কোরাকাগজের খেরোখাতা
জিললুর রহমান
সম্ভবত স্কুলে যাত্রার কিছুদিন পর থেকেই আরবী পড়াও একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছিলো। বাইরের কোনো মৌ-লোভী মৌলবি’র পা পড়েনি ঘরে। বরং মৌলানা মোঃ আমিনুর রহমানের ২য় পুত্র মোঃ মাহবুবুর রহমান, মানে স্বয়ং মদীয় পিতৃদেব এই গুরুদায়িত্ব লঘু বেত্রাঘাতের সহায়তায় সফলভাবেই পালন করছিলেন। “লেই আলিফ বে তে ছে-রা / কানত ধরি ছেছেরা” পেছনে পেছনে যতোই ছড়া কাটি না কেন, পিতার কর্ণকুহরে আমার কর্ণের বেদনা বিধুর রক্তাভা’র দীর্ঘশ্বাস কখনও পৌঁছেনি। এই ভাবে প্রভাত মানে সূর্যোদয় কিনা তা জানার বুঝার আগেই জেনে গিয়েছিলাম প্রভাত মানে সপাৎ নারকেল শলার ঝাড়ু কী বেতের বাড়ি (আঘাত) সমেত আলিফ বে পড়তে পড়তে আমপারা’র পৃষ্ঠা কুঁকড়ে যাওয়া। বেশিক্ষণ নয়, পনের মিনিট মতো আরবী পড়ে স্কুলের জন্যে প্রস্তুত হতে হতো। তারপরও ধীরে ধীরে একদিন আমপারা পড়া শেষ হয়ে এলো। কিন্তু এই পুস্তিকা পাঠ করে আম্রবৃক্ষ হতে একটিও আম পেড়ে আনা হয়নি আমার। তবু যেন কেন আম না পাড়া ক্ষীণাঙ্গী পুস্তিকাটিকে আমপারা বলে ডাকে সবাই আজও তার কিনারা করতে পারিনি। হয়তো আমজনতা যে বই পড়তে পারে তাকেই আমপারা বলে থাকে। আসল সত্য নিশ্চয় হুজুরদের অজ্ঞাত নয়, তবে আমি তো হুজুরের ছাত্র নই, বরং হুজুরের প্রপৌত্র বলা চলে। কারণ আমার দাদার বাবা জনাব আব্দুল লতিফ খোনকারী পেশায় নিযুক্ত থাকলেও তস্য পুত্র মৌলানা আমিনুর রহমান মানে মদীয় দাদাজান কিছুতেই মৌলোভী ছিলেন না। বরং আয়কর অফিসে সামান্য চাকরি জুটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। আর আমার আরবীর গুরু স্বয়ং একাউন্টিং-এর অধ্যাপক। জানি না, তিনি আরবী পাঠেরও কোনো হিসাব নিকাশ তথা নগদান বাকিদান ইত্যাদি করে দেখেছিলেন কিনা। এর মধ্যে সবাই যেমন শেখে —— ‘আলমাদুলিল্লাহ’ সহ আরো ১০টি সুরা আমাকে জবরদস্তি মুখস্ত করিয়ে ছেড়েছেন। পরে জেনেছি ‘আলহামদুলিল্লাহ’—কে সুরা ফাতেহা বলে। আম্মা ভাল কিছু রান্না করলেই আব্বাকে বলতেন ফাতেহা দিতে। আমি লক্ষ্য করেছি, আব্বা নামাজ পড়ে লম্বা মোনাজাত করে বলতেন, ফাতেহা দেওয়া হয়েছে, খাওয়া শুরু করতে পারবে। আমিও একদিন আম্মাকে বলেছিলাম — আমি তো সুরা ফাতেহা জানি, তাই এখন থেকে আমিই ফাতেহা দিতে পারবো। অবশ্য আম্মা আমার ফাতেহা দেওয়া গ্রাহ্য করেননি কোনোদিন। আরও অনেক পরে বুঝেছিলাম ফাতেহা মানে সূচনা বা শুরু। তাই নামাজের প্রতি রাকাতে এই সুরা দিয়ে শুরু করতে হয়। তখন একদিন আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খাওয়া শুরু করলেই তো ফাতেহা হয়ে যায়। কিন্তু না, আম্মা বললেন, ফাতেহা মানে শুরু হলেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে তারপর শুরু করলে আহারও ইবাদত হয়। যাই হোক, একদিন আব্বা আমাকে অজু করতে শেখালেন, জায়নামাজে দাঁড় করিয়ে নামাজের নিয়ম শেখালেন। এসব শিখতে শিখতে চতুর্থ শ্রেণীর শুরুর দিকে একদিন এক মৌলানা সাহেবকে বাসায় নিয়ে এসে আমাকে অজু করতে বললেন। অজু করে এলে, আমার হাতে মোটা কোরাণ শরীফ তুলে দিলেন। আর হুজুর কি সব বলে টলে আমাকে কোরাণ থেকে সুরা ফাতেহা পাঠ করতে বললেন। তারপর লম্বা করে মুনাজাত করলেন আমাকে নেক হায়াৎ দানের জন্যে এবং বাবা-মার সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির জন্যে বেশ দরদ দিয়ে আল্লাহকে বললেন। কিন্তু তার পরদিন থেকে হুজুর আর আসেননি। তারপর থেকে কোরআন পাঠ এবং নামাজ শিক্ষাও যথারীতি পিতার নিয়ন্ত্রণেই চলছিলো। একদিন আব্বা ঘোষণা দিলেন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে হবে। আব্বার হাত ধরে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে সুন্দর মসজিদটির ভেতরে পা রাখলাম। এর বাহ্যিক কারুকার্যের জন্যে চট্টগ্রামের মানচিত্রের প্রচ্ছদে এই মসজিদের ছবি ছাপা ছিলো দেখেছি। এতো রঙের শিল্পিত সমাহারে মসজিদ যেন পুষ্পশোভিত হয়ে ছিলো। সবাই একবাক্যে বলে চন্দনপুরা বড় মসজিদ। বহুকাল ধরে এই নামেই মসজিদটির পরিচয় জেনে এসেছি।
এর মধ্যে জামাতে নামাজ পড়ার অজুহাতে দৈনিক পাঁচবার বাড়ি থেকে বেরুনোর একটা চমৎকার ব্যবস্থা হওয়ায় আমি নামাজে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়লাম। মসজিদে দৌড়ে দাপিয়ে বেড়ানোর কিছু সঙ্গীও জুটে গেলো। আমি সবসময় চেষ্টা করতাম শেষ কাতারে দাঁড়াতে। আমাদের ছোটদের মধ্যে যারা সামনের কাতারে নামাজে দাঁড়াতো, তারা সিজদায় যাওয়াটা বড় বিব্রতকর ছিলো, কারণ পেছনের জন নীচে থেকে সামনের জনের লুঙ্গিটা উপরের দিকে তুলে দিলে ভেতরের খোলনলচে প্রকাশিত হয়ে যেতো। আরেকটা কাজ খুব প্রিয় ছিলো, মসজিদের অনেকগুলো মিনারে মিনারে ঘুরে বেড়ানো। এমনও হয়েছে আজান দিতে না দিতেই এমনকি বা’জানের আগেই ছুটে গিয়ে মিনারের সবচেয়ে উঁচু ধাপ বেয়ে চূড়ায় উঠে দূরে চিকন ফিতার মতো কর্ণফুলীর রূপ দেখতে দেখতে জামাত শেষ হয়ে যেতো। মুসল্লীদের বাড়ি ফেরা লক্ষ্য করে কাঁচুমাচু মুখে নেমে এসেছি নীচে। আমাদের বিটলেমির শাসন করার জন্যেও কয়েকজন যুবক বেশ সচকিত থাকতেন। তারা এমনকি মসজিদ ঝাঁট দেবার খেজুর পাতার ডাল কিংবা মসজিদের ঝুল পরিষ্কার করার ডান্ডা নিয়ে বহুবার তাড়া করেছিলো। এই মসজিদের মিনার বাইতে বাইতে একদিন দেখলাম দেয়ালে সিমেন্ট দিয়ে লেখা আছে “হামিদিয়া তাজ মসজিদ”। তার মানে এতদিন বা পরেও যা চন্দনপুরা মসজিদ নামে খ্যাত তার প্রকৃত নাম এক্ষণে আবিষ্কৃত হলো। আমাদের এই মসজিদটির মোতোয়াল্লি জহির ভাই। শুনেছি মসজিদটি পাকিস্তান শাসনামলে তাঁর পিতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দক্ষিণে একটি পুকুর সহ উত্তর ও পশ্চিম পাশের জায়গাজমিও মসজিদের জন্যে লিখে দিয়ে গেছেন বলে শুনেছিলাম। কিন্তু মোতোয়াল্লি পরিবারের সন্তান হওয়ায় মসজিদের জায়গা তারা যথানিয়মে ভোগ উপভোগ করে গিয়েছেন, এখনও করছেন। সে যুগে রমজান মাসে মাঝে মাঝে দেখেছি আমাদের বন্ধু আব্দুল হাইয়ের বাবা আব্দুল হাদী সাহেব বেশ তর্ক জুড়ে দিতেন মসজিদ পরিচালনা কমিটি ইত্যাদি গঠন করার জন্যে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি কোনোদিন।
