আজ একুশ শতকে, জানি, খুব ভালো করে আমরা জানি, বিশ্ব-উপন্যাসের পরিসরটি নেহাত ছোট নয় আর, নেহাত ছোট নয় বাংলা ভাষায় লিখিত উপন্যাসের পরিসরটিও। সময়ের বিবর্তন-পরিবর্তন-অভিযোজনে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো এ শাখার পরিধিও আজ বেশ বিস্তার লাভ করেছে।
পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষায় যেসব উল্লেখ্য উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে, হচ্ছে, আরও হবে− বাংলা উপন্যাস মানে ও শক্তিতে সেসবের পাশে অবশ্যই সমান উচ্চতায় দাঁড়াতে পারে, বিশ্ব উপন্যাসের পাঠ অবশ্যই আমাদের সেটা জানান দেয়। পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক লেখকদের হাতে উপন্যাসের যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে আছে, তাকে সামনে রেখেই উপন্যাস রচনা করতে হবে, হবে, কিন্তু শুধু সে-পথেই সৃষ্টি হবে ভবিষ্যতের উপন্যাসের ইতিহাস− একথা পুরোপুরি ঠিক নয়। আজকের উপন্যাস হবে আজকের উপন্যাসের বাস্তবে, তার ভেতরই ফুটে উঠবে সমাজের ছবি, জীবনের দায়, গতি, বিকাশ ও পরিণতি− সময়ের পটভূমিকায় ব্যক্তির একেকটি দিন ও রাত্রি, আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের রূঢ় বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বাস্তবের পাশাপাশি মূর্ত ও বিমূর্ত, অতি সরলও নয়, নিছক দুর্বোধ্যও নয়, জীবনের সংগ্রাম ও নিষ্ঠুরতার ছবি, তার ভেতরই আভাসিত হয়ে উঠবে ব্যক্তির জীবনযাপন, অবস্থান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যক্তির ভূমিকা কী? এবং ব্যক্তি কীভাবে পালন করছে তার সেই ভূমিকা। তবে, অনেক কাল থেকে যে আমরা শুনে আসছি, উপন্যাস হচ্ছে সমাজের দর্পণ, আমি বলি, উপন্যাসকে ঐ সমাজ-দর্পণোত্তীর্ণ হতে হয়।
মৌন ধারাপাত-এর পূর্বে মাসুমুল আলমের একটি গল্পগ্রন্থ ও দুটি উপন্যাস বেরিয়েছে। মৌন ধারাপাত তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। তিনি এখনও লিখে চলেছেন, তাঁর সমসাময়িক আরও অনেকেই লিখছেন। সমকালীন কিংবা ভবিষ্যৎ-বাংলা কথাসাহিত্যে উপন্যাস হিসেবে মৌন ধারাপাত-এর অবস্থান কোথায় এবং কী, তা বিচার করার সময় এখনই নয়। কেননা, যে কোনো নতুন লেখক ও উপন্যাসের বিশুদ্ধ বিচারের জন্য একটা সময়ের অপেক্ষা দাবি করে, ওই অপেক্ষা মানে বিগত কালের, সমকালীন, পর্যায়ক্রমিক তাবৎ উল্লেখ্য লেখক কিংবা উপন্যাসের সমাবেশ থেকে একজন বিশেষ লেখক কিংবা ঐ সময়ের একটি বিশেষ উপন্যাসের যথার্থই খাঁটি উপন্যাস হিসেবে পাঠক-সমালোচকের বিচারের কাছে দাঁড়াবার বিশেষ সুযোগ। যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একদিকে পাঠক কিংবা সমালোচকের অভিজ্ঞতা, রুচি এবং বিচার করার বোধ, অন্যদিকে সমালোচকের নৈতিক সততা ও নির্মোহতা। মোট কথা, একটি ভালো উপন্যাসের সমকালীন বিচার অধিকাংশ সময়ই প্রাথমিক কিংবা খণ্ডিত হবার সম্ভাবনা থাকে, উত্তীর্ণ সময়ের ওপরই সেটি যথার্থ বিচারের সুযোগ পায়।
মৌন ধারাপাত (২০১৭) প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর প্রকাশক: উলুখড় দাম: ১০০ টাকা |
তাছাড়া নানা কারণে এ-সময়ের বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো উপন্যাস শাখাটি নিয়েও নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়ে আছে। সময়ের আগে অযথা প্রচার, প্রপাগান্ডা, প্রচারসর্বস্বতা, সাহিত্যের দশকি বিচার, দশকি রাজনীতি, দশকি সংকলন-মূল্যায়ন, লিটনম্যাগ চর্চার নামে পারস্পরিক মূল্যায়ন-বিনিময়ের গোষ্ঠীভিত্তিক চর্চার দূষণ, ডামাডোলে যে বিভ্রান্তি ও ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে, এসব দূর হয়ে গেলে তবে একজন বিশেষ লেখক কিংবা বিশেষ গ্রন্থের উপর যথার্থ বিচার কিংবা মূল্যায়ন সম্ভব হতে পারে।
মাসুমুল আলমের কথাসাহিত্য কিংবা মৌন ধারাপাত উপন্যাসের লেখকের ওপর সুহৃদ শহীদুল্লাহ বাংলা কথাসাহিত্যের ভবিষ্যৎ-নির্ভর গুটিকয় লেখকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছেন। বলেছেন, একটি গল্পগ্রন্থ এবং দুটি উপন্যাস দিয়ে এ উপন্যাসের লেখক ইতোমধ্যে সে-জায়গাটি মজবুত করেছেন আরো। মৌন ধারাপাত তাঁর সেই জায়গাকে বিস্তৃত করবে আবার। সুহৃদ শহীদুল্লাহ’র মীমাংসায় মাসুমুলের সর্বশেষ ছোট আখ্যান মৌন ধারাপাত বর্তমান বাংলাসাহিত্যে এক বড়ো সংযোজন। এই বিবেচনা কতটা সত্য, মাসুমুলের এ যাবৎ লেখা সাহিত্যের ওপর তা খাটে কিনা, তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ-সমগ্র সাহিত্যের বিবেচনা হিসেবেই ওই মন্তব্য কি?
যাই হোক, উপন্যাস অনেক ধরনের। পাঠকও অনেক ধরনের, সমালোচক কিংবা বিচারকও। শেষ পর্যন্ত, উপন্যাসে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা চেতনাই প্রকাশ পায়। পাঠকও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা চেতনাটা খুঁজে নিতে চান একটা উপন্যাসে। কেউ কেউ ঐতিহাসিক উপন্যাসকে গুরুত্ব দেন, কারও কারও সামাজিক উপন্যাসের প্রতি একান্ত ঝোঁক।
চূড়ান্তভাবে বলা যায়, উপন্যাসসহ সব সৃজনশীল সাহিত্যই শেষ বিচারে ব্যক্তি-পাঠকের নিজস্ব অভিরুচির ওপর নির্ভর। পাঠক-সমালোচকের উপলব্ধি, বিচার ও রুচির ভিন্নতার কারণেই যে কোনো উপন্যাস বিভিন্ন বিবেচনার মানদণ্ডে দাঁড়াবার সুযোগ পায়।
তবে, আগেই বলেছি, কোনো প্রকৃত বিশুদ্ধ উপন্যাসই সমসাময়িককালে নিখুঁতভাবে মূল্যায়িত হতে পারে না, যদি হয়ে থাকে, তবে সে উপন্যাসের বিশুদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ জাগে।
২.
