প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব ভঙ্গি থাকে। একটি লেখা পড়ে বুঝে যাওয়া যায় কার? একে শুধু গদ্যের ভঙ্গি বলে সীমাবদ্ধ করে ফেলা যায় না, দেখার প্রবণতা ভঙ্গি হয়ে ওঠে। মাসুমুল আলমের লেখায় না-কাহিনীমূলক একটি দিক আছে। তার গল্প উপন্যাসে যে কাহিনী নাই সেটা না, তবে কাহিনীটাই যেন সবকিছু না। আসল ব্যাপারটার আশপাশ ঘিরে যেন বর্ণনা চলতে থাকে, কিংবা আসল বলেও কোনো সীমা-নির্দেশ নাই। কিছু গল্পে কাহিনী নাই বললেই চলে। তেমন দুই একটা গল্প নিয়ে এখানে কথা বলব। তার কাহিনীমূলক লেখাগুলোও যে আসলে কাহিনীকেন্দ্রিক না শুধু, অন্যকিছু, এই দিকটি বোঝার জন্য এমন বাছাই। কাহিনী নাই অথচ গল্প!— ঘটনা আছে, ধারাবাহিকতা নাই, সম্ভাবনা বা পতন নাই কোনো, প্যারালাল টেক্সট থাকে, আছে রিফ্লেকশন। এছাড়াও আরও দু’একটা গল্প নিয়ে আলোচনায় যাবো, সবমিলিয়ে মাসুমুল আলমের লেখার বৈশিষ্ট্যকে বুঝতে।
`অনাথবন্ধু, পালাও’ গল্পের স্থান একটি রাস্তা, মাত্র কিছু সময়, দুটি ছেলেমেয়ের দেখা হয়। কিছু সময়ের ভেতরেই অনেক কিছু। তারা একই অফিসের কলিগ। অফিসের বস এখানে ক্ষমতার একটি পর্যায়। ছেলেটি হীনমন্য সেখানে, আর নিত্রা বসের সাথে সাবলীল, ক্ষমতার ‘পূজারি’, সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। ছেলেটি মনে মনে বিদ্বেষই রাখে মেয়েটির প্রতি। তার একটিই স্বান্তনা, পঠনপাঠনের কারণে নিত্রা তাকে গুরুত্ব দেয়। দেখা হবার পরে মামুলি কিছু হাসিতামাশা। নিত্রা আইসক্রিম খেতে চায়, যদিও রোজার সময় চলছে। ‘চিপাগলিতে’ ঢোকে, আড়ালের জন্য। ছেলেটির অস্বস্তি হয়, কে কী মনে করে, ভাবে পালিয়ে যাই, মেয়েটি কিন্তু ‘নির্ভার’। ছেলেদের সমাজ-টানাপোড়েন বেশি এখন। পরক্ষণেই অন্যদিক নেয় গল্পের মোড়। নিত্রার হাতে ছিল বাজারের ব্যাগ, কই মাছ কিনেছে, বাজারঘাট ওই-ই করে, স্বামী না। ছেলেটি বলে, ‘ব্যাগের মধ্যে কী? ব্যাগটা হাতে নেন, বেড়াল ঘুরঘুর করতেছে।’‘তাই তো, দেখছেন, এই জন্যই কয় বিলাই, ঠিকই টের পাইছে মাছ।’সংলাপে একটা ইঙ্গিত আছে। ধরে নেয়া যায়, রোজা রক্ষাকারীদেরকে বোঝানো হচ্ছে, কিংবা ছেলেটির আকর্ষণ। ইন বিটুইন দ্য লাইন্সে ইঙ্গিত যেমন থাকে, নানামাত্রিক অর্থও তৈরি করে। মাসুমুলের লেখায় এই তলটা থাকে সবসময়। প্রসঙ্গক্রমে স্বামীর কথা এলে, ‘... তার হইলো টিভি চ্যানেলে চাকরি, রাত্রিকালীন, বাবু খালি বাসায় আসেন আর মর্জি মতো চোদেন।’