পুরস্কার হাত ফসকে কদাচিৎ সঠিক লেখকের কাছে গেলেও যে বা যারা এটা দিচ্ছেন তাদের সবকিছুই ওউন করতে হবে, সব কর্মকাণ্ড তখন যুক্তি দিয়ে জায়েজ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে কিনা?
-মাসুমুল আলম
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: প্রথমেই জানাতে চাই আমাদের এই আড্ডার বিষয়টিকে কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করা হয়েছে।
প্রথম পর্ব: যে উত্তরতম হেঁটে আসো
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: এই পর্বে আপনার কাছে জানতে চাইছি আপনার লেখালেখি শুরুর গল্পটা। কখন এবং কীভাবে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করলেন? লেখক হবার ইচ্ছেটা কি ছোটোবেলা থেকেই ছিলো?
মাসুমুল আলম: ভালো। এখন তো নিউ নরমাল সিচুয়েশন।
শুরুর কথা? খুব ছোটোবেলা থেকেই বাড়িতে দেখতাম পড়াশোনার এক পরিবেশ। আমার বাবা ওনার বই আছে, আর আমার ভাইয়েরা কেউ কবিতা লেখে, ছবি আঁকে কেউ।
ছোটোবেলায় আমি ছিলাম ধইঞ্চা, রোগা এবং আর সবার মতোই খেলাধুলা করতাম। শুধু যখন খুব জ¦র-টর হতো তখন ঐ বই পড়াটা হতো। তখন পাঠ্যবই মাফ। আগেই বলেছি বাড়ির সবাই লিখতো এবং হাতের লেখা সবার ভালো। আমার হাতের লেখা জঘন্য। ছবি আঁকা, কবিতা লেখা হবে না আগেই বুঝে গেছি। বাবা প্রচুর লিমেরিক লিখেছিলেন। না লেখালেখির কোনো পূর্ব পরিকল্পনা আমার ছিলো না।
তো, হঠাৎ-ই খেলাধুলা ছেড়ে দিয়ে বাড়ির বইগুলোতে ঢুকে গেলাম। পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতে শুরু করলাম। এটা খুবই প্রাচীন, প্রচুর বই আছে এবং সম্ভবত: বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি। বইয়ের জগৎ। ১৯৯০ তে দস্তয়েভস্কির ক্রাইম এ্যাণ্ড পানিশমেন্ট পড়লাম। এসএসসি’র পর আমার সেজো ভাই এটা পড়তে বললো। আমার মাকে আমি বিকেলবেলা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ডমরু-চরিত, পরশুরামের বই পড়তে দেখেছি : কজ্জলী, হনুমানের স্বপ্ন... এসব। দুপুরে খাওয়ার পর সন্ধের আগ পর্যন্ত বই পড়তেন মা। ছোটোবেলায় যা-যা পড়ার, সবাই যা পড়ে এবং পড়তেই থাকে কৈশোরযুবকাল অব্দি এবং সেই হ্যাংওভার অনেকের আর কাটে না। আমার তেমনটা হয়নি। আমি সিঁড়ি থেকে নেমে অথবা উঠে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো-তে ঢুকে পড়েছি; আর পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বাবা বই তুলে নিয়ে আসতেন। দেখছি তিনি দুপুরে ড. জিভাগো পড়ছেন। এক লিমেরিক ছাড়া কবি হিসেবে বাবা সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা আমার ছিলো না। অন্ত:মিল না থাকায় আধনিক কবিতা নিয়ে ওনার বেশ বক্রোক্তি ছিলো। কিন্তু আমাদের বাড়িতে ছিলো এমন সব বইয়ের সমাহার যে, সস্তা জনপ্রিয় ধারার বইপত্র সেগুলো না, এখন বুঝি সিরিয়াস ধারার বইই ছিলো সেগুলি, এবং আমি ঘটনাচক্রে ওগুলো কারো সাজেশন ছাড়াই এমনিই পড়তে শুরু করেছিলাম।
শুরু থেকেই লেখালেখির ইচ্ছে? এটা স্পষ্ট কখনো বুঝি নি। কেবল পড়াতেই আনন্দ। ফলে, সমবয়সীদের সাথে অনিবার্য বিচ্ছিন্নতা, এবং বড়োদের সাহিত্য, বড়োদের জটলা, সমাবেশ, কথোপকথনে কান পেতে রাখার বিশ্রী অভ্যাস ও আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগও ছিলো একটু। পড়া হতো প্রকাশ্যে এবং গোপনেও। পাঠ্য বইয়ের নিচে বই। রসময় গুপ্তের চটি বা জলসা যেমন। এ অভিজ্ঞতা অবশ্য ছেলেদের কমবেশি সবারই আছে।
যশোরে তখন পাড়া-মহল্লায় নববর্ষে বা একুশে ফেব্রুয়ারিতে পত্রিকা বের করার একটা রেওয়াজ ছিলো। পাবলিক লাইব্রেরির হল রুম, শুনেছি সেখানকার সাহিত্য আসরে একদা বিভূতিভূষণও আসতেন গোপালপুর, নদীয়া থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় আমার কৈশোরযুবকাল পর্যন্ত দেখেছি সেখানে শনিবাসরীর সাহিত্য আসর হয়ে আসছে। এখনো হয়। কাছের সাহিত্য পরিষদেরও এরকম শুক্র বা রবিবাসরীয় আসরে সাহিত্যের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিগণ এসে আলো করতো। কিন্তু আমি কোথাও কখনো যাই নি। দর্শক মাত্র। প্রচুর সাহিত্য পত্রিকা বের হতো। আমি কোথাও ছিলাম না। ঐ পত্রিকায় যারা লিখতো তারা দৈনিকেও লিখতো। দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে লেখার সিঁড়ি ছিলো ঐ সাহিত্য পত্রিকাগুলো। ঈদ সংখ্যা বিচিত্রা, রোববার, পূর্ণিমা, মাটি, শৈলী, কোলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হলে চাপা আনন্দে সেদিনের সাহিত্য আসর নাকি আলোকিত হতো শুনেছি।
মাধ্যমিকের পরপরই তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, মিখাইল শলোকভ, ওয়ালীউল্লাহ্ পড়েছি। ইন্টারমিডিয়েটে এসে বুঝলাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে ন্যারেটিভ ও সিনট্যাক্স ট্রান্সফর্ম হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকে। পরবর্তী কালে এই টেক্সট দেখি শহীদুল জহিরের গল্পধারায়, তাঁর অনবদ্য জাদুবাস্তবতাসহ, তাঁর রিপিটেটিভ টেক্সেটে।
