতকথন দিয়ে। তিনজনের ভেতরেই আছে মূল থেকে ছিন্ন হওয়ার বিচ্ছিন্নতাবোধ। গ্রামে বা ছোট শহরে জন্ম নিয়ে সেই দোলাচল রক্তে চাপা রেখে তারা এসেছে রাজধানী শহরে। বড়ো এক জীবনের আশায়।ভৌগোলিক এই পালাবদল তাদের জীবনকে দিয়েছে জীবনাতিরিক্ত অভিজ্ঞতা; কেড়েও নিয়েছে অনেককিছু। কাহিনিতে তাদের চরিত্রে দান করছে ভূগোলকেন্দ্রিক নানা মাত্রিকতা।
আরব্যরজনীর ঘোড়া প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর |
মরা নদী পাড়ের যশোর (আবারও) থেকে উঠে আসা বীণা একজন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছেন ছোট এই শহরেই। কিন্তু যতদিন যশোরে শুধু ততদিনই আমরা দেখি বীণা সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছে নিজের মতো করে। নিজের পেশার একটি সাংস্কৃতিক মাহাত্ম্য খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। কিন্তু ঢাকা আসার পর শুরু হলো জীবিকার পেছনে দৌড়ানো। তার ফলশ্রুতিতে সে নিজেকে দেখতে পেল সিনেমার এক্সট্রা হিসেবে। কখনও ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার। মঞ্চেও পারফর্ম করে। সিনেমায় মেয়ে সাপ্লাই দেয়। আসলে লোকজন তাকে ‘বেশ্যা’ বলেই জানে।
বড় ভূগোলে এসে ছোট ভূগোলের চরিত্রগুলোর এইভাবে আত্মাভিমান বিলোপ হতে থাকে। আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে তারা। বীণার স্বামী যেমন। কাহিনিতে নিজের কোনো পরিচয়ই তৈরি হয়নি তার। এমনকি বীণার স্বামী হিসেবেও সে যেন অসম্পূর্ণ; কোনো দাবী-দাওয়া নেই, না, শরীরেরও না। বরং সেই স্পেস সে ছেড়ে দেয় বীণার মঞ্জুর ভাইয়ের জন্য। রাজধানী শহরের প্রতিনিধি এই মঞ্জুর ভাই বরং নিজের সবটুকু এবং তারচেয়ে বেশি কিছু আদায় করে নেয় ’মফস্বল’ থেকে আসা চরিত্রগুলোর কাছে থেকে। কোনো সংবেদনশীলতা নেই। আছে শুধু নিজেরটুকু বুঝে নেয়ার ব্যাপার।
এই আখ্যানে মাসুমুল স্পেসের ব্যবহারে দারুণ এক কৌশল দেখিয়েছেন। সিনেমার মানুষদের নিয়ে কাহিনি যেহেতু তাই এই কাহিনি বলতে গিয়ে সিনেমারই একটি টেকনিক ’মন্তাজ’ এর ব্যবহার করেছেন দারুণ সফলভাবে। আখ্যানে বীণা ও মঞ্জুরের সম্পর্কের টানা-পোড়েন ও চিন্তার ভিন্নতা দেখানোর জন্য লেখকের প্রয়োজন ছিল বীণা, মঞ্জুর ও সাইদুলের এই ত্রিমাত্রিক কথোপকথনের। যেখানে সাইদুলের সক্রিয় ভূমিকা বীণাকে সহায়তা করতে পারে বীণা চরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু সম্মুখ-সমরে সাইদুল এমন বাকপটু ও বহুমাত্রিক সক্রিয় হয়ে উঠলে কাহিনীতে বর্ণিত ‘অক্রিয়’ ও ’মিতবাক’ সাইদুলের চরিত্র বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলতে পারে। লেখককে তাই এমন এক টেকনিকের আশ্রয় নিতে হয় যেখানে সাইদুল ঘটনায় উপস্থিত না থেকেও থাকতে পারে।সাইদুলের সক্রিয় উপস্থিতির অভাব পূরণ করে বীণাদের পেছনের বসা মোবাইলের বকাবাজি, মাইকে সিনেমার বিজ্ঞাপন, রেডিয়োর অনুষ্ঠানমালা ঘোষণা। কতটা সফল লেখক তা বুঝতে নিচের অংশটুকু আবার পড়া যেতে পারে।
কাউন্টার থেকে বাস ছেড়ে দিয়েছে। বীণার পাশে লোপা (সিনেমার এক্সট্রা; এই আখ্যানেরও যেন) বসে। তাদের পেছনে এক লোক উঠার পর থেকেই মোবাইলে অনবরত কথা বলতে থাকে; সংলাপগুলো বুঝার সুবিধার্থে বর্তমান লেখক প্রয়োজনমতো চরিত্রগুলোর নাম প্রথম বন্ধনীতে দিয়েছেন।
…… ……
আমি তো মানুষ আমার গা-য় তো মানুষের চামড়া . . . পেছনের লোক
সাইদুল, তুমি মঞ্জুর ভাইরে কিছু বলো,(বীণা) সাইদুলে বাড়ি-কাঁপানো হাঁচির শব্দ
