.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

জিললুর রহমানের আত্মজীবনী (পর্ব ৯)

জিললুর রহমানের আত্মজীবনী। কোরাকাগজের খেরোখাতা
কোরাকাগজের খেরোখাতা

ছোটকালে ঈদের ছুটিতে মামার বাড়িতে আমাদের একটা বিশাল দল হয়ে যেতো। আর ছিলো হ্যামিলনের বাঁশিঅলা লিয়াকত ভাইজান। বিশাল বাহিনী নতুন জামা কাপড় পরে পাড়া বেড়াতে বের হতাম হ্যামিলনের বাঁশিঅলা লিয়াকত ভাইজানের সাথে। সবার ঘরে ঘরে গিয়ে সালাম করা এবং সেলামী’র জন্যে বসে থাকা ছিল আমাদের কাজ। সেই একটাকা দু’টাকা সেলামী পেলে আনন্দে চক্ষু ছলছল করে উঠতো। তবে, অধিকাংশ বাড়িতেই সেমাই খেয়েই ফিরে আসতে হতো। এমন ঈদের সেলামীর টাকা দিয়েও বই কেনা হয়েছে অনেক। বিশেষ করে মোহাম্মদ নাসির আলীর লেখা শিশুতোষ কিশোরতোষ বইগুলো আমাকে বেশি টানতো। খান মোহাম্মদ ফারাবীর বইটিও বেশ জমিয়ে পড়েছি বহুবার। রাহাত খানের লেখা ‘দিলুর গল্প’ আমার প্রায়শ পাঠ্য হয়ে উঠেছিল। ‘দিলুর গল্প’ বারবার পড়তে পড়তে পৃষ্ঠা পর্যন্ত ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থা হয়েছিল। তাঁর ‘হবু রাজা গবু মন্ত্রী’ অনেকবার পড়েছি, এমনকি পরবর্তীতে আমার মেয়েদেরও পড়িয়েছি। আরেকটি অসম্ভব প্রিয় বই ঈদের সেলামীর টাকায় কিনেছিলাম ‘ভীনদেশী এক বীরবল’। এটা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ঘটনাবলী নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনীর সরস সচিত্র উপস্থাপন। কতোবার যে পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বড় হয়েও পড়েছি অনেকবারই। 

ঈদের বেড়ানো শেষ হলেও ছুটি শেষ হতো না। তাই আমরা থেকে যেতাম মামার বাড়িতে লম্বা সময়ের জন্যে। গরমের ছুটিতে তো বটেই, বার্ষিক পরীক্ষা শেষেও লম্বা ছুটি এই ফতেয়াবাদেই কাটতো। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ। ছিল লিয়াকত ভাইজান ও তার গালগল্প। অনেক রাত করে ঘুমালেও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেতে হতো বড়দের কোলাহল কলকাকলীর জন্যে। চোখ কচলে কচলে যেতাম সামনের পুকুরের ঘাটে। সেখানে তখন অনেক লোকের জমায়েত। কেউ লোটা বা বদনা হাতে, কেউ মিসওয়াক নিয়ে, কেউ তুষ বা কয়লার গুঁড়া দিয়ে দাঁত মাজতে ব্যস্ত। 

কে যেন আমাকে শিখিয়ে দিলো আমের পাতা দিয়েও দাঁত মাজা যায়। তাই আমি আম্মার দেয়া ব্রাশ পেস্ট উপেক্ষা করে আম পাতাকে নির্ভর করেছিলাম অনেক অনেকদিন। 

পুকুর ঘাটের কোলাহলে নানা বয়সের লোকজন বেশ আড্ডায় মেতে উঠতো। কেউ আবার ঝপ করে একটা ডুব মেরে নিয়ে উঠে পড়ছে। সেই ভোরে খুবই শ্লথগতি, হাঁটছে কী হাঁটছে না এমন ভঙ্গিতে বদনা হাতে যে বুড়োর দেখা মিলতো, তিনি অনেক দূরে থাকতেই লিয়াকত ভাইজান হয়তো আমাদের উসকে দিলেন ‘জিন্দালাশ’ বলে হাঁক দিতে। এখন অর্থ বুঝলেও তখন না বুঝেই জোরে চিৎকার করে উঠতাম— ‘জিন্দালাশ’! তখন বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি তাঁর গতি বেড়ে গিয়ে আমাদের ধরতে উদ্যত হচ্ছেন। আমরাও ভোঁ-দৌড়। কিন্তু তাঁর উদ্যত হওয়াটাই সার, দৌড়ানোর সাধ্য তাঁর ছিল না। তাই পা ছুটছে না দেখে তিনি মুখ ছুটাতেন —— চাটগাঁইয়া ভাষায় মধুর সব গালিবর্ষণে আমরা ক্ষিপ্ত ও সিক্ত হতে থাকতাম। 

