.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

অনুবাদ সাহিত্য বিষয়ে মাসুমুল আলমের সাক্ষাৎকার

অনুবাদসাহিত্য বিষয়ক সাক্ষাৎকার মাসুমুল আলম
‘ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যে এখনো নিটোল গল্প ও ঘটনাপ্রধান কাহিনীর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে’ 
----মাসুমুল আলম
[প্রশ্ন: ০১] মানুষের জীবন তার নির্মিত পরিমণ্ডলে এমনভাবে ঘুরপাক খায় যেন এই পরিস্থিতি নির্মাণে তার কোন ভূমিকা নেই। ব্যক্তি-ভূমিকা ও সামষ্টিক ভূমিকা এমনভাবে তার পরিবেশ-প্রতিবেশকে প্রভাবিত করে যে ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় সেই প্রভাবের ফল সে ভোগ করছে দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য হিসেবে। ব্যক্তিগত সমস্ত ঘটনার সাথে রাজনৈতিক বা দার্শনিক সম্পর্ক মোটেই চাপিয়ে দেয়া নয় এই অর্থেই। এসমস্ত বিষয় বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষায় এসেছে কী? কীভাবে এসেছে?

উত্তর: এটা ঠিক নিয়তিনির্ভরতা নয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সব ঘটনা, ভালো বা মন্দ, দৈবদুর্বিপাক, সব আসলে চাপিয়ে দেয়া একটা অবস্থা। প্রত্যক্ষতার বাইরে বা পরোক্ষ বন্ধুতার ছদ্মবেশেও এটা হতে পারে। ফলে, মানুষের ব্যক্তিচিন্তাও কিন্তু প্রভাবিত হয়। আধুনিক সময়ে এই চিন্তার নিয়ন্ত্রণটা উচ্চমার্গীয়, ষড়যন্ত্রমূলক এবং আরো একচ্ছত্র হয়ে উঠেছে। কোন কোন সংস্কৃতির ওপর এই চাপটা আবার এমনও হয় যে, গোটা জাতিগোষ্ঠী নিষ্ক্রিয় উদাসীনতায় পর্যবসিত হয়। ব্যক্তি-মানুষ তখন কোন কূটপ্রশ্ন বা কোন ক্রিয়ায় আর প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মূল্যবোধের ক্ষীণরেখাও আর দৃশ্যগোচর হয় না। তাহলে, সেই সংস্কৃতিতে সাহিত্যের কি অবস্থা হয় তখন? প্রবহমান সংস্কৃতির ধারণাটি কি আবদ্ধ হয়ে পড়ে? নিশ্চয় তা নয়।

ব্যক্তি-তার কোন ভূমিকা নেই? বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া রাজনৈতিক বা দার্শনিক তত্ত¡ কিংবা মতবাদেরই কেবল প্রশ্নহীন দাসত্ব করে চলে সে? অর্থাৎ একটা অনড় স্থায়ীত্বের আজ্ঞাবহ বিমূঢ়তার শিকার! চেক দার্শনিক ইরাজিম কোহাক যেমনটা বলেন, জরবদস্তিমূলক এই অচলাবস্থা আসলে আগামী দিনের স্থায়ীত্বহীনতাকেই সুনিশ্চিত করে। ফলে, অবধারিতভাবে সাহিত্যের পরিবর্তনও সূচিত হয়। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া সেই মানুষ, আপাত উদাসীন ঐসব ব্যক্তি-মানুষ তখন একচ্ছত্র ক্ষমতাকেন্দ্রকে ক্রমশ: অস্বীকার করতে থাকে। যার প্রভাব পৃথিবীর নানা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিতে প্রতিভাত হয়েছে।

