এই লিখাটি পড়ার আগে মৌন ধারাপাত মূল উপন্যাসটি পড়ুন। তারপর প্রয়োজন মনে করলে এটি পড়ুন অথবা না পড়ুন।
আদতে আমি জানিনা মূলত কী লিখছি! হয়তো মৌন ধারাপাত এর টুপটাপ ধারা গায়ে মাখার চঞ্চল দৃশ্য ও অনুভূতি অথবা আপন ভাবনার মৌনতা কিংবা হৃদয়ের ধারাপাত ইত্যাদি কিছু অগোছালো প্যাঁচাল বা নিরস বকবক।
লাউ গড়-গড়
লাউ গড়-গড়...
মৌন ধারাপাত ফোটা ফোটা অবিরাম ঝরছে...
আলেকজান বুড়ির কুজো পিঠ ও বয়সি বটে যাওয়া শীর্ণদেহ নিয়ে দুটো পা হাঁটছে— দুটো হাত চাইছে একশ বছর পার হওয়া শরীরটাকে বহন করার শক্তি— ভিক্ষে দে!
কিংবা আলেকজান ডাকপিয়ন আজমল কবির এর দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে তার মুখের গন্ধ, বুকের গন্ধ; স্বামী আয়নাল সর্দার আর ছেলে সানালের করুন ইতিহাসকে।
আর পৃথিবীর সকল করুন গল্প উবে গিয়ে অবিবাহিত আজমল কবিরের ঘুমের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে শুকুর সাহেবের মেয়ে ফারজানা। ভিজে যাচ্ছে গোপন পোশাক!
পাগল লোচ্চাবুড়োকে ক্ষ্যাপাচ্ছে বিচ্ছু ছেলের দল!
মঞ্চের ওপর নারী দেহ টলছে, কামনার আগুনে জ্বলছে পুরুষ বুক! এ আগুন থামায় কে? মহা ক্ষুধার এরকম ধারালো প্রভাব আর কোন কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ করতে দেয় না কাউকে। যদি কেউ মরে যায় যাক— যদি কিছু পুড়ে যায় যাক।
মৌন ধারাপাত (২০১৭) প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর দাম: ১৫০ টাকা প্রকাশক: উলুখড় |
সমাজের নিচু শ্রেণির চরম দূর্ভোগ! কারও ভোগের দারুণ উল্লাস— কারও অনাহারী করুণ আর্তনাদ! যুদ্ধ চলছে তো চলছেই! যে বিরাজমান যুদ্ধের ভেতর মুক্তি নেই তাকে মুক্তিযুদ্ধ বলি কী করে! যুদ্ধের ভেতর মহাজগৎ, পৃথিবী, দেশ, সমাজ শৃংখল বা উশৃংখল ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার ভেতর মানুষ, ক্ষুধা, সংগ্রাম, যৌনতা কিংবা তীব্র যৌনতার দমন! ইত্যাদি সমস্তকিছুই ইশারা করছে সিস্টেমের দিকে। আর এই তথাকথিত সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণকারী, রক্ষাকারী বেশ ধারীরা— ইঁদুর রক্ষার নামে বিড়াল পুষছে, কুকুর মারছে। আবার আঙুল তুলছে নিরীহ, নিরপরাধ ও অসহায়ের দিকেই। বন্দিও করছে তাদেরই। তবুও কি কাউকে প্রকৃত বন্দি করা যায়! রাততো শেষ হয়ই— সূর্য তো ওঠেই।
'মৌন ধারাপাত' এর পাণ্ডুলিপি পাঠপ্রতিক্রিয়ায় সুহৃদ শহীদুল্লাহ যা লিখেছিলেন, আশা করি তা পড়ে হয়তো পাঠক আরও ভালো বুঝতে পারবেন। তাই সেই পাঠপ্রতিক্রিয়ার কিছু কিছু অংশ আমি তুলে দিচ্ছি:
...কিছু প্রান্তিক চরিত্রকে অবলম্বন করে মাসুমুল আলমের ছোট আখ্যান 'মৌন ধারাপাত। ছোট বলেই বোধ হয় 'মৌন ধারাপাত'-এর দাবিটা অনেক বড়ো। আপাতসরল একটি কাহিনীর ভেতর দিয়ে মাসুমুল আমাদের জন্য উপস্থাপন করেন এক সাবঅল্টার্ন অধ্যয়ন। ছোট ছোট স্কেচে চরিত্রায়ন, ভাষার ধীর গতি ও ঘনত্ব এবং লুকিয়ে-ফেলা সামাজিক রাজনৈতিক ডিসকোর্স নিয়ে 'মৌন ধারাপাত' দাবি করে নিবিড় পাঠের।......ছোট ছোট চরিত্রের কোলাজ এই আখ্যান। চরিত্রগুলোর ভবিষ্যৎ নেই কোনো। বর্তমান গতিহীন। অতীত তাদের জীবন্ত ছিল কিছুটা কিন্তু সেখানে যাবার কোনো পথ খোলা নেই আর। এর ফলে আখ্যানের কোনো শুরু বা শেষ নেই। পরিণতি নেই সেই অর্থে। সম্পূর্ণ কোনো গল্প নেই। কিন্তু সব চরিত্রের গল্পই মিলে গেছে। তাদের মুক্তিহীনতার দৈনন্দিনতায়। তবে স্বল্প পরিসরে এলেও সবকটি চরিত্র সমান মনোযোগ পেয়েছে লেখকের। চরিত্র চিত্রায়নে মাসুমুলের সংযম আখ্যানটিকে শক্তিশালী এক স্প্রিংয়ের অন্তশক্তি করেছে। যেন স্প্রিং থেকে হাতের ভার তুলে নিলে প্রতিটি চরিত্র সহসা খুলে ধরবে তাদের নিজ নিজ শক্তি। চরিত্রের মোহে পড়লে ছোট এই আখ্যানটি অনায়াসে কয়েকশ' পৃষ্ঠার মনোহরী গল্প-গাথা হয়ে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু লেখকের উদ্দেশ্য সেটি নয়। গল্প না বাড়িয়ে তিনি পাঠকের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন ভাবনার ভার।এই কাজে মাসুমুলকে সাহায্য করেছে তাঁর ভাষা। মৌন ধারাপাত নিয়ে তিনটি বড়ো-ছোট আখ্যান পড়া হল আমার। তিনটিতেই তিনি আখ্যানের দাবি অনুযায়ী ভাষাকে আলাদা আলাদা করে গড়ে নিতে পেরেছেন। এই আখ্যানে যেমন ব্যবহার করেছেন প্রচুর লোকজ উপাদান, শুধু সংলাপে নয়, বর্ণনাতেও স্থানীয় ভাষার ব্যবহারে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কিন্তু সেসবকে অতিক্রম করে মাসুমুল সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন ভাষার ভেতর থেকে সমস্ত উত্তেজনাকে সরিয়ে ফেলাতে। যেন এক সময়হীনতার ভেতরে বসে কথা বলছেন লেখক। ইচ্ছে করেই ভাষার ভেতরে লুকিয়ে ফেলেছেন গতিকে। কখনো কখনো মনে হতে পারে আখ্যান যেন এগোচ্ছে না কোথাও। দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে জলের মতো ঘুরে ঘুরে। লাউ গড় গড় থেকে ঝকর ঝক আর ঝকর ঝক থেকে লাউ গড় গড়।
এবার 'মৌন ধারাপাত' এর ভেতরের কিছু অংশ পড়ুন:
আলেকজান বুড়ির ঘুমন্ত শরীর দেখে আবার অদূরে সদরমুখী রোডের দিকে চোখ যায় আজমল কবিরের। উঁচু রাস্তার ওপারে বাড়িগুলো কেমন নিথর, থেকে-থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে শুধু, পরপরই আবার ঘন অন্ধকার। আজমল কবির অফিস-ঘরে ঢুকে একটা আলমারির পেছন থেকে গোটানো মাদুর মেঝেতে পাতে। এখন তার নিজের ঘুমের আয়োজন করা দরকার। রাত্রিকালীন অন্ধকারে অনেকগুলো আয়োজনের শেষতম এই আয়োজন এই-অমোঘ মৃত-প্রায় ঘুম; এবং এই ঘুমের ভেতরে কতো যে স্বপ্ন-আয়োজন চলে। ঘুমের মধ্যে শাকুর সাহেবের মেয়ের সঙ্গে স্বপ্ন-সহবাস ঘটে প্রায়: কোনো কোনো রাতে লুঙ্গি ভিজে যায় তারপরেই য্যানো ঘুমটা আরো ঘন হয়ে চোখে নামে, চোখ মোটে খুলতেই চায় না, লুঙ্গির ভেজা অংশ লিঙ্গমুণ্ডে চটচটে আঠার মতো শুকিয়ে লেগে থাকে। সকালে উঠে গোসল না-করা পর্যন্ত আজমল কবিরের কী অস্বস্তি কী অস্বস্তি! রহস্যময় পয়গম্বরী খৎনা সত্ত্বেও রাতের অন্ধকারে অবৈধ স্বপ্ন-সহবাসে বার বার ফারজানা রেখা চলে আসায়, পরে, কখনো শাকুর সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে পূর্বরাত্রির কথা মনে পড়ায় আজমল কবির তার সামনে ভেতরে-ভেতরে একটু কুণ্ঠিত হয়ে থাকে।
যৌনতা অথবা শরীরের এমন অনুভূতির তীব্রতার এরকম দারুণ শৈল্পিক উপস্থাপন পাঠককে আরও আকর্ষণ করে।
আরেকটি অংশ পড়ুন। আশাকরি এটি পড়লে মাসুমুল আলমের ভাষার খেলা, রসবোধ, বিষয়কে দেখার চোখ, লোকজ উপাদানের ব্যাবহার ও দৃশ্যের বর্ননা, নিয়ে নিজে কিছু অনুমান করতে পারবেন।
আলেকজানের হয়েছে এক জ্বালা, বয়সের সাথে সাথে কান তার ঠসা হলেও অনেক অপ্রয়োজনীয় ছোট-কথাও সে শোনে, শুনে ফ্যালে, আবার দরকারি জোর-শব্দও বুড়ির কানে পশে না। গেট দিয়ে একজন বের হয়ে গ্যালো। মগার ছাওয়াল-টাওয়াল হবে বোধ হয়। বুড়ি তাকালো। সেদিকে। বোম্বাই হাজি মকবুল আহমেদ ওরফে মগা মিয়া পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে রওনা করে বোম্বে থেকে ফিরে আসার পর তার অস্থায়ী নিবাস' নামধারী বাড়িটার গেটে কে বা কারা আলহাজ্ব মগা মিয়া' লেখা একটি নামফলক ঝুলিয়ে দ্যায়; নিয়তই হলো আসল কথা, সেই নিয়তের আগে আগে মগা মিয়া পাড়ার মধ্যে সবচে' বেশি জমি-জায়গার মালিক; এবং একইসঙ্গে অনেকগুলো ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে পরে তাদেরও ঘরে নাতি-নাতনি-পোতা-পুতনির সংখ্যা বাড়তে থাকলে মগা মিয়া হজ করার নিয়তে পানিপথে বের হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্য, মাসাধিককাল ভ্রমণের পর ভারতের বোম্বাই নগরীতে পৌঁছে জানা যায়, হাতে যে ক'দিন আছে তাতে পবিত্রভূমিতে পৌঁছানো অসম্ভব। সুতরাং ভগ্ন-মনোরথে ফিরে আসলেও মকবুল আহমেদ তার সফেদ পরিধান আর হাজি-ভাব কিছুতেই ছাড়ে না। অন্যদিকে, আল-হাজ তো দূরের কথা, লোকের সম্বোধনে মগা মিয়া নামেরও কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। পরন্তু, পাড়ার ছেলেছোকরাদের সাথে তার নিজের বাড়ির গোঁফ না-ওঠা আওলাদেরা পর্যন্ত শেয়ালের পালের মতো কোনো গলির ভেতর থেকে গলা বের করে সমস্বরে আওয়াজ তোলে:মগা শালা ডিম চোর/বেড়া ভেঙে দিলো দৌড়।কথায় বলে সব শিয়ালের এক রা—বয়স যতই বাড়ছে মগা মিয়া ততই তা দেখছে। গুড়ি গুড়ি ছেলেপেলে, যেটা ডিম ফুটে মাত্র বেরোলো সে-ও মগা মিয়াকে আওয়াজ দ্যায়? তখন বৃদ্ধ মকবুল আহমেদ ওরফে মগা মিয়া হাতের বাঁকানো মোটা বেতের লাঠি নিয়ে ছুটে যেতে যেতে নির্বিশেষে সবার উদ্দেশ্যে 'মগা না? দাঁড়া হারামজাদা' বলে স্থানকালপাত্র ভুলে জোরে জোরে চেঁচায়:মগা না? ম-গাতোর মা-র শাউর মদ্যি লগা ... লাঠি উচিয়ে তেড়ে যেতে-যেতে গলির ভেতর থেকে ছেলেরা আবার আওয়াজ উঠিয়ে একদম নেই হয়ে যায়।
লেখকের চমৎকার বর্ননায় লিবিডোর টানটান উত্তেজনাময় আরেকটি অংশ পড়ুন:
মন য্যানো তাঁতিবাড়ির চরকা। চাঁদের বুড়ি অফুরান খটখট শব্দে চরকা কেটে চলে, আর তাই সব মনে পড়ে যায় বিন্দুবিসর্গসহ ... তখন, বাইরে প্রাক-সন্ধ্যায় দুনিয়া রঙিন-করা আলো। তারপরেই ঝুপ করে নেমে আসে অন্ধকার; অন্ধকার সম্ভাবনাময় এবং প্ররোচনাকারী; অন্ধকার তাকে উস্কে দ্যায়: ফলে সে, আজমল কবির দূর থেকে ভেসে আসা আহ্বানে সোৎসাহ সাড়া দ্যায়, নীরবে ... এবং ইচ্ছা হয়, প্রবল ইচ্ছা করে আর সুতীব্র ইচ্ছার বশেই আজমল কবির অবশেষে গুটিগুটি পায়ে বাইরে এসে রাস্তা ধরে, যতোই এগোয় উচ্চকিত বাদ্যযন্ত্রানুসঙ্গের সাথে শরীরের রক্ত নেচে ওঠে তার; আবার গোপনীয়তা বজায় রাখতেও আজমল কবির সমান সতর্ক। এবং একসময় সে আলোকিত প্যান্ডেলের সামনে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে পিঠাপুলি, কুটিরশিল্পের সারি-সারি পশরা সাজিয়ে বসে আছে সুবেশ নারী-পুরুষ। হর্নের আওয়াজ কান-সহা হতে সময় লাগে। কিন্তু চোখ জ্বলে ওঠে কিছুক্ষণ বাদেই উদ্দাম উদোমনৃত্য কল্পনা করে। মঞ্চের পর্দা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ঝটিতি সরে গেলে দেখা যায়, ঘূর্ণ্যমান রঙিন আলোর মধ্যে নাচনেওয়ালির অর্ধ-নগ্ন দেহ, আবেদনময় নাচ। পাবলিক আকর্ষণে চোখ- ধাধিয়ে দেয়া লোভ-জাগানো কৌশল। নারীদেহ দেখার সুপ্ত বাসনার টানে টিকেট কিনে ফেললো আজমল কবির। রুমঝুম নাচ, পরিচিত মানুষজন এড়াতে সে সন্তর্পণে এগোয়; কপাল ভালো, দর্শকশ্রোতাপূর্ণ প্যান্ডেলে আজমল কবির ঢুকলো আর সঙ্গে সঙ্গে আলোও নিভে যায়; এবং সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতালের শীকার ধ্বনিময় বাজনা বেজে উঠলে শূন্য মঞ্চে আলোর বল নেচে বেড়ায়। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর তা-ও বন্ধ হয়ে যায় এবং ঘোষণা আসে যে, দর্শকদের প্রিয়মুখ টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেত্রী এবার ঝুমুর-ঝুমুর নাচে-গানে মাতোয়ারা করতে আসছে ... পাবলিক হই হই করে ওঠে। ব্যাপারটা ডাহা মিথ্যা, অভিজ্ঞতায় তারা জানে। এ নিয়ে একটু ভাবলো সে, তার মনে হয়, শরীরের টানে খ্যাংড়াকাঠি আবেদনহীন সঙ্গীর চে' হোক দূরবর্তী ব্যাপক পরিচিত নায়িকাকল্পনায় যৌন উপভোগ বেড়ে যেতে পারে। ... তো, তথাকথিত টিভি-নায়িকা নিজেও তার প্রকৃত স্বরূপ না-লুকিয়ে চড়া মেকাপে সাদা হয়ে এসেলাল-নীল আলোর বৃত্তের মধ্যে ফ্যাসফেসে বেসুরো গলায় হিন্দি ও সাহেবান ও সাহেবান ...' শুরু করলে পাবলিক প্রথম দু'লাইন ধৈর্য ধরে শোনে এবং কিছুক্ষণ পরেই দুয়ো দ্যায় : ভূয়া-ভূয়া এ ভূয়া... তখন মেয়েটা তার গানটা অর্ধেক গেয়ে শেষ করতেই নেপথ্যে উচ্চমাত্রার বিট, সে জানে এখন কী করতে হবে, কেননা সে ডানসার; না নৃত্যশিল্পী না নর্তকী; বিদ্বদজনেরা যতোই অভিজাত উচ্চারণে ‘নটা’ বলুক, এই সমবেত পাবলিকের কাছে তারা স্রেফ নোটিমাগি ছাড়া আর কিছু না। বিটের তালে তালে বন্ধনহীন স্তনযুগল ঝাঁকায় সে, ঢেউটিনের খাঁজকাটা কোমরে তুমুল তুফান তোলে, কোমর ভাঙলে বড় গলাকাটা কাপড়ের ফাঁকে আলোর বল এসে স্থির, মঞ্চের সামনে এসে নিজ হাতে আরেকটু ফাঁক করে ধরলে পাবলিক শিস দিয়ে ওঠে, তারা আরো মত্ত হতে চায় এভাবে একজন-দুজন-তিনজন হয়ে গেলে সবশেষে এক সিনেমার নায়িকা এবার মঞ্চ দাপাতে আসে। পদ্মবনে মত্ত হাতি য্যানো; এই কি পদ্মবন? আজমল কবির দেখলো, মেয়েটির হস্তিনী শরীর হলেও ছোট মুখখানা বেশ সুন্দর। যদিও সবার মতো সে-ও পাউডারে সাদা, যত্রতত্র অধৈর্য শিসধ্বনি উঠলে আজমল কবির বোঝে, এ মেয়ে এবার কাঁপাবে এবং ভেজাবে; নিজে সে আগেই প্রস্তুত, অতএব, সাদা ফসফরাস বাতাসের সংস্পর্শে আসতেই জ্বলে যাবে নিশ্চিত ... তারপর যথারীতি সেই মেয়ে শরীর ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে নিজেই বিপজ্জনক সব ইশারা করে, দর্শকরা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে সমর্থন জানায়; উচ্চমাত্রার লয় স্তিমিত হয়ে আসার ফাকে টাইট লাল গেঞ্জিটা খুলে ফেললে কাঁচুলির ভেতর দুটি 'ছোলম' কেবল উপত্যকা দেখা যায়। তখন আরেকজন মেয়ে আসে—তারা দুজন মিলে নারী-পুরুষের সঙ্গমের ধরনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচে, দর্শকদের উন্মাদ চিৎকার লালাসিক্ত নৈঃশব্দ্যে রূপ নেয় যখন মঞ্চের উপর ওই দুজনের সঙ্গম-নাচ বেশ দীর্ঘায়িত হয়। উচ্চমাত্রার বিট আবার বেজে উঠলে সঙ্গমনৃত্য শেষ হয় এবং তখন সামনের সারির একজন জড়তাহীন দর্শক তার রুমালখানা মঞ্চের দিকে ছুঁড়ে দিলে নৃত্যপর প্রথম মোটা মেয়েটি সেটি লুফে নিয়ে তার বুকের খাঁজে রাখে, নাচতে-নাচতে দু'পায়ের উরুসন্ধিতে রুমালটা দুইয়ে দিয়ে মঞ্চের সামনে এসে চুমু দিয়ে রুমালটা ফেরত দ্যায় এবং রুমালঅলা লোকের হাত থেকে বখশিশ নেয় ... ওয়ান মোর ওয়ান মোর যথারীতি এসব অনুরোধ, জোর আপত্তি সত্ত্বেও সর্বব্যাপী কটকটে হলুদ আলো জ্বলে ওঠার আগেই প্যান্ডেলের বাইরে চলে আসে আজমল কবির।... মাথার উপর কামনা-ছড়ানো মেঘ আর জ্যোত্মা-ধোয়া আশ্বিনের রাতে সে ফিরে যাচ্ছে এখন: তবে মুখটা ভারি মিষ্টি হলেও মেয়েটা একটা স্থূলকায় বলশালী মর্দিনী ... এ কী, রেতঃপাত হয়ে যাবে না-কি! ছি-ছি! ... যেতে যেতে ক্ষুদ্রায়তন ভূ-খণ্ডে অলক্ষে কতোনা পরিবর্তন, ইতিহাসের কতোনা বিবর্তন, ধ্বংসযজ্ঞ সে প্রত্যক্ষ করে।
আর সবচে সুন্দর বর্ননা ও দৃশ্য, যা আমাদের এতক্ষণ নদীতে ভাসাতে ভাসাতে শেষে সমুদ্রের মধ্যে নিক্ষেপ করলো, আর সেই সমুদ্রে কোনও কূলকিনারা না পেয়ে আমরা পাঠকেরা ক্রমশ অতলে ডুবতে থাকি।
দ্যাখো, তিন-কেলে বুড়ির চলা-আটক করে ফেলে রাখা যায়নি। বুড়ি তখন লাউ গড়গড় লাউ গড়গড় ... করতে-করতে মৃতপ্রায় ভৈরবের তীরভূমি ধরে দ্রুত হাঁটতে থাকে; সঙ্গে তার কোলকুঁজো ছায়া। আজমল কবির এদিক-সেদিক অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আর চাঁদটাও সাথে সাথে ঘোরে: যেদিকে সে যায় সাথে সাথে সে-ও চলে আসে, সে থামলে সে-ও থেমে যায়... এই খেলা চলতে-চলতে আজমল কবির কাঠের সাঁকোর উপর এসে দাঁড়ায়। বেদের দল চলে গেছে। তাদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত জিনিসের ওপর মুখ ঘষে চলেছে একটা কুকুর। শূন্যতল্লাট জুড়ে খা-খা জ্যোৎস্না।আলেকজান বুড়ি পূব দিকে হেঁটে চলেছে। নদীতীর ধরে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে... আর আজমল কবির দ্রুত সাঁকো থেকে নামে। প্রশান্ত বিমুখতায় মা চলে যাচ্ছে। জোড়া-বাশের চারের উপর দিয়ে খাল পার হয়ে গ্যালো মা, পেছনে ছুটছে এক বিহ্বল বালক ... এবং তখন আজমল কবির আলেকজান বুড়িকে অনুসরণ করতে থাকে।হাঁটতে-হাঁটতে বুড়ি এক সময় চরের জমিতে বসে পড়লো। বামে প্রবহমান ক্ষীণতোয়া ভৈরব, মরণশ্বাস নিয়ে বয়ে চলেছে, দূরে-দূরে ধানক্ষেত, আর এমন সুতীব্র জ্যোৎস্নাধারা—এমন জ্যোৎস্নায় ধানের দুধ শুকিয়ে যায়; ধান চিটা হয় আর আকাল নেমে আসে দেশে।বুড়ি আবার উঠতে যায়, উঠতে গিয়ে দ্যাখে, তার পাশে মানুষের ছায়া।কী গো বুড়ি?বুড়ি কথা বলে না। আজমল কবির আবার বলে, কোন দিক যাবা?ওই তো— বলে বুড়ি পুব দিকে দেখায়।সেখানে কি নদী আছে? একই তো।না।কি-না?তখন একটু খানি চুপ থেকে চাঁদের বুড়ি বলে, ওই তো নৌকো!বুড়ির গলায় সমৃদ্ধ সুখ উছলে উঠলে আজমল কবির দ্যাখে, আশ্চর্য, নদীতে নৌকা ভাসে ... পাশ থেকে জড়ো হওয়া কচুরিপানা সব সরে গিয়ে টলটলে স্বচ্ছ পানিতে জ্যোৎস্নার সর ... দূরে ফসলের ক্ষেতে মাটির গভীর থেকে জল তোলার একটানা শব্দ ... লোকে বলে, 'ডিপকল ... পাশে নদী রেখে দু'জন মানুষ শুধু চুপচাপ বসে থাকে।এবং তখন, মাথার উপর দিয়ে ডানা ঝাপটে কোনো রাতচরা পাখি উড়ে যায়; শরতের আকাশে ছাড়া-ছাড়া মেঘ, শ্যালো ইঞ্জিনের অবিশ্রাম শব্দ, আর নদীর জলে ভাসমান একটি নৌকা নিঃশব্দ মুখরতায় অবিরত দোল খেয়ে যায়।...কোথাও কোনো ঐকতান শোনা যায় না।
উপন্যাসে এভাবেই চলে গেছে একটি টানটান স্রোত। আর আগেই বললাম পাঠক সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতে গিয়ে ঠেকেছে সমুদ্রে। সমুদ্রের কোন কূল কিনারা নেই আর এই সমুদ্র রহস্য অন্তহীন সমস্তকিছু প্রবল হ্যারিকেনের মত পেঁচিয়ে উঠছে মগজের ভেতর।
আর লেখকের বর্ণনাভঙ্গি ও সংলাপে লোকজ উপাদানের চমৎকার প্রয়োগ, বারিধারার মতো ভাষার দ্রুত ধীর ছান্দিক গতি কিংবা গভীরতার সাথে দারুন রসবোধ ও স্যাটায়ারের সমসত্ব মিশ্রণ। সর্বোপরি সবকিছুর সুন্দর মেলবন্ধন উপন্যাসটিকে আরো ওপরে তুলেছে বলে মনে হয় আমার কাছে।
আর এত কিছু লেখার পরও বলছি, 'মৌন ধারাপাত' উপন্যাসটি পড়ে ফেলুন। মূল লেখা পড়ার ভেতর যে আনন্দ পাবেন, তা এখানে পাবেন না। এসব নিরস ফালতু গদ্য পড়ে মিছিমিছি সময় পার হবে কেবল।
মন্তব্য