মাসুমুল আলমের গল্পের সাথে আমার পরিচয় ২০১৮ সালে। সেই বছরের বইমেলায় উলুখড় থেকে বেশ কিছু বই আমার কেনা হয়েছিলো। সেগুলার মধ্যে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নামপুরুষ ও অন্যান্য’বইটাও ছিলো। সেই বইয়ের প্রথম গল্প ‘স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা’বইটা কেনার আগে উলুখড়ের স্টলে দাঁড়িয়েই পড়ে ফেলেছিলাম। বলে রাখা ভালো যে, লেখকের শ্রমলব্ধ শক্তিশালী উইট বরাবরই আমার অত্যন্ত পছন্দের। যে কারণে গল্পকার হিসাবে আমার পছন্দের কথা জিজ্ঞেস করলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নামটা সবার আগেই চলে আসে, এখনো আসবে। তবে ইলিয়াস কিংবা যে কোন লেখকের উইটের পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গি, প্রকৃতপক্ষে সেটাই আমাকে আকর্ষণ করে। ‘স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা’গল্পটিতে শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনের কতিপয় লুম্পেনকে কেন্দ্র করে মাসুমুল আলমের চাপা কিন্তু তীক্ষ্ণ উইটের সন্ধান পেয়ে বইটির বাকি গল্পগুলো পড়াটা আবশ্যক মনে করেই বইটা কিনেছিলাম। তার উল্লিখিত গল্পগ্রন্থটির অন্য যেই গল্পটি পরে সবার আগে পড়েছিলাম তা ছিলো ‘ভৈঁরো’। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সংকটকে কেন্দ্র করে লিখিত গল্পটিতে শৈশবের স্মৃতি, নস্টালজিয়া ও সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিত থেকে উদ্ভুত সাম্প্রদায়িক সংকটের বিষবাষ্প আমাদের মস্তিষ্কে অবিরাম হ্যামার করতে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে এই কথা জানিয়ে রাখি- মাসুমুল আলমের যতো সংখ্যক গল্প এখনো পর্যন্ত আমার পড়া হয়েছে; ‘ভৈঁরো’ গল্পটি আমার সবচেয়ে পছন্দের গল্পের মধ্যে উপরের দিকে থাকবে।
আমরা যদি মাসুমুল আলমের ‘নামপুরুষ ও অন্যান্য’ গল্পগ্রন্থটির বিভিন্ন গল্প লক্ষ্য করি তবে দেখবো যে মাসুমুল আলমের বিভিন্ন গদ্যে শৈশব ও অতীত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা দখল করে আছে। ‘এপ্রিলের এক সন্ধ্যা’, ‘আনন্দ কোথা থেকে আসে’, ‘ওয়ান্ডারল্যান্ড’, ‘জ্বর’, ‘বাদশা নামদার ডাকাতের গল্প’ ইত্যাদিতে বিভিন্ন মাত্রায় শৈশব ও তার স্মৃতি বর্ণিত আছে। পাঠক হিসাবে জেনারেলাইজেশনের ঝুঁকি নেওয়াটা সময়ে সময়ে অর্বাচীন ঠেকে বলেই মনে হয়, তারপরেও ঝুঁকি নিয়ে এই কথাটি বলতে চাই যে- শৈশবের বিবিধ স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা এবং তা থেকে জারিত অভিজ্ঞান ভেতরে ভেতরে আমাদের জীবনকে পরিচালিত করে থাকে; এমন একটি কথা লেখক আমাদের বলতে চেয়েছেন এমনটা উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন গল্প পাঠ করে মনে হয়েছে। গল্পের বিষয় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপাদান বিবেচনায় অতি অবশ্যই একেকটি গল্পের এসেন্স একেকরকম; কিন্তু গল্পগুলোতে লেখকের শৈশবকে তুলে আনার ধরণ আমাকে এমনটা ভাবতে প্ররোচিত করেছে।