আমার গা-য় তো মানুষের চামড়া না কি. . . লোকটা বিনবিন করে কানতেছে
বীণা আমি তোমারে প্লেজার দিই আর তুমি সানন্দে গিয়ে জড়ায় ধরো সাইদুলরে. . . (মঞ্জুর)
এই শোন, আমারে এক শ’ মতো ফ্লেক্সি দিস তো, বাড়ি বলিস গাড়ি লেইট, রাত হবে. . . পেছনের লোকটা
বীণা তুমি একটা বেশ্যা. . . (মঞ্জুর)
হ্যাঁ, ভা-ই, আপনাদের প্রিয় প্রেক্ষাগৃহ, দেশের সর্ববৃহৎ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মনিহার সিনেমা হলে মহাসমোরোহে চলছে ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু ঘোষ অভিনীত গ্রাম বাংলার প্রে মে র. . . (বিজ্ঞাপন)
সাইদুলের তো ধোন নেই. . . (মঞ্জুর)
অ্যাতো বেশি অভিযোগ, পাহাড় প্রমাণ অ্যাতো অভিযোগ নিয়ে তুমি একসাথে থাকতে চাও ক্যানো? . . . পেছনের লোকটা
চিরঞ্জীব দা, আপনি একটা উপলক্ষ মাত্র, আপনি কিছু জানেনই না
হ্যাঁ, ঐ বাড়ি থেকে ফোন দিছিলাম রাতের বেলা সব টেনশন করতেছে, আচ্ছা তুমি আমার সাথে অ্যামোন করো ক্যানো? আমার তো গা-য় মানুষের চামড়া. . . পেছনের লোকটা
তুমি তো এখনো সিনেমাটা দেখলে না, বীণ বাজানোর শব্দে বুঝলে বীণা নাইট শো-তে সাপ ঢুকে পড়েছিল (চিরঞ্জীব)
হ্যাঁ, সাপ, সা-প. . .
শালা মাকুন্দা. . . চিরঞ্জীবের মাঝখানে কিন্তু সমতল (মঞ্জুর)
উ উ উ. . . আমার গা-য় তো মানুষের চামড়া নাকি । . . .উ উ উ . . . পেছনের লোকটা
বে শ্ শা।
ছায়াছন্দ ছা-য়া-ছ-ন্দ. . . সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার. . . (রেডিও)
আরে বারোচোদা আমি যদি বেশ্যা হই তুই তা’লি কী? (বীণা)
চলমান ছবি বুঝাতে একসময় সিনেমার নাম হয়েছিল মুভি। বাংলায় চলচ্চিত্র। এই বাসটাকেও এখন সিনেমা হল মনে হতে পারে। আর স্পেসের এই সুযোগ নিয়ে লেখক ‘পেছনের লোক’টার আড়ালে কয়েকটি সংলাপ দিয়ে চরিত্রটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। সে শুধু সাইদুলের এজেন্ট হিসেবেই এখানে কাজ করছে না বরং তার নিজের জীবনের টানপোড়েনও স্পষ্ট হচ্ছে।
মন্তাজের ব্যবহার অবশ্য তাঁর বাকী দুটো উপন্যাসেও সফলভাবে করেছেন। প্রথম উপন্যাস ‘র্যা ম্প….” এর কাহিনিতে কেন্দ্রশহরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনার ভোরে আহতদের নিয়ে যখন হাসপাতালে যাওয়া হচ্ছে আর ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় মোশি কিছু বুঝতে না পেরেও সেও জনতার স্রোতকে অনুসরণ করতে থাকে। তখন এবং ঘটনার পর থেকেই কেন্দ্রশহর যশোরের যে-বর্ণনা তখন উপন্যাসে আমরা পাই তা সিনেমার মন্তাজের মতই। মনে হয় শহরের চারিধারে ক্যামেরা বসিয়ে দিয়ে সম্পাদনা করে মাসুমুল সব ক্যামেরার পার্সপেক্টিভ থেকে লেখক আমাদের শহরকে দেখাচ্ছেন। আর এই গভীর ’দর্শনে’ কেন্দ্রশহরের যে নিজস্ব একটি মনও আছে আর সেই মনটিও যে ঘটনার এই বীভৎসতায় বিষাদে ভরা তা আমরা দেখতে পাই।
তৃতীয় উপন্যাস, ’মৌনধারাপাত’-য়েও এমন মন্তাজের দৃশ্য আমরা পাই যখন দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচির উদ্বোধনের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সময়ে বিভিন্ন পরিসরে চরিত্রগুলো আটকা পড়ে অপেক্ষা করতে থাকে নিজ নিজ মুক্তির।