১৯৯১ তে স্থানীয় আলোচিত এক পত্রিকায় পরপর ২ সপ্তাহে দীর্ঘ একটা গল্প ছাপা হলো। ঐ একবারই। আবার, এতো যে জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতা নিয়ে তখন আলোচনা, সরগরম, তো ভাবলাম দেখি তো পাঠিয়ে। ১৯৯২-৯৩ সালে, বাংলাবাজার সাহিত্যপাতায়, পরে জেনেছি নাসরীন জাহান তখন ঐ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। সে গল্প ছাপা হয়ে গেলো। এরকমভাবে চলছিলো।
তো, যশোরের চলতি সাহিত্যপত্রিকায় ধারাবাহিকতার বাইরে গিয়ে ঐ শনিবাসর-রবিবাসরের অংশগ্রহণকারী মূলত: কবিদের একটা গ্রুপ নিজেদের মতো করে ‘প্রতিশিল্প’ করার সিদ্ধান্ত নিলো। তখন, ভৈরব নদের পাশে দড়াটানা মোড়ে শ্রী বিভূতোষ রায়ের একটা বইয়ের দোকান ছিলো ‘কালপত্র’ নামে। জীবিকার সন্ধানে কুমিল্লা থেকে আগত শতাব্দী হাবিব তখন উনি ‘দিশা বা বিদিশা’ নামে সাহিত্যের একটা ‘ভাজপত্র’ বের করেছিলেন, (পরে উনি সৈকত হাবিব হন) ‘কালপত্র’ দোকানে কাজ করতো। ‘কালপত্র’ কেন্দ্রিক আড্ডা থেকে সর্বজনাব সৈকত হাবিব, মারুফুল আলম, মহিউদ্দীন মোহাম্মদ, অসিত বিশ্বাস, কবির মনি, এঁদের উদ্যোগে ‘প্রতিশিল্প’ বের হলো। আর ‘প্রতিশিল্প’ প্রথম সংখ্যায় ছোট কাগজের ‘চারিত্র্য’ বজায় রাখতে রাখতে দ্বিতীয় সংখ্যায় এসে একইসাথে ‘ছোটকাগজ’ এবং ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ প্রবণতার দিকে যেতে থাকলো। ফলে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রথমেই সৈকত হাবিবসহ বেশ ক’জন সক্ষোভে অভিমানে সরে গেলেন। প্রতিশিল্পের ১ম সংখ্যা থেকেই আমার লেখা ছিলো। যেখানে সবাই ছোটকাগজ বা সাহিত্য পত্রিকায় হাত মকশো করে, চোখকান খুলে মোটামুটি পাকনা হয়ে বঞ্চনাবোধ আর অভিমান-অভিযোগের পাহাড় নিয়ে সব এক সময় বড়োকাগজে যায়, সেখানে আমার ছিলো উল্টোযাত্রা। কই মাছের কানকো ধরে শুকনো ডাঙ্গায়। আমি জানি আমি যেভাবে লিখতে বা বলতে চাই, যে ন্যারেশনে আমার পঠনপাঠনের অভিজ্ঞতায় ততোদিনে আরো যাঁর যুক্ত হয়ে গেছেন, তাঁদের মতো স্টোরিটেলিং, কাউন্টার স্টোরি, এন্টি ন্যারেটিভ টেক্সট, ধরাকে সরা জ্ঞান, রুচিবোধের থোড়াই কেয়ার করতে গেলে এ ধরণের লেখার দু:সাহসিক প্লাটফর্ম একমাত্র ‘ছোট কাগজ’। আর সবকিছুর পেছনে রয়েছে আনন্দ। আনন্দ কোথা থেকে আসে? নাহলে আর কেন লিখি।
দ্বিতীয় পর্ব: সমুদ্দুরে চোখ
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: আপনি এমন একজন লেখক আপনাকে অনেক প্রশ্ন করেও প্রশ্নরা ফুরিয়ে যায় না। তার মানে আপনি নিজেই অফুরন্ত। ধরা যাক “কথা পরিধি: ২২ পয়েন্ট বোল্ড ও অন্যান্য” এটা এমন একটা বই মনে হয় যা সমাপ্ত হয়নি যেন বা এখনো লিখেই চলেছেন- এমন মনে হচ্ছে কেন?
মাসুমুল আলম: না, এটা একটা খুব বড়ো কথা হয়ে গেলো। এমন নয় বিষয়টা। অফুরন্ত কেন বলছেন, আমার স্বার্থপরতা, ছোটোলোকোমি সীমাবদ্ধতার অন্ত নেই। আসলে, শুধু লেখক হয়ে থাকাই কিন্তু ছোটকাগজের একমাত্র শর্ত না। আমি কখনো প্রেসে যাইনি, ছোটো কাগজ বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী বিষয়ে নীতি নির্ধারণী মিটিং-এ কথা বলতে পারি না অথচ এ তত্ত্ব পদ্ধতি বা অনেক সিদ্ধান্তই ভেতরে ভেতরে পছন্দ হচ্ছে না। মূলত: মিটিং জিনিশটাই পছন্দ হচ্ছে না। কতো কিছু আমার এন্টেনার ওপর দিয়ে চলেও যাচ্ছে। এবং সেলফ রেজিস্ট্যান্স: হয়তো জিনিশটা বুঝতে চাই না বলেই। ভালো লাগছে না বলেই তো। কিন্তু লিখতে তো আনন্দ পাচ্ছি। এটা কি স্বমেহনের আনন্দ? এবং তা কোনো প্রচলিত লেখাও না। সুতরাং, তখন উত্তর নেই- প্রশ্নের পাহাড়।
তবে, এটা ঠিক আমার “কথা পরিধি: ২২ পয়েন্ট বোল্ড” একটা ওপেন এন্ডেড বই। সমকালের অনেক বিষয়, শুধু তো শিল্পসাহিত্য না, অনেক কিছুই শিল্পসাহিত্যের আলোকে বোঝার চেষ্টা আছে বইটিতে। অনুষঙ্গে হয়তো বই নিয়ে টুকিটাকি কথা, চলচ্চিত্র বা নাটকের প্রসঙ্গ এসেছে। সাহিত্য, সাহিত্যিক সম্পর্ক ও সাহিত্যিক-রাজনীতি। একটা রিফ্লেক্সিভ ফিলিং থেকে “কথা পরিধি: ২২ পয়েন্ট বোল্ড” লেখা। বইটি আসলে দুই পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বটা প্রথম থেকেই শুরু। ১০৫টি ছোটো ছোটো লেখা আছে সেখানে। আমি আমার পাঠ-অভিজ্ঞতা, সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও সুলুকসন্ধান, সাংস্কৃতিক হালচালের সাথে সাথে আমার প্রতিক্রিয়া এবং সেই প্রতিক্রিয়ার সাথে শিল্পের কোনো মাধ্যমের সংযুক্তির বয়ান লিখেছি ক্ষুদ্র পরিসরে । বৈঠকি চালে। আড্ডার মতো করে, স্কেচি। এছাড়া, শিল্পসাহিত্য বিষয়ে যতোটুকু আমার কুলায় সেই আলোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু প্রবন্ধ, গল্পের অনুবাদ এবং সাক্ষাৎকার নিয়ে আরো একটা পর্ব। যেটা আসলে বইটির দ্বিতীয় ভাগ। এক হিসেবে এই বইটি পরিসমাপ্তিহীন। কেননা, এখনো আমি এরকম বিষয় নিয়ে ভাবছি, ভাবছি মানে লিখছিও তো। চলমান।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: আপনার “সমাপতন” গল্পটি আমাদের একটা প্রিয় গল্প। কেনো জানি মনে হয় এই গল্পের ভাষাশৈলী ও গল্পকাঠামো আপনার নিজস্বতাকে খুব বেশি চিনিয়ে দেয়, আপনি কি তা জানেন?
মাসুমুল আলম: আমার নিজের যেটুকু শুধু মনে আছে; একটু ক্যাসুয়াল ফর্ম মুখ-চলতি ভাষায় উত্তম পুরুষের টেক্সট ছিলো ওটা। ঢাকায় ফকিরেরপুল গরমপানির গলির নামকরণ নিয়ে একটা মনগড়া নাগরিক মিথ ছিলো। যেটা আমি আবার আমার মতো করে নিয়েছিলাম গল্পের ভেতর দিয়ে।
‘সমাপতন’ গল্পে নাগরিক মিশ্র ভাষার সাথে, পরিবেশের সাথে, বাগেরহাট খান জাহান আলীর মাজারের কুমিরের দেখভাল করা পলাতক এক খাদেমের কথাবার্তা ছিলো। একটা দীর্ঘ বিরতির পর ‘শিরদাঁড়া’ থেকে যখন নকীব ভাই (কবি আহমেদ নকীব) একটা গল্প চাইলো তখন এটা লেখা। একদিনে। হ্যাঁ, এর স্ট্রাকচার আলাদা, ডি-রেইলড বাবা আর ছেলের অন্তর্বয়নের চিন্তাস্রোতে পৃথক দু’টি প্যারালাল টেক্সট। এখানে একটা কথা বলি: আমার প্রথম বইটিতে মোট ২০টি গল্প ছিলো। ১৬৭ পৃষ্ঠার একটা বই। ঐখানেও একটা পর্ব বিভাজন আমি করি। ’৯৪ সালের পরে ১০/১২ টা গল্প লেখার পরে, ২০০৭/২০০৮ এর দিকে আমার এই গল্পটার স্ট্রাকচার এবং ভাষা অটোমেটিক পাল্টে যায়। যেতে থাকে। এরকম আরো দশটি গল্প।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: আবার মাঝে মাঝে মনে হয় “ষষ্ঠীর খেলা” এর মতো দুরন্ত গল্প এই আপনিই লিখলেন। আপনার নিজ এলাকা থেকে একটু আলাদা তবে ভাষা ভঙ্গিটা কিন্তু আপনারই আছে। তাই না বলুন?
মাসুমুল আলম: এটা পাঠক ভালো বলতে পারবে। মফস্বল শহর বা মেট্রোপলিটন শহরের বাইরে গিয়ে একটা গ্রামীণ ভূ-গোলের মধ্যে, প্রাগৈতিহাসিক এক অন্ধকারের মধ্যে একটা নারকেল গাছকে কেন্দ্র করে অন্ত্যজ আর অভিজাত এই সাদাকালো ফ্রেমের মধ্যে কিছু আঁচড় কাটার চেষ্টা আর কি! ভাষ্যের সাথে বর্ণনার সাথে অন্ত্যজ মানুষের সমান্তরালে আরেক সমাপতন কালোমুখ হনুমান আর লোকভাষ্যে ষষ্ঠী দেবীর মিথের কোলাজ এই গল্প।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: যদ্দুর মড়ে পড়ছে “তিমি” গল্পটার পরপরই আপনার গল্পচর্চায় একটা ইউ-টার্ন নেয়। সম্ভবত: এই পর্বে প্রথম গল্পটি হলো “পানির সহজ সংকেত”। এবং তারপরে এরকম আরো ছোট ছোট গল্প আপনি রচনা করেছেন। যেগুলি নিয়ে “বরফের ছুরি” নামে একটা আস্ত একটা গল্পের বই এই বছরই প্রকাশ পেলো। মজার ব্যাপার হলো এটা আপনার সাথে মানিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে সম্ভব হলো প্লিজ একটু বলবেন?
মাসুমুল আলম: ‘তিমি’ নামে যে গল্পটির কথা আপনি বলেছেন সেটা আমার “দর্শনীর বিনিময়ে” নামে একটা গল্পগ্রন্থের। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এ বইটির শেষে “পানির সহজ সংকেত” এবং “প্রদর্শনী: ১০ সেকেন্ড” নামে ২টি গল্প আছে। সবগুলোই খর্ব রচনা। ২০২০ সালে “উড়কি” থেকে প্রকাশিত “বরফের ছুরি” বইয়ের ১২ টি গল্প আসলে “দর্শনীর বিনিময়ে”-র শেষ ২টি গল্পের সমগোত্রীয়। এ ধরনের গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়া, লেখা বা লিখতে পারা আমার নিজের জন্যই একটা অভিজ্ঞতা, তুমুল এক্সট্যাসি-র। আমি অণুগল্প বা ফ্লাশ ফিকশন বা মাইক্রো ফিকশন লিখবো অথবা বোর্হেসের মতো কম্প্যাক্ট আধুনিক প্যারাবল; এরকমটা ভাবিনি। প্রকৃতপক্ষে, আমার লেখাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, আমি আগে থেকে আসলে জানিও না।
শুধু একটা তীব্র সংবেদন, একটা ঘোরের মধ্যে আমি একটানা লিখেছি এগুলো। দীর্ঘদিন আমি বাসায় একা ছিলাম। পড়াশোনা, টিভি দেখা, এটা সেটা করতে করতে আমি হঠাৎই লিখতে শুরু করতাম। এবং হয়ে যেতো। একটা বীজভাবনা এবং এটা ইমেজ হয়তো শুধু আমাকে হন্ট করতো। আকৃতিগতভাবে ছোট, ফিকশন-নন ফিকশনের মতো, ঠাসবুনোট টেক্সেটের তীর্যক কল্পবাস্তব, মুখের ভাষায় কিছু একটা বলা। গল্পের ন্যারেটিভ বাদ দিয়ে কিছু একটা। সারফেস আর ইনার লেভেলের জার্নি, ট্যুইস্ট রেখেই আন্ডারস্টেটমেন্ট।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: “লাউ গড় গড়” লাউ গড় গড়” -এই অদ্ভুত ধ্বনিটি দিয়ে উপন্যাসের শুরু। শুধু তাই নয়, পুরো আখ্যান জুড়ে ধ্বনিটি ফিরে ফিরে আসে। “ মৌন ধারাপাত” - এ সকল স্মৃতিরা মনে হয় যেনবা এই মাত্র ঘটছে। কায়দাটা কিন্তু দারুণ। তাই না?
মাসুমুল আলম: “মৌন ধারাপাত” আমার লেখা প্রথম উপন্যাস। আর প্রকাশিত হিসেবে তৃতীয়। প্রথমে এটি প্রতিশিল্পে প্রকাশিত হয়েছিলো।
এ উপন্যাস একটি মহল্লাকেন্দ্রিক যেখানে একজন ভিখিরি বুড়ি, একজন কুষ্ঠরোগী, ’৪৭ সালের উদ্বাস্তÍ মানুষ, একঘরে রাগী এক অধ্যাপক/ পণ্ডিত যিনি বিলিতি ইঁদুর পোষেন, একজন মাছ চাষী, যার নতুন কাটা পুকুরের রাক্ষুসে পিরহান মাছ, মুক্তিযুদ্ধের আগে ডাকাত কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, দেশ স্বাধীনের পর তার জীবিকা - দুধেল গরুর ওলান সাবাড় করে দ্যায় রাক্ষুসে মাছ, এই খবরে অন্ধ লোকটির স্বাধীন দেশে আর কোন পেশা না থাকায় লাঠি হাতে প্রবল বিক্রম দেখায়। এখানে আছে বোম্বাই হাজি, মহল্লার ভেতর আছে কবিরাজি শালসা বিক্রির জন্য ক্যানভাসারসহ একটা গায়কদল। আছে স্কুল, মসজিদ, আর একটা মরা নদী, যার পাড়ে ফি বছর বেদের দল এসে তাঁবু ফেলে; পাড়ায়, ভর দুপুরে আসে শিঙা লাগালো বেদে নারী আর সাপুড়ে ও কোনো কোনো দিন হিজড়েরা। ডাক বিভাগের এক যুবকপিয়নের পয়েন্ট অব ভিউ। আর তার সঙ্গে ভিখিরি বৃদ্ধার স্মৃতি। একেকটি ঘটনা থেকে স্মৃতি জাগ্রত হয়। সেই বৃদ্ধার চলনের সাথে লেইট মোটিফের মতো ঐ ‘লাউ গড় গড়’ ধ্বনি। একজন ক্ষমতাবান মানুষ ঐ এলাকা সফর করতে আসবেন বলে জীবিকার প্রয়োজনে বেরোনো ঐসব উদ্বাস্তু ও ভাসমান মানুষকে আটকে রাখা হয় পরিত্যক্ত এক বাড়িতে। কিন্তু মরানদীতে বান আসে, সেই কবে থেকে মৃত নদের পাশে ফসলি জমি, নদীর তীর ধরে ভিখিরি বুড়ি হেঁটে যায়। তার চলা আটক রাখা যায় নি। ডাক বিভাগের পিয়ন শিক্ষিত যুবক তার মাকেই প্রকৃতির মধ্যে হেঁটে যেতে দ্যাখে। ফের ঐ ‘লাউ গড় গড়’। এর সাথেই ’৪৭ থেকে ’৫২ আর ১৯৭১ সবই ঘটনাসূত্রে আসে। যেমন, ঝড়টড় না এমনিই এক বিকেলে বটগাছ উপড়ে গেছিল আর বুড়ির ছেলে অন্ধ হলো। ফলে, বুড়ি বটগাছ উপড়ে যাওয়াটা ভোলে না, যার সাথে তার ছেলের অন্ধত্বের সম্পর্ক। অথবা প্রতি বৈশাখে শুঁয়োপোকা এবং সজনের ফলন দেখে একদা মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফর্মার গাছ থেকে পড়ে নিহত স্বামীর কথা মনে হয়। এই সব স্মৃতি ভিখিরি বুড়ির চলন আর “লাউ গড় গড়” ধ্বনির সাথে মিলেমিশে এমন একটা ঝিম-আচ্ছন্নতা নিয়ে আসে; ‘মৌন ধারাপাত’-এর ন্যারেটিভে স্মৃতিগুলি দূরাগত থেকে নিকট অতীত করার চেষ্টা। যেন ঘটমান বর্তমান। পড়ার সময় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কি এই পরিক্রমণ?
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: যৌনতা দেখার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে আপনার। সেটা আপনার লেখায় নক্ষত্রের মতো ছড়িয়ে আছে। একঘেয়ে যৌনভাবনার বিপরীতে “আরব্যরজনীর ঘোড়া”-য় অন্য ধরনের যৌনতা ফসলের মতো ফুটছে যা তিনজন নারীর আপন মনের সাথে কথা- উপন্যাসটির টোটাল কাঠামোসহ এইটা আপনার কাছে ক্যামনে ধরা দিলো?
মাসুমুল আলম: তিনজন নারীর মনোলোগের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে উপন্যাসটি। তাদের জীবন-জীবিকা বিরাজমান সমাজবাস্তবতা ও রাজনীতির সাথে মানুষের সম্পর্ক ও যৌনতা নিয়ে পৃথকভাবে বর্ণনা দিয়ে যায় ভিন্ন বয়সী তিনজন নারী। পাঠকও হয়তো বিশ্বাস করে ঐ বিশ্বস্ত বর্ণনায়, একটা বাস্তবতার ভিত্তি তৈরি হতে হতে যাত্রাদলের বিবেকের মতো উটকো একটা চরিত্র এসে ঐ নারীচরিত্র ও বিবৃতিকেও সংশয়গ্রস্ত করে তোলে। নিজেকেই সে বিশ্বস্ত করে তোলার চেষ্টা করে তাদের কথামালা শেষে। কিন্তু এরকম ভিত্তিও শেষ পর্যন্ত টেকে না যখন ঐ চরিত্রটি নিজেই বলে সে আসলে ঠিক বলে নি। সত্য ও মিথ্যা গুলিয়ে যায়। শুধু সম্পর্ক, শুধু প্রেম, শুধু যৌনতা। ব্যাপক ইউফোরিয়া। প্রেম ও যৌনতার ভরকেন্দ্র এ উপন্যাসের ভেতর তাদের আকাঙ্খার অশ্বহ্রেষা জেগে ওঠে। সত্য/মিথ্যাও তখন গুরুত্বহীন হয়ে ওঠে। মারিও ভার্গাস ইয়োসা-র সেই The truth of lies এর মতো। ‘আরব্যরজনীর ঘোড়া’ উপন্যসের তিনটি পর্বে তিনটি আলাদা আখ্যান আবার আন্ত:সংযোগের মাধ্যমে এটা একটা টোটাল আখ্যানও। প্রতিটি পর্বের শেষে আগের প্রতিষ্ঠিত সত্য ভেঙে যায়। বলতে বলতে সত্য পুনর্নিমিত হয় আবার তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হতেই ফের ঐ আরেকজনের কথাসূত্রেই আলগোছে, ক্যাসুয়ালি আগের বাস্তবতা পুরো ধ্বসে যায়। সত্যমিথ্যা মিলে এক বিভ্রম তৈরি হয় এক্সিসটিং স্ট্রাকচারগুলো ভেঙে দিয়েই। বইটি ২০১৬ সালের বইমেলায় যখন বেরিয়েছিলো তখন সেরা অনলাইন জরিপে ১০টি বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
আমি যৌনতা নিয়ে ডিল করবো একরকম একটা প্রবণতা নয়, আসলে এটা হয়ে গেছে এ উপন্যাসে। বা, পরবর্তীকালের অনেক গল্পে। চরিত্রের অন্ত:সত্তা দেখতে চাওয়ার চেষ্টা থেকে স্ট্রাকচারটাও লিখতে লিখতে এভাবে চলে এসেছে। হ্যাঁ, শুধু জৈবিকতা নয়, যৌনতাকে আমি দেখার চেষ্টা করি মানুষের জীবনপ্রণালীর একটা নির্ণায়ক হিসেবে। যেমন কারো কারো জন্য এই নির্ণায়ক হয় পলিটিক্স বা স্পিরিচ্যুয়ালিটি। যেমন, মিলান কুন্দেরা বা আইজ্যাক বাশিভিস সিঙ্গার।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: এইবার একটি কঠিন পরীক্ষা। “মানুষ আসলে স্মৃতির সমষ্টি।” বলুন তো আপনার কোন লেখায় আপনি এই অমর বাক্যটি লিখেছেন?
মাসুমুল আলম: ‘মৌন ধারাপাত’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ঐ ভিখিরি বুড়ি, যার কাছে ঘটনাই স্মৃতি। অন্যদের কাছেও কি তাই না? ভালো বা মন্দ স্মৃতি। সুখস্মৃতি। দু:খস্মৃতি। যেমন, সমকালের কোনো ঘটনা বা কথাসূত্রে অতীত তার কাছে আছড়ে পড়ে। তখন অতীত বর্তমান হয়ে যায় এমনভাবে। মানুষ তো আসলে স্মৃতি-ই লেখে।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে আমাদের শহরের নাথপাড়া, বেজপাড়া, ভৈরব নদের পাড়ে জেলেপল্লীতে আতংক তৈরি হয়। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে টিন পেটাতে পেটাতে লাঠিমিছিল যায়, ৬ ডিসেম্বর রাত্রিবেলা। ১৯৪৬ এর দাঙ্গা, যা আমার মায়ের স্মৃতিতে তখনো জাগরুক, তাঁরও অনেক হিন্দু সহপাঠী, প্রতিবেশী দেশান্তরী হয়। ১৯৪৬ আর ১৯৯২ এর আতংকিত দিনযাপনের সমরূপতা নিয়ে আমার একটা গল্প ‘ভৈরোঁ’। উদ্ধৃতিটা ওখান থেকে নেয়া। আবার, ২০১৯ এ ‘তিমি’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম, যেটা আপনি আগেই উল্লেখ করেছেন, এটাতেও দেখছি রিপিটেটিভ এই বাক্যটিই এসে গেছে।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: আমি দীর্ঘদিন ধরে শুধু লিটলম্যাগাজিনে লেখালেখি করছেন। শুরু থেকেই কি ভাবতেন লিটল ম্যাগাজিনই আপনার সাহিত্যচর্চার জায়গা হবে? লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিকূল পরিস্থিতি আপনার লেখালেখির ক্ষেত্রে কখনো প্রভাব ফেলে কি?
মাসুমুল আলম: দ্যাখেন, ‘প্রতিশিল্প’ প্রথম সংখ্যা যেটা বেরিয়েছিলো ৯৪ সালে, সেখানে আমার ‘মাকড়সা এবং অন্ধকারের গান’ নামে গল্পটা ছাপা হয়। তখন প্রতিশিল্পে ১২/১৩ জনের একটা গ্রুপ। পরে, এদের সাথে এসে যুক্ত হন ’৮০-র দশকের কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ। ওনার তখন একটিই বই ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’। ওনার সাহচর্য ও চিন্তা পুরো গোষ্ঠীর ওপর এরকম প্রভাব তৈরি করে যে, ২ মলাটের মধ্যে ছাপা হলেই সেটা ছোটকাগজ হয়ে যায় না। ছোটকাগজের একটা দার্শনিক অভিমুখ থাকে। ফলে স্থানীয় সাহিত্যপত্রিকা, সে যতোই শুদ্ধ মিডি-ম্যাগ হোক, সেখানে ৫০’র কবি অপ্রতিষ্ঠানিক ধারার কবি আজীজুল হক যতোই লেখেন বা স্থানীয় কিন্তু রাজধানীবাসী তারকা-কবিরা, যেই ওখানে লিখুক না কেন, এগুলোকে আমরা আর কিছুই মনে করলাম না। এতে ওনাদের সাথে একটা দূরত্বও তৈরি হলো।
আর নিজের অনুসন্ধিৎসায় আমার পাঠরুচি, পাঠাভ্যাসের পরিবর্তন এটা আগে থেকেই ঘটছিলো। তখন আমার চারপাশে সবাই ছিলো কবি। তবু অগ্রজ কথাসহিত্যিক সেলিম মোরশেদ আর কবি পাবলো শাহি এঁদের দু’জনের সাথেই আলাপ হতো। কিন্তু মুভমেন্টের স্বার্থে এই লেখা, এই বই, এই লেখক, এদের প্রাধিকার দিয়ে কথা বলতে হবে; প্রচার করতে হবে, আমি তা করতাম না। আড্ডায়ও না। বরং পড়ার পর ভালো লাগলে যার লেখাই হোক আমি পঞ্চমুখ হয়ে কথা বলতাম। অনেক লেখকের নামধাম উচ্চারণ করতাম যারা ছোটকাগজের না। ফলে, এটা একটা সমস্যা বলতে পারেন। আর শুধু লেখা পড়েই লেখা না, কেবল পাঠচক্রের মতো আড্ডা না। আরো অনেক শিল্পমাধ্যম বিশেষ করে, নিয়মিত সিনেমা দেখাটা তখন আমাদের এক্টিভিজমের অংশ ছিলো। তৈরি হওয়ার জন্য ফাউন্ডেশন। এবং তখন ঠঈজ-র যুগ, আমার নানা ধরণের ছবি দেখতাম। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান আমরা বহু আগেই শুনেছি। তারেক শাহরিয়ার, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, শহিদুল আলম, পারভেজ হোসেন, নুরুল আলম আতিক, আশিক মুস্তাফা, এঁরা এসে আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিয়েছেন তখন। খুলনা, নড়াইল বা কোলকাতায় যাওয়া আসার পথে যশোর ছিলো ওঁদের ট্রানজিট পয়েন্ট।
একসঙ্গে এতোগুলো মানুষ দিনে-রাতে কখনো টাউন হল মাঠে, কখনো চা-দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। এই আড্ডা ছিলো প্রেরণাদায়ী। বহু দিনের প্রচল সাংস্কৃতিক বলয়ের প্রাকটিসের বাইরে গিয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক ধারণার বিপরীতে, প্রচলিত সাহিত্য পত্রিকার বাইরে গিয়ে প্রতিশিল্পের এই তীব্র অভিপ্রকাশ একটি গোষ্ঠীবাদী প্রতিষ্ঠানবিরোধী চারিত্র্য বুঝিয়ে দেয়। এতে আগেই বলেছি, শুরুর দিকে বেশ ক’জন সরে যায়। আর সাহিত্য-পত্র এবং স্থানীয় সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নাখোশ হতে থাকে। কেননা, তাদের শুক্র বা শনিবাসর বা রবিবাসরের অনেকে একদা ফি সপ্তাহ উপস্থিত থাকলেও এখন সচেতনভাবে ভিন্ন মতাবলম্বী। ‘গাণ্ডীব’-এর পরে ‘প্রতিশিল্প’-ই একমাত্র গোষ্ঠীবাদী ছোটকাগজ। যশোরে এর পরে ‘জঙশন’ এবং ‘সূর্যঘড়ি’ চলে আসে এই ধারাবাহিকতায়। বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রায়।
দ্যাখেন, লিটল ম্যাগের প্রতিকূল পরিস্থিতি আসতে পারে নানা কারণে। সামাজিক গোষ্ঠীবদ্ধ চেতনার বাইরে একান্ত ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, আকাঙ্খা ইত্যাদি কাজ করে যখন। কবি বা লেখক হিসেবে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে মনে করলেও এটা হয়। পূর্ণ স্বাধীনতার বাসনা থাকলে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী তত্ত¡ ও মুভমেন্টে একাত্ম হতে না পারা। মুশকিল হলো এগুলো নিয়ে আমার কোন সুনির্দিষ্ট চিন্তাও ছিলো না, অন্যের চিন্তারও শরিক হতে না পারার যোগ্যতাও একটা সমস্যা। সুতরাং, চুপ থেকে লেখা-ই ছিলো সার। ফলে, আমার মতো যদি কেউ থেকে থাকে লিটলম্যাগে, না ঘরকা না ঘাটকা, তাহলে এটা একটা সমস্যাই। আর গোষ্ঠীবদ্ধতার সমস্যা হলো, যৌথচেতনার নামে যৌথমমত্বের নামে, প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্পচেতনার নামে সবল কর্মী বা স্ট্রং এক্টিভিস্ট কিন্তু দুর্বল লেখকের ভারও বহন করতে হবে। দলবেঁধে চললে যা অনেক সময় চোখে ধরা পড়ে না। আর আমার মতো যাঁরা শুধুই লেখক; যারা কর্মী বা এক্টিভিস্ট নয়, কেবল লেখা, এক্সপেরিমেন্টাল বা ভিন্নধারার লেখাই (যদি) তাদের একমাত্র ইয়ে হয়, তবে, ‘ভৈরব বাঁচাও’ বা ভবদাহ জলাবদ্ধতা নিরসন আন্দোলনে যারা যায় না বা যাবে না, যাদের লেখাপত্র ছাড়া আর আর কোনো প্রকার এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিস না থাকায় লিটলম্যাগে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
তবে, এখন আর এমন সমস্যা-টমস্যা হবে না বলে আমার ধারণা। কারণ, ইশতেহারবাদিতার কনসেপ্ট দিয়ে লেখালেখির বিষয়টি এখন খুব কাজ করবে না তরুণ বা তরুণতরদের মধ্যে। এটা আমার মনে হয়। বরং প্রয়োজন এমন লেখা যার প্রতাপ থাকবে। পুতুপুতু পোয়েটিক ফর্মের ভালো টেক্সট লেখাই শুধু না, এবং শুদ্ধ বাক্য লিখতে পারাটাই শুধু না, ভালো লেখার যোগ্যতাই শুধু না, বরং ধক্ যেমন থাকতে হবে, তেমনি লেখককে হতে হবে নির্লোভও। লোভী মানুষ লিটলম্যাগে থাকতে পারে না।
আর অতোটা অন্তর্লীন না থাকার করণে ছোটোকাগজের উদ্ভুত সমস্যা প্রতিকূল পরিস্থিতি আমার লেখালেখিতে প্রভাব তৈরি করেছে নতুন ধরণের লেখার কন্টেন্টে; মানে লেখায়, কিন্তু লেখা তো বন্ধ হয়নি। আপনি হয়তো আমাকে ঘাপটি মেরে থাকা একুশে বইমেলা-কেন্দ্রিক মৌসুমি বিপ্লবীও বলতে পারবেন। কিন্তু জনাব, সেটা ভুল, আমি তাও না। আমার নিজের কিছু জিজ্ঞাসা, নিজস্ব কিছু সংকট, নিজস্ব এক ধরণের সংশয় আমি আমার লেখায় এক্সপ্রেস করি। সে লেখার ধরনটা আলাদা। স্বত:স্ফূর্ত। এটাই আমার কাছে শিল্প। এই বালই আমি করছি গত ২৬ বছর ধরে। আর তো কিছু না। আপনার ধরন আলাদা, আপনাকেও আমি পাঠ করি, হ্যাঁ, সম্মান করি।
আরও ‘প্রতিশিল্প’ ছাড়া গাণ্ডীব, দ্রষ্টব্য, অনিন্দ্য, দুয়েন্দে, জঙশন, সূর্যঘড়ি এগুলোই আমার লেখাপত্রের ক্ষেত্রভূমি। এর বাইরে কোলকাতায় ‘বাঘের বাচ্চা’, ত্রিপুরার ‘হারাকিরি’-তে আমি লিখেছি। ওয়েবজিনের মধ্যে উলুখড় এবং ওয়াকিং ডিসট্যান্স। সাকুল্যে এইই আমার বিচরণক্ষেত্র।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: গত ৪০ বছরে লিটল ম্যাগাজিন থেকে যেসব সাহিত্য জন্মলাভ করল, আপনার কি মনে হয় তা বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত হবে?
মাসুমুল আলম: দ্যাখেন, এটা ঠিক যে, লিটল ম্যাগ বাদে যেসব সাহিত্যপত্র রয়েছে সেখানে মুদ্রিত সিংহভাগ সাহিত্যই আসলে ট্রাডিশনাল। ইচ্ছাপূরণের গল্প বা কবিতা। কালেভদ্রে ২/১ জন এক্সপেরিমেন্ট করছি, এটা বোঝাতে চেষ্টা করেন মাত্র। অসাধু শব্দের প্রয়োগ সেখানে পাবেন না এসব শিষ্ট গো-রাখালদের লেখায়। মানে তাইই হলেই যে সাহিত্য, দৃশ্যমান ২২ পয়েন্ট বোল্ডের টেক্সটই যে এক্সপেরিমেন্টাল সাহিত্য তাও আমি বলছি না। আমি বলছি, আপনি জীবন্ত/জ্যান্ত ভাষার টেক্সট এদের থেকে পাবেন না। সোল-টা পাবেন না। আত্মশূন্য পারফেকশনিস্ট। হ্যাঁ, কখনো কখনো আপনি ‘বাহ্’ বলে মুগ্ধ হতে পারেন মাত্র। কিন্তু, এদের কাছ থেকে কোন প্রকার দু:সাহসী কিছু পাবেন না। নিজের কোন বিশ্লেষণ নেই, ঘটনার স্বাদুবর্ণনা আছে কেবল। এদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই প্রচল। পাঠকের বিনোদনের যোগানদাতা এরা। এরা ভদ্রলোকী সাহিত্য করেন। এর মধ্যে উৎকৃষ্ট আখ্যানরচয়িতা যারা, যারা ভাল কবি, তারা এই সমাবেশের মধ্যে হাতে গোণা। বিষয়টা কেবল ভাল লেখার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখার না। বিষয়টা দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা পদ্ধতির। আর গাদাগুচ্ছের সমাবেশের মধ্যে হাতেগোনা যারা ভাল লেখেন, তাদের লেখার মতো তাদের তো আমরা চিনি।
দ্যাখেন, কল্লোলের অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র মিত্রের পাশে জগদীশ গুপ্তও লিখতেন। এটা মনে রাখতে হবে জগদীশ গুপ্ত জগদীশ গুপ্তই। ব্যক্তি লেখকের প্রবণতাও একটি ফ্যাক্টর। এই প্রবণতা তাঁকে যে কোন স্থানিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও আলাদা করে দেবে। লিটলম্যাগ দুরবিন উল্টো করে দেখতে চাওয়ার দু:সাহসিক ডেপথ অব ফিল্ড। সেইসাথে সীমা অতিক্রমণের সাহস ও ভরসা যোগায়। কোনো বিগ হাউজের দৈনিক পত্রিকা বা সাহিত্য পত্রিকা অথবা মিডি-ম্যাগ সাহিত্যপত্রে এটা থাকবে না। কোমলবিহবল রোমান্টিক টেক্সটের বাইরে অপ্রচলের ধক্ তারা নিতে পারবে না। আর, পাঠককেও তৈরি হতে হয়, বস্! গত চল্লিশ বছরে সব শিল্পমাধ্যমের মধ্যে কবিতা, কথাসহিত্য, চলচ্চিত্র অর্থাৎ যেগুলো একটু ভিন্ন ট্র্যাকের মানুষ ধীরে ধীরে তা গ্রহণ করেছে। করছে। এবং সেগুলোই এখন আলোচ্য। যেমন, জগদীশ গুপ্তের সমকালে আলোচিত প্রতাপশালী অচিন্ত্যকুমার বা প্রেমেন্দ্র মিত্র এতো বছর বাদে আর আলোচ্য থাকছেন না। যতোটা প্রবলভাবে জগদীশ গুপ্ত। কিংবা যতোটা এসময়ে সেলিম মোরশেদ। বা ইচক দুয়েন্দে ওরফে শামসুল কবির, তাঁর ৭টি গল্পের যে ভার এবং একটি ছোটো উপন্যাসসহ তাকে আণ্ডাররেটেড করে রাখার দশা থেকে তিনি পাঠকের আলোচনায় উঠে আসছেন। না, আম-পাঠকের কাছে নয়। এঁরা তো আর শ্রমবিমুখ উইট আর হিউমারের সন্ধানে মজামারা ম্যাংগো-পিপলের জন্য শিল্প করেন না, ওস্তাদ!
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: অনেকে লিটল ম্যাগাজিনের মানে ব্লগজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিনের বিরোধিতা আছে বলে মনে করে। এ বিষয়টা নিয়ে আপনার মতামত কি?
মাসুমুল আলম: গুণগত পার্থক্য নির্ভর করছে ক্যারেক্টারের ওপর। ব্লগজিন বা ওয়েবজিন লিটল ম্যাগের চারিত্র্যই ধারণ করতে পারে। পার্থক্য থাকে দু’টি ওয়েবজিনের মধ্যে যেভাবে হার্ডকপিতে বিগ হাউজের দৈনিক বা সাহিত্য পত্রিকার সাথে লিটল ম্যাগাজিনের। একটা প্লাটফর্ম বা সাহিত্যসংঘ যা করে থাকে এবং দৈনিকে গল্প-কবিতা ছাপানোর জন্য চাতক পাখির মতোই অপেক্ষায় থাকে তার বা তাদের কাছে ঐ কোনো এক সাহিত্য পরিষদের রকমফের সাহিত্যক্যাফে বা পরস্পর বা গল্পপাঠ বা তীরন্দাজ বা ঐহিক বা অপরজন বা আপনজন বা আরো যা-যা, এসব, এদের অনলাইন, ওয়েবজিন, ব্লগজিন ঐ একই জিনিশ। এছাড়া, ওয়েবজিনের যারা সম্পাদক কাম কবি বা লেখক, তারাও জানে, প্রকাশ-উৎসাহী কবি বা লেখক তারা তার যে কোন লেখায় ‘আহা’, ‘অসাধারণ’ বলার জন্য রেডি, আর ঐ সম্পাদক/কবিও এতে অভ্যস্ত। এই হচ্ছে প্লট। তাহলে, এরকম ওয়েবজিন/ব্লগজিন, এঁদের আপনি কীভাবে ট্রিট করবেন, ওস্তাদ?
প্রকৃতপক্ষে, বিগ-হাউজ বা টিভিতে মুখ দেখিয়ে কথা বলার সংগুপ্ত বাসনা মেটানোর জায়গা হয়ে গেছে ইদানীং এই অনলাইন বা ওয়েবজিন। একে তো করোনাকাল, তাই বঞ্চনাবোধ থেকে এইসব ইচ্ছাপূরণের সাহিত্য করার জায়গা থেকে এরকম সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা এই অনলাইন বা ওয়েবজিনকে পুরো স্পয়েল করে দিচ্ছে। জিনিশটা ব্যাঙের ছাতার মতো গজালেই তো আর হলো না।
লিটল ম্যাগের সাথে ওয়েবজিনের কোন বিরোধিতা নেই। বরং কারা একসাথে বসে লিখছে বা ঐ অনলাইন লাইভে কারা একসাথে বসে স্বর্গনরক গুলজার করে চলেছে, এটাও দেখার ব্যাপার। বøগজিন বা ওয়েবজিন হলে বড়ো কাগজ - ছোট কাগজের পার্থক্যটা ঘুচে যাবে না। কে বা কারা ব্লগজিন বা ওয়েবজিন করছে সেটাই দেখার বিষয়। যে কেউ এটা করতে পারে। তাই বলে ছোটোকাগজে তো সবার লেখা ছাপা হয় না, তাই না? অনলাইনে গেলেই তো আর ছোট-বড়-মাঝারি-বাজারি-আহাজারি... সব গড়ে ‘হরিবোল’ হয়ে যাবে না।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: সিন্ডিকেটের বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন? একজন লেখকের জন্য আদৌ কি এর কোন প্রয়োজনীয়তা আছে?
মাসুমুল আলম: আপনি কি চান তার ওপর প্রয়োজনীয়তাটা ডিপেন্ড করছে। স্বীকৃতি, সম্মাননা, পুরস্কার, এন্থোলজিতে সংকলনভূক্ত হওয়া, ক্রোড়পত্র, পুজো বা ঈদসংখ্যার লেখার গোপন বাসনা এবং বাস্তবায়ন এবং করোনাকালে সঙ্গনীরোধহেতু ফেসবুক লাইভে ঠিকঠাক ডাক পড়–ক এটা চান তো? তারপর, টিভিতে, টকশোতে বাঘে-গরুতে একসাথে কথাবার্তা বলা, আলোচনা সভায় অতিথি হওয়ার আকাঙ্খা বয়:জ্যেষ্ঠ কেউ আপনার ওপর লিখুক, তারকাখ্যাতি, লেখা অনুষঙ্গে বিদেশের সাহিত্য মঞ্চে অংশগ্রহণ বা প্রমীলাসঙ্গ এসব চান তো? এই প্রয়োজন থাকলে সিন্ডিকেটের কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে, সিন্ডিকেট খুবই উপাদেয়। সিন্ডিকেট হতাশা দূর করে। সিন্ডিকেট যতো পাওয়ার সেন্ট্রিক হবে আখেরে ততো লাভ। এর লেজ বা অবশিষ্টাংশ হতে পারলে ভালো। একসময় পালে বাতাস বয়ে যাবে।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: লেখালেখির জন্য আড্ডা কি কোনো ভূমিকা রাখে?
মাসুমুল আলম: লেখালিখির শুরুর সময় আপনি যদি অতি তরুণ, এবং যদি আপনি অনুসন্ধিৎসু, এবং তরুণ পাঠক-কাম লেখকদের অংশগ্রহণে আড্ডার সুযোগ পেয়ে থাকেন, তবে এই আড্ডা আপনার কাজে লাগবে। তবে, আপনার ক্ষমতাকে পয়লা স্বীকার করে নিয়েই, আমি বলবো, এই আড্ডার ভূমিকা ব্যাপক। দেখবেন দিনরাত, এমনকি, উৎসবের দিন বা মৃত্যুময় শোকের বাড়িতেও একত্রিত হলে শেষমেশ ঐ শিল্পগত আলাপটাই এসে যাচ্ছে। এটা ভালো না?
‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা দীর্ঘজীবী হোক’ উৎকীর্ণ শার্ট, টি-শার্ট গায়ে, এবং প্রতিশিল্পের ৩টা সংখ্যা বেরিয়ে যাওয়ার পরও শ্মশ্রুময় মুখ হুজুর-মার্কা পাঞ্জাবি গায়ের চামড়ার সাথে অচ্ছেদ্যবন্ধনে আবদ্ধ, কতোরকম সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা কতোরকমের সর্বান্ত:করণ সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে দিন-রাত কিচাইন, আন্তরিক আড্ডা চলেছে ‘কালপত্র’ টাউনহল ময়দানে। এর মধ্যে বিকাল-সন্ধ্যায় সীমাবদ্ধ খণ্ডকালীন আড্ডাধারী হওয়ায় আপনার এডামটিজিং যে হবে না, তা না। হতেও পারে। সেক্ষেত্রে, আমি অবশ্য এতে কান দিতাম না। ঐ খণ্ডকালীন আড্ডাই ছিলো আমার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু দিনরাত এক করে নিয়মিত গভীর রাত অব্দি আড্ডা দিতো যারা তাদের স্বাধীনতা, সৌভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করতাম।
তবে, এই আড্ডা থেকে অনেক লেখার প্রেরণা আমি বাসায় নিয়ে গেছি। আড্ডা দিতে দিতেই হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আইডিয়া এসে গেছে। আড্ডা শেষে, একা বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই ভাবনার ফলাবর্তন ঘটতো পরবর্তীকালের কোনো লেখায়।
আর ২০০০ সালে শাহবাগের আড্ডা সে তো আরেক পর্ব। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে, এখানে আড্ডাটা হতো চলচ্চিত্রকর্মী এবং অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের বন্ধুদের সাথে। কিন্তু আজিজ মার্কেটের আড্ডাটা ছিলো নিয়মিত। আড্ডা থেকেও আইডিয়া পাওয়া যায় বলেছি। যে নিতে পারে, সে পারে। আর যে পারেনা, সে তো পারেই না। যে পারে পত্রিকায় নীরস কলাম থেকেও লেখার বীজভাবনা নিয়ে নিতে পারে। একই বিষয় নিয়ে আপনি ফিচার/কলাম যেমন পারবেন তেমন উপন্যাস লিখতে পারবেন গার্সিয়া মার্কেজের মতো। একেকজনের তরিকা বস্ একেক রকম। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী তো কখনো তাঁর ঐ এক পত্রিকা অফিসের চাকরি ছাড়া ঘর থেকেই বেরোননি, আড্ডা দেন নি কোথাও। গল্প লেখার বিষয় খুঁজতে গল্পশিকারী হননি। তবু, উনি নমস্য লেখক। নাজিব মাহফুজও তাই। উনি কখনো কায়রো শহরের বাইরে না গেলেও, এমনকি নোবেল নিতে না গেলেও, শহরের এক ক্যাফেতে এবং পত্রিকা অফিসে নিয়মিত বৈকালিক আড্ডা দিতেন। আড্ডাও নেশার মতো। আবার আড্ডা দিয়েই খুব যে আর্টিস্ট হতে পারবে এমন কোন কথাও কিন্তু নেই। লেখক হওয়া-টওয়া না, নির্ভেজাল আড্ডাও তো দেয়া যায়।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: সাহিত্যের ক্ষেত্রে পুরস্কার দেয়া ও নেয়ার প্রথাটাকে কীভাবে দেখেন?
মাসুমুল আলম: পুরস্কার তো একটা স্বীকৃতি। বিষয়টা হলো কে বা কার কাছে থেকে এটা নিচ্ছেন। যে কারণে সবার সাথে আপনি এক জায়গায় বসেন না বা সামাজিক কারণে বসলেও একাগ্রতা অনুভব করেন না, অন্তর্গতভাবে। তাহলে সাহিত্য-রাজনীতি বা সাহিত্যিক-রাজনীতিক কারণেও পুরস্কার নেয়া যেতে পারে। এই পুরস্কার আপনার লেখার জন্য বা আপনার লেখকসত্তার স্বীকৃতি আমি তা মনে করি না। পুরস্কারটি নিয়ে আমি/আপনি একটা সাহিত্যিক রাজনীতির সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে গেলাম। লবিং বা সিন্ডিকেটে না থাকলে আপনার নাম কিন্তু পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও উঠবে না, পাওয়া তো দূরের কথা।
দ্বিতীয়ত, পুরস্কারের তো একটা অর্থমূল্য আছে। এটা কাজেও লাগে। আর পুরস্কার হাত ফসকে কদাচিৎ সঠিক লেখকের কাছে গেলেও যে বা যারা এটা দিচ্ছেন তাদের সবকিছুই ওউন করতে হবে, সব কর্মকাণ্ড তখন যুক্তি দিয়ে জায়েজ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে কিনা? কিন্তু যেইমাত্র আমি বা আপনি এটা নেবো, সন্দীপন চট্রোপাধ্যায় পুরস্কার নিয়ে বলেছিলেন যে, “ আকাদেমি আমার বিচি কেটে দিয়েছে” খেয়াল করে দ্যাখেন জিনিশটা নিয়েই তবে উনি এটা বলছেন। তো, মুষ্কহীন হলে আপনি তাকে/তাদের সবকিছুকেই জাস্টিফাই করতে চাইবেন ঠিকঠাক মতো? সম্মাননা/স্বীকৃতির বিনিময়ে এই কৃতজ্ঞতা? পেছন পেতে দেয়া? আমি মনে করি, সাহিত্য-রাজনীতি বা সাহিত্যিক-রাজনীতির দাবা খেলুড়েরা এ লাইনে থাকবেন না। কেউ তো মনে করতে পারেন এগুলো তাঁর অধিকার। তুমি বরং তাকে সম্মাননা/পুরস্কার দিয়ে নিজেই ধন্য এবং সম্মানীত হয়েছো। এতে করে তুমি জাতে উঠেছো, ব্যাস্। কিন্তু সে ব্যক্তিত্ব কোথায়? দেখছি পুরস্কার পাওয়ার অব্যবহিত আগে ও পরে অতীতের সর্বৈব ভুল, একবুক হতাশা প্রকাশের পর বর্তমানের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে দেখা যায় অনেকের আচরণের মধ্যে।
পুরস্কারকে আমি ভালোভাবে দেখি। আমি পুরস্কার/সম্মাননার পক্ষে। তবে বিনিময়-প্রথা জিনিশটা মাথায় রেখেই লেগে থাকতে হবে আর কি। এটাও অনেকটা সিন্ডিকেটের মতোই। অন্যথায়, আপনার কাছে হাত ফসকে পুরস্কারটি এমনি এমনি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ, অন্তত: এই দেশে।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: নিজের লেখা কোন বইটা নিয়ে সিনেমা হলে আপনার ভালো লাগবে?
মাসুমুল আলম: আরব্যরজনীর ঘোড়া।
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: ভালো লেখক এবং প্রিয় লেখক- এ ব্যাপার দু’টি আলাদা। বাংলা সাহিত্যে অনেক বালো লেখক থাকলেও আপনার প্রিয় লেখক কারা? এদের সম্পর্কে যদি দুই/তিনটি কথা বলতেন।
মাসুমুল আলম: ভালো লেখকের তালিকা বললে তো লম্বা হয়ে যাবে। একটা বইয়ের জন্য বা কয়েকটি ভালো গল্পের জন্য অথবা একটি কবিতার জন্যও কেউ কেউ আমার কাছে প্রিয় লেখক।
তৃতীয় পর্ব: ফেসবুক টাইমলাইন
ওয়াকিং ডিসট্যান্স: “সুস্থ হয়ে উঠছে পৃথিবী ....... কতো চুক্তি কতো কিছু। সব ব্যর্থ। ওজনস্তরে ক্ষয়, গ্রিনহাউস গ্যাস নি:সরণ ৪০% শতাংশ কমে গেছে। মানুষের কৃতকর্মের বিনিময়ে প্রকৃতি ব্যালেন্স করছে।” আপনার একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস। এই প্রসঙ্গে কিছু বলবেন কি?
মাসুমুল আলম: কি আর বলার আছে। করোনা ভাইরাস এলো বলেই না প্রায় গোটা পৃথিবীর কলকারখানা, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, সড়ক, রেল যোগাযোগ সব একযোগে বন্ধ হয়ে গেলো। এমন রোগ, যে, মানুষ মানুষের কাছে যাবে না। মানুষকে নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং মাস্ক পরে থাকতে হবে। গণমাধ্যম মানুষকে হাত ধোয়া শেখাবে। মানুষ ‘লকডাউন’ এবং ‘কোয়ারেন্টাইন’ ২টি শব্দ শিখে গেলো এই অদৃশ্য জীবাণুর কল্যাণে। আতঙ্কিত মানুষ গৃহবন্দী করলো নিজেই নিজেকে, প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ কমে গেলো। ফলে, আমাদের সমুদ্রপাড়ে লাল কাঁকড়া এবং ডলফিন দেখা গেলো। ক্রমশ: গাছ সবুজ হয়ে উঠলো এবং প্রচুর পাখির সমারোহ দেখা গেলো। ফেসবুকে দেখা গেলো মুম্বাইয়ের বাসা-বাড়ির ছাদে ময়ূরের দেখা মিললো নির্ভয়ে তারা চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। আর করোনা সন্দেহে মানুষ মানুষকে ফেলে চলে গেলো। কিন্তু প্রকৃতি ক্রমশ সবুজ হয়ে উঠলো। দূষণ কমে গেলো। এটা তো কেবল মানুষের পৃথিবী না। সর্বপ্রাণবাদ ছাড়া সভ্যতা টেকে না।
আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন নিউ-নরমাল কন্ডিশন। এটা আমাদের মনে এবং মেনে নিয়ে থাকতে হবে, এই আর কি।
ওয়াকিং ডিসট্যান্সকে ধন্যবাদ। সবার জন্য শুভেচ্ছা।
[২০২০ এর ডিসেম্বরে ওয়াকিং ডিসট্যান্স কর্তৃক গৃহীত এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। আমরা কৃতজ্ঞ।]
মন্তব্য