উপন্যাস হিসেবে মৌন ধারাপাত সম্পূর্ণ নতুন ও ব্যতিক্রম, এই কথা এখনই বলা যায় না। এই পথে অনেকেই হেঁটেছেন, এখনও হেঁটে চলেছেন অনেকেই, এবং এই পথে বাংলা সাহিত্যে যেমন অনেক সফল উপন্যাস রয়েছে, তেমনি রয়েছ বিশ্ব সাহিত্যে।
বিশ্ব সাহিত্যে যেমন ডস্টয়েভস্কির লাঞ্ছিত ও আহত, বাংলাসাহিত্যে তেমনি সমরেশ বসুর গঙ্গা, বিশ্ব সাহিত্যে যেমন উইলিয়াম ফকনারের স্যারকুচয়ারি, লাইট ইন অগাস্ট, দা আনভ্যাংকুইশড, দা হেমলেট, গো ডাউন মোজেজ প্রভৃতি উপন্যাস, যেগুলো আঞ্চলিক হয়েও সর্বজনীনতায় উত্তীর্ণ, বাংলা ভাষায় সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোঁড়াই চরিতমানস। রিক্ত সর্বহারাদের কাহিনি নিয়ে লেখা ঢোঁড়াই চরিতমানস। নিদারুণ অর্থনৈতিক নিষ্পেষিত জীবনের কথা বলে− নিম্নবিত্ত মানুষ আশ্রয় ও সান্ত্বনা চায়, সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর ঢোঁড়াই চরিতমানসে এ-ই জীবনবাস্তবতার কথাই বলেছেন।
আমরা যাকে ব্রাত্য কিংবা প্রান্তজন বলতে অভ্যস্ত, যাকে আমরা ধরে নিই নিয়তির ধ্রুব চরিত্র বলে, সেটি মূলত এই সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রেরই সৃষ্ট, কৃত্রিম চরিত্র, মানবিক রাষ্ট্রের বিপরীতে মূলত সামাজিক ও রাষ্ট্রিক চরম বৈষম্যে আরোপিত চরিত্রর। যেখানে, চরিত্রটি প্রতিমুহূর্ত কেবল সমাজ থেকেই নয়, নিজের কাছেই নিজে বিচ্ছিন্ন ও অচেনা। রাষ্ট্র ও সমাজে বৈষম্য যত তীব্র হয়, প্রান্তজনের ওপর এই বিচ্ছিন্নতা ও অস্তিত্ব-সংকটের চাপ তত তীব্র হতে থাকে। মৌন ধারাপাত-এ প্রান্ত-ব্যক্তির এ রকমই প্রায় একটি চিত্র অংকন করার চেষ্টা করেছেন মাসুমুল আলম, তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমাজের, ছোট, অথচ স্পষ্ট গভীর একটা চেহারা। এই চেহারার সূত্রে দানা বেঁধে ওঠে এই প্রান্তজনপদেরই এক ছোট্ট আখ্যান।
ছোট হলেও, আখ্যানটির চরিত্র ও কাহিনির মধ্যে ধারাবাহিকতা আছে। স্মৃতিসূত্রের ভেতর দিয়ে ছোট ছোট একেকটি চরিত্রের একেকটি ঘটনা নিয়ে জলের মতো সরলতায় জীবন বয়ে গেছে। নিছক ঘটনার বর্ণনার বদলে লেখক চরিত্রগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিত্তাকর্ষক করে তুলতে চেয়েছেন। ফলে আখ্যানটি পাঠে কোনো ক্লান্তি কাজ করে না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ অন্ত্যজ আলেকজান বুড়িকে যদি নিজের সম্পর্কে জিগ্যেস করা হয়, তাহলে সে তার জীবনের ঘটনা মনে করে বলে:
সেই যেবার আকাল আসলো দেশে আর সিবার গিরামে ঘুড়া দাবড়ও হলো না, তখন আমার এক কুড়ি বয়েসও হইনি, বিয়ে হলো ওই সানালের বাপের সাথে।
আর আলেকজনের একমাত্র অন্ধ ছেলে সানাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বলে :
