এমন নয় যে না-পড়তে আমি চাই-- না, আমি পাঠবিরোধী নই; তবে এ ভাবনাও আমার সমান প্রবল যে পাঠের বিস্তার দিয়েই লেখকের বিচার কিছু জরুরী নয় এবং তেমন বিচার বেশ অবিচারই বটে। কোনো লেখকের লেখা ভাল লাগল আর পরে জানলাম তিনি এটা পড়েন নি, ওটা পড়েন নি, সেটা পড়েন নি, তখনই নিমেষে ওইসব ভাললাগা না-এ পরিণত হবে? বা আমরা কি একজন লেখককে পড়ার আগেই জেনে নেব তিনি নিজে কী কী পড়েছেন? পাঠক হিশেবে এমনতর প্রক্রিয়া অনুসরণের বাস্তবতাও কি আদৌ আছে-- অর্থাৎ, পাঠকের পক্ষে, তিনি চাইলেও, কি আগেভাগে জেনে নেয়া সম্ভব যে একজন লেখক কী কী প'ড়ে কিংবা কী কী না প'ড়ে লেখক হয়েছেন? আমার এই ভাবনার-- লেখকের পাঠপরিধি দিয়ে তাঁকে না মাপার পক্ষে দাঁড়াবার-- বিবিধ তাৎপর্য রয়েছে আমি নিশ্চিত, তবে সেসব তাৎপর্যের চেয়ে একেবারে সোজাসাপ্টা সুবিধার দিক হচ্ছে, এতে ক'রে নিজের যথেষ্ট না প'ড়ে উঠতে পারাকে বৈধ ক'রে নেয়া চলে। ফলে, মাসুমুল আলমকে আমি যে তেমন প'ড়ে উঠতে পারি নি সেটা বেশ বৈধই!
তবু, এমন বৈধতা সত্ত্বেও, একটা টানাপোড়ন কি থেকে যায় না মনের মধ্যে? থাকেই। নইলে পড়া/না-পড়া বিষয়ে কথাই বা উঠছে কেনো এত-- একজন গ্রামবাসী হয়ে কেনোই-বা?’ ‘র্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো’, ‘মৌন ধারাপাত’, ‘মেন ইন দ্য সান' বইগুলি রাজধানী থেকে সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছিলাম? কিন্তু শেষপর্যন্ত, আমার ক্ষেত্রে ওই "প'ড়ে উঠতে না পারা"! তবে ওই টানাপোড়েনের একটা চলনসই মীমাংসা চাই তো! তখন ভেবে দেখি, বুঝে দেখি, আমি আসলে পূর্বতন লেখকদের প্রতিই আগ্রহী, অনুরক্ত। কিন্তু "পূর্বতন" মানেটা কী? এর বিপরীতে কি "সমকালীন" বা "সমসাময়িক"? কিন্তু সমকালিনতা বা সমসাময়িকতাই-বা কাকে বলে? সুবিমল মিশ্র ও মাসুমুল আলম যেহেতু একই সময়ে বর্তমান, তাহলে তাঁরা নিশ্চয়ই সমসাময়িক! তাহলে, আমি নিজে যদি সুবিমলকে আমার পূর্বতন মনে করি তবে একজন পূর্বতন এবং একজন অ-পূর্বতন সমসাময়িক হয়েই একই সময়কে লিখছেন-- সেক্ষেত্রে সুবিমল পড়ব কিন্তু মাসুমুল পড়ব না কোন্ যুক্তিতে? তখনও খোঁড়া যুক্তি একটা থাকে বটে: কথাটা সমসাময়িক নয়, কথাটা হবে সমবয়স্ক-- সমবয়স্ক লেখকের লেখা তেমন পড়ব না কারণ আমরা সমবয়সীরা যে যার মতো নিজেদের সময়টা লিখব, পাশের জন কেমন ক'রে তাঁর লেখাটা লিখছেন সেটা আমার দেখার সময় থাকলে দেখলে মন্দ নয় তবে না দেখলেও ক্ষতি কিছু নেই। কিন্তু তাহলে যুক্তিটাকে "খোঁড়া" বললাম কেনো-- সে কি সত্যিই চলতে পারে না? ভাল ক'রে ভাবলে, তাকে আসলে মৃদুখোঁড়া বলাই ভাল কারণ সে বেশ ভালই চলতে পারে, কেবল দুর্বলতা এইটুকু যে সমবয়স্কতার সীমা কীভাবে নিরুপিত হবে, জন্মসাল কতটুকু দূরত্বে থাকলে সমবয়স্ক বলা যাবে এসবের কোনো অনড় নির্ণায়ক যন্ত্র নেই। অতএব দেখা গেল, মৃত লেখকদের বাদ দিলে, জীবিতগণের ক্ষেত্রে একই সময়কে একজন কুড়ি বছরের লেখক যেমন লিখছেন তেমনি লিখছেন আশি বা চল্লিশ বা ষাট বা ত্রিশ বছরের একজন-- পাঠক কাকে কীভাবে পড়বেন সেটা তাঁর ব্যক্তিগত রুচি ইচ্ছা ও সামর্থ্য ও অন্যান্য অনেক কিছুর ব্যাপার। ফলত, মাসুমুল আলমকে না পড়ার কোনো চূড়ান্ত বৈধতা আমি দাঁড় করাতে পারি না।
এবং এই যে টানাপোড়েন আমার তাঁকে নিয়ে, এতে প্রমাণিত হয় তিনি একজন বিশিষ্ট লেখক আমার কাছে-- কারণ অনেক লেখককেই তো নির্দ্বন্দ্ব বর্জন ক'রে দিতে পারি, কিন্তু প'ড়ে উঠতে না পারলেও, এমনকি কোনোদিন না পারলেও, মাসুমুলকে বর্জন করতে পারি না-- বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যের কথা উঠবে আর মাসুমুল আলমের কথা উঠবে না সেটা হতেই পারে না।
মনে রাখতে হবে, আমি বলেছি "তেমন প'ড়ে উঠতে পারি নি"-- অর্থাৎ, তাঁকে নিয়ে গভীর কিছু লেখার মতো পড়াটা হয় নি, কিন্তু কিছুই না প'ড়ে আমি নিশ্চয় এসব কথাও বলতে পারতাম না! আর কথা বলার জন্যে সব যদি পড়তে হবে, আমরা কি সব রবীন্দ্রনাথ সব জীবনানন্দ সব কমলকুমার পড়েছি?
বিব্রত হয়েছি, বেশ ব্যথিতও হয়েছি বিন্দু-সম্পাদক সাম্য রাইয়ানের প্রীতি-উচ্ছল আমন্ত্রণ রক্ষা করতে না পেরে। তবু বেশ ক'দিন ধ'রে এই শিরোনামটিকে কেন্দ্র ক'রে কথা ঘুরছিল মাথার ভেতরে-- কিন্তু সে-কথাগুলোকেও ধ'রে বসাবার মতো স্থির সুযোগ আমার ছিল না বা আমি পারছিলাম না সুযোগটা রচনা ক'রে নিতে। এর মধ্যে লেখা দেবার বর্ধিত সময়সীমাও অতিক্রান্ত হল আর আমি দুঃখে দুঃখে বেঁচেও গেলাম! তার পর, শেষের পরের শেষে, কাল কবি নাভিল মানদার শিরোনামটি শুনেই আবিষ্কার করলেন এর মধ্যে পাঠক-লেখকের মধ্যেকার গূঢ় দুর্ধর্ষ চিরজীবী দ্বন্দ্ব; এবং প্রেরণাসঞ্চারী আশা রাখলেন যে লেখাটি হয়ত হয়েও যেতে পারে এর মধ্যে যখন কি না 'বিন্দু' প্রকাশের আর এক দিন মাত্র হাতে। তাঁর আশা ফলল : হয়েই গেল এই যে! কিন্তু সময় শেষ, সম্পাদক যে লেখকসূচী প্রকাশ করেছেন সেখানেও এই লেখার লেখক অনুপস্থিত-- অতএব সব মিলিয়ে লেখাটি না-লেখা হয়েই রইল। আর সকল প্রশংসা বন্ধু নাভিল মানদারের।
হ্যাঁ, আমি সাম্যকে এবং নাভিলকে বলেছিলাম, এমনটা হওয়া কিছুতেই উচিত হবে না যে অনুপ চণ্ডাল ওভাররেটেড-- তেমন কিছুই লিখতে পারলাম না অথচ আমারও একটি লেখা রইল সংখ্যাটিতে। এখন, আমিও নিশ্চিত, নাভিল ঠিকই ধরেছেন: পাঠক-লেখক দ্বন্দ্বটি বা পাঠকের অন্তর্দ্বন্দ্বটি এইখানে আছে। হয়ত আর কিছু নেই! আর কিছু আছে?
মন্তব্য