ব্যক্তি মানুষের স্মৃতি, ভাবনা, চিন্তনকণা, যা কবিতায় - কথাসাহিত্যে, থিয়েটারে, প্রতিবাদী গানে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ব্যক্তিকে, তার অস্তিত্বকে বাইরে থেকে নিস্পিষ্ট করবার সব প্রচেষ্টা তখন ব্যর্থ হয়। তাই আমরা দেখি আফ্রিকায় সেমবেন ওসমান, তায়্যিব সালিহ, আলেক্স লা গুমা, আমা আতা আইডু, জে এম কোয়েৎজি, নাদিম গার্ডিমার-এঁদের লেখায় শ্বাসরোধী একটা ব্যবস্থার বিপরীতে মানুষের বেঁচে থাকার তুমুল আনন্দ, তীব্র দুঃখ, আর শেষতক্ মানবিকতাই বড়ো হয়ে উঠেছে। আলেক্স লা গুমার টেকস্টের বিমূর্ত ভাবকল্পনা কখনোবা এন্টিন্যারেশনে কিংবা সোমালিয়ান লেখক নুরুদ্দিন ফারহা-র টেকস্টের জটিল বয়ান এবং নির্মাণশৈলীতে আফ্রিকী সাহিত্যের এক বিশেষধারা সৃজিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে চিনুয়া আচিবে বা নগুগি ওয়া থিয়োংগার কথাও এসে পড়ে। শিল্পসাহিত্যের ভিন্ন ভিন্ন কন্ঠস্বর আমাদের পাঠকৃতিতে সঞ্চিত হয়। লাতিন আমেররিকান সাহিত্যের হুলিও কোর্তাসার কিংবা একেবারে হাল আমলের হোসে অগাস্টিন বা নর্বার্তো ফুয়েন্তেসওর গদ্যেও এই পৃথক কণ্ঠস্বরের ছায়াপাত ঘটেছে।

কোনো মহার্ঘ্য ভাবনা নয়, বরং ব্যক্তি মানুষের, এসব অনির্ণেয় মানুষের জীবন আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে পূর্ব ইউরোপেরও শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির দিকপাল চেক লেখক মিলান কুন্দেরা, ড্যানিলো কিস, নাট্যকার ইউজিন ইয়েনেস্কো, চলচ্চিত্রকার ক্রিস্তফ কিসোত্তল্লস্কি, কিংবা সিমাস হিনি-র কবিতার মাধ্যমে।

হ্যাঁ, এঁদের কেউ লিখেছেন ইদ্দিশ ভাষায়, কেউ স্প্যানিশ, ফরাসী, কেউ জার্মানীতে। কিন্তু এই সব লেখাপত্রগুলো ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। তাদের লেখার জগতের সঙ্গে পাঠকের দীর্ঘ কথোপকথনে, ব্যক্তি-মানুষের রক্তমাংসময় অস্তিত্ব যাবতীয় প্রভাবকে অস্বীকার করে জেগে উঠেছে,- এবং এই বোধি পাঠকের মনোজগতে ও সঞ্চারিত হয়েছে।

আর দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য যাই বলা হোক, নিয়তিনির্ভরতার বাইরে এসব অনির্ণেয় মানুষেরই প্রচেষ্টায় শিল্পের সঙ্গে মিশ্রিত বিজ্ঞান ও দর্শন অন্য ভাষার সাহিত্যকে বিশিষ্ট করে তুললেও এর কিঞ্চিৎ উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে রয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহির, দেবর্ষী সারগী এঁদের রচনাসমূহ আসলে প্রতিষ্ঠিত আপ্তবচনের সচেতন উপেক্ষার ভাষার টেক্সট, যা অন্যভাষার সাহিত্যের সঙ্গে তুল্যমূল্য ক’রে দেখা যায়।

[প্রশ্ন: ০২] যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি, বিভিন্ন সময়ের দার্শনিক তত্ত্ব কিংবা যৌনতা ইত্যাদি বিষয়ে সুগভীর আলোকপাত করা হয়েছে কোন কোন ভাষার সাহিত্যে? সেই সমস্ত সাহিত্যের সাথে বাংলা সাহিত্যের কোন তুলনাত্মক আলোচনা করবেন কি বয়ান পাঠকদের জন্য?