আমাকে যে হুজুর কোরাণ হাতে তুলে দিয়েছিলেন, উনিই এই মসজিদের ইমাম আলহাজ্ব মওলানা ক্বারী মোখতার আহমেদ। আমরা অবহিত হলাম বাংলাদেশের খ্যাতিমান ক্বারী তিনি। সত্তর সালে তিনি সারাদেশে ক্বেরাত প্রতিযোগিতায় ১ম কী ২য় হয়েছিলেন। তিনি আমার দাদার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হলেও আব্বার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন। আমার দাদার অনেক প্রশংসা করতে শুনেছি হুজুরকে। হয়তো কিছুটা বন্ধুত্বও ছিলো তাদের মধ্যে। মুয়াজ্জিন আরও অনেক বেশি বুড়ো — পক্ককেশ। মুয়াজ্জিন সাহেবকে মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় ভাত খাওয়ার দাওয়াত করতে দেখেছি। খাবার পরে লম্বা মুনাজাত ধরে আমাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর মঙ্গল কামনা করতেন——সাথে হাত তুলে রাখা আমাদের যে হাত টনটন করছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ থাকতো না। মুয়াজ্জিন যে ইমাম অপেক্ষা নিম্নস্তরের জ্ঞানী এবং আয়ের দিক থেকেও পিছিয়ে, তা কেমন করে যেন টের পেয়ে যাই আমরা ছেলে-ছোকরারা। তাই তাঁকে তেমন একটা সালাম পাত্তা দেওয়া হতো না। তা’ছাড়া আজানটা দিতেন এমন কুউ কুউ করে যে, কিছুতেই কায়কোবাদের কথার সাথে মেলাতে পারতাম না। “আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী” কিছুতেই অনুভব করতে পারতাম না।
বেশ কয়েক মাস মসজিদে যাওয়া আসা চলছে। এরই মধ্যে হঠাৎ আব্বা একদিন আছরের নামাজের পরে মসজিদের মধ্যেই ডেকে ইমাম সাহেবের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। আর জানালেন, আছরের পরে হুজুর কিছু দোয়া দরুদ শেখায়, অন্যদের সাথে বসে সেসব শিখতে হবে। অগত্যা বসে গেলাম গোল হয়ে। হুজুর কিছু নীতিকথা শুনালেন, যেমন সকল হুজুর শুনিয়ে থাকেন। তারপর কয়েকটি দোয়া শেখালেন—-মসজিদে প্রবেশের দোয়া, মসজিদ থেকে বেরুনোর দোয়া, পায়খানার দোয়া, গাড়িঘোড়ার দোয়া।
এভাবে প্রতিদিন বিকেলে অনেকটা আড্ডাচ্ছলে হুজুরের কাছ থেকে শিখতে লাগলাম ঘুমানোর দোয়া, ঘুম থেকে ওঠার দোয়া, গাড়ি চড়ার দোয়া, নৌকা চড়ার দোয়া, কিছু হারিয়ে যাওয়ার পরে পড়ার দোয়া। হাঁচির পরে পড়ার দোয়া —- এরকমভাবে দেখলাম জীবনটা দোয়ায় দোয়াক্কার হয়ে গেছে। আমিও কিছুদিনের মধ্যে কোন্ দোয়া কোন সময় পড়বো ভাবতে ভাবতে একপর্যায়ে সব “দাদখানিচাল মশুরের ডাল চিনিপাতাদই” অবস্থা করে পিটার বিকসেলের বিদঘুটে নামবিভ্রাটের গল্পের মতো দোয়াবিভ্রাটে ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। জানতে পেলাম টয়লেটে প্রবেশ করা ও বের হবারও দোয়া রয়েছে। অর্থাৎ দোয়ায় পরিপূর্ণ এমন এক জীবন ব্যবস্থায় সকল কর্মই ইবাদত। কিন্তু আমি মাত্র চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র, এতো কিছু মাথায় ধারণ করতে না পারলেও চেষ্টার ত্রুটি করিনি। তাই অনেকের চেয়ে আমার পারফরমেন্স অপেক্ষাকৃত ভাল হওয়ায় হুজুরের সুনজরে ছিলাম। এর মধ্যে জানতে পেলাম, হুজুরের অই সব কর্মকাণ্ড একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অংশও বটে —— যার নাম “তৌহিদী ইনকিলাব”। তখন মনে পড়েছিলো, কোথায় যেন শুনেছি “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”। কিন্তু এখানে স্লোগান নেই, স্লো বা ধীর কোনো গান বা সঙ্গীতও নেই। তবে, রয়েছে নীরবে শিশুমনে স্রষ্টার আদেশ ও ধর্মীয় রীতিনীতি শিক্ষা। হয়তো এর মধ্য দিয়ে হুজুর নীরবে ইসলাম প্রচারের কাজটি শিশু কিশোরদের মধ্যে বপন করে যাচ্ছিলেন। শুনেছি আমাদের অগ্রজদের অনেকেই এই তৌহিদী ইনকিলাবের সদস্য ছিলেন। যাদের একজনকে চিনতাম যিনি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং পরবর্তীতে ইঞ্জিনীয়র হয়েও তাবলীগের