আরেকটি চরিত্রের কথা এক্ষণে না বললে পরে ভুলে যেতে পারি। এক মহিলা আমার নানার বাড়ির পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ভিক্ষা করতেন, কারও কারও ঘরে কিছু কাজকর্মও হয়তো করে দিতেন। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো সব ঘরের অনেক গোপন তথ্য নিজের মগজের কোষে কোষে জমিয়ে রাখতে পারতেন। আর সে সব তথ্য অর্থাৎ একটি বাড়ির খবর আরেক বাড়িতে গিয়ে প্রচার করতে খুব দক্ষ ছিলেন। এই অসামান্য যোগ্যতার জন্যে আমাদের চেয়ে বয়সে যারা বেশ একটু বড় তারা ওনাকে আড়ালে ‘রেডিও’ বলে ডাকতেন। তবে সামনাসামনি বলতেন না। সামনাসামনি ‘রেডিও’ ডাকার দায়ভার ছিল আমরা যারা ছোট গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত তাদের। আর আমরাও জোর আওয়াজ করে ‘রেডিও’ বলে ডেকে দূরে পালিয়ে যেতাম। আমাদের ধরতে না পেরে তিনিও আমাদের যথেচ্ছ চাটগাঁইয়া গালি সহযোগে তিরষ্কার করে তৃপ্ত হতেন। আমরাও দূর থেকে এই ক্ষেপে যাওয়া ‘রেডিও’র রণমূর্তি উপভোগ করতাম। 

আমার আম্মার মেজ চাচা অর্থাৎ আমার মেঝ নানা, যাঁকে সকলেই মেঝ হিসেবে ‘মাইজ্জা’ ডাকতেন। আমরাও মাইজ্জা নানা বলেই ডাকতাম। তিনি তেমন পেশাগত কাজকর্ম করতেন না বলেই হয়তো ঘরোয়া কাজ তথা গৃহকর্মীর নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সকালে দেখা যেত, তিনি পাটি বা ধারার সাথে বাচ্চাদের ভেজালে কাঁথা জামা ইত্যাদি নিয়ে ধোয়ার জন্যে পুকুরঘাটে আসতেন। তিনি অবশ্য সবাই সকালের দাঁতমাজা গোসলকরার ভীড় কমে গেলেই মাথাটা কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে ধীরপদে আসতেন। সেসময় পুরুষব্যক্তি এসব বউবাচ্চার জামা কাঁথা ধোয়ার কাজকে পুরুষতান্তিরক মানসিকতা হেতু সুচক্ষে দেখা হত না। তাই হয়ত বা আমাদের সেখানে হলো মাইজ্জা নননার জন্যে নতুন ছড়া—
আবুল হাতেম মাইজ্জা
তেল’র বোতল ধাইজ্জা

আর আমাদের এই নতুন লব্ধ পাঠ আমরা ঘন ঘন আওড়ে যেতাম মাইজ্জা নানাকে দেখার সাথে সাথে। আজ এসে ভাবছি কোনোদিন এই লোকটি কোনো কটুকথা বলেননি এসবের প্রতিক্রিয়ায়, বরং নিজ নাতিনাতনিদের সাথে আমাদেরও সমান স্নেহ ছায়া ছড়াতে দিতেন। 

আমার স্মৃতিতে নেই বা স্মৃতি শুরু হওয়ার আগে কোনো এক সময় আমার মামার বাড়ির তরুণ যুবকেরা সিরাজউদ্দৌল্লা নাটক মঞ্চায়ন ও অভিনয় করেন। আর তারপর থেকে আমার ছোটমামা ও লিয়াকত ভাইজানকে দেখেছি, সেই সব চরিত্রদের নামে একে অপরকে ডাকতে। ওপাড়ার সম্পর্কে আমার নানা হন কিন্তু বয়সে তরুণ বলে রফিক বদ্দার ইয়া বড় বিশাল একজোড়া গোঁফ দেখলে মনেই হতো কোনো রাজপুত বীর যোদ্ধা। তিনি অভিনয় করেন মহারাজ যৌশবন্ত সিং-এর চরিত্রে। পরবর্তীতে ছোটমামারা যখন ক্রিকেট নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। তখন নিজেদের নামগুলো বিখ্যাত ক্রিকেটারদের নামে ডাকতে থাকায় নাটকের চরিত্রগুলো মুছে যায়। কিন্তু মহারাজ যৌশবন্ত সিং-এর নাম টিকে গেল। বিশেষত ছুটির দিন সকালে পুকুরপাড় গিয়ে লিয়াকত ভাইজানকে দেখেছি প্রায়শ উচ্চকন্ঠে ডাক পাড়তেন — “মহারাজ যৌশবন্ত সিং” বলে। এবং ওদিক থেকেও যাত্রার ঢঙে উত্তর আসতো, “বলে বৎস, কী বলিতে চাহ”। আমার নিজের কাছেও তিনি আমৃত্যু মহারাজই ছিলেন। 