ঐ যিবার মুখির ভাষায় কথা বলাবলি নিয়ে রক্তারক্তি কারবালা হয়ে গেলো...তখনো কিন্তুক দেশ স্বাধীন হইনি... সেই তখন আমার সানাল হলো।
আর সানাল অন্ধ হলো কীভাবে, জানতে চাইলে মা আলেকজান বলে−
কিরাম করে আবার... প্রথমে তো বুঝতি পারিনি... তার চোখি দি-রাত্রির কোনো হুশদিশ ছিলো না। দুপুরি ঘুমোয়ে ঘুম থেকে উইঠে বইলতো, মা সন্ধে লাগিছে নাকি রে... তখনো বুঝিনি। সেদিন ছিলো শবেবরাত... সব বরাতের লিখন... মোড়ের মাথায় বড় বটগাছটা এমনি এমনি উল্টে পড়লি কিয়ামত না গজব নামার শব্দ হলো যিনু, সানাল উঠে কয়, মা কী হয়েছে? আমি কই বুঝতিছিনে বাপ... শুনে সে কয়, বুঝতিছো না মা? তুমি আমারে ধরো দিনি, আমি তো কিসসু দেকতিছিনে, কিছুই না... তো, উই যিবার বটগাছ পড়লো, শিঙ্গায় ফু দিয়ার মতোন কানে তালা ধরার মতোন শব্দ হলো... আমার সানালও অন্ধ হলো বাপ!
এভাবে আলেকজানের স্মৃতিঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে অতীত থেকে উঠে আসে, মুক্তিযোদ্ধা স্বামী আয়নাল সর্দারের জীবন, যার মাথাভর্তি ছিল বাবরিচুল; যে ‘বাড়ির পাশের জঙ্গলে গিয়ে মুঠো করা দু’হাত মুখে নিয়ে কী কৌশলে নিজেই ঘু-ঘু...ঘু.ঘু ডাক-ডেকে সুতোয় বাঁধা পোষা ঘুঘুর খাঁচা খুলে দিয়ে বনঘুঘু ধরে ফেলতো’; যে একজীবনে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহু পেশা বদল করেছিল। কিংবা সেগুলো মোটা দাগে কোনো পেশাই ছিল না; নিছক ক্ষুণ্ণিবৃত্তির যা-হোক একটা উপায় মাত্র।
চামড়ার কারবারি চৌধুরিদের জমিতে একটা গোলপাতা ছাওয়া ঘরে বিনা পয়সায় থাকতো আলেকজানরা। অনেক পরে কদবেলতলায় অসম্পূর্ণ একটা ছাদ না-ওঠা পরিত্যক্ত দরদালানে আলেকজানের সংসার স্থানান্তরিত হয়, সময়ের ফেরে পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল ঘেরা যে বাড়িতে একদিন পুতের বউ ঝিনুকা বেগম তার মতোই পরাশ্রয়ী সংসার পেতে বসে।
এভাবে ‘আলাই’নামে এক কুষ্ঠরোগী আলেকজানের স্মৃতির ভেতর দিয়ে উঁকি মারে, একদিন আয়নাল সর্দারের সাথে রতিমোচনের আগে আগে যার এক বগগা কালো শরীরখানা মনে ক’রে আলেকজান গোপনে অশেষ তৃপ্তি পেয়েছিল।
এদিকে নিম্নবিত্ত সরকারি পোস্টঅফিসের সামান্য কেরানি আজমল কবির, ঘুমের মধ্যে যার শাকুর সাহেবের মেয়ের সঙ্গে স্বপ্ন-সহবাস ঘটে যায়। শাকুর সাহেব মুসলমান, তবে শ্রেণিভেদ-মানসিকতা ক্রিয়াশীল তার মধ্যে, তিনি পাড়া-মহল্লার মসজিদে জামাতে নামাজ পড়েন না। একা একা নামাজ পড়েন।
শাকুর সাহেবের স্ত্রী, যিনি সমবায় ব্যবস্থা চালু করে পাড়ার অনেক মহিলার উপকার করেন।
মৌন ধারাপাত-এ প্রান্তরেখার বাহিরে ছড়িয়ে গিয়ে আবার কোনো কোনো চরিত্র কোথায় হারিয়ে যায়, তার হদিশ মেলে না। উপন্যাস এগিয়ে যায় আরও কয়েকটি এমনই চরিত্রকে ঘিরে, যারা উঠে আসে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত জীবনের শেষ প্রান্তরেখা থেকে।
৩.
মৌন ধারাপাত-এ কোনো বিশেষ বক্তব্য বা চিন্তা সরাসরি জানান দিয়ে ওঠে না, কাহিনির মধ্যেও তেমন কোনো বিশেষত্ব দেখা যায় না। আলেকজান নামের বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক বুড়ির স্মৃতিসূত্রের পথ ধরে প্রতিটি চরিত্র ছোট ছোট জীবনের গল্প নিয়ে হাজির হয়, কিন্তু আলেকজানসহ আখ্যানের কোনো চরিত্রই আলাদা করে বিশেষ কোনো গুরুত্ব পায় না। সব চরিত্র সমান গুরুত্বে বয়ে চলে আখ্যানের দরকারে। একটু জোর দিয়ে বললে বলতে হয়, নিছক কোনো কাহিনির বর্ণনা নয়, মৌন ধারাপাত-এ ভাষা নিয়ে মাসুমুলের একটা স্ক্ষ্মূ পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে। ঔপন্যাসিকের নিজস্ব সচেতনভাবে যেমন, তেমনি অমিয়ভূষণ-কমলকুমার-জগদীশ-সতীনাথ ভাদুড়ীসহ স্পষ্টত আরও পূর্বজ কারও কারও ভাষা-প্রভাবে, এই ভাষাভঙ্গির পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেষ্টা প্রতিভাসিত হয়ে উঠতে চায়।
এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পশ্চাতে যা কাজ করে, এসময়ের অনেক কথাসাহিত্যিকের মধ্যে, মাসুমুলের মধ্যেও প্রথমত সেই ভাষার প্রথা ভাঙার চেষ্টাই। উল্লেখ্য, আগে তো পূর্বজদের ভাষার অনুসরণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা চাই, বহু-বহু অনুশীলন-পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তারপর পূর্বজদের ভাষা উত্তীর্ণ হয়ে নিজের নতুন ও ব্যতিক্রম ভাষাটি খুঁজে পাওয়ার ব্যাপার, অর্থাৎ দাঁড়িয়ে যাবার ব্যাপার, যা পরবর্তী কারও কারও আদর্শ হতে পারে। আবার তাকেও কেউ কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারে পরবর্তীকালে, ভাষা এগিয়ে যেতে পারে, সাহিত্য এগিয়ে যেতে পারে। মাসুমুলের ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেষ্টা এই পথে বলেই আমার মনে হয়।
এককালে পাঠক-সমালোচকেরা সাহিত্যে, বিশেষ করে গল্প-উপন্যাসে এমন একটি বাস্তবতা আকাঙ্খা করতেন, যার মধ্যে মনে হবে নায়কচরিত্রটি স্বয়ং যেন লেখক নিজে, কাহিনিটি যেন তারই জীবনের দগদগে বাস্তব অভিজ্ঞতাসঞ্জাত কিন্তু এখনকার ব্যতিক্রম কারও কারও গল্প-উপন্যাসের ভাষা এমনভাবে সৃষ্টি হয় বলে আমার মনে হয়, যাতে উপন্যাসের মধ্যে লেখককে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু লেখককে খুঁজে পাওয়া না গেলেও, তার শক্তি খুঁজে পেতে তেমন কষ্ট হয় না। আড়াল থেকে ঠিকই লেখকের শক্তি বোঝা যায়। লেখকের এই শক্তি নিজের মধ্যে ধারণ করেই, মৌন ধারাপাত রচনায় মাসুমুল আলম নিজেকে কোনো প্রকার জাহির না করে, নিজের রচনা থেকে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে পারেন বেশ ভালোভাবেই।
বলতেই হয়, কাহিনি নয়, মাসুমুলের মৌন ধারাপাত ভাষা-প্রধান উপন্যাস। অবশ্য আগেই ইংগিত দিয়েছি, এ কৃতিত্ব মাসুমুলের একার নয়, তাঁর সময়ের উল্লেখ্য অনেক লেখকেরই অন্বিষ্ট প্রথাগত ভাষাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে অন্যতর এক ভাষার বুননে উপন্যাসকে বেঁধে ফেলা।
মৌন ধারাপাত-এর গতি যেমন শ্লথ নয়, তেমনি দুর্বারও নয়। ছোট ছোট কাহিনির ছোট ছোট চরিত্র, ঔপন্যাসিক কাহিনির মধ্যে যেমন তেমনি চরিত্রগুলোর মধ্যেও অযথা লগ্ন করে দেননি কোনো আদর্শের ভার, উপদেশের ভার, হিতৈষণার ভার, কোনো তত্ত্বকথা কিংবা কোনো বিশেষ চেতনাও। পরিবেশ ও চরিত্রগুলোয় বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। কোনো নাটকীয়তা নেই।
মোদ্দা কথা, মৌন ধারাপাতে অযথা বাস্তবতা উত্তেজনায় তীব্র হয়ে ওঠে না, কাহিনিও নেহাত ছোট, কিন্তু ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে কৃতিত্ব, তা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।
বলাই হয়তো যায়, সমাজের মঙ্গল কিংবা সমাজে শ্রেণিবৈষম্যের ভারসাম্য কিছুটা হয়তো দূর হতে পারে, কিংবা ঐ জাতীয় সামাজিক অসংগতি দূর করণীয় যে কোনো এক বা একাধিক দায় বা অঙ্গীকারের ইংগিত উপন্যাসে থাকা উচিত, কিংবা আরও এমন কিছু দগদগে বাস্তব চিত্র, যা ঔপন্যাসিকের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সরাসরি প্রকাশ করবে, কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের এই উদগ্র প্রকাশ্য রোমান্টিকতা আর কত কাল? কিংবা শুধু এই পথেই উপন্যাসের সৌন্দর্য সৃষ্টি হতে পারে− এ কথা ঠিক নয়। একজন দেবেশ রায়, কমলকুমার মজুমদার, সতীনাথ ভাদুড়ী যেসব উপন্যাস রচনা করে গেছেন, সে-ধারায়ই শুধু লিখে যেতে হবে− তিস্তাপারের বৃত্তান্ত বা গঙ্গা যে-ভাষা বা চরিত্র সৃষ্টি করে গেছে, তা-ই অনুসরণ্য− একথা ঠিক নয়। মৌন ধারাপাত-এর কাহিনি ও চরিত্রসমূহের মধ্যে যে নীরবতা, মন্তর গতি ও শান্ততা লক্ষ করা যায়, তার মধ্যেই একটা সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়ে যায়, ভাষার গুণপনার এই দিকটি মাসুমুলের উপন্যাসের ভবিষ্যতের উপর আমার মধ্যে একটা আস্থা রাখতে চায়। ঠিক তিস্তাপারের বৃত্তান্ত নয়, অথচ অন্য ধারার নতুন আর একটি তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, কিংবা ঠিক গঙ্গাও নয়, আবার গঙ্গাও− আরও হয়তো অনেক সফল উপন্যাস সৃষ্টি হবে ভবিষ্যতে, আমরা সেসবেরও প্রশংসা ও মূল্যায়ন করব− উপন্যাসের সমগ্র পরিপ্রেক্ষিতকে ভেদ করে, তেমন একটি রচনা সৃষ্টি কি হতে পারে একদিন, এই ঔপন্যাসিকের হাতে!
মন্তব্য