এক
রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প আমার কাছে বরাবর ম্যাজিক্যাল মনে হয়। ছোট গল্পের যে ফর্মে তিনি লিখতেন একে আমি ম্যাজিক্যাল বলি এই অর্থে যে, তাঁর গল্প এক ধরনের মগ্নতা সৃষ্টি করতে সক্ষম! পরবর্তী কালে অনেক গল্পকার-উপন্যাসিক সুড়সুড়ি লাগা অনুভূতি জাগানিয়া ফর্মের আবিষ্কার করেন। সে অনুভূতি প্রথমে লেগেছিলো মধ্যবিত্ত বলয়ের তরুণ-তরুণীদের মাঝে। এই মধ্যবিত্ত বলয়ের পাঠক মোটেও বোদ্ধাশ্রেণীর/ সচেতন পাঠক নয়, কেননা এরা শিখতে চায় না; শুধু হাসতে চায়। সে হাসির জন্য গল্পের চরিত্র যদি চামুচে করে ‘গু’ তুলে খায় তাতেও এদের তেমন আসে যায় না। মধ্যবিত্ত বলয়ের পাঠকের এই দৈন্যতা যেমন ভয়ংকর তেমন সুবিধাও আছে – এই সত্যকে উপলব্ধি করে কিছু মুনাফালোভী লেখক বাজার কাঠামো তৈরি করে তুলতে সক্ষম হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এ কারনেই হয়ত সেল্ বাজারের মানদণ্ডে অনেকে জনপ্রিয় হয়ে গ্যাছে, অনেকে বনে গ্যাছে মিডিয়ার বাঘ। স্রোতে ভেসে চলে না সকলে, কেউ কেউ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জানান দেয়, “আছিতো...!” আমরা অনেকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে উঠি...! স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো এই মানুষগুলেকে সাধারণেরা চিনতে চায় না, কিংবা বলা যেতে পারে বুর্জোয়ামিডিয়া এঁদের চিনতে দেয় না। এঁদেরকে নিয়ে কাজ করে বুর্জোয়ামিডিয়ার বিপরীতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু সংখ্যক ছোট কাগজ! মাসুমুল আলম সেই ছোট কাগজের মানুষ!
দুই
‘শিল্প’কে ধরাবাঁধা কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গ মনে হয় না।আমি বিশ্বাস করি, যে কোন মাধ্যমে শিল্পী; তাঁর সৃজন শীলতায় অথবা সৃষ্টি কৌশলে ‘শিল্প’ গড়ে তুলতে সক্ষম! একটু খোলাসা করে আলোচনা করা যাক-
আমাদের মধবিত্ত বলয়ের দর্শক যখন অঞ্জু ঘোষ’র সামান্য কাপড় তোলা দেখে তখন এদের মাথায় সেক্স জাগে, এরা সিনেমা হলের কোনার বসে উত্তেজনার বশে হস্তমৌথুনে মেতে ওঠে আবার এই দর্শকই যখন “টাইটেনিক” দ্যাখে তখন সেক্স উত্তেজনায় ভাসে না…শিল্পবোদ্ধা হয়ে ওঠে।
“মাসুমুল আলমের আরব্যরজনীর ঘোড়া”র পাঠে এসে পাঠককে ভাবতে হয়, নিজগুনে পাঠক হয়ে ওঠেন শিল্পবোদ্ধা! নারী, জীবনের চলমান কথা বলতে গিয়ে, চলে এসেছে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রেম, যৌনতা, নিজের প্রতি তুমুল ভালোবাসায় আলাপচারিতা... পাঠক এখানে নির্মান শৈলীর কাছে নত স্বীকার করে ‘রা-রা’ করতে পারে না, উপস্থাপনের ভঙ্গির সাথে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে পাঠক ভাবনায় মত্ত হন। এখানেই শিল্পের চুড়ান্ত বিজয়।
তিন
দাদা বাবুদের পিঠ (পাছা) চাপড়ানি পাবার তাগিদে এ বঙ্গের অনেক রঙ্গসন্তান নিয়মিত বলে বেড়ান- গল্প লেখার চালে এ বঙ্গে ‘শিল্প সফলতা’ নাই! এই জাতের চুদিরভাই মার্কা আলোচনা আবার আমাদের বুর্জোয়ামিডিয়ার (ভয়ংকর রকমের অদৃশ্য শক্তিতে ভরপুর) কর্মী সেটা প্রচার করে বড়ই তৃপ্তি পায়। অপরদিকে ইতিহাস তৈরি হতে থাকে নিজ কক্ষপথে...
আমার নিজের মতামত এই যে, গল্পের নতুনত্ব আবিষ্কার মূলত প্রতিভার সাথে দীর্ঘ চর্চার উপর নির্ভরশীল। আমাদের সময়ে অনেকে সে কাজ করেছেন। নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতার সাথে ভাষা শৈলীর বোধ থাকলেই মানসম্পন্ন গল্প লেখা যেতে পারে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ গল্পকারের গল্পের বিষয়বস্তু ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’ জাতের। গল্পহীনতা অনেক গল্পকারের অক্ষমতা। প্রায় সকল ভাষার গল্প সাহিত্যের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য হলো গল্পের মধ্যে গল্প থাকা। প্রতীকী বুদ্ধিময়তায় পাঠকের আস্থা কম। বেশির ভাগ পাঠক গল্পে আমি গল্প রাখার পক্ষপাতী । যেখানে এমন কাজ করা হয়েছে সেখান থেকেই শক্তিশালী কথা সাহিত্যিকরা বেরিয়ে এসেছেন। এদের থেকে অধিকতর শক্তিশালী কথা সাহিত্যিক আমাদের দেশে নেই- সেটা আমার বিশ্বাসহয় না। এ দেশের চলমান সময়ের প্রতি পরতে পরতে গল্পের ভাণ্ডার সংগুপ্ত রয়েছে। শুধু প্রয়োজন সৃজনশীল মানসিকতা নিয়ে সত্যের উপর চোখ ফেরানো। তাহলেই আমাদের ছোটগল্প আবার সজীব হয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস।
মাসুমুল আলমের গল্পবলার ভঙ্গি অন্যদের চেয়ে আমার ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে- সমাজবাস্তবতার দিকে আলোকপাত করে তাঁর চলতি ভাষার ব্যবহার যেমন চটকদারিহীন তেমনি আকর্ষন করে পাঠককে-
বুড়ির গলায় সমৃদ্ধ সুখ উছলে উঠলে আজমল কবির কবির দ্যাখে, আশ্চার্য, নদীতে নৌকা ভাসে... পাশ থেকে জড়ো হওয়া কচুরিপানা সব সরে গিয়ে টলটলে স্বচ্ছ পানিতে জ্যোৎস্নার সর... দূরে ফসলের ক্ষেতে মাটির গভীর থেকে জল তোলার এইটানা শব্দ... লোকে বলে, 'ডিপকল'... পাশে নদী রেখে দু'জন মানুষ শুধু চুপচাপ বসে থাকে।(মৌন ধারাপাত-মাসুমুল আলম)
মন্তব্য