মাসুমুল আলমের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘দর্শনীর বিনিময়ে’ ২০১৯ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়। তার প্রথম গল্পগ্রন্থের বিভিন্ন গল্প পাঠের অভিজ্ঞতার কারণে বইটি কেনার ব্যাপারে সেকেন্ড থট দেওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। লেখকের নির্দিষ্ট কিছু গল্প যেমন ‘নাটুকে’, ‘সুবর্ণ বানিয়া’ ইত্যাদি গল্পে রাজনৈতিক-অর্থনীতি প্রশ্নে লেখকের পাওয়ারফুল উইট ও অনতিক্রম্য ইনসাইটের সন্ধান পেয়ে সচেতন পাঠকেরা নড়েচড়ে বসবেন বলেই মনে হয়। ‘নাটুকে’গল্পটির কিছু লাইন লক্ষ্য করা যাক-
৪৭- পরবর্তী বিকাশমান মধ্যবিত্ত সমাজের উত্তরসূরিগণ ১৯৭১-র পরে যে গতিতে দৌড়েছিলো, তাতে হাসনাত সাহেব কিংবা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম একটা বৈষম্যমূলক অবস্থার প্রেক্ষিতে সমাজে বেনিফিশিয়ারী হয়ে যায়; এবং অর্থনৈতিক- সংস্কৃতিটা এমন হয় যে, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে আয়ের তুলনায় ব্যাপক খরুচে-স্বভাব; এই অসংগত আচরণকেই তো বিবেচকরা বরাবর ঘোড়ারোগ বলে এসেছেন, তাই না? ভৌত অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন অথবা শিল্পায়নের পাশাপাশি ব্যক্তিশ্রেণির সঞ্চয়ের নিম্নগতি সত্ত্বেও বিলাস-ব্যসনে গা-ভাসানো সমাজকে নিরঞ্জন বরাবরই প্রশংসা করে এসেছেন। অথচ প্রশংসার কাঠিলজেন্স চুষতে চুষতে হাসনাত দেখলেন, মিতব্যয়ী সমাজের জীবনধারা। কিন্তু সে-ও যেন খণ্ডিত দৃশ্যপর্যায়। আর দৃশ্যান্তরে, ভারসাম্যহীন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাঃ হাতে মোবাইল নিয়ে রেললাইনের ধারে হাগতে বসে যাচ্ছে ভোর-সকালে। বিপরীতে, অমর্ত্য সেন যতই বলুন স্যানিটেশন, শিশুমৃত্যুহার হ্রাসে এই দেশ অভূতপূর্ব- কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছে, তাতে আবুল হাসনাত- নিরঞ্জনরা সরকারের সাথে একযোগে যতই প্রীত বোধ করুক কেউ-কেউ তো ঠোঁট টিপে হাসে।
স্থূল ও সারবস্তুহীনভাবে হলেও সাহিত্যে রাজনীতির প্রতিফলন বনাম পোয়েটিক ফর্মের গদ্যে সাহিত্যের সৌন্দর্যচেতনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা; এরকম একটি বাইনারী আমাদের সাহিত্যজগতে ও আমাদের পাঠকমননে প্রবলভাবে প্রচলিত আছে। মাসুমুল আলমের উল্লিখিত লাইনগুলোতে অনবদ্য উইটের সাথে সাথে উপরিউক্ত বাইনারীটি যথার্থরূপে অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়েছে বলেও আমার মনে হয়।