মেয়েটির এতো সাবলীল কথাবার্তায় ছেলেটি ধাক্কা খায়। দাম্পত্য প্রাইভেসির মধ্য দিয়ে যে আইডিয়াল নির্মাণ করে সমাজে, সেখানে এধরনের কথাবার্তাগুলো বিষয়কে সাধারণে নামিয়ে ফেলে। একজন লেখক পবিত্রতাকে ধ্বংসও করেন। হঠাৎই হৈ হট্টোগোল, আবারও অন্যদিকে গল্প। রোজার ‘পবিত্রতা রক্ষাকারীরা’খাবারের দোকান সব ‘গুঁড়িয়ে’ফেলছে। ওরা দুইজন পালালো ওখান থেকে। পরদিন, মেয়েটি টেক্সট করে, ‘দূ-র, আপনার সাথে ফাও প্যাচাল জমানোই কাল ঠিক হয় নাই। জানেন আমার ৫টা কই মরছে’। ছেলেটি উত্তরে ‘বাল’লিখে পাঠালেও, পরে ‘দু:খিত’লিখল। গল্প শেষ। প্যারালাল কয়েকটি মূহুর্তে একটি পরিস্থিতি উঠে এসেছে। পরিস্থিতি মানে হলো একটি সময়কে ধরা। স্বাধীনচেতা একটি মেয়ে। বাসার বাজারঘাটের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে। চাকরি করে। কিন্তু অফিসের আরেক ক্ষমতা-বলয়ে সে যাপিত হচ্ছে, সুযোগও নিচ্ছে। কলিগের সাথে তার সম্পর্কটা মজার, ইয়ার্কির, আকর্ষণের। যদিও ছেলেটি হীনমন্য, বস হলো তার ভাষায়, ‘নায়ক এবং আধিপত্যকামী’। মেয়েদেরকে বশে রাখতে পারার তার যোগ্যতাকে সে ঈর্ষা করে। যদিও নিজের পঠনপাঠন দিয়ে মেয়েটির কাছে আকর্ষণীয় হয়ে থাকতে চায়। ছেলেদের কমোন দুইটা প্রবণতা দেখি এখানে। পুরুষ কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতা হয়ে উঠতে চায়, না পারলে তখন ঈর্ষা। এই যে একদিকে আধুনিক এক আবহ দেখা যাচ্ছে, এবং এর ভেতরে অনেক লেয়ার আছে, যৌনতাও, অন্যদিকে সমান্তরালভাবে প্রতিক্রিয়াশীল এক অবস্থা— পরিস্থিতির বিবরণ হয়ে ওঠে তার গল্প। একজন লেখক পরিস্থিতি দেখান। পরিস্থিতিকে ধরতেই যেন মাসুমুলের এই প্যারালাল টেক্সট।
তার গল্প পড়লে মনে হয় একজন পর্যবেক্ষকের সাথে এগোচ্ছি, পরপর নানা মূহুর্ত, ইমেজ, ঘটনা। লেখক ঘটনার ভেতরেও আছেন, বাইরেও থাকেন। ভেতরে থাকেন বলতে, বিষয় যখন নির্দিষ্ট ওই মূহুর্ত বা ঘটনা। আর যখন তিনি পর পর বিষয়কে দেখাচ্ছেন, তখন যেন বাইরের কেউ। গল্প-কথনে যেন দুই সত্বা থাকে।
‘শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি’গল্পে ক্ষমতায়নকে বুঝাতে প্যারালাল টেক্সট হাজির করেন তিনি। ধনীর সাথে গরীবের বা রাষ্ট্রের সাথে জনগণের ভেতরে ক্ষমতায়ন বা রাজনীতির যে মহাআখ্যান আছে, সে জায়গায় লেখক অফিস আর দাম্পত্য, যে দুই যাপনে ব্যক্তি অকুপাই হয়ে থাকে সার্বক্ষণিক, সেসব নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। যেন দেখাতে চাচ্ছেন, যে যাপনে থাকা হয় সর্বক্ষণ, সেখানে রাজনীতি আছে। আর রাজনীতি থাকলে সেখানে ক্ষমতারও উপস্থিতি থাকে। যদিও তিনি রাষ্ট্রীয় রাজনীতির প্রসঙ্গও আনেন আন্ডারটোনে। এই গল্পে একাধিক দিক দেখা যায়ঃ সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সেনাবাহিনীর সাথে সিভিল প্রশাসনের দ্বন্দ্ব টানাপোড়েন, স্বামীর সাথে স্ত্রীর সুসম্পর্ক টানাপোড়েন এবং সমঝোতা। ঘরে-বাইরের নানামুখী রাজনীতির ভেতরে যাপিত হচ্ছে ব্যক্তি। ক্ষমতা বা সম্পর্কে শান্তিপূর্ণ এক সহাবস্থান থাকে, একইসাথে অন্তর্তলে চলে এক মোকাবেলা। রাইসুল, একজন সরকারি কর্মকর্তা হঠাৎ রাত্রে এক সেনাঅফিসারের ফোনে হন্তদন্ত হয়ে সেই রাতেই রওয়ানা দিয়ে দিলেন নিজের কর্ম-জেলার উদ্দেশ্যে। ঘুম হারাম হয়ে গেল তার। সকালে সেখানে পৌছিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে অপেক্ষা, কখন আসবেন ওনারা। পরপরই আরেকটি টেক্সট এসে গেল। তনিমা, তার স্ত্রী, তিনিও ‘ঠাণ্ডা ঘরে’। বাসায় স্বামী মেয়ে কেউ নাই। ‘সি সি ক্যাম আর গেইটের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে বেশ এক চোট হা-ডু-ডু খেলা যায়, এমন একটা প্রাসোদোপম ফ্ল্যাটে সারাদিন সে শুয়ে-বসে-পড়ে-লিখে অথবা চ্যাটিং বা সিনেমা, যদৃচ্ছা সময় পার করা যায় সে করে...’। নিয়ন্ত্রিত জীবনের এক স্বাধীনতা দেখি এখানে। লেখক কি শুধু কথিত এই স্বাধীনতা-পরাধীনতার বিষন্নতাই দেখান? না, তিনি কাউন্টার অ্যাক্ট দেখান। স্বামীর অর্থনৈতিক ‘ব্যাকআপ’-এ সে ‘গলে যায়নি’, ‘মানিনা-মানবোনা’মতো একটি আচরণ স্ত্রী জারি রাখেন। স্বামী তার ‘একাকীত্বের যাপন প্রক্রিয়া’একদমই পছন্দ না করলেও, স্ত্রী নিজের ইচ্ছা-একাকীত্ব আর নিস্পৃহতা দিয়ে স্বামীটিকে চাপে রাখেন। যৌনতা নিয়েও খেলেন তিনি। স্বামীকে ঘুরঘুর করান এই-সেই বলে। উদাসিনতার উপেক্ষা। লোকটি যেন তার ক্ষমতার শক্তি ভুলে যায় বউয়ের যৌন-শক্তির সামনে। যৌনতা যেন এখানে ক্ষমতা হয়ে উঠেছে। ‘ক্ষমতা থাকা মানে ইচ্ছা-অনিচ্ছার জোরটাও থাকা। রাইসুলের সঙ্গে তনিমা সেই ক্ষমতারই প্রয়োগ ঘটায়।’অফিসের প্রসঙ্গে লোকটির এই কথাটি মনে হয়েছিল। তার যেভাবে হুড়াহুড়ি করে অফিসে চলে আসতে হলো, রাইসুলও একজন প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারি, ‘ঠাণ্ডা ঘরে’বসে আছেন, অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আরেক ক্ষমতারা আসলেন কিন্তু ধীরে সুস্থেই। এসে অবান্তর প্রশ্ন সব। আসলে জরুরি তেমন কিছু ছিল না। তাদের উপস্থিতিটাই যেন গুরুত্বপূর্ণ। অযথা সব প্রসঙ্গ বলা দিয়ে ক্ষমতার ইচ্ছা প্রদর্শন হলো, মানে ক্ষমতার শক্তিকে বোঝানো হয় এভাবে। প্রদর্শন ছাড়া ক্ষমতা তার শক্তিতে কিভাবে দেখায়, এমন যেন ব্যাপারটা। সিভিল ক্ষমতার ধৈর্য ভেঙে পড়ার উপক্রম হলে, মূল কাজ শুরু করার উদ্যোগ নিলেন সেনা-ক্ষমতা। ভেঙে যাওয়ার মুহূর্তে পানি ঢেলে দেয়া আরকি। ক্ষমতা এরকম টানটান অবস্থায় থাকে। দুই ক্ষমতার ভেতরের কাটাকাটি, কিংবা ক্ষমতার ভেতরকার দ্বন্দ্ব। তনিমাও যেমন করে, একটা আউটবাস্টের ঠিক আগ মূহুর্তে ‘সাড়া দেয়’। এসব হলো ক্ষমতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার খেলা। ক্ষমতা ব্যাপারটা এই গল্পে ক্রিটিকাল হয়ে উঠেছে। সবাই সবার সাথে মোকাবেলা সারছে, মানে রাজনীতি করছে। ক্ষমতাটা যে আসলে কোথায় অবস্থান করে? এখান থেকে ওখানে সরে সরে যাচ্ছে যেন। ক্ষমতা আর আপাত অনুসারির যখন-তখন স্থান বদল, কেমোফ্লেইজ তৈরি করছে।
‘স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা’-য় রিমি নামে যে মেয়েটাকে দেখা যায়, সে যেন একটি রূপক। একটি জেলা শহর। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তার ওঠা-বসা। তরুণদের আকর্ষণ। হঠাৎই এই তরুণদের দুঃখ দিয়ে ফরাসি প্রবাসী একজনকে বিয়ে করে চলে গেলো সে। আবার ফিরে আসে যখন, একা, সামরিক শাসন চলছে দেশে। সাংস্কৃতিক সমাজের তরুণরা আবারও আশাবাদি এবং উৎসাহিত হয়ে ওঠে তাকে ঘিরে। সামরিক শাসনের শেষের দিক তখন, তরুণ সেনা অফিসাররা পাড়ায় হাঁটতে বের হয়, ‘মেয়ে দেখতেই’। ‘তারা জানত যে, সময়ের বাস্তবতায় অভিভাবকদের কাছে তাদের সবিশেষ প্রাধান্য আছে।’ একদিন তরুণ এক অফিসার রিমিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে। বিয়ে হয়ে গেলো ওর, চলে গেলো আবার অন্য কোথাও। জেলার শিল্পীসমাজ আবারও হতাশ হয়। বারেবারে দখল করা হচ্ছে, কিংবা নিজেই দখলে চলে যাচ্ছে, অন্যরা হারাচ্ছে, কখনই পাচ্ছে না ওরা। ক্ষমতা যেন পারস্পরিক একটি ব্যাপার। তরুণ অফিসার একদিন সুন্দরী স্ত্রীর ইচ্ছাপূরণ (!) করতে বোটে করে ঘুরতে বের হয় তাকে নিয়ে, উল্টিয়ে পানিতে পড়ে গেল ওরা। অফিসারটি মারা যায়। রিমি বেঁচে যায় অলৌকিকভাবে। লেখক যেন একটি ইঙ্গিতও দিয়ে যান, ‘আর পানির পীর খোয়াজ খিজির কি তাহলে বাঁচিয়ে দিল রিমিকে ফের কোনো অভিঘাত সৃষ্টির জন্য?’ সামরিক শাসনেরও পতন ঘটে যায় সে সময়টাতে। রিমিকি কোনো মায়াজাল? যে ক্ষমতাকে টানে, নাকি ক্ষমতাকেই তৈরি করে? কিংবা ক্ষমতার অল্টারইগো? সেই জেলা শহরে যখন অঘটনের খবরটা পৌছায়, তরুণ সাংস্কৃতিক সমাজ আবারও প্রতীক্ষা করতে থাকে ওর ফিরে আসার। এক ইন্দ্রজাল বিস্তার করেন যেন লেখক। গল্পের শুরুটা ছিলো এমন, ‘রিমিরা থাকত যে শহরে, সেই শহরে আছে এক মৃত নদী’। এই গল্পটিতে একটি কাহিনী আছে, একজন কথক বুড়ির বেশে যেন বলে গেলেন।
‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’ নামের গল্পের সূত্র-ঘটনা এক জেলা শহরের জেল-বিদ্রোহ, এবং কিছু কয়েদির মৃত্যু। ঘটনা-বর্ণনা চলতে থাকে এক কিশোরের দৃষ্টিতে, যার পিতা ছিলেন সেখানকার রাজনৈতিক বন্দী। পারিবারিক উৎকণ্ঠার এক গুমোট আখ্যান। যদিও কাহিনীটা সেখানেই থেকে যায় না, মাসুমুলের গল্পের যে বৈশিষ্ট্য, বৃত্তায়িত হতে থাকে সেই আখ্যান-পরম্পরার অসঙ্গতি ঘটিয়ে। ভৈরবের তীর ঘেঁষে কিছু অপরাধীদের আড্ডা, যারা নানা কর্মকাণ্ডের কারণে জেলে যায়, ফিরে আসে আরও বেশি গুণ্ডা হয়ে। একদিন এমন এক গুণ্ডা গল্পের এই কিশোরকে কোনো এক বিপদ থেকে বাঁচিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসে। পরিবার আর তার রাজনৈতিক পিতা, কোনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা তো দূরে থাক, ও-তো গুণ্ডা বলে আলোচনাটা থামিয়ে দেন, মানে ধামাচাপা দেয়া আরকি। কিশোরটি যখন ভাবে ‘পরিবার থেকেই আমি ঘৃণা করতে শিখেছি’, তখন মনে হয় জেল-শাসন আর সমাজ-অনুশাসন যেন একইরকম কিছু। এই দুই-ই সমাজের কনফ্লিক্টকে ধামাচাপা দিয়ে রাখে। কিশোরটির ভাবনায় বারেবারেই আসে, পিতা বা পরিবার থেকে পাওয়া ভালোর সংজ্ঞার দ্বন্দ্বপূর্ণ দিকগুলো। গল্পটির মূল ঘটনা, মানে যা মূল ভাবা হচ্ছিল, সেখান থেকে সরে যেতে থাকে। একদিকে জেলের এই দূর্ঘটনা, তার বাবাকে নিয়ে পরিবারের দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে শাসন অনুশাসনের ডিসকোর্স গল্পটিকে শুধুমাত্র জেলবিদ্রোহের কাহিনীর ভেতরেই সীমাবদ্ধ করে রাখে না, ব্যাপ্তিতে নিয়ে যায়। প্যারালাল টেক্সট বলে যে কথাটা আমি বলেছি মাসুমুলের গল্প নিয়ে, সেটা হলো একটি বিষয়কে নানামাত্রিকতায় নিয়ে যাওয়া। কয়েদি বিদ্রোহের কারণে যেসব কূট-আলোচনা আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শীদের মধ্যে চলতে থাকে, সেখানে এই পরিবার সঙ্কোচে গোপনতা অবলম্বন করে। শুদ্ধ-রাজনৈতিক পিতাই শেষমেশ ভূক্তভোগী হয়ে যান নিজেদেরই সামাজিক মানসিকতার দ্বারা। গল্পটি বাস্তব থেকে এলিগরিতেও চলে যায়। বাস্তব আর বিমূর্তায়নের এই স্থানবদল তার নানা গল্পের ঘটনা (অ)পরম্পরার মতোই সহজাতভাবে এসে যায়। গল্পের তাতে কিছু এসে যায় না। লেখক তার দেখার দিকে ধাবিত হতে থাকেন। যার দেখা থাকে, তার কোনো সীমা-নির্দেশ থাকে না। কিশোরটি এক শহরে গিয়ে হাজির হয়, ওয়ানতানামোয়। বোঝা যায় গুয়েনতানামোরই নামান্তর এটা, যদিও আক্ষরিক মানে হয়ে থাকে না শেষমেশ। ‘একটা ব্যবস্থাপনা যা তোমরা প্রতিটি দেশেই করে রেখেছ। তথাপি, ভাগ্যিস, ওয়ানতানামোয় কখনো কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় না’। সেই শহরে গিয়ে সে বিস্মিত হয়, ‘কোথায় বন্দীশালা?’ সবাই সেখানে হাসিখুশি, সুন্দর বাড়িঘর, লোকজনরাও যেন সবাই তার সেই পরিচিত জন। এ তো এক ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’। লেখক যেন দেখালেন, জেল কাঠামোর বৃহৎ এবং বিস্তৃত রূপ হলো এই রাষ্ট্র, এই সমাজ। নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণ চলে সবখানে। যদি বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় কখনও, ‘আপনি তো ভেতরে ছিলেন, কয়জন মরেছে? / একজন। / সত্যি বলেন। / একজনও না’— এভাবে করে একটা ব্যবস্থা টিকে থাকে ধামাচাপা দিয়ে। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিপোর্ট বা ফিচার হয়। সংবাদ পাঠক আমরা, পড়ি। এখনকার রিপোর্টে তো ভূক্তভোগীদের দুঃখ দুর্দশার যাপনও এমনভাবে উঠে আসে যে সাহিত্যিক টেস্টই (!) পাওয়া যায়। তাহলে গল্প কী? ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’হলো গল্প। গল্প যে শুধু ন্যারেশন আর কাহিনী না, মাসুমুলের লেখা পড়লে বোঝা যায়।
সাহিত্যে চিহ্নের ব্যবহার থাকে। এটা যে সাহিত্যিককৃতি শুধুমাত্র, সেটা না। জীবনেই অনেক সাংকেতিক দিক আছে, মানুষ তৈরি করে যাচ্ছে। একদল মেয়ের সামনে পড়ে যেতেই দেখা যায় ছেলেটি সিগারেট ধরালো। সিগারেট খাওয়া এখানে একটি চিহ্ন হতে পারে। ছেলেটি নার্ভাস হয়তো, সেটা লুকাতে চাইছে, দুই হাত নিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিংবা নিজের ইনসিকিউরিটি থেকে ব্যক্তিত্বের প্রদর্শন। চিহ্নের অনেক লেয়ার থাকে, চরিত্রায়ণ সিচুয়েশন ব্যাকগ্রাউন্ড এমন অনেককিছু। লোকে তো গোটা গোটা কমপ্লিট বাক্যে কথাও বলে না, সাহিত্যও তাই। ‘ভাষার খেলা’বা দৃশ্যায়নে চিহ্ন থাকে, সংকেত দেয়। কথাসাহিত্যে আবহ তৈরি হয় কিভাবে, বুঝতে ‘চিহ্ন’গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। মাসুমুল আলমের ‘সবুজ করুণ ডাঙায়’গল্পটি আরকিছু না, চিহ্নের খেলা। গল্পের ক্ষেত্রপট হলো এক বিকাল, শিশুরা ব্যাডমিন্টন খেলছে মাঠে, মায়েরা আড্ডা দিচ্ছে, লুডু খেলছে, অপেক্ষাকৃত আরও ছোট বাচ্চারা আশপাশে দৌড়াদৌড়ি করছে, মায়েরা মাঝেমধ্যে সাবধান করছে ওদের। একজন পুরুষ বসা সেখানে। কাছে হণ্যের বিল। সেখানে একজন লোক ভেড়া চড়াচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। এই হলো গল্পের আওতাক্ষেত্র, এর বেশি কিছু নাই, মানে এই জায়গাই, এইটুকু সময়ই, একটি ব্যাকগ্রাউন্ড আছে খালি, আর ছুড়ে দেয়া কিছু কথা। বাহ্যিকভাবে স্টিল ফ্রেম যেন একটা। এই ফ্রেমটার ভেতরে কি চলছে?
প্রতিদিনকার একইরকম পরিবেশের বাইরে, ‘কিন্তু আজ সেখানে আরো একজন বাড়তি মানুষ।’গল্পের ইঙ্গিত যেন। ‘...তার চিকন শরীর ও মায়াময় এক কিশোরমুখ।’ অনেক নারীর ভেতরে বসে থাকা একমাত্র পুরুষের সৌন্দর্য বর্ণনা আরেকটু এগিয়ে স্পষ্ট-অস্পষ্টতার দিকে নিয়ে যায়।
একটি শিশু লোকটিকে জ্বালাচ্ছে অন্যদিকে ঘুরতে যাবার জন্য। মায়েরা তাদেরকে ‘ভর্ৎসনা করছে, জ্বালাতন! ভাইসেব, আপনি থাকেন তো এখেনে, খ্যালবেন উরিগের সাথে? না কি আমাগের সাথে লুডু খ্যালবেন?’ একটি ধারালো হাসি, একজন নারীর।
[লুডু খেলার আহ্বান, একটি ইঙ্গিত]
বড় শিশুরা কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলছে। অপেক্ষাকৃত আরো ছোট বাচ্চাদের ‘খেলার দুর্মর ইচ্ছে হয় রোজ। ... কোর্টের পাশেপাশে ছুটে-ছুটে তারাও খেলে, চুনটানা দাগের মধ্যে অবশ্য যায় না।’
[পুরুষটি কোনদিকে যাবে? তার জায়গাটা কোথায়? টানাপোড়েন।]
‘ভাইসেব, পারেন তো লুডু খেলতি নাকি পারেন না?’
[আকর্ষণকে উচ্চকিত করা হচ্ছে।]
‘বেশ ক-বছর আগেও সে (এই পুরুষটি) একবার এখানে এসেছিল। তখন এই শিশুরা কোথায় ছিল? তখন সামনের এই কামিনীগাছে ঝাঁপিয়ে ফুল এসেছিলো। তীব্র গন্ধযুক্ত শাদা শাদা ফল।’
[যৌন-প্রাপ্তি বা সম্ভাবনাময়ী নারী।]
পুরুষটি সেবারে কলতলায়, “...ঢুকতেই এখন ঐ ‘পারেন তো লুডু খেলতি’বলা নারীটি তখন দ্রুত ধবল দুটো আলগা বুক গামছায় ঢেকে নিয়েছিল।... কিন্তু ঐ পর্যন্তই।”
[গল্পেএকটিমাত্র পূর্ব সূত্র। পুরুষটি এগোয়নি, নীরবতাতেই ছিল।]
শিশুদের টানাটানিতে লোকটিকে শেষমেশ অনিচ্ছা সত্বেও বিলের দিকে যেতে হলো। “পেছনে খেলায় আহ্বনকারী নারীদের হাসি আর মৃদুভাস পড়ে থাকে।... হণ্যের বিলের ধীরগামী গাদ-কচুরিপানার মাঝে মাঝে জেলেদের মাছধরা নৌকা। ডাঙা থেকে ‘এ বা’মা তোর ডাইকতেছে’ দূর থেকে একটা শিশুর তীক্ষ্ণ আহ্বানের পর ‘আসতিছি’বলে একটা জোর জবাবও আসে।”
[পুরুষটি তার আকাঙ্খাকে পেছনে রেখে হেঁটে যায়। এরপরের দৃশ্যে আরেকটা অর্থ এসে যায় যেন, মনে হয় ঘর বাধার ডাক। নি:সঙ্গতা। পুরুষটি নীরব এখনও।]
“সে দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখল বাঁশের চটা দিয়ে বানানো মানুষের কাঠামো— কচুরিপানাময় হাঁটুজলের মধ্যে ‘ঠাকুরের চিহ্ন’দেখতে পেল সে। হরিণা বা হণ্যের বিলের জলে বড়োপুজোর দুর্গাঠাকুরের মাটির শরীর ক্রমে ধুয়ে ধুয়ে হাড়কাঠামো বেরিয়ে পড়লে জেলেরা পবিত্র জ্ঞানে ওখানে ওটা গেঁথে রেখেছে। দ্যাখো, একটা ফিঙে বসে আছে ঠাকুরের চিহ্নের ওপর।”
[যৌনতার এক অদ্ভূত চিহ্নায়ন।]
পুরুষটি উঠি উঠি করছে এমন সময়ে নারীরা এসে হাজির, ‘থাক ভাইসেব, আমরা আসলাম আর আপনি যাচ্ছেন। আমরা ওগের (শিশুদের) নিতে আসিছি। আপনি এখেনে আকাশ-বাতাস দ্যাখেন।
[পুরুষটির নীরবতার কারণে একটি খোচা নারীটির।]
বিলের পাশে ভেড়ারা চড়ে বেড়াচ্ছে তখন। রাখাল একদিকে বসে মোবাইলে গান শুনছে। নারীটি তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই, এইটে কি ভেড়া? / না, বুনডি। ... সেই নারীটি আবার সরব হয়ে উঠল: তা’লি কী ইডা? / এরে কয় গাড়ল। / ক্কিহ্! / এর ল্যাজ দ্যাখেন কত্ত লাম্বা। ভেড়ার ল্যাজ তো খাটো হয়।’নারীরা হেসে ওঠে।
[নারীটি অপমান করল তাকে। আর পুরুষটি ‘মুখ খুলবে খুলবে এমন সময়ে...’ কিছুই বলে ওঠা হলো না শেষমেশ। যৌন-নি:সঙ্গতায় থেকে গেল পুরুষটি, সে-ই নীরবতাই]
এই গল্পে পদে পদে সংলাপের খেলা, ছুড়ে দেয়া কথায় চিহ্ন ভাসছে। আর ‘কামিনীগাছে ঝাঁপিয়ে ফুল’, ‘শাদা শাদা ফল’, ঠাকুরের চিহ্ন, ফিঙে, লুডু খেলা, ভেড়া এসবের ইনসার্টও এক একটি চিহ্ন হয়ে উঠেছে। যৌন সম্পর্ক না, যৌন আকাঙ্খার আবহ এমন ভাবে এখানে ব্যক্ত হয়েছে যে যৌনতা বিশেষ হয়ে উঠেছে, সে নিজেই একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। যৌনতাও যেন কতো নি:সঙ্গ। চিহ্নগুলোর অর্থময়তা ট্রাফিক সিগানালের মতো সহজেই কমুনিকেট করে ফেলে। চিহ্ন ব্যবহারে এতোটাই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন মাসুমুল আলম।
আমরা জানি লেখা নানারকমের হয়। মাসুমুল আলম হলেন এমন একজন সাহিত্যিক যিনি নিজেই নানারকম, মানে তার লেখালেখি একেকরকমের। নিজস্ব সাইন আছে যদিও, সেটা তো থাকে। তার যে তিনটা উপন্যাস আছে, আরেকটি বের হচ্ছে তাড়াতাড়িই। সবগুলোই সবের থেকে আলাদা। তার নিজের দেখা তাকে চালায়, ‘লেখা এমন হয়’তাকে ডমিনেট করে না। ফর্ম বা স্ট্রাকচারের একটা অভ্যস্থতা থাকে, দক্ষতাও থাকে একে ঘিরে; মাসুমুল রিস্ক নেন এখানে। এইসব পারফেকশনের শাসন থেকে তিনি মুক্ত। মাসুমুল আলম হলেন এ সময়ের একজন স্বাধীন লেখক।
মন্তব্য