আমরা নানার বাড়িতে রাত্রি যাপন করলে সকালে মুখ হাত ধুয়ে সবাই পৌঁছে যেতাম বিশাল প্রশস্ত রান্না ঘরে। লাকড়ির চুলায় আমাদের নানী যাকে আমরা নানুমনি ডাকতাম তিনি তখন প্রাতরাশের আয়োজনে মগ্ন। চুলার পাশ থেকে সার বেঁধে পিড়ি সাজানো। আমরা নাতি নাতনিরাও সার বেঁধে বসে পড়তাম। আমাদের সামনে একটা লম্বা চিকন বাঁশ শোয়ানো থাকতো যার এক প্রান্ত চুলার অদূরে দরজা দিয়ে ফুট খানেক বেরিয়ে থাকতো। বাইরে চড়ে বেড়ানো মুরগীগুলো ঢুকার প্রয়াস পেলে আমরা বংশদণ্ডটি নাড়তে থাকতাম। ফলে মুরগীগুলো ভয়ে দূরে সরে সরে যেতো। কিন্তু আবার ফিরে আসতো। আমরাও আবার বাঁশ নাড়াতাম। এর মধ্যে খাবার তৈরি হয়ে গেলে নানা গালগল্পে মগ্ন হয়ে বড় আয়েশের সাথে খাওয়া সারতাম। বিশেষত শীতকালে যখন ভাপাপিঠা তৈরি হতো, সেটি আগে ভাগে পাতে নেবার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম মামাত ফুফাত খালাত ভাইবোনেরা। প্রাতরাশ শেষ করেই উঠানে দৌড়ঝাপ করে নানারকম খেলায় মেতে উঠতাম এবং শীঘ্রই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তাম। তখন নানুমনি আমাদের একটা গামলায় বেশ করে মুড়ি দিয়ে দিতেন। কখনও কখনও নারকেলের টুকরা চিনিসহ মেখেও দিয়েছেন। বড় আয়েশ করে খেতাম সেই মুড়ি। সেই বিখ্যাত মুড়ি কুসুমবালার মুড়ি নামে পরিচিত ছিল। বহুবছর সেই মুড়ির স্বাদ মুখে লেগেছিল। এখনও মুখে মুড়ি তুললেই কুসুমবালার মুড়ির জন্যে মন আকুলিবিকুলি করে। কিন্তু কোথায় পাবো সেই কুসুমবালাকে! সে কবে ইহধাম ছেড়েছে! তারপরও এখনও ফতেয়াবাদ থেকে ছোটমামার পাঠানো মুড়ি খেলে মনে হয় সেই কুসুমবালার মুড়ির কিছু স্বাদ এখানে রয়েছে লেগে। 

এদিকে নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে হতে লিয়াকত ভাইজান ও ছোটমামাদের সব বন্ধুরা আমারও খুব ঘনিষ্ট হয়ে ওঠে। আমি তাদের পেছন পেছন তাদের সব কর্মযজ্ঞে হাজির থাকতাম। বয়সে তাঁরা প্রায় আটবছরের বড়, কিন্তু বাৎসল্যে দূরত্ব অনেক কমে গিয়েছিল। মনে পড়ছে, একবার তাঁরা ঠিক করলেন, বনভোজন করবেন। তবে অবশ্যই এটা আমাদের শহুরে ইশকুল কলেজের তথাকথিত পিকনিকের মতো কিছুতেই নয়। ওরা এর বাড়ি থেকে চাল, তার বাড়ি থেকে ডাল, আরেকজনের বাড়ি থেকে পেঁয়াজ রসুন এমন করে সংগ্রহ করে আয়োজন শুরু। বিভিন্ন জনের ক্ষেতের ফসল চুরি করা, এবং যার ক্ষেত তার ছেলেও চুরিতে অংশ নিতে হলো। সবচেয়ে কঠিন হলো মুরগী চুরি। বাড়ির ছেলে ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আমিও ওদের সাথে সামিল হয়ে টকবেগুন সংগ্রহ করেছিলাম। পরে ‘সিকার পুকুর পাড়ে’ আমাদের রান্নার আয়োজন হয়। যখন খুব আয়েশ করে খাওয়া শুরু হলো, তখন পাড়ার বিভিন্ন বাড়ির কর্তা কর্ত্রীরা চেঁচামেচি করে গালিগালাজ করছে। আমি খুব ভীত হয়ে পড়লে, তারা আমাকে আশ্বস্ত করলেন কিছু হবে না। যার বাড়ির জিনিষ তার বাড়ির ছেলেই চুরি করেছে। অতএব নিশ্চিন্তে খেয়ে নাও। আমি ওদের অনেক কর্মকাণ্ডসহ পেছন পেছন থাকতাম বটে, সব কিন্তু বুঝে উঠতে পারতাম না। ছোটমামাদের বন্ধু একদিন আমাকে ‘মাসুম’ বলে অভিহিত করলেন। আমি তখন জানতাম না মাসুম শব্দের অর্থ কী! কিন্তু আমি অনুধাবন করলাম এটা আমাকে ঠাট্টা করে বা ঠেস মেরে ডাকা হচ্ছে, অতএব এটা আমার জন্যে অপমানজনক। যাই হোক, অনেক কান্নারতটা করেছিলাম এই নাম ডাকার জন্যে। তার ফলে এই নামটা ওদের মুখে আরও পাকাপোক্ত হয়ে গেল যেন। পরে লিয়াকত ভাইজান আমাকে বুঝালেন সম্প্রতি তারা হিন্দি ছবি ‘মাসুম’ দেখেছেন। আর মাসুম শব্দের অর্থ অবুঝ বা নিষ্পাপ, এতে আমাকে খারাপ কিছু বলা হয়নি। কিন্তু আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে ঠিকই বুঝিয়ে দেয় — যত কিছুই বুঝানো হোক, আমাকে নাম এমন নামে ডাকা আমার জন্যে একটু হলেও অপমানজনক। পরে আমি ব্যাপারটা উপেক্ষা করতে থাকি। মনে মনে যত কষ্টই পাই না কেন, তা তাদের কাছে প্রকাশ করিনি। এর ফলে মাসুম ডাক শোনার প্রকোপ কমতে থাকল ধীরে ধীরে। 

আমার যতদূর মনে পড়ে ৫ম কি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় ছোটমামাদের নতুন তোড়জোড় হলো পাঠাগার স্থাপন। ফতেয়াবাদ স্কুলের কাছে রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে তারা একটি ঘরেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। নানাজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছিলেন ‘ফতেয়াবাদ গণ পাঠাগার’। ততদিনে আমি দু’চারিটি বই পড়ার সুবাদে এই কর্মে অতিরিক্ত উত্সাহী হয়ে উঠি। কোনো এক নেতা সেই পাঠাগার উদ্বোধন করেছিলেন বটে, কিন্তু নেতার পা তো লেই একবারই পড়েছিল, আমার পা পড়তো সবসময়। মানাবাড়ি গেলেই তখন পাঠাগারে যাওয়াটা আমার জন্যে ফরজ হয়ে উঠলো। এই পাঠাগারেই প্রথম পাঠ করেছিলাম “শাপলা শালুকের আসর” নামের সংগঠনটির ম্যাগাজিন ‘শাপলা শালুক’। সেই সংকলনে অনেক মজার ছড়ালএবং গল্প পড়ার সুবাদে চট্টগ্রামের সেকালের কিছু তরুণ লেখকের নাম জানতে পারি—যারা সেসময় আমার কাছে রূপকথার রাজার মতো স্বপ্নময়। মনে পড়ে ছড়া পড়েছিলাম  সনজীব বড়ুয়া, ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী এবং ইউসুফ মুহম্মদ নামের বেশ কয়েকজনের। পরে পরে জেনেছিলাম ইউসুফ মুহম্মদ মামাদের বন্ধু, বাড়িও ফতেয়াবাদ। আর তাঁর সূত্রে ওমর কায়সাররাও ওঁদের বন্ধু হয়েছিলেন। তবে, আমার কাছে তখনও তারা রূপকথার স্বপ্নপুরুষের মতো। যাদের লেখা বইতে ছাপা হয়, তারা নিশ্চয় ভিন্ন কোনো জগতের বাসিন্দা হবে এমনটাই ধারণা করতাম বহুকাল। হায়, সে গনপাঠাগার কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে! সে পথ দিয়ে যাবার সময় চোখ ফেরালেই দেখি ঘরটি কাঠমিস্ত্রির দোকানে পরিণত হয়ে যায়। এখন তো তা’ও নেই। 

আরেