উলুখড় থেকে ২০১১ সালে মাসুমুল আলমের যখন প্রথম গল্পের বই প্রকাশ পেলো তার অনেক বছর আগে থেকেই মাসুমুল আলমকে একজন কমপ্লিট গল্পলেখকরূপে চিনি। কেননা ততোদিনে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনগুলোর পাতায় পাতায় তার গল্পের মেজাজগুলো পূর্ণ উৎকর্ষতায় উজ্জ্বল। ‘নামপুরুষ ও অন্যান্য’− এই নামের প্রথম বইটির ভেতরে সম্ভবত: কুড়িটির মতো গল্প ছিলো আর ছিলো মোজাই জীবন সফরীর আঁকা একটি দুরন্ত প্রচ্ছদ। আসলে তার বইয়ের কথা বলতে চাইছিনা, চাইছি তার এক একটি গল্পের কথা, এক একটি উপন্যাস বা আরো আরো নানাবিধ লেখার কথা। একটি লেখার ভেতরেই একজন কথাসাহিত্যিক কতোটা এবং কীভাবে নিহিত থাকে− তার কথা। নব্বই দশকের প্রারম্ভিককালেই প্রতিশিল্প প্রকাশ পেতে শুরু করলো। লিটল ম্যাগাজিন ওরিয়েন্টেডে তখন সুবিমল, সন্দীপন, উদয়ন, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, ইলিয়াস সহ আরো অন্যান্য ঝাণ্ডাবাহী লিজেন্ড লেখকদের নাম কানের কাছে ঘুরঘুর করছে। দেবর্ষি সারগি’র নাম তখনো শোনা হয়নি। ঠিক ঐ সময়ে ঐ সময়কালে ঠিক ঐ উদীয়মান যৌবনে মাসুমুল আলম লিখে ফেললো ‘মাকড়সা এবং অন্ধকারের গান’− এর মতো পেকে যাওয়া একটি মারাত্মক নিরীক্ষাধর্মী গল্প। আহ্ কী ভঙ্গি! জাস্ট ঐ কম বয়সেই মাসুমুল আলমের হাতে এমন ভাষাভঙ্গি কীভাবে হস্তগত হলো!− যা একজন লেখককে অর্জন করতে হয় নিরন্তর সাধনায়। প্যাটার্নটি ঝুঁকিপূর্ণ ফলে হয় কী, তার ভাষার ভেতর ঢুকে যেতে যেতে পাঠকের আগ্রহ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুরুতেই মাসুম এমন একটি পথের আনন্দে পথে হাঁটলো যেখানে শব্দ এবং বাক্য তার পায়ের নিচে পাড়া খেতে খেতে ভীষণ আশ্রয় পেয়ে গেলো নতুন গদ্যধারায়। ফলে আকাশ আর পাতাল এক বিছানায় নেমে এলো বিনা দ্বিধায়। যেনবা এই লেখক ঐ বাড়ার সাহিত্যকে তো কোনো ধারই ধারে না, বরং সে যা লিখবে তা সাহিত্য হতে বাধ্য।
কিন্তু এখন বুড়ি একটানা গোঙিয়ে অথর্ব শকুনির মতো অমঙ্গলের কালো ছায়া বিস্তার করে, মড়ক-ডাকা ইঁদুরের মতো লালাসিক্ত ঠোঁট ঝুলিয়ে বিলাপ চালিয়ে যেতে থাকে। পাশের ঘরটিতে, তখন, প্রাণবীর্য অন্ধকার জরায়ু মুখে পতিত, প্রোথিত হলে পর রতি-ক্লান্ত ছেলে এবং ছেলে-বউ কোলকুঁজো বুড়ির একনাগাড়ে খিনখিনে বিলাপ শুনতে শুনতে হয়তো-বা আবার ঘুমিয়ে যায় কিংবা বিরক্ত হয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে।(গল্প: ‘মাকড়সা এবং অন্ধকারের গান’)
ছানাগুলিকে এক-একদিকে পাঠিয়ে মাকড়সা-মা অপেক্ষা করে রইলো। খাবার দেখা মাত্র একটি ছানা সুতোয় টান দিলে মাকড়সা-মা সেদিকে ধাবিত হতে গেলে অপরদিক থেকেও টান পড়লো। আবার অন্য আরেক দিক হতেও টান পড়লো। ছানা-সকল মা-কে আকাঙ্খা করে সব সুতোয় তীব্র টান দিতে থাকলে মাকড়সা-মায়ের শ্বাসরোধের উপক্রম হলো। সুতোর এইসব তীব্র টান খেতে খেতে মীরা বুড়ি হয়ে গেলো। লোকজ গল্পের গল্পটুকু নিয়ে এমন একটি প্যারালাল গল্প যার ভেতর আছে স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্খা আর যৌনতার ক্রাইসিস আর আছে নিয়তির মতো অমোঘ বিলাপ। গল্পে গভীর দেখা আছে। সত্য নেই, যেহেতু শিল্পে সত্য বলে কিছু নেই। বলাবাহুল্য এই সত্য খুঁজতে গিয়ে আমাদের অনেক অনেক লেখক কলমের উপর শুধু বলপ্রয়োগ করে চলেছেন। কলমের অশ্রুর প্রতি সহমর্মী হতে পারেননি। মাসুমুল আলম সত্য খোঁজেননি। তার নিবিষ্ট দেখার ভেতরেই রয়েছে জীবনের অমোঘ দশা− দশার অশ্রু। মাসুমুল আলমের কমবেশী সকল গল্পগুলোর তলায় এমন একটি ভঙ্গি আছে, কী ভাষাগত কী ফিল্ডের ডেপ্থগত− একটা তুমুল উপন্যাস সংলগ্ন হাওয়া প্রবাহিত হয়। বোধ করি সেটা দোষের কিছু নয়, পরন্তু, সেটা গুণের দিকে ঝুঁকে গিয়ে গল্পকে বাড়তে না দিয়ে বিদিক আঁটোসাটো করে রাখে। এই সংহত রূপটি লেখকের পাতার পর পাতা বৃদ্ধি না করে শিল্পগত অভিযাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এমনকি তার উপন্যাসের ক্ষেত্রেও অভ্যন্তরীণ অনেক ডিটেইল থাকা সত্বেও ঐ আঁটোসাটো রূপটি ছেড়ে চলে যায় না। ‘স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা’ এমন একটি গল্প− পাঠক খুব মনে রাখবে। মনে রেখে আবার ভুলেও যাবে। এবং ফের ভুলে গিয়ে আবার মনে রাখবে। কী অদ্ভুত তাই না?
খবরটি যেদিন জেলা শহরে পৌঁছলো উত্তুঙ্গ আন্দোলনের মুখে সেদিনই দেশের প্রধান সামরিক শাসকের পতন ঘটে গেছে। হৈ চৈ আর ককটেল ফাটিয়ে জয়োল্লাস প্রকাশ করছে জনগণ। টি-স্টল আর ময়দানের আড্ডায় লীন ‘বন্ধুরা’ সেদিনও নীরবে বসে ছিল: রিমি তাহলে আবার ফিরে আসবে এবং রোহিনীর মতো জলের তলে জল আলো করে নতুন স্বৈরিণীরূপে তাদের মাঝে আবির্ভূত হবে। ততদিন এই মৃত নদী আর ধুলোওড়া শহরে তার জন্য কয়েকটি সামান্য করুণার্দ্র অন্তঃকরণ হয়তো প্রতীক্ষা করে থাকবে!(গল্প: ‘স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা’)
অভিঘাত সৃষ্টিকারী রিমির অজান্তেই রিমির সৌন্দর্য ও গানের গলা শিল্পীসমাজে ছড়িয়ে দিতো কাম-উত্তেজনা নাকি প্রেম? রিমি তা’ বোঝে এবং বোঝার একটা তার আলাদা কায়দা আছে। ২য় স্বামী ডুবে মারা যাবার পর রিমি ফের শিল্পীদের চোখে কামদেবী হয়ে উঠলো। রিমি কী জানতো রিমির ভেতরেই রয়েছে গোটা সামরিক শাসকের মতো এক যৌন শাসক। তার সুমধুর কন্ঠের নেপথ্যে ছড়িয়ে থাকতো মায়াবী প্রেমের অনির্ধারিত আকর্ষণ। আর সেই আকর্ষণে ডুবে যেতো শহরের যতো নারী বিবর্জিত শিল্পীসমাজ। মূল গল্পের আড়ালে আড়ালে রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামরিক শাসনের পরিস্থিতি ও শিল্পীসমাজের ভেতরগত সংকট শুধুমাত্র একজন নারীকে ঘিরে লেখক যেভাবে গল্পের ফুলটি ফুটিয়ে দিলেন তা সত্যিই শুধু দক্ষতার ব্যাপার না, দেখার ব্যাপার। শেষে গিয়ে লেখকের নিজস্ব শূন্যতাবোধ ফের গল্পটিকে আরো এক নতুন মাত্রার জন্ম দেয়। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্বেও সমকালীন ঘটনার প্রেক্ষিতে তার গল্পভাষা এমন সাবলীল অথচ দুর্গম পথের অভিযাত্রী হয়ে ওঠে তা যেন বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে রইলো। ফলে ঐ ঝুঁকিটাই লেখকের আসল পুঁজি হয়ে ওঠে। মাসুমুল আলমের হ্যান্ডেলিং ক্ষমতাটা দেখার মতো। লাল ঘোড়াটা দাবড়ে দেয় ঠিকই কিন্তু বাক্য থেকে বাক্যের দূরগামী কানেকশন বজায় থাকে পরিপূর্ণভাবে। তীর্যক ভাবটা শুধু তীর্যক থাকে না− ওটা ভঙ্গিতে অবতরণ করে। মানুষের সমাজ বাস্তবতায় যে সমাজটুকু পাওয়া যায়, তার অলিগলি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক যৌথ যাপনের ভেতর দিয়ে যে নাগরিক চোখ পৃথিবীর মাটিতে ঘুমায় আর জেগে ওঠে, সেই চোখকে তিনি এক অনন্য ভাষার ভেতর ঢুকিয়ে দেন। তার ভাষায় অন্তর্গত চর্চা তো আছেই আর আছে সেই চর্চার আড়ালে ভাষাকে আরো চর্চাহীন করে তোলা। মানে তার ভাষা ঠিক কৃষিকাজের মতো নিয়ম মেনে মেনে বীজ বপন করে না বরঞ্চ মাসুমুলের ভাষাভঙ্গি অরণ্যের মতো বিস্তারময় যেখানে বৃক্ষরাজীর কোনো নিয়মকানুন নেই তবে ঝরাপাতার পতন আছে। সেই পতনই তার ভাষা। গদ্যের ঋজুতা আর কবিতার বোধ একে অপরকে থাপড়াতে থাপড়াতে মাসুমুল আলমের ভাষা ভীষণ অ্যালকোহলিক হয়ে ওঠে।
মাসুমুল আলম লিটল ম্যাগাজিনের একজন ঘনিষ্ঠ লেখক। লিটল ম্যাগাজিনের তিনি প্রবক্তা নন অথবা শিল্পগত কোনো দার্শনিক অবস্থানে নিজেকে ফিক্সড রাখেননি বা ঐ অর্থে তিনি একজন এক্টিভিস্টও নন অথচ নবসৃষ্টির নবধারায় সচল থেকেছেন তার সাহিত্যকর্মে। লেখা না বাঁচলে যেমন লেখক বাঁচে না। তিনি লেখাকে বাঁচিয়েছেন। ফলে তিনি নিজে জীবন্ত। লিটল ম্যাগাজিনের শুধুমাত্র আন্দোলনমার্কা কিছু বহুল ব্যবহৃত জীর্ণ বাক্য রচনা করে তিনি ধামাধরা বিশুদ্ধ লেখক হতে চাননি। পরন্তু তিনি লিটল ম্যাগাজিনেরই ভরসা হয়ে রয়েছেন। অ্যাজ অ্যা কনসেপ্ট লিটল ম্যাগাজিন দুরন্ত, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কাজ দিয়েই তাকে জীবিত করতে হয়। শিল্প সৃষ্টি ব্যতীত কোনো শিল্প আন্দোলন টিকে থাকতে পারে না বা সিন্ডিকেট দিয়ে তোমার ভাত কাপড় বা পুরস্কার জুটে যেতে পারে, কিন্তু বাবু,− শিল্প আন্দোলন তাতে প্যারালাইজ্ড হয়ে যায়। বড্ড আনন্দের কথা, মাসুমুল আলম নিরন্তর সেই শিল্পের কাজটিই করে চলেছেন ফলে হয় কী, লিটল ম্যাগাজিন স্বত্বাটিও কখনো তাকে ছেড়ে চলে যায় না। আমাদের সেলিম ভাই মানে কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ প্রায়ই একটি কথা বলেন− “একজন লেখকের জন্য লিটল ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিনের জন্য লেখক নন।”− কথাটি হান্ড্রেড পারসেন্ট আমি মানি। সত্যিই তো, লেখক যদি লেখায় না দাঁড়ায় তবে আন্দোলন দাঁড়াবে কী রূপে! মাসুমুল আলমের ‘সমাপতন’ গল্পটি যখন পাঠকদের হাতে পৌঁছলো পাঠকরা ভীষণ আলোড়িত হন। কেননা গল্পের ভেতরেই সেই আলোড়নটা ছিলো। বাক্যের অন্তর্গত গঠন, বিশেষ্য-বিশেষনের অভ্যন্তরীন খেলা, সর্বনাম থেকে সর্বনাম আর ক্রিয়ার অহিংস প্রয়োগ, গল্পের ভেতরে পাল্টা গল্পের ঋজুতা এমনকি গল্পটি যখন শেষ হয়ে যায় তখনও শেষ বাক্যটি হেঁটে যেতে থাকে সর্পের মায়াবী দেহে।
আমার নাম টাইগার।আমার মা দুই ভাতারের ঘর করে মোট ৩ সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আমি দ্বিতীয় পক্ষের ছোট ছেলে। আমার মায়ের মেদস্ফীত বয়স্থা শরীর বেলুনের মতো অহংকারে শুধুই ফুলতে থাকে, কেননা তার দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত বড় পোলাডা নামজাদা উকিল আর কী যেন বার এ্যাট ল এবং পি এইচ ডি। তো, আমার মতো বখাটে পোলার খোঁচায় কিংবা কুখ্যাতিতে বাতাস বেরিয়ে গেলে সেই বেলুনটা প্রায়ই চুপসে যায়। চুপসে থাকে। আর যে লোকটা অনেকদিন হাওয়া হয়ে থাকার পর বাইরের লোকের মতো জীবনে একবারই আমাদের বাড়িতে এসে বাইরের ঘরে বসেছিলো চুপচাপ, একবেলা খেয়ে চলে গেছিলো− সে যে আমার আব্বাহুজুর তা অনেকদিন পর বুঝেছিলাম। নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার পর ঐ একবারই আসছিলো।(গল্প: ‘সমাপতন’।)
গল্পের দ্বিতীয় কেন্দ্রিয় ক্যারেক্টার টাইগার অথবা টাইগার বিল্লাল। তার আসল নাম বেলাল, বয়স ২২। বেলালের বাবা একাব্বর মুন্সী, বয়স ৭২। বাহোত্তারা বা ভাদাইম্যা বলে খ্যাত তার বাবা। ভাদাইম্যা বাবার যোগ্য উত্তরসূরী বখাটে পুত্র বেলাল। বেলালের বড় ভাই সফল উকিল। একই বাবার দুই পুত্র দুই জগতের। গল্পের প্রথম কেন্দ্রিয় ক্যারেক্টার বেলালের বাবা বাগেরহাটের খান জাহান আলীর মাজারের খাদেমগিরি ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়। রাস্তার মোড়ে বুট পালিশ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। চোখ ধাঁধানো স্তনঅলা বানুর সাথে প্রেম হয়। বানুর মা মায়মুনা বেগমের অশেষ আপত্তি থাকা সত্বেও একাব্বর মুন্সী বানুকে বিয়ে করে। যদিও বানুর আগের পক্ষের একটি সন্তান ছিলো। একাব্বর মুন্সী আগে বিবাহিত ছিলো কিনা গল্পে তা’ বলা হয়নি। বানু বলছে− ভালোবাসা; আর মা তার বিপরীতে বলছে− আমার মেয়ে রাজকইন্যা আর তুই একটা ফকিন্নির পুত। তবু বানুর দৃঢ়তায় ঐ ভাদাইম্যার সাথেই বানুর বিয়ে হয়। এবং ক্রমান্বয়ে দুটি সন্তানের মালিক হয়ে যায় তারা। বানুর সঙ্গে একাব্বর মুন্সীর যৌন প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও মনে মনে একটি আশ্রয় পাওয়ার মনটাও ভীষণ লক্ষযোগ্য। তারপর বানুর মুখে শুধুই বিষ:− “অন্য মাগি দ্যাকলেই তোমার মূলা খাড়ায় যায়”। অতঃপর নিরুপায় একাব্বর মুন্সী সবাইকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো। এই সাধারণ ঘটনা কেনো অসাধারণ হয়ে উঠলো!? প্রকৃত অর্থে গল্পটি অভিনব বিষয়ের জন্যে নয়, বিষয়বস্তুর সাথে শিল্পবস্তুর যে ইনার কেমিস্ট্রি তা পুরো গল্পটিকে পূর্ণ অন্তর্ভেদী করে তুলেছে। একটি ক্যারেক্টার অবলীলায় দুটি ক্যারেক্টার হয়ে যায়। আর দুটি ক্যারেক্টার আসলে তো দুটি নয়। তারা আসলে একজনই। একাব্বর মুন্সী পুত্র বেলালের ভেতর বিলীন হয়ে গেলো। বোর্হেসের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু তবু বোর্হেস নয়। লেখক ঘটনার ভেতরে ঘটনা বলে যাচ্ছেন। যেন কেন্দ্রিয় ক্যারেক্টারটি ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে পরিপার্শ্বের আরো আরো চরিত্রের ভেতর। বর্তমানের ভেতর অতীতও যেন বর্তমান হয়ে উঠেছে। এমন একটি মহাকালের বাস্তবতা সামান্য এক টুকরো সময়ের ভেতর ঢুকে গিয়ে বাক্য এগিয়ে যাচ্ছে তীব্র মনোজগতে।
‘বরফের ছুরি’ গল্পগ্রন্থটি মাসুমুল আলমের একটি টার্নিং পয়েন্ট গল্পগ্রন্থ। লেখক নিজেকে ছাড়িয়ে তার অন্যতর স্টোরিলাইন কাঠামোয় ভাষাভঙ্গি আরো তীব্র অথচ অনুচ্চ হয়ে উঠলো। গল্পের বাক্যগুলো পাশাপাশি অবস্থান করেও কোনো কথা বলে না, নীরব থাকে অথচ এক অন্তর্গত আলাপে মেতে ওঠে। ঠিক যেন মনে হয় কোনো চরিত্র নেই, প্রেক্ষিত নেই এমনকি বাক্য-শব্দ কিছুই নেই, শুধু হু-হু করে গল্প উঠে আসে। একটি নিরাকার গল্প। সমকালীন বাতাশ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তা ফুসফুসে ঢুকে যাচ্ছে। গল্পের ভেতরে আরো আরো গল্প। আরো আরো প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা, আত্মগত সংকট আর সংশয়, স্মৃতি আর যৌনতা, ক্ষুৎ ও পিপাসা একটি চাকায় ঘুরে ঘুরে অন্তহীন ঘোরা আবার একই সাথে তার পরম্পরা ভেঙে ভেঙে আবার ঘোরা। যদি সেটা গল্পের কক্ষপথ হয় তবে নিশ্চয়ই তার পরিধির দূর অবস্থানে একটি সূর্য আছে। ঐ সূর্য কেন্দ্রে পৌঁছনোর কোনো তাড়াহুড়ো নেই কিন্তু ধাবিত হওয়ার একটা আনন্দ আছে। ‘বরফের ছুরি’র সকল গল্পগুলো ভীষণ ধাবিত করে পাঠকের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দূর অতল পাঠককে। যৌনতার ফুল ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয় আমাদের প্রতিটি ভাতের প্লেটে।
মাসুমুল আলমের তিনটি উপন্যাসের ভেতর একটি হলো ‘মৌন ধারাপাত’। আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি উপন্যাস। বইটির পেছনে মৌন ধারাপাত নিয়ে কবি সুহৃদ শহীদুল্লাহ একটি গভীর পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনা লিখেছেন। সত্যি কথা বলতে কী এরকম আলোচনা আমাদের খুব অভাব রয়েছে। আমি শুধু অনুভূতিটুকু ব্যক্ত করবো। লাউ গড় গড় লাউ গড় গড়− এরকম একটি অদ্ভুত ধ্বনি দিয়ে উপন্যাসটি শুরু হলো। যে ধ্বনির ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে আলেকজান বুড়ির সমগ্র জীবনের হেঁটে যাওয়ার শব্দ। কী বলবো, গোটা উপন্যাসের সকল শব্দ-বাক্য কেনো যেন মনে হয় ঐ লাউ গড় গড় লাউ গড় গড় ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি। একটি স্মৃতিবাহী আখ্যান কীভাবে তারিয়ে তারিয়ে আলেকজান বুড়ির পায়ের সাথে সাথে তাল রেখে আমাদের মনের ভেতরের বর্তমান মনকে নিয়ে হেঁটে যায়। ভেবে দেখার মতো স্ট্রাকচার। শুধুমাত্র এই ভঙ্গির কারণে মৌন ধারাপাত উপন্যাসটি মৌনতা ভেঙে কথা বলে। লাউ গড় গড় লাউ গড় গড়− এই লোকজ ধ্বনিটি অন্য আর কোনো কিছুর জন্য নয় একমাত্র মৌন ধারাপাত উপন্যাসের সিগনেচার হয়ে রইলো।
সম্প্রতি মাসুমুল আলমের প্রকাশিত ‘কথাপরিধি: ২২ পয়েন্ট বোল্ড ও অন্যান্য’ গদ্যগ্রন্থটি অত্যন্ত অভিঘাত সৃষ্টিকারী মাল্টি ডাইমেনশনাল বই। আমার দেখা মতে এরকম বিস্ফোরক গদ্যের টুকরো টুকরো রূপ এ যাবৎ বাংলা সাহিত্যে অতি বিরল সংযোজন। এছাড়াও এ বইতে আছে অনুবাদ গল্প, গ্রন্থ আলোচনা, সাক্ষাৎকার আর লেখকের একটি মৌলিক গল্প। আকারে ছোট হলেও আসলে ঐ আন্ডার কারেন্টসমৃদ্ধ গদ্যগুলোর কথাই বলছি। লেখক সমকালীন বাংলা সাহিত্য আর বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তীর্যক ভঙ্গিমায় ঠেঙিয়েছেন মূলত ঐসব সাহিত্যিকদের যারা শুধু ২২ পয়েন্ট বোল্ড মনস্কতায় মার্কেটিং তৎপরতায় ব্যস্ত। নানাবিধ প্রশ্ন, বিদ্রুপ আর ঠাট্টা একটা মোক্ষম পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে কাল্পনিক দেবী চৌধুরানী, মিঃ চৌধুরী, ওস্তাদ বা বস− এইসব সম্বোধনে লেখক সুতীব্র কথাগুলো বলেছেন আসলে নিজেরই সঙ্গে। সাবঅল্টার্ন এই গদ্যগুলোর গদ্যভাষা যেন আরো একটু এগিয়ে লেখকের কলমকে দমশক্তি বাড়িয়ে দিলো।
মন্তব্য