আমরা পরে ’মৌন ধারাপাত‘ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এবিষয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করতে পারব। তার আগে ’আরব্যরজনীর ঘোড়া’ উপন্যাসের অপর দুই আখ্যানের পরিসর ও চরিত্রগুলো নিয়ে আমরা কথা বলি। ‘আরব্যরজনীর ঘোড়া’ উপন্যাসের প্রথম আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র কিশোয়ার যশোর থেকে ঢাকা আসে প্রথমে লেখাপড়ার জন্য। আর ঢাকা এসে সে জ্বরাক্রান্ত এক সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো পায় স্বমেহনের স্বাদ যেন নিজেকে ছুঁয়ে দেখতে ও আবিষ্কার করতে এই প্রথম যথাযথ অবকাশে ও পরিসর পেল সে।তবে এই আত্মানুসন্ধানের পথে একধরনের অসুস্থতা বা অস্বস্তি যে জড়িয়ে থাকবে তা জ্বরের ঘোর দিয়ে লেখক আমাদের জানিয়ে রাখেন। কিশোয়ারের প্রেম হয় গ্রামে কিন্তু বিয়ে ক’রে নিজ সংসারের স্বাধীনতার জন্য ঢাকা আসে সে। বিশ্বাস করে শহর মানে নিউক্লিয়াস পরিবার। প্রাইভেসি। সেই স্বাধীনতা সে পায়। নিজের শরীরকে ভালোবেসে তার জন্য সে ব্যবস্থা করতে পারে নানা পুরুষের প্রেম ও শরীর।কিন্তু নিজের রক্তের হীনম্মন্যতা সে লুকাতে পারে না। প্রিয় ‘শরীর’ কে ’শরীল’ বলার অভ্যাস জানিয়ে দেয় ‘শরীর’ এও উত্তীর্ণ হতে পারে নি সে।
তৃতীয় আখ্যানের প্রধান চরিত্র সনি, সোনিয়ার কাছেও বড়ো শহর মানে সেই স্বাধীনতা। সে সাক্ষী দিচ্ছে: ”বুঝতেছিলাম, বাপ-মার সঙ্গে এই ব্যাকওয়ার্ড মানিকনগরের বাড়িতে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না। আশেপাশের লোকজনের কৌতূহল একটু বেশি। একটু রাত করে ফিরলে চা’র দোকানে বসে থাকা আজাইরা লোকজন চায়া চায়া দ্যাখে। সক্কালবেলা যারে দেখছি ফেরার সময় সে তখনো খাম্বার মতো খুঁটি গেড়ে বইসা আছে। আকাম্মা পাবলিক। এরাই সমস্যা করে বেশি, প্রতিবেশীর গুরুদায়িত্ব নিয়ে আমার ইনোসেন্ট বাবা-মারে এরাই সাসপিশাস কইরা তুলবো। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম হলেই থাকবো। হলে বড়ো স্বাধীনতা। স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে. . . ভাবসম্প্রসারণ করো।” এই ভাব সম্প্রসারণ করতে করতেই সোনিয়া তার জীবনকে বুঝে নিতে চায় শরীরের উদ্দামতা দিয়ে। বন্ধনহীন জীবনের ডাকে সে জুটে যায় আরো সব বন্ধনহীনের সাথে। শহরের উদোম প্রাইভেসি যা সম্ভব করেছে তাদের জন্য। কিন্তু দেখা গেল জীবনের জন্য এই শহর বা প্রাইভেসিও ততটা যথেষ্ট নয়। তারুণ্যের চঞ্চলতা থেকে সরে এসে সনি যখন নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে তখন বয়স্ক ‘বস’ এর সাথে তার একধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়। আর তা উন্মুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না খোদ রাজধানীতে। তারা সেইন্ট মার্টিন (আরো প্রাইভেসিতে) যাওয়ার বাসে উঠে। আর বাসে উঠে সোনিয়া বুঝতে পারে সহযাত্রীদের অনুসন্ধিৎসু চোখ তাকে অনুসরণ করছে। ভূগোলকেন্দ্রিক যে স্বাধীনতার ধারণা তা আবার ভেঙে পড়ে সোনিয়ার মনে। আসলে পাঠকের মনেই।
উপন্যাসে তিন প্রধান নারী চরিত্র শরীরকে বিশ্বস্ত পরিসর ভেবে যে স্বাধীনতা চেয়েছিল জীবনের কাছে তা শরীর তাদের দিতে পারে নি শেষ পর্যন্ত। প্রথম কাহিনির কিশোয়ার যেমন অধিকারবোধের প্রবল ব্যাধিতে ভুগে কিন্তু তার ‘সার্জারি আর কাটা ছেঁড়া দাগে ভরা’ শরীর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না সেই অধিকারবোধ। আবার শরীরকে অর্জন করার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিত্বও যেন ব্যর্থ হয় যখন তাকে শুনতে হয়: “তুমি কিসের অ্যাতো লেখাপড়া জানা মেয়ে, হ্যাঁ,? শরীর নিয়ে মাতামাতি অথচ ‘শরীর’ শব্দটাই ঠিকমতো বলতে পারো না। বারবার কেবল, ’শরীল, শরীল, শ-রী-ল’ শুনে কান আমার পচে গেলো।’ দ্বিতীয় আখ্যানের বীণার নৃত্যশৈলীর শরীরকে শুনতে হয় ’বেশ্যা’র অবনমন আর নিজেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে শুরু করে ‘মেয়ে সাপ্লাইয়ের’ কাজ। আর তৃতীয় আখ্যানের সোনিয়া শরীরের যে প্রাইভেসির খোঁজে এসেছিলেন রাজধানী শহরে তা তাকে দিতে ব্যর্থ হয় শেষ পর্যন্ত। একসময় উদ্দাম ফ্রি-সেক্সের কুশলী সোনিয়াকে বয়স্ক না-প্রেমিক পুরুষকে নিয়ে যেতে হয় সেইন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে।