যৌনতার অসামান্য উপস্থাপনা মাসুমুল আলমের গল্পের অন্যতম প্রধান একটি দিক। তবে মাসুমুল আলমের গল্পের সাথে যাদের সম্যক পরিচয় আছে তারা এই বিষয়েও নিশ্চিতরূপে অবগত আছেন যে তার গল্পে যৌনতার নামে অহেতুক সুড়সুড়ির প্রত্যাশা করাটা বাতুলতা। তা এক ধরণের বেকুবিই হবে বৈকি! তার গল্পসমূহে যৌনতা ও ক্ষমতায়নের আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি কম বেশী মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠে। যেমনটা আমরা লক্ষ্য করবো ‘অনাথবন্ধু, পালাও’গল্পটির নিম্নোক্ত কিছু লাইনে-
অতি-সতর্কতায় সে অপ্রতিভ এবং তার কাজে ভুল হতে থাকে। তো, অন্য নারীরা কেউ কেউ তার এই নার্ভাসনেসে কিছুটা সদয় থাকলেও ঘটমান সময়ে নিত্রা পাগলাটে মজায় হি-হি হেসে ওঠে; এমনিতেই তার মতো বায়-ফাজিলের এমন একটা ধারণা আছে যে, চশমাঅলা মেয়েরা মোটের ওপর বদের হাড্ডি হয়। কেননা, নিত্রার আচমকা হাসি তাকে তোৎলা করে। কর্তৃত্বপরায়ণ লোকটির সমুখে ঘেমে ওঠে। আর দ্যাখো, বালপাকা বয়সটাকে প্রৌঢ়ত্বে আটকে গিয়ে ‘অমিতাভ’-বিক্রমে লোকটা কেমন ‘শাহেনশা’হয়ে ওঠেন। নায়ক এবং আধিপত্যকামী। সাংস্কৃতিক রুচিস্নিগ্ধতার ছদ্মবেশ নারীদের সামনে নাজেহালটা সূক্ষ্ণভাবে করতে পারেন, করেন; এবং এতটাই সুগারকোটেড, এতটাই কুউল, কিন্তু অন্তর্গতভাবে বিদ্বেষপরায়ণ ও হিংস্র। আর মুক্ত চেতনার অধিকারী তন্ত্রবাদী সমভ্যব্যাহারে চললেও- অন্যদের কথা বলতে পারবেনা সে, নিত্রা তো নিশ্চয়ই বোঝে বাঞ্চোতটা একজন প্রবল আধিপত্যবাদী, যেঃ এ জমি আমার, এ জলমহাল আমার, এ চর আমার, মায় ডুবোচরও আমার। এহেন বলয়গ্রাসে নিত্রা-রা কবে থেকেই ক্ষমতার পূজারি। প্রশ্নাতীত যে ক্ষমতার পতন নেই। সেই পতনকল্পনা ঘুণাক্ষরেও আসে না, সে-তুমি যদি কোনো লক্ষণচিহ্ন দ্যাখো, তবে তোমার চোখে চালশে আর তোমাকে পাগল সাব্যস্ত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
প্রেম, যৌনতা এবং তা নিয়ে ছেঁদো আবেগের যেই বেলুনে আমরা অভ্যস্ত- তা মাসুমুল আলমের বিবিধ গল্পে ফেটে যায়।
এবং আমরা তার ধারাবাহিক বিকাশ দেখি তার সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ ‘বরফের ছুরি’এর বিবিধ গল্পে।
‘শীতগ্রীষ্মের স্মৃতি’ গল্পে আমরা যেমনটা দেখতে পাই- সংসারের আবহমান কমপ্লিকেশনস; তাকে কোনভাবে হলেও টিকিয়ে রাখবার বাসনায় অবধারিতভাবে যৌনতা হয়ে পড়ে নিয়মতান্ত্রিকতার দোষে দুষ্ট আর আট দশটা মামুলি সাংসারিক কর্মকাণ্ডের সমতুল্য। যৌনতার সকল সৃষ্টিশীলতা কেজো সাংসারিক ডিনামিক্স উদ্ভুত প্রেক্ষিতের কাছে পরাভূত হয়ে সংস্কারে পরিণত হয়; যার একমাত্র উদ্দেশ্য তখন পরিবারের নড়বড়ে ও আত্মপ্রবঞ্চক কাঠামোটিকে ধরে রাখা। উল্লিখিত এই গল্পটিতে এবং আরো কিছু গল্পে একটি ভিন্ন বিষয়কেও মাসুমুল আলম দক্ষভাবে ডিল করেছেন। সরকারী প্রশাসনের বিবিধ অভ্যন্তরীণ জটিলতাও ক্ষমতায়নকে কীভাবে প্রকটিত করে তা আমরা অবলোকন করি ‘হত্যাকারী’গল্পটিতে। যৌনতা ও ক্ষমতায়নের প্যারালাল একটি সম্পর্কও গূঢ়ভাবে উপলব্ধি করা যায় তার ‘কামধেনু’গল্পটিতে। পাওয়ারসেন্ট্রিক শিল্পসাহিত্যাঙ্গনের দিকপালসমূহ এবং তাদেরকে ঘিরে ক্লাইম্বার ও কৃত্রিম স্বভাবের প্রমিলাগণের সরব উপস্থিতির আখ্যানে আমরা বিস্মিত হইনা বটে; কিন্তু তা আমাদেরকে নিশ্চিতরূপে আঘাত করে। কেনোনা এই বিষয়টিও সেসকল ইস্যুর মতোই যার সম্পর্কে আমরা সম্যক ধারণা রাখি কিন্তু যার সম্পর্কে আমরা স্বার্থগত কারণে নীরব থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
মাসুমুল আলমের গল্পে ঘটনাপ্রবাহ প্রায়শই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায়না। একটি নির্দিষ্ট দৃশ্য বা কিছু ইমেজকে ঘিরেও তার গল্পসমূহ আবর্তিত হতে পারে। কিন্তু সেসকল গল্পে তেমন কিছু না বলেও বেশ খানিকটা বলে ফেলা বা ইঙ্গিত প্রদানের একটা প্রয়াস আমরা অবলোকন করে থাকি। তার ‘দর্শনীর বিনিময়ে’গল্পগ্রন্থের সর্বশেষ গল্প ‘প্রদর্শনীঃ ১০ সেকেন্ড’বা উপরিউক্ত গল্পগ্রন্থের ‘সবুজ করুণ ডাঙ্গায়’গল্পটিতে আমরা এই প্রবণতাটি লক্ষ্য করে থাকি। বড় কোন প্রেক্ষাপট নেই, বিশেষ কোন ঘটনাপ্রবাহও দেখা যায়না; কিন্তু এর মাঝেই প্রচুর ইঙ্গিত চোখে পড়ছে। অনেক রকমের ইশারা। যার প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারা প্রায় অসম্ভব।
আমরা মাসুমুল আলমের ৩টি গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো যদি পর্যবেক্ষণ করি তবে বিষয় ও ফর্ম বিচারে অনিবার্যভাবেই ভিন্নতা অবলোকন করে থাকবো। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মতে, গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ সাদৃশ্যতা রয়েছে। সেটা হলো- ব্যক্তিমানুষের জীবনের বিবিধ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি; যেগুলাকে বিষয় এমনকি জীবনের সুবিধাল প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেও আমরা প্রায়শই উড়িয়ে দিয়ে বা তুচ্ছজ্ঞান করে অভ্যস্ত- তার অনেক কিছুই আমাদেরকে ও আমাদের জীবনকে ভেতরে ভেতরে পরিচালিত করে। একে সম্ভবত আন্ডারগ্রাউণ্ড রিয়েলিটি হিসাবে অভিহিত করাটা ভুল হবেনা। মাসুমুল আলমের বিভিন্ন গল্পে সেই তার ছাপ স্পষ্ট বলেই আমি মনে করি। যে কারণে আমার মনে হয় কোন সচেতন পাঠক যিনি সঙ্গত কারণেই গড়পড়তা পাঠকের বিভিন্ন সংস্কার থেকে মুক্ত; মাসুমুল আলমের গল্পে সেই বেনিথ দা সারফেস রিয়েলিটির সন্ধান তার জন্য যুগপৎভাবে আনন্দদায়ক ও থট প্রভোকিং হয়ে থাকবে। তার ভবিষ্যৎ গল্পগুলোর সম্ভাব্য বিবর্তন যে সেই আন্ডারগ্রাউণ্ড রিয়েলিটিকে বাইপাস করবেনা- এই কথাটুকু বোধকরি নিরাপদে বলাই যায়। ফলে, মাসুমুল আলমের গল্পসমূহের বিবর্তন এবং তাতে পাঠক হিসাবে আমাদের সমৃদ্ধ হবার সম্ভাবনায় আমরা আশাবাদী হতেই পারি।
মন্তব্য