উত্তর: যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি তো আমরা মানুষের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় দেখি। আবার সেই সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় রয়েছে মানুষেরই নানা চিন্তা ও চিন্তাসূত্রের উত্তরাধিকার। বিভিন্ন সময়ের দার্শনিক তত্ত¡কে মাথায় রেখে ভাবনার বিস্তার, নিজেকে ব্যাখা করতে চাওয়া, আত্মানুসদ্ধান, এসব বিষয়ে বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের রয়েছে উজ্জ¦ল উত্তরাধিকার। এন্টি কলোনিয়াল তত্ত¡ ও প্রণোদনা থেকে উপন্যাস ও নাটক রচয়িতা হিসেবে (ভারতীয় ইংরেজির মতো আফ্রিকী ইংরেজি বলে একটা জিনিস আছে)- কেনিয়ার ন্গুগি ওয়া থিয়োংগার লেখার হদিশ এবং বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়া তাঁর সাহিত্যের রসাস্বাদনের জন্য আমরা তাঁর গোষ্ঠীভাষা গিকুয়ু নয়, বরং ইংরেজিতেই তা পাঠ করি। তত্ত¡কে কেন্দ্রে রেখে এক ধরনের রুশ সাহিত্য এবং বাংলায় ৭০ দশকের সাহিত্যের গ্র্যান্ড ন্যায়োটিভের পাঠ্যকৃতিও আমাদের অভিজ্ঞতা। এসময়ের বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ কোনো গল্পের রিভলবার প্রসবের ঘটনায় প্রসঙ্গটা আন্দোলন হলেও সাহিত্য হিসেবে তৃতীয় শ্রেণির শিল্পই হয়ে যায়।

আর মাকসীয় দর্শনের তত্ত¡-পদ্ধতি ও প্যারাডাইম বা চিন্তাকাঠামোর বাহক এই টেক্সটও একসময় কর্তৃত্ববাদী সাহিত্যের আচ্ছন্নতায় আটকে যায়। মানুষের দিনানুদৈনিক রূঢ় বাস্তবতা মার্কসবাদী তত্ত¡কে ঘিরে নির্মিত প্রচারিত কর্তৃত্ববাদী টেকস্টের বিপরীতে কাউন্টার টেক্সটও অবশ্য সৃষ্টি হয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ায় দানিল খার্মসের লেখাপত্রে এবং আলবেনিয়ার ইসমাইল কাদারের রচনায়। আবার উত্তরাধুনিকতা ও মার্কসবাদকে মিলানোর চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় সাব-অল্টার্ন সাহিত্যেও। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’, রামকুমার  মুখোপাধ্যায়ের ‘দুখে ক্যাওড়া’ পড়লেই এই ক্ষীণ ধারণাটি বোঝা যাবে। মিশেল ফুকো কথিত ক্ষমতা ও জ্ঞানের অচ্ছেদ্যবন্ধনের ব্যাখা ও চিন্তাপরিধি ছড়িয়ে আছে নীরিক্ষাপ্রবণ সুবিমল মিশ্র, মলয় রায়চৌধুরী আর বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখের কথাসাহিত্যে।

জ্যাক দেরিদার ডি-কন্ট্রাকশন থিওরিকে মার্কসের তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে কিংবা এর সঙ্গে নারীবাদকে জুড়ে দিয়ে যে জ্ঞানকাণ্ড, তত্ত্ববিশ্বের যে ভাবনা পরিধি, তার অভিঘাত পড়েছে বিশ্বের নানা ভাষায় সাহিত্যের মতো বাংলা ভাষার সাহিত্যেও। ফলে, ক্ষীণধারার বাংলা সাহিত্যের সমান্তরাল পাঠ হতে পারে পূর্ব ইউরোপের বিচিত্র শিল্পসাহিত্য।

এদিকে, যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিজনিত একটি সাহিত্যধারার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। যুদ্ধ, মানে যদি যুদ্ধক্ষেত্রই ধরি তবে, সেই যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলবার্তো মোরাভিয়া, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বা এরিখ মারিয়া রেমার্কের কথনবিশ^ একটা ধারা, যা অনুসন্ধিৎসু পাঠকমাত্রই জানেন। তবে, যুদ্ধপরিস্থিতি, ঘটমান বর্তমানের মধ্যে থেকেও রণরক্তময় যুদ্ধের বর্ণনা, মানবিকতা ও সহমর্মীতার সরলীকরণ না, বরং যুদ্ধটাকে টেক্সট থেকে সরিয়ে শুধু প্রতিক্রিয়া, ইমেজ, ব্যক্তি মানুষের ইনার রিয়ালিট প্রকাশের ভেতর দিয়ে শিল্পের উত্তরণ ঘটেছে অন্যধারার সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে। বিচার্য সেগুলোও, এবং সারফেস রিয়ালিটিই কিন্তু সব না। শিল্পসাহিত্য কেবল ডকুমেন্টেশনও না। এক্ষেত্রে, হাঙ্গেরিয়ান ইমরে কার্তেশজ-এ লেখার সাথে শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ মিলিয়ে পড়া যেতে পারে। সিরিয়ার ওসামা আলোমার, জাকারিয়া তামের-এর ছোটগল্প এবং ঘাসান  কানাফানি-র গল্প ও উপন্যাসে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ পরিস্থিতির ভেতর ইনার রিয়ালিটি-ই শিল্পরূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

আর বিশ্ব সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সাহিত্যের বিভিন্ন স্তরেই ছড়িয়ে আছে প্রবল যৌনতা - ব্যক্তিমানুষের বিচ্ছিন্নতা ও সেক্সুয়ালিটি। ইমেজ ও সেক্সুয়ালিটি বিষয়ক ভাবনা সাপ্রতিক বিশ্বসাহিত্যের কথন বিশ্বের একটা সাধারণ প্রবণতা। ডি. এইচ. লরেন্স, হেনরি মিলার - নবোকভ-এর বহুল উচ্চারিত নামের পাশে মিলান কুন্দেরা-র ‘আইডেন্টিটি’, ইমরে কার্তেশজ্-এর উপন্যাস, আইজ্যাক বাশিভিস সিঙ্গারের আখ্যানবিশ্বের ধর্মীয় চেতনা ও যৌনতার মোটিফ, মলয়ালামভাষী কমলা দাশের কথাসাহিত্যের ভরকেন্দ্রে এই ‘যৌনতা’ একই সঙ্গে শারীরিক-মনস্তাত্বিক - সমাজতাত্ত্বিক - সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গের সাথে প্রবলভাবে সম্পৃক্ত।

কিন্তু যৌনতাকে বিশ্লেষণ করার স্পর্ধা, এটাকে আরো প্রশ্নময় করে নানামুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন বাংলাভাষায় জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে অসীম রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র, বাসুদেব দাশগুপ্ত, অরুণেশ ঘোষ ছাড়া আর তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ সাহস করেন নি। ‘সেক্স মোটিফ’ ব্যবহারে বাংলাভাষার ‘সিংহভাগ সাহিত্যিকই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ জাতীয় একট ব্যাপারের মধ্যে বরাবর সীমাবন্ধ থেকেছেন।

মূলত অনূদিত যেসব ভাষার সাহিত্য আমরা পাঠ করি, সেখানে, তত্ত্ববিশ্বের ‘পুতুল চরিত্র’ নয় মানুষ। মানুষ সেখানে সবকিছুর চেয়ে বড়। কেননা, একক মানুষের বিশুদ্ধ আত্মোপলদ্ধিই এসব সাহিত্যের প্রাণ।

[প্রশ্ন: ০৩] জীবনকে দেখার ও নতুনভাবে সেই দেখাকে বিন্যাসের ক্ষেত্রে অন্য ভাষার সাহিত্যের সাথে বাংলা ভাষার সাহিত্যের ফারাক আছে কী?

উত্তর: ব্যতিক্রম বাদ দিলে, বাংলা ভাষার সাহিত্যে অধিকাংশ লেখকই ছক - বাঁধা প্রচলিত জীবনটাই তুলে ধরেছেন। তথাকথিত মধ্যবিত্ত-আদৃত রুচি-স্নিগ্ধ, পুতুপুতু ন্যাকা জীবনকাহিনীর বয়ান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ‘সাহিত্য করছি’- এই রকম একটা অন্তঃসারশূন্য প্রচলতার বাইরে বাংলাসাহিত্যের লেখকদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে পড়ার তাগিদও অবশ্য দেখা যায় না। কেননা, ড্রইংরুম আর ইদানিং ক্যাফেভিত্তিক সাহিত্য চর্চাটা মিডিয়া-মারফত প্রভাবিত। ফলে,  জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, কায়েস আহমেদ, শহিদুল জহির, সেলিম মোরশেদ কিংবা বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র, দেবর্ষি সারগী, কার্তিক লাহিড়ী, অরুণেশ ঘোষ, এঁদের জীবনযাত্রা ও টেক্সট আমজনতার সামাজিক অবস্থান এবং তাদের প্রচল সংস্কৃতিক রুচি ও অভ্যাসকেই ক্রমাগত আক্রমণ করে এগিয়েছে। পাশাপাশি, অন্যভাষার সাহিত্যে যা অনূদিত হয়ে আমাদের পাঠরুচিকে সমাদৃত করেছে, আমরা দেখি, শিল্পের চাতুর্যে সেখানে কাহিনি/গল্পহীনতার আভাস, রয়েছে জ্ঞান ও কল্পনার মিশ্রণ। কাহিনির, টেক্সচারের ভেতরে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে প্রবন্ধের আঙ্গিক ও বিশ্লেষণ। বোর্হেস, মিলান কুন্দেরা-র কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। আর প্রবলতম সেক্স এর অভিঘাতও এসব সাহিত্যের অন্তর্বস্তুকে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যে, পাঠক আর স্বস্তিতে থাকে না। থাকতে পারে না। বিপরীতে, আমাদের বাংলা সাহিত্যের আখ্যানভাগ, টেক্সচারে অবিরল ধারায় কেবল শান্তি আর বিনোদন-পাঠকের ইচ্ছাপূরণের যাবতীয় উপাচার। প্রচলিত মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার এই ‘সুইটেন্ড শিট’ (মারিও ভার্গাস য়োসা যেমনটা বলেন) বাংলাভাষার সাহিত্য, বিশেষতঃ বাংলাদেশের সাহিত্যকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ইচ্ছাপূরণের জড়ভরতে পরিণত রেখেছে এখনো। তবে, বিপ্রতীপ অন্তঃস্রোতে কিছু সাহিত্যিক বাংলাভাষায় কাজ করেছেন বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তাল রেখেই, আশার কথা এটুকুই।

[প্রশ্ন: ০৪] বাংলায় যেমন দশক বা শতক ধরে সাহিত্য নিয়ে আলোচনার প্রবণতা আছে, অন্য ভাষার সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা কতটা? ঠিক কোন ধরণের মনস্তত্ত্ব এইভাবে সাহিত্যকে সময়ের প্রবণতা হিসেবে প্রকাশের ক্ষেত্রে কাজ করে?

উত্তর: দশক বা শতক ধরে এই পাল্লাভারি ধারণাটা বাংলাভাষার সাহিত্যের ক্ষেত্রেই কেবল উল্লিখিত হতে দেখা যায়। সাহিত্যের বাঁক বদল, অন্যভাষার ক্ষেত্রে, শিল্প সাহিত্যের আন্দোলনের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটা বিষয় হিসেবে দেখা হয়।

কিন্ত বাঙালি মনস্তত্ত্বে যৎকিঞ্চিত কাজের বিনিময়ে, চিহ্নিত হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর বাণী হয়তো আমাদের বাঙালি রক্তে অবিরত খেলা করেঃ মানুষ হয়ে জন্মেছিস যখন দাগ একটা রেখে যা।
এই আর কি!

[প্রশ্ন: ০৫] এ পর্যন্ত কী কী ভাষার সাহিত্য আপনি অনুবাদ করেছেন?

উত্তর: মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, তরুণ ঘটক, ঋতা রায় এঁরা যেমন স্প্যানিশ, পতুর্গিজ জানেন, ফলে তারা সরাসরি মূলভাষা থেকে অনুবাদ করে থাকেন। করে থাকেন সেই অনুবাদ মূলানুগ এবং স্বচ্ছন্দ। বাংলাদেশেও বহুভাষাবিদ কিছু অনুবাদক আছেন। ভবিষ্যতে অনুবাদ সাহিত্য তখন আরো সমৃদ্ধ হবে।

তবে, অনেকেরই ইংরেজি ভিন্ন অন্য ভাষার ব্যুৎপত্তি না থাকায় অনেকে কেবল ইংরেজি থেকেই অনুবাদ করেন। ফলে, সেটা হচ্ছে অনুবাদের অনুবাদ। এবং এটা আমারও সীমাবদ্ধতা।

[প্রশ্ন: ০৬] কথা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোন ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন? সাহিত্য কর্মগুলোর শিরোনাম, লেখকের নাম ও দেশের নামসহ জানতে চাই।

উত্তর: এ পর্যন্ত আমি ৩৭টি গল্প ও একটি উপন্যাস (‘মেন ইন দ্য সান’) অনুবাদ করেছি।

পবিত্র চিঠি (গল্প)-নবার্তো যুয়েন্তেস (কিউবা), আন্ট বার্টার জন্য শোক (গল্প)-হোসে অগাস্টিন (মেক্সিকো), নীল চোখের তোড়া (গল্প)-অক্তাভিও পাজ (মেক্সিকো), শেষ পর্যন্ত ঐ ত্বকটুুকুই কেবল (গল্প)-হার্নান্দে তেলেজ (কলম্বিয়া), আমি স্বপ্ন ফেরি করি (গল্প)-গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (কলাম্বিয়া), শীতার্ত (গল্প)-আলেক্স লা গুমা (দক্ষিণ আফ্রিকা), সিরিয়ার মাইক্রো ফিকশন লেখক ওসামা আলোমার-এর ২০টি গল্প, জাকারিয়া তামের-এর ৮টি গল্প, আরব পরবাস্তবতা (গল্প)-খালেদ সামেহ (জর্ডান) এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা লেখক ঘাসান কানাফানি-র উপন্যাস-‘মেন ইন দ্য সান’ এবং তাঁর ৩ টি গল্প।
-
[অমিতা চক্রবর্তী সম্পাদিত গল্পের পত্রিকা ‘বয়ান’ (২০১৯) কর্তৃক এই সাক্ষাৎকারটি গৃহীত ও প্রকাশিত হয়। পুনঃপ্রকাশের অনুমতি দেয়ায় আমরা কৃতজ্ঞ। -সম্পাদক]

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,151,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: অনুবাদ সাহিত্য বিষয়ে মাসুমুল আলমের সাক্ষাৎকার
অনুবাদ সাহিত্য বিষয়ে মাসুমুল আলমের সাক্ষাৎকার
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg21osYI-xKqAIoU0v_ECb6r4mkFkX6MX6bLwVT5gRacoUqbLa1rWclK6bN4ndyxh0M-71eN5kLSAKFMx97JScl3TuSRXWWaKgL_KDmjwt6A1p2EpSjLZ7QEXCmo4mEoSIAvLm6mVwNipQ/w320-h160/%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A6%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AF-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25B7%25E0%25A7%259F%25E0%25A6%2595-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BE%25E0%25A7%258E%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg21osYI-xKqAIoU0v_ECb6r4mkFkX6MX6bLwVT5gRacoUqbLa1rWclK6bN4ndyxh0M-71eN5kLSAKFMx97JScl3TuSRXWWaKgL_KDmjwt6A1p2EpSjLZ7QEXCmo4mEoSIAvLm6mVwNipQ/s72-w320-c-h160/%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A6%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AF-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25B7%25E0%25A7%259F%25E0%25A6%2595-%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BE%25E0%25A7%258E%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2021/01/Masumul-Alam-Interv.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2021/01/Masumul-Alam-Interv.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy