পড়া এবং তার আফটার এফেক্ট, ভাল লাগা/মন্দ লাগা জানান দেয়া ইনফরমাল ভাবে সহজ,কিন্তু ফরমাল কোন কিছু লেখা আমার জন্য বেশ কঠিন।সব কাজের জন্য একটা প্রি এক্যোয়ার্ড স্কিল সেট লাগে, এই কাজের জন্য যা আমার নাই।
মাসুমুলের এ যাবত প্রকাশিত ৩ টি উপন্যাস নিয়া আমার সামান্য মতামত, যার সাথে অন্য যে কারো ভিন্ন মত থাকবে, আর সেটাই সুন্দর।
র্যাম্প, বার- বি-কিউ আর কানাগলির হুলো
র্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো প্রচ্ছদ: শাহীনুর রহমান |
মাসুমুলের প্রথম উপন্যাস। মনে হয়েছে খুব সচেতন ভাবে মাসুমুল তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্পেস আর টাইমের ভেতর এই লেখার জাল বুনেছেন। জাল শব্দটা সচেতন ভাবেই ব্যাবহার করলাম।
এই লেখার যে স্পেস, সেটা এই দেশের যে কোন মফস্বল শহরকে আইডেন্টিটিক্যালি রিপ্রেজেন্ট করে।যেন এটা আমার শহর যেন এর সব কটা চরিত্র আমার মোটামুটি চেনা।
মাসুমুল যা করেছেন তা হলো একটা শহরের কোন একটা উপ অংশের থেকে কিছু চরিত্র তুলে নিয়েছেন যাতে এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, দার্শনিক দিকগুলি যে কোন পাঠক আন্দাজ করতে পারেন।
সমাজের ভেতরে কিভাবে একি অর্থনৈতিক পেরিফেরিতে থেকেও বাংগালী /বিহারি ইনসাইডার আর আউটসাইডার থেকে যাচ্ছে,কিভাবে সংস্কৃতি ধ্বংস করে ধর্মীয় মৌলবাদ জাগতে শুরু করছে,কিভাবে রাজনীতির সাথে অর্থনৈতিক শক্তির যোগাযোগ ঘটছে।কিভাবে একজন প্রান্তিক মানুষকে দিয়েই তার শ্রেণীকে শেকল পরানো হচ্ছে।কিভাবে সমাজের সব শ্রেনীর মানুষ তার লোভ আর বিকার দিয়ে ক্ষমতা বলয়ের কাছে নিজেকে আরো বেশি এক্সপ্লয়েটেড হওয়ার রাস্তাটা তৈরি করছে।
এই গল্প মোশিউরের আবার এই গল্প এই লেখার যে কোন চরিত্রের হলেও একি ভাবে আমাদের কাছে ঐ সময় আর ঐ স্থানিক বোধের জন্ম দিত।
প্রথম উপন্যাস হিসাবে মাসুমুল তার লেখার সময় আর স্থান নির্বাচন করেছেন দারুণ বুদ্ধিমত্তায়।
এর ভাষা আমাদের জানিয়ে দেয় যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েই মাসুমুল লিখতে এসেছেন,কোন বাড়তি ন্যারেটিভ কোন বাহুল্য শব্দ এড়িয়ে গেছেন সাধু সক্ষমতা দিয়ে।
একটা অভিযোগ, লেখাটা টানা, এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে যাওয়ার গতিটা স্মুথ হলেও যতিহীন।আমার মত পাঠকের জন্য দম নেয়ার খানিকটা যায়গা রাখলে ভাল হতো।
এই উপন্যাসের একটা লাইনঃ
"তবু,ভাগ্যিস, প্রতি বছর একই সময়ে একই সংগে বাপ-ব্যাটা সবাই উন্মাদ হয়ে যায় না, তাই রক্ষে,!"
তাইতো, এই ভূখণ্ডের সবাই আমরা এখনো এক সাথে উন্মাদ হয়ে যাইনি,তাই রক্ষে।নইলে কি হতো ভাবেনতো একবার।
মৌন ধারাপাত
মাসুমুলের এই লেখাটা আমার সবচেয়ে প্রিয়।
মৌন ধারাপাত প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর |
এতো নৈর্ব্যক্তিক ভাবে কোন লেখককে তার চরিত্রদের নিয়ে ডিল করতে দেখাটা প্রায় অর্গাজমিক আনন্দের পর্যায়ে পরে। টেক্সটের সাথে নিজেকে কোন ভাবেই ইমোশনালি যুক্ত না করেও যে চরিত্রগুলির অন্তরের অন্ধকার আর সামান্য যে আলো আছে তা দেখা যায় সেটা মাসুমুল করে দেখিয়েছেন নিখুঁত ভাবে।বাংলায় এই রকম লেখা আমার পড়ায় কম। মানে এই যে লেখক নিজেকে এলিয়েনেটেড করে সব চরিত্র আর তাদের প্রায় নিয়তি নিদৃষ্ট জীবন যাপনের কথন লিখছেন সেটা অসম্ভব সুন্দর হয়ে উঠছে, সত্য হয়ে উঠছে আর এই সুন্দর হয় উঠা সত্য হয়ে ওঠার ভেতর লেখকের নিজের কোন আবেগ নাই। এই যে নির্মম শীতলতা, এর ফলাফল মৌন ধারাপাত।
এই লেখা পড়লে একই সাথে সব চরিত্র আর তাদের ভ্রমণ কে চেনা আবার অচেনা লাগে। এই ম্যাজিকটা মাসুমুল কিভাবে করলেন সে এক বিস্ময়।
সবচেয়ে যা আকৃষ্ট করে তা হলো এই লেখায় কোন ড্রামাটাইজেশন নাই, কোন কি মোমেন্ট নাই,কোন গন্তব্য নাই। যেন এক চরাচরের ভেতর কিছু মানুষ প্রায় পূর্ব নির্ধারিত ছকে জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছে।লেখক এখানে স্রেফ দর্শক।
যেটুকু যাদু এই লেখায় আছে সেটা ঐ ককুরের অন্ধ হওয়ায় আর আলেকজান ও আজমল কবিরের পাশাপাশি বসে থেকে নৌকা খুঁজে পাওয়ার মধ্যে। আর সামান্য এই যাদুটুকু উপন্যাসের আত্মা হয়ে ওঠে।
মৌন ধারাপাত কে আমি যে কোন নামকরা আন্তর্জাতিক লেখার পাশে রাখবো, কিন্তু রাখতে আমরা পারছিনা আর সে দায় লেখকের না,রাষ্ট্রের।
সামান্য আক্ষেপ (পাঠক এক নাপাক অতৃপ্ত আত্মা), মাসুমুলের সমৃদ্ধ ভাষাটা যদি আর একটু ব্রাত্য করা যেত!
বই থেকে এক লাইনঃ
"মন য্যানো তাঁতিবাড়ির চরকা।"
কি অমোঘ,তুলা থেকে বয়ন পর্যন্ত, মানুষের এই মন।
আরব্যরজনীর ঘোড়া
এই লেখাটা আমি সম্ভবত তিনবার তিনভাবে পড়েছি, কারন একেক বারের বোধ আগের বারের চেয়ে আলাদা, ব্যাপারটা কনফিউজিং।
আরব্যরজনীর ঘোড়া প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর |
মাসুমুল এই লেখায় যৌনতার অন্তর মহল ই ধরতে চেয়েছেন , তিন ভিন্ন প্রেক্ষিতের নারীর মনো কথনে ভর দিয়ে।
এই লেখায় এসে মাসুমুল তার সক্ষমতার জায়গা, তার ভাষা ছেড়ে দিয়েছেন চরিত্র গুলির চিন্তাকে স্পষ্ট করে ধরতে এবং প্রায় কঠিন এক কাজ, একজন পুরুষ হয়ে এক লেখায় তিন রমণীর বেড়ে ওঠা,যৌনতা নিয়া তাদের সম্ভাবনা আর বিপন্নতা একি সাথে ধরতে চেয়েছেন এবং বেশ অনেকটা সফলও হয়েছেন।
কিন্তু আমার সমস্যা এই লেখা নিয়া অন্য জায়াগায়। একে নারীর মনোকথন তায় যৌনতা, তো এই লেখায় আমার আরও অনেক উন্মত্ততা চাই,চাই আরো রগর আর বমি, বিকার।আমরা জানি তো মানুষের মন এর চেয়ে কদর্য!সভ্যতা আমাদের সেই কদর্যতা আরো বাড়িয়েছে, তার নৈতিকতার ভার, অবদমনের বিষাদ দিয়ে।
মাসুমুল অতটা এগোন নি। পুরো ল্যাংটা হওয়ার কথা ছিল, মাসুমুল খানিক আব্রু রেখে দিয়েছেন।
এই সব বলে আমি এ বোঝাচ্ছিনা যে এই বই পড়ে আমার খুব খারাপ সময় কেটেছে,বা এই লেখা আমার চিন্তাকে স্পর্শ করেনি,বরং নারীরা পুরুষকে কিভাবে দেখছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কি কি সুন্দর আর সাহস ডেকে আনছে, সে সব ভাবিয়েছে, অন্য পাঠককেও ভাবাবে।
সব নাচের আলাদা সৌন্দর্য আছে,আবার এটমোস্ফেয়ার ও নাচের চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। এই লেখায় আমার উন্মত্ত, উন্মাদ নন কোরিয়োগ্রাফড নাচ দেখতে পেলে ভাল লাগতো, আরো।
এই বইয়ের শেষ লাইনঃ
"যদি কখনো দিগন্ত ফুঁড়ে উচ্চকিত হ্রেষা শোনা যায়..."
শুনছি এবং আরো তীব্র ও মায়াবী স্বর আর সুরে আরো শুনতে চাই, মাসুমুল, শিল্পযাত্রা অনেক দূরের পথ হাঁটুক, প্রত্যাশা।
মন্তব্য