লেখক মাসুমুল আলমের সাথে ২০২০-এর বইমেলায় ‘সংবেদ’-এর স্টলেই প্রথম পরিচয় হলো। তাঁর গল্পের বই উপহার দিয়েছিলেন। বাসায় এনে কিছুটা পড়েছি। তারপর অন্ত্য মার্চ থেকেই কোভিড ও অতিমারীর সাথে আমাদের সংগ্রাম! মাসুমুল মূলত: ছোটকাগজের লেখক। ‘প্রতিশিল্প’বা ‘জঙশন’সহ নানা ছোট কাগজে গল্প লিখেছেন তিনি। বাংলাদেশে দেখতে দেখতে যে ধারাটি ক্ষীণতোয়া হতে হতে বিলুপ্তই হয়ে এলো প্রায়! এখন যখন আজ ১লা জানুয়ারি ২০২১ ও ঘড়িতে রাত/সকাল একটা আর আমি লাল চোখ নিয়ে পিসির সামনে বসে আছি মাসুমুলের বই নিয়ে লেখাটি লিখব বলে, তখন শেষবারের মত তাঁর বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে ভাবছিলাম তা-ও ত’ কতদিন পর এক সমকালীন লেখকের (মাসুমুল ও আমার জন্মবছর একই সালে) পুরো বই পড়তে পারলাম। এবং সানন্দে। এই যে বাজারে কমসে কম পাঁচ/ছ’টা পুরষ্কার বগলদাবা করে ঘুরে বেড়ানো অনেক গদ্য লেখকের গদ্য পড়াই যায় না, পড়তে বিরক্ত লাগে...অথচ মাসুমুলের নাম আমি জানতামই না!
আগামী পরশু আমার দু’টো পরীক্ষা। তবু আজ সন্ধ্যা থেকে অতিমারীতে খানিকটা বিকল হয়ে যাওয়া তবে বাংলা ফন্ট ভাল আসে সেই নোটপ্যাডে লিখব নাকি ইংরেজি ফন্ট ভাল আসে তবে বাংলা ফন্ট হারিয়ে যায়, তবে যে কোন ফাইল ভাল ডাউনলোড হয় সেই বড় বোনের ল্যাপটপে লিখব সেটা নিয়ে বিচলিত হয়ে আছি। জাতিসঙ্ঘে স্বল্পস্থায়ী একটি গবেষণা কাজের সুযোগে হাতে কিছু টাকাও এসেছে। একটি ভাল ল্যাপটপই কেনা দরকার যেটায় বাংলা-ইংরেজি সব ফন্টই খুব ভাল আসবে। কিন্তু এক সপ্তাহ হয় মার্কেটে যাবারও সুযোগ পাচ্ছি না সময় সঙ্কটের কারণে। রাত একটা পর্যন্ত গুঁতিয়ে অবশেষে ফাইল ভাল ডাউনলোড হয় তেমন পিসিতে মাসুমুলের একটি বই খুলে রেখে, বাংলা ভাল আসে এমন নোটপ্যাডটি খুলেছি লেখাটি লিখতে। আমার দুই চোখ লাল হয়ে আছে গত কয়েকমাসের অসম্ভব কিছু পেশাগত চাপ থেকে।
নামপুরুষ ও অন্যান্য প্রচ্ছদ: মোজাই জীবন সফরী |
প্রথম গল্প ‘স্বৈরিণীর জন্য প্রতীক্ষা’টি এরশাদ আমলের এক দশকের কঠিন সময়ের গল্প। মফস্বলের স্বৈরাচারবিরোধী তরুণ কবি-লেখক-চিত্রশিল্পী-সঙ্গীতশিল্পী বৃত্তে সুন্দরী ও গায়িকা রিমির প্রথমে বিয়ে হয় এক প্রবাসী যুবকের সাথে। তবে প্রবাসী যুবক প্রতারণা করলে রিমি ফিরে আসে এবং কিছুদিন পর তার দ্বিতীয় বিয়ে হয় এক সেনা অফিসারের সাথে। সেই স্বামীটিরও পানিতে ডুবে অপঘাতে মৃত্যু হলে রিমি ফিরে আসে তার জেলা শহরে এমন একদিনে যেদিন শহরে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে। কেমন এক অদ্ভুত সমাপতন! দু’টো বিয়েতে ব্যর্থ রিমির জন্য
ততদিন এই মৃত নদী আর ধুলোওড়া শহরে তার জন্য কয়েকটি সামান্য করুণার্দ্র অন্ত:করণ হয়তো প্রতীক্ষা করে থাকবে।
দ্বিতীয় গল্প ‘এপ্রিলের এক সন্ধ্যা’-য় কুষ্টিয়ার লোকজ শব্দ যেমন ‘কায়ো’ মানে যে ‘কাক’ বা ‘ঢক’ মানে যে বৃষ্টি এমন কিছু সুন্দর তবে অজানা শব্দের দারুণ ব্যবহার করেছেন মাসুমুল। বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় যেমন ‘সিডর-নার্গিস-অভয়ে’র প্রেক্ষিতে গ্রামীণ জনপদগুলোয় পুলিশ বা বিজিবির উপস্থিতির দৃশ্য মিলিয়ে লেখক তৈরি করেছেন বেশ কিছু বাস্তববাদী গল্প। এই বইয়ের তৃতীয় গল্পে মধুমতি তীরের গন্ডগ্রামের রাস্তা ধরে চলা গগন আর তার ছোট ছেলে দীনুর সন্ধ্যা অতিক্রান্ত রাতের তারাভরা আকাশ আর একপাশে খরস্রোতা নদীর পথে সহসা কিছু শীর্ণ মানুষ অথবা ভৌতিক দৃশ্যের যেন তারা মুখোমুখি হয়! জ্ঞান হারা পিতা-পুত্র জ্ঞান ফেরার পর দ্যাখে যে হাট ফেরতা তাদের হাতে চাল-মাছ-সব্জি কিছু নেই!
চতুর্থ গল্প ‘আনন্দ কোথা থেকে আসে’-র চির অকৃতদার ও তাই সংসারে খানিকটা অবহেলিত আকবর ভাই যেন সমাজতন্ত্রের দূরবর্তী স্বপ্ন দেখার আকাঙ্খা ব্যক্ত করলেও চাল-চুলোহীন আকবর ভাইয়ের সমাজের সর্বত্র ক্রমাগত ‘প্রান্তিক’ হয়ে পড়ার বিষয়টি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। এমন কত শত শত আকবর ভাইয়ের জীবন যে গুঁড়িয়ে গিয়েছে তথাকথিত প্রেরেস্রৈকা ও লক বা হবসের মত লেখকদের ক্ষেত্রেও তা’ বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ওয়ান্ডারল্যাণ্ড’ গল্পটি খানিকটা সুস্থ ও সাউণ্ড প্রকৃতির।’
‘বিশেষায়নের প্রতিবেদন’ গল্পটির শিরোনামই যেন আমাদের দেবেশ রায়ের ‘খরার প্রতিবেদন’ বা ‘দাঙ্গার প্রতিবেদনে’র কথা মনে করিয়ে দেয়।
‘ভৈরোঁ’ গল্পে যশোরের গ্রামে শীতকালীন সকালের অনবদ্য বিবরণ মেলে। খেজুর গাছে উঠছে ‘গাছি’ মাটির ভাঁড়ে সারারাত জমতে থাকা খেজুরের রস নিয়ে। শাল-সেগুন-মেহগনি-আমলিচুজলপাইয়ের বাগানে আচ্ছন্ন, কুয়াশাময় যশোরের শীত চোখের সামনে ধরা দেয়। সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ এই গল্পের মুখ্য প্রতিপাদ্য।
‘উল্লেখযোগ্য বোরিং বিষয়’ অবশ্য গল্প হিসেবে ততটা সফল বলে মনে হয়নি। ‘বাদশা নামদার’ গল্পটি না পড়লেও যেন তেমন কোন ক্ষতি হবে না। ‘হনুমানের স্বপ্ন ও এক পেয়ালা পরিবেশনা’ সম্পর্কেও একথা বলা যায়। ‘ত্রিমুণ্ড থেকে আদি কাণ্ড’ও পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত ঘটাতে অসমর্থ। ‘সমবেত হত্যাকাণ্ড’ও নির্দিষ্ট কোন আখ্যানের কথা বলে না সেইভাবে। ‘নীলমন্থন’ একটু যেন ভাবি বা বড় আপার মত সিনিয়র নারীকে নিয়ে তরুণতর যুবকের চির নিষিদ্ধ ফ্যান্টাসির কথা বলে।
‘নবকুমারের শান্তিঘুম’ গল্পে নবগঙ্গা নদীর এক জেলের কথা এসেছে। ‘সমাপতন’ গল্পটি বিষয়বস্তুর কারণেই চিত্তাকর্ষক। ‘নামপুরুষ’ গল্পটিতে কাহিনীবস্তুর চেয়ে ডিটেইলসের কাজে লেখককে বেশি মনোযোগী মনে হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে মাসুমুলের গল্পে কাহিনীর থেকেও কাহিনীকে কিভাবে বলা হবে সে বিষয়ক মুন্সিয়ানাই প্রধান। সমকালীন রাজনৈতিক নানা ঘটনার আলোচনা থেকে আরো নানা প্রসঙ্গ গল্পে আনেন তিনি। সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গ যেমন গুয়ানতানামো থেকে বার্লিন প্রাচীর সব প্রসঙ্গই এসেছে তাঁর গল্পে। রমজানের পবিত্রতা রক্ষার নামে সঙ্ঘটিত কর্মকাণ্ড থেকে শাসক দল কিভাবে শাহবাগ আন্দোলন তৈরি করে সেটা ভেঙ্গেও দেয়, সে বিষয়ে খোলাখুলি ও রাখ-ঢাকহীন, অকপট বয়ান আছে তাঁর। যৌনতাও মাসুমুলের গল্পে দীর্ঘ ও তীব্র পরিসর দখল করে আছে। তবে তা’ কখনো কখনো এতটাই দীর্ঘ ও তীব্র যে অস্বস্তিকর হতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে খুবই কাজে ব্যস্ত ও ক্লান্ত সময় যাচ্ছে বলে মাসুমুলের গল্প নিয়ে গভীরভাবে লেখা হলো না। খুবই উপরভাসা এই লেখার জন্য আমি আন্তরিকভাবে লজ্জিত। মাসুমুল আলম আরো লিখুন। লিখে খানিকটা হলেও বিশল্যকরণী যোগান বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোর প্রণোদনায় কবিতা-গল্প সবকিছুকে সঙ্কুচিত ও প্রমোদ পণ্য করে তোলার মারণ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধ প্রক্রিয়ায়।
মন্তব্য