এই তিন আখ্যান আবার নিজেই একটি পরিসর কাজ করে কিছু কিছু চরিত্রের জন্য। প্রথম আখ্যানের বয়স্ক ব্যবসায়ী/ শিল্পপতি যাকে বাসে দেখতে পায় কিশোয়ার। তার এক ছেলের (রেডিও জকি) সাথে পাঠকের দেখা হয় দ্বিতীয় আখ্যানে যে বীণার কাছে এসে সিনেমায় নামার আগ্রহ দেখায়। আর রেডিও জকির ছোট ভাইকে আমরা পাই তৃতীয় আখ্যানে সোনিয়ার বন্ধু ও সেক্সপার্টনার হিসেবে। রেফারেন্স চরিত্রগুলোর সংযোগবিন্দুর কারণের তিনটি আখ্যান কখনও কখনও একটি আখ্যানই হয়ে উঠে। ফ্রসোঁয়াত্রুফোর সিনেমায় যেমন অন্য ছবির চরিত্র ও দৃশ্য ঢুকে পড়তে দেখি মাসুমুল এই উপন্যাসের আলাদা আলাদা আখ্যানে এইসব কমন রেফারেন্সর সিনেমাটিক টেকনিকের ব্যবহার করে আখ্যানটির পরিধিকে নিজের বৃত্তের বাইরে নিয়ে আসেন। তিনটি আখ্যান শেষেই যেমন একজন স্থানীয় প্রতিবেদককে আমরা পাই যা প্রধান চরিত্র তিনটির স্বগতকথনের সময় করা নিজ নিজ দাবীকে নস্যাৎ করে দেয়। পুরো ন্যারেটিভটি যেন ধ্বসে পড়ে তখন। তিনটি আখ্যানকে আবার নতুনভাবে পড়া শুরু করতে হয় পাঠককে। এভাবে আখ্যান তিনটির সীমানাদেয়ালও ভেঙে দেন মাসুমুল। প্রধান চরিত্রগুলো তখন ভাসমান হয়ে যায়। প্রতিটি চরিত্র নিজেদের কাহিনি দিয়ে ইতোমধ্যে পাঠককে যখন সম্পর্কিত করেছিল তখন এই স্থানীয় প্রতিবেদকের বয়ানে পাঠক-মনে সন্দেহ চারিয়ে দেন লেখক এবং পাঠকের মনোভূমিতেও চরিত্রগুলোকে ছিন্নমূল করে দেন। আবার প্রতিবেদকের মুখেই যখন আমরা জানতে পারি যে তিনি নিজে প্রতারণার মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন তখন প্রধান তিন চরিত্রের কথাকে নস্যাৎ করে দেয়া তার প্রতিবেদনগুলো নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়। এরফলে পাঠক বাধ্য হোন, চরিত্রগুলো সম্পর্কে নিজের মতো করে তাদের ভাবনা তৈরি করতে। এভাবে ’আরব্যরজনীর ঘোড়া’ লেখকের কর্তৃত্বের লাগাম থেকে ছাড়া পেয়ে ছুটে বেড়াতে পারে প্রতিটি পাঠকের চিন্তার ভূগোলে। সেখানে কোনো স্থানীয় প্রতিবেদক বা শেহেরজাদে নেই গল্পগুলোকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য। বরং পাঠকের স্বাধীনতা আছে গল্পগুলোকে নিজের মতো সাজিয়ে তোলার। প্রত্যেক সক্রিয় পাঠকের কল্পনার ভূগোলে আলাদা আলাদা কিশোয়ার, সোনিয়া ও বীণা এসে দাঁড়ায় আর দাবী করে বেড়ে উঠার নতুন পরিসর।
মৌন ধারাপাত: প্রান্তিকের লাউ গড় গড় থেকে ফ্যান্টাসির চন্দ্রাভিযানে
ছোট উপন্যাস ‘মৌন ধারপাত’ এর প্রধান স্পেস ঘর নয় পথ। কিন্তু শুরু হচ্ছে পোস্ট অফিসের বারান্দা দিয়ে। কোনো ইংগিত কি লেখক প্রথমেই দিয়ে রাখছেন? পোস্ট অফিস তো অনেক ট্রান্জিশন পয়েন্ট। আপনার কথা আমার কাছে আসার আগে যেখানে শেষবারের মত থামে। তারপর পিয়নের হাত ঘুরে আমার কাছে। পিয়ন আজমল কবির এই গোটা আখ্যানেরই পিয়ন মানে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেন। যদিও প্রধান চরিত্র আলেকজানবুড়ি। তাঁর কাজ পথ ধরে হেঁটে হেঁটে এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করা। যেদিন ঘরে ফিরতে পারে না সেদিন পোস্ট অফিসের বারান্দাতে শুয়ে পড়ে।
মৌন ধারাপাত প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর |
আজমল কবির যেমন সরকারি চাকুরে হয়েও একধরনের ছিন্নমূলতা অনুভব করেন অজগ্রামে এসে। কিন্তু তার এই ভৌগলিক ছিন্নমূলতার সাথে সাথে সমান্তরাল হিসেবে আছে মানসিক এবং বিশ্বাসের ছিন্নমূলতাও। একসময়ের সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী এক রাজনৈতিক কর্মী যেভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের চাকর হয় এবং রাষ্ট্রের তথাকথিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে পড়ে তাতে মানুষ হিসেবে তার দিশাহীনতায় চোখে পড়ে পাঠকের। এই নানারকম ছিন্নমূলতা তাকে প্রেমিক হিসেবে রাখে অপ্রকাশ্য এবং অসম্পূর্ণ। প্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে তার সংকোচ প্রায় কাপুরুষতা পর্যায়ে চলে যায় এবং তার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে স্বপ্ন(দোষের) এর ভেতর প্রেমিকার সাথে মিলিত হওয়ার অপরিণত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।
আবার ‘ঈমান হোমিও ফার্মেসী’র শাকুর সাহেব বাড়ি বানাতে বানাতে অর্ধনির্মিত রাখেন এই ভয়ে যে বাড়ি বানালে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে নিজ দেশে পরবাসীর মতো জীবন কাটে তার। আরেকজন তথাকথিত পরবাসী আজমল কবির ছাড়া আর কারো সাথে তাকে আলাপ করতে দেখি না আমরা।
পুরো উপন্যাসে মাত্র দুটো চরিত্রের সাথে আমাদের দেখা হয় যাদের ভূগোল নিয়ে কোনো নিরাপত্তাহীনতা নেই। এক মেম্বর সাহেব। কিন্তু চরিত্র হিসেবে সেও কেমন উদাসীন। বিষয় ‘মাথায় নেয়া’ ছাড়া যার আর কোনো সক্রিয়তা চোখে পড়ে না। আর একজন মগা মিয়া। গ্রামে যার আনেক সহায়-সম্পত্তি। কিন্তু ভূগোল তাকেও ঠকায়। নতুন এক পরিচয়ের খোঁজে সে যেতে চেয়েছিল পবিত্র নগরী মক্কা-মদীনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বোম্বাইয়ে পৌছে সে হিসেব করে দেখে জাহাজে চেপে বাকী দিনগুলোতে সে আর হজ ধরতে পারবে না। এভাবে সময় ও ভৌগলিকতার হাতে ধরা খেয়ে ফিরে এসে নতুন কোনো পরিচয় পায় না মগা মিয়া বরং শিশু-কিশোরদের কাছে তামাশার বিষয় হয়ে ওঠে সে।
প্রথম উপন্যাস ‘ব়্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলি হুলো’ এর মতই ঘটনাক্রমের এই উপন্যাসেও আমরা ছিন্নমূল বিহারীর দেখা পাই। কিন্তু প্রথম উপন্যাসে বিহারীদের যে যুথবদ্ধ কলোনি ছিল এখানে সেটি নেই। এখানে বিহারীদের নিঃসঙ্গ প্রতিনিধি হিসেবে আমরা পাই এক তথাকথিত ‘আধ-পাগলা’ বুড়োকে। ওকে সবাই লুচ্চো বুড়ো বলেই জানে বা অভিহিত করে। ওর নিজের কোনো কলোনি বা ঘর নেই। রাস্তাতে দেখা পাই তার। রাস্তায় পেয়ে তরুণরা তাকে নাজেহাল করে। খেলার পুতুল ভাবে। তরুণদের অত্যাচারে পালাতে পালাতে শেষ অবধি নিজের পশ্চাদ্দেশ দেখিয়ে সে মুক্তি পায়। কিন্তু এই যে লুচ্চো বুড়ো দৌড়ায় পথে, লেখক আমাদের বলেন, এই দৌড় দিয়েই যেন সে ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৬৭, ১৯৭১ পার হয়ে যেতে চায়। এখানে লেখক ইতিহাস ও ভূগোলকে মিলিয়ে দেন এবং তারা একে অপরের সাথে কিভাবে জড়িয়ে আছে তা মাত্র একটি বাক্যে আমাদের সামনে হাজির করেন। কিন্তু লুচ্চো বুড়ো দৌড় দিয়ে কোথাও পালাতে পারে না। তাকে ফিরে আসতে হয় চেনা পথে। স্থানীয় তরুণদের হাতে ফের নাজেহাল হতে। পথ-চলতি মানুষের মনোরঞ্জনের স্বার্থে তাকে সাজতে হয় নটসম্রাট; ইচ্ছা-অনিচ্ছা সেখানে তেমন কোনো ধর্তব্য নয়। দেশে দেশে তথাকথিত সংখ্যালঘুরা যেমন খেলার পতুল হয়ে থেকে যায়। রাষ্ট্রযন্ত্র আর রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের নাজেহাল করে। খেলার পুতুল ভাবে আর প্রয়োজনে বাধ্য করে শিখিয়ে দেয়া ডায়ালগ মুখে নিয়ে সামাজিক ও জাতীয়রঙ্গমঞ্চে যাত্রার পার্ট বলতে। ভূগোল ও সময়ের এই চক্করে পড়ে ’মৌনধারাপাত’ এর প্রায় প্রতিটি চরিত্র ওই লুচ্চো বুড়োর মতোই হেঁটে বেড়ায় জীবনের পথে। জীবন সম্পর্কে উদাসীন থেকেই। যেন অদৃশ্য এক বৃত্তের ভেতর আটকে পড়ে তারা ঘুরে বেড়ায়; আটকে যে পড়ে সে-সম্পর্কে কোনো ধারণা বা অভিযোগ না রেখেই। মানসিকভাবে ছিন্নমূল শাকুর সাহেবের মেয়ে যুবাতরুণী শিক্ষয়িত্রী ফারজানা রেখা যেমন বাবা কর্তৃকে ওয়াকফে প্রদত্ত হয়ে বা ধর্মের সেবাদাসী হয়েও অভিযোগহীন থেকে জীবনের রঙতামাশা দেখে যায়। মাঝে মাঝে সে নিজেও রঙতামাশায় অবদান রাখে। প্রেমপ্রার্থী আজমল কবীরকে উষ্ণতা মাখা শ্লেষ দিয়ে একতরফা প্রেমিকের স্বপ্নের জমিনে ঢুকে তার উত্থান-পতনের কারণ হয়ে ওঠে।
ভূগোলবৃত্তের এই বন্দীদশা একদিন দৃশ্যমান ও প্রকট হয়ে ওঠে ছিন্নমূল চরিত্রগুলোর জন্য। আরো একটি মন্তাজের মধ্য দিয়ে লেখক আমাদের সামনে তা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেন। বুড়িভৈরবের দুই পাড়ের অধিবাসীদের জন্য দারিদ্র্য-হ্রাসকরণ প্রকল্পের মহতী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যেন সফল ও সার্থকভাবে শেষ হতে পারে তার জন্য কর্তৃপক্ষের আদেশে রাষ্ট্রপ্রহরীরা রাস্তা পরিষ্কার রাখতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু রাষ্ট্র না-বুঝা যে মানুষগুলোর কাছে রাস্তাই ছিল জীবনের প্রধান অবলম্বন তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে আটকে রাখা হয় শাকুর সাহেবের অর্ধনির্মিত পোড়ো বাড়ির বারান্দায়। গৃহবন্দী আলেকজান বুড়ির সাথে সেখানে আরো আছে যাত্রার পার্ট বলা লুচ্চো বুড়ো, কয়েকজন ভবুঘুরে ও নেশাখোর এবং নাম-সচেতন একজন ‘পাগল;। তাদের সাথে ধরে এনে রাখা হয় পথ চলতে-চেয়ে তর্ক করার জন্য ‘কর্তৃপক্ষ’ কর্তৃক সদ্য পাগল ঘোষিত যুবককে। বেদের দল আর হিজড়াদের ফিরে যেতে হয় উপার্জনহীন। আলেকজানের অন্ধছেলে সানালের ‘মজমা’ ক্যান্সেল হয়ে যায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বসা ‘মজমা’র জন্য এক অর্ধনির্মিত বাড়িতে আটকে রাখা হয় ওই গ্রামেরই অতিদরিদ্র মানুষদের। পেশাগত পরিচয়ের বাইরে থাকা আজমল কবির যখন সন্ধ্যার পর খবর দিতে আসে যে, মজমা শেষ,সবাই চলে গেছে- এখন মুক্তি। তখনে সে এসে যা দেখে তাতে তালগোল বেঁধে যায়। ধারণা হিসেবে ‘মুক্তি’ তো আসলে তাদের কাছে একটি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ব্যাপারই। আমাদের কাছেও যেমন। ভৌগলিক স্বাধীনতা পেলেও সেই স্বাধীনতা নিয়ে কোথাও যাওয়ার কোনো গন্তব্য খুঁজে পাওয়া হয় না তাদের। প্রথমে আলেকজান আর তাকে অনুসরণ করতে করতে আজমল কবির হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় এক নদীর দিকে। সেখানে যে এক নৌকা বাঁধা আছে—চাঁদের বুড়ি দেখায় তাদের। শাকুর সাহেব অবশ্য এই দলে নেই এবার। ধার্মিক হয়েও ধর্ম নিয়ে তার ভিন্ন অবস্থানের কারণে তার ‘ঈমান হোমিও ফার্মেসি’সহ তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল। তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে একটি ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রাস্তায়। কিন্তু এদেশে সংখ্যালঘুদের ফেস্টুন কে কবে পড়েছে?