দলে নিবিষ্ট হন। আরেকজন অবশ্য ছড়াকার, কলাম লেখক এবং আওয়ামী রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন। তবে হুজুরকে আমি কোনো রাজনীতির কথা আমার সামনে বলতে শুনিনি। আমি হুজুর বলতে এই একজনকেই মেনে এসেছিলাম সবসময়, যিনি আমাকে কোনো বদ্ধ চিন্তার শৃঙ্খলে না বেঁধে বরং জ্ঞান অন্বেষণের পথ দেখিয়েছিলেন। মনে পড়ে, একদিন বলেছিলেন, জ্ঞান অন্বেষণ করতে গিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে বা পথে না পৌঁছালেও জ্ঞান অন্বেষণের সওয়াব কিন্তু পেয়ে যাবো।
আমি এই সংগঠনের কল্যাণে দলের সাথে থাকা, সাংগঠনিক হওয়া এবং বন্ধুত্ব এসব কিছু অর্জন করেছি। কিছু বন্ধু ছিল, যাদের সাথে কেবল মসজিদ এবং তৌহিদী ইনকিলাবের আসরেই কথা হতো। মনে পড়ছে জুয়েল নামে একজন ছিলো, আমার চেয়ে এক ক্লাস সিনিয়র। তার বাড়ি সিলেটে। থাকতো মসজিদের উত্তরে খানিকটা দূরে। তার কথা ও ব্যবহার আমাকে খুব টানতো। বেশি কথা হয়তো হতো না — তবু কী যেন এক সঙ্গীতের সুর আমাদের ভেতর বয়ে যেতো। ওর কাছ থেকে জেনেছিলাম মাংসেরও শুটকী করা যায়। কুরবানীর মাংস রোদে শুকিয়ে শুকনো করে শুটকী বানানোর ধারণা চট্টগ্রামের লোকেদের জানা ছিল না——দেখিওনি আত্মীয় পরিজনের ঘরে। কিছুটা বয়সে বড় ভাইদের সাথেও বেশ হার্দিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো এই তৌহিদী ইনকিলাবের কল্যাণে। আর হুজুরের নানান বয়ানে নবীদের নানান কাহিনী আমাকে তথ্যগুলো বই থেকে পড়তে আগ্রহী করে তোলে। আমি অনেক অনেক জীবনী গ্রন্থ পাঠ করেছি—— যেমন, আদম সফিউল্লাহ, নূহ নবীউল্লাহ, মুসা কলিমুল্লাহ, ঈসা রুহুল্লাহ, ইত্যাকার বিশেষণসহ নামের বইগুলো সে যুগে সাড়ে তিন থেকে পাঁচ/ছয় টাকার মধ্যে পাওয়া যেতো। আমি আব্বার কাছ থেকে মাঝে মধ্যে সিকি আধূলি নিয়ে জমিয়ে ভরদুপুরে দৌড়ে যেতাম আন্দরকিল্লার জুমা মসজিদের নীচে নওরোজ কিতাবিস্তানে। এই ভাবে ধীরে ধীরে ইসলামের অনেক মনীষী সম্পর্কে জেনেছিলাম। আর তার মধ্য দিয়ে ইসলাম সম্পর্কেও সম্যক একটা ধারণা মনের ভেতরে তৈরি হয়, যা একান্ত নিজের পাঠ-অভিজ্ঞতার নির্যাস। কোনো হুজুরের, কোনো দলের বা কোনো মতবাদের প্রভাবে নয়, বরং নিজের পাঠ ও বিবেচনায় আমি ইসলামের উজ্জ্বলতা এবং স্নিগ্ধতা উপলব্ধি করতে শিখেছিলাম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সেই শৈশবেই মসজিদে গিয়ে পড়তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। হুজুর বলেছিলেন টানা চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়তে পারলে তার আর নামাজ ক্বাজা হবার সুযোগ নেই। এমন কতো চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছি, কিন্তু একদিন ফজরের নামাজ পড়তে যখন বেরিয়েছি, গলির পথ তখন অন্ধকার, তার মধ্য থেকে অকস্মাৎ ৩/৪টি কুকুরের একই সাথে তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠার ফলে এমন ভয় আমাকে কাবু করে ফেললো যে, প্রাণ হাতে করে ছুটে গিয়ে ঘরে ঢুকে কাঁপতে থাকলাম। ফলশ্রুতি——পরদিন থেকে ফজরের নামাজ পড়তে আর মসজিদে যাওয়া হয় না। আর এভাবেই আমি ধীরে ধীরে নিয়ম থেকে অনিয়মের দিকে পা বাড়াতে থাকি। আজ মনে হলে খুব লজ্জিত হই যে, সামান্য সারমেয়দের উৎকট চিৎকার আমার ভেতরে যে ভয় ঢুকিয়েছে, তেমন আর কেউতো পারেনি!
মুসলিম মনীষীদের জীবন ঘাটতে গিয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি আপ্লুত এবং চমকিত করেছিলেন হযরত ওয়ায়েছক্বুরুনি (রাঃ) এবং হযরত মনসুর হেল্লাজ (রহঃ)। ওয়ায়েছক্বুরুনির ক্ষেত্রে তাঁর নবীজীর প্রতি ভালোবাসার গভীরতা আমাকে অভিভূত করে। আর মনসুর হেল্লাজের ‘আনাল হক’-এর গূঢ় দার্শনিক তত্ত্ব আমাকে অনেক ভাবিয়েছিলো। আর একটা ব্যাপার আমাকে তখনও যেমন এখনও খুব আকর্ষণ করে তা হলো নবীদের মাজেজা এবং আউলিয়াদের কেরামতি। এসব পাঠ ও জ্ঞান শৈশবের ভাবনার দুয়ারকে এমন প্রসারিত করেছিলো যে, আমি সেসব অতিলৌকিক কর্মকাণ্ডের পাঠ নিতে নিতে হারিয়ে যেতাম এক অতীন্দ্রিয় জগতে। তাই ম্যাজিক রিয়ালিজম পড়তে গিয়ে কিংবা শতবর্ষের নির্জনতার বুড়ির আকাশে উড়ে যাওয়ায় ততোটা বিস্মিত হইনি। আমি খুব মুগ্ধ হয়ে বারবার পড়েছি মনসুর হেল্লাজের জেল-যাপন, যাতে তিনি অন্তরীন থাকলেও নিজের হাত প্রসারিত করে দূরে আঙ্গিনায় শুকাতে দেওয়া গামছা টেনে নিতে নিতে বলেন ‘বেরিয়ে যাবার সাধ্য থাকার পরও বন্দী থাকাকে দারিদ্র বলে’। সেদিন প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম, দারিদ্র আমাদের উদ্যোগহীনতা ও আলস্যের পরিণাম।
ততোদিনে আবার ইশকুলের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি কিছু বিজ্ঞান শিক্ষার বইও পাঠ করা শুরু হয়ে গেছে এবং বিজ্ঞান পাঠে এটাও জেনে গেছি, সূর্য নয়, পৃথিবী ঘুরছে। জেনে যাই, সেই প্রাচীনকালে টলেমির মডেল কেমন করে আমাদের বিশ্বাসের ভেতর ঢুকে পড়ে বংশ পরম্পরায়।
আর তার ফলে চাঁদের দু’টুকরা করা এবং হাতের তালুতে চাঁদ ও সূর্যকে ধারণ করে দেখানো, মনের ভেতরে বিভ্রম তৈরি করেছিলো বটে। তবে, আরেকটু বড় হলে যখন একজনের ছবি দেখলাম সূর্যকে হাতের তালুতে নিয়ে সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে, তখন ফিজিক্স অতো না বুঝলেও, কিছু একটা তো বুঝেও গিয়েছিলাম। তারপর আরও বড় হতে হতে বোধ ও অবোধ বারবার গুলিয়ে যেতে থাকে, বিশেষত সংকট মুহূর্তে।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০; পূর্বাহ্ণ (রাত) ১২:১০
সংশোধন: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ অপরাহ্ন ৩:৫০
দারুণ!
উত্তরমুছুনhttps://images.pexels.com/photos/1003914/pexels-photo-1003914.jpeg
ভালো লাগল। তার জীবনী আরও পড়তে চাই।
উত্তরমুছুন