এই যে প্রান্তিক দুই প্রধান চরিত্র আলেকজান বুড়ি আর আজমল কবির শেষ পর্যন্ত চাঁদের বুড়ির দেখিয়ে দেয়া নৌকায় উঠে পড়ে তাতে ভূগোল হিসেবে যে গ্রাম বা দেশ তারা পেয়েছিল তা তাদের কাছে ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রান্তিকতার চূড়ান্তপর্ব অতিক্রম করে গেলে কোনো স্থানিকতা দিয়ে যে তাকে আর আটকে রাখা যায় না বরং শেষ পর্যন্ত তারা আশ্রয় নেয়, নিতে বাধ্য এক ফ্যান্টাসিল্যান্ডে তা লেখক সরাসরি না বলেও আমাদের বুঝিয়ে দেন।
উপকথার স্বদেশ: মাসুমুলের চরিত্ররা যেভাবে বৌবাজার থেকে কানাগলির দেশ ঘুরে যেতে চায় চাঁদের সাম্পানে
মাসুমুল'র উপন্যাসগুলো ছোট ছোট অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও একটু গভীরে গিয়ে দেখলে বুঝা যাবে সেসব অঞ্চলের মধ্যে একটিদেশও গোপনেবিরাজ করছে। ‘র্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো’ উপন্যাসের কেন্দ্রশহর (যশোর) থেকে মোশিউরের পাড়ায় পুরো ব্যবস্থাটাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারব সেখানে আসলে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা জারি আছে। আদিবাসিন্দা, বিহারীসহ আরো সব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য, কেন্দ্রশহরের (রাজধানীর) দৃষ্টিভঙ্গী, সুশীল সমাজের উন্নাসিকতা কী নেই সেখানে! ভ্যাগাবন্ডে মোশিউরের ক্ষুদ্র সমিতি থেকে ব্যাংক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং পতন তো একেবারে আধুনিক বিশ্বপুজিঁব্যবস্থারই আয়না। সুযোগ পেলে যেকোনো ক্ষুদ্র ক্ষমতাকাঠামোও যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর সমান্তরালে বেড়ে উঠতে চায় তা মোশির নিজস্ব ক্যাডার বাহিনি, অর্থব্যবস্থা ও ব্যক্তি মোশি চরিত্রের রুপান্তরের নকশার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এবসার্ড বা হার্ড রিয়েলিটির ব্যবহার করেও মাসুমুল আমাদের মনে করিয়ে দেন তিনি আসলে বাংলাদেশের কথাই বলছেন। মোশি এবং তার বোন চায়নার মাসের পর মাসে অন্ধকারে আপাত বিনা-খাওয়ায় ভূতের বাড়িতে থাকে এবং সেখান থেকে তাদের বের করে আনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ঢাকার এক বাড়ি থেকে দুই বোনকে ওভাবে বের করে আনার ঘটনাকে। ২০০৫ সালে ঢাকার মীরপুর থেকে ডাক্তার আইনুন্নাহার রীতা ও তাঁর ছোট বোন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নুরুন্নাহার মিতাকে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে থেকে তথ্য পেয়ে উদ্ধার করে পুলিশ। নিজেদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের কারণে প্রায় ভূতগ্রস্ত হয়ে ভূতের মতই বছরের পর বছর নিজেদের বাড়িতে আটকে রেখেছিলেন তাঁরা। পুঁজিপতি মজিদের হাড়-গোড় খুঁজে পাওয়াটাও যেমন স্মরণে নিয়ে আসা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জামাল উদ্দীনের হাড়গোড় পাওয়ার ঘটনাকে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা জামাল উদ্দীন অপহৃত হয়েছিল ২০০৩ সালের ১৭ আগস্ট। এক খুনীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ সালের ২৪ আগস্টে তাঁর শরীরের হাড়-গোড় পাওয়া যায় ফটিকছড়িতে। ‘আরব্যরজনীর ঘোড়া’ উপন্যাসে আমরা পাই ঢাকার দেয়ালে গ্রাফিত্তি লেখার রেফারেন্সকে আর ক্ষমতাকাঠামোর বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে দখিনা ভবনের (হাওয়া ভবন?) এর রেফারেন্স। আবার মৌনধারাপাত উপন্যাসে শাকুর সাহেবকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার সাথে মিলে যায় বিভিন্নসময়ে কয়েকজন আধ্যাত্মিক পীরকে বীভৎসভাবে খুন করার চেষ্টা বা খুন করে ফেলার ঘটনাকে।
এই যে ছোট-বড় ঘটনা জাতির জীবনে এসে এক একটা ঢেউ তুলে আবার হারিয়ে যায়। আমরা কিছুদিন পর সেসব ভূলে গিয়ে মন দিই ‘নিজ নিজ পাঠে’ একজন কথাসাহিত্যেকের তেমনটি হলে চলে না। প্রত্যেক দায়িত্বশীল কথাসাহিত্যিক আসলে তাঁর জাতির স্মৃতিধর ও জীবনীকারও। জাতীয় জীবনে যে-সব সংবেদনশীল ঘটনা ঘটে তাঁর নির্যাস একজন সাহিত্যিক সেসব কোনো না কোনোভাবে আবার আমাদের স্মরণে নিয়ে আসেন। যে-কোন বড়ো লেখকের মতো মাসুমুলের কৃতিত্ব এই যে, এইসব ঘটনা মাসুমুল তাঁর উপন্যাসে আরোপ করেন নি। বরং মোশি ও তার বোন চায়না অমন যে ভৌতিক পরিণতি তা প্রথম উপন্যাসের কাহিনির স্বাভাবিক পরিণতি বলে পাঠকের মনে হবে ঠিক যেমন খুনী ও ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে কাজ করা পুঁজিপতি মজিদের পরিণতিও স্বাভাবিক এক বিকল্প বলে মনে হয় আমাদের। যেন ঘটনাচক্রেই তা কেবল বাস্তবের দুই বোন রীতা ও মিতা ও ব্যবসায়ী জামাল উদ্দীনের ঘটনার সাথে মিলে যায়। আর লেখক আমাদের ভুলিয়ে রাখতে চান ‘নিতান্ত কাকতালীয়’ এর ছদ্মবেশে।
একই কথা খাটে মাসুমুলের উপন্যাসে বিহারীদের প্রসঙ্গে। উপন্যাসের স্বার্থে মাসুমুল তাদের ভাড়া করে কাহিনিতে নিয়ে আসেন না। বরং মরানদীর পাড়ে তাদের বসবাস স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই আসে। কিন্তু দেখা যায় কাহিনির বয়ানে যেমন তেমনই কাহিনির চরিত্রগুলোর ক্ষমতাকাঠামের তুলনা-প্রতিতুলনায় তাদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সেসব করতে গিয়ে মাসুমুল কখনই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষমতাকাঠামোয় সংখ্যালঘুদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা লোভে বা ফাঁদে পড়েন না। অথচ স্থানিক ভূ-রাজনৈতিক তাদের অংশগ্রহণে এমন কুশলতার সাথে দেখান যে যে-কোনো সচেতন পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথাটা ভেসে উঠবে। মাসুমুলের উপন্যাসের বিহারীরা তখন বাংলাদেশ তথা সারাবিশ্বের সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে।
আর এভাবেই মাসুমুলের মূল ভূগোল যে মরানদীর পাড়ে অবস্থিত সেই ছোট বৌবাজারকে মাসুমুল সফলভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন অনায়াসেই। একদা নদী-মাতৃক বাংলাদেশ কিভাবে নিজের মা-নদীগুলোকে খুন করতে করতে মাতৃ-হন্তারকের মতো একটি অভিশপ্ত সময়-ভূগোলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে মাসুমুলে উপন্যাসগুলো আমাদের সামনে জ্বলজ্বলে বৃত্তান্ত উপস্থাপন করে। কোনো রাজনীতির ক্যাডার হিসেবে মাসুমুল এই সময়ভূগোলকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করার জন্য শ্লোগান তুলেন না কিন্তু পাঠক হিসেবে আমরা যদি সেই অন্তর্লীণ ডাক শুনতে না পাই তাহলে বুঝতে হবে আমাদের পায়ের নিচের মাটির যোগ্য আমরা নই। এবং মাতৃ-হন্তারকের অংশীদার হয়ে আমার একটি ভূগোল-শূণ্যতার ফাঁদে আটকে পড়ে কেবল দিনগত পাপক্ষয় করে কাটিয়ে যাচ্ছি আমাদের দৈনিন্দনতা। লুচ্চো বুড়োর মতো হয়তো রাস্তায় দৌড়ে যাচ্ছি কেবল কিন্তু কোনোকিছুকে পশ্চাদ্দেশ দেখানোর প্রয়োজনীয় অশ্লীল ক্ষমতাটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই সন্দেহ, আলেকজান বুড়ির চাঁদের নৌকাতেও হয়ত আমাদের ঠাঁই হবে না। হয়ত আলেকজানের ভিক্ষালব্ধ সোনার ধানেই সেই সোনার তরী ভ’রে গেছে। কোনো ফ্যান্টাসির অধিকারও আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
তিনটি প্রকাশিত ও একটি অপ্রকাশিত উপন্যাস নিয়ে মাসুমুল তাঁর ঔপন্যাসিক জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত হয়েছেন। একজন লেখক হিসেবে মাসুমুল শুধু এখন সামনে এগোতে পারেন। মাসুমুলের এই অগ্রযাত্রায় মাসুমুলের আগামীর ভূগোল কেমন হয়,ইতোমধ্যে গড়ে তোলা নিজস্ব ভূগোলের পরীসীমা পার হয়ে তিনি আর নতুন কোনো ভূগোলের মায়াবী ডাকে সাড়া দেন নাকি পরিচিত ভূগোলকেই আরো খনন করে উনি তুলে আনতে চান অপরিচিত আরো সব জীবনসার, জেগে উঠতে উন্মুখ কোনো রহস্যফসিল-- আশা ও আশঙ্কা নিয়ে আমরা সেদিকে দৃষ্টি রাখব।মরানদী মাসুমুলের বর্ণস্রোতে যে জীবন পেয়েছে তা সে কৃতজ্ঞচিত্তে মাসুমুলকে ফেরত দিয়েছে মাসুমুলের কথার জগৎকে উর্বর করে তুলতে। মাসুমুলের হাতে মরানদী বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব পাবে এই ভরসা আমার আছে। হয়ত মরানদী তার পেটে মাসুমুলের জন্য এখন কোনো রূপকথা লুকিয়ে রেখেছে, হয়ত সেই রূপকথার তলপেটেই মাসুমুল খুঁজে পাবেন কোনো নতুন ভূগোলের মানচিত্র যেদিকে ধাবিত হবে তাঁর ভবিষ্যতের চরিত্রগুলো। আমাদের চাওয়া মরানদীর দুই পাড়ের চরিত্রগুলো মাসুমুল যে অভাবনীয় শৈল্পিক অভিনিবেশে তৈরি করেছেন আবার তাঁর চরিত্রগুলো সৃষ্ট সময় ও ভূগোলকে যে চারিত্র্য দান করেছে ভবিষ্যতেও মাসুমুল সেই শৈল্পিক অভিনিবেশ ধরে রাখবেন তো বটেই; তাকে অতিক্রমও করে যাবেন।
মরানদীর মহৎ রূপকার মাসুমুল আলমের কথক জীবন দীর্ঘতর হোক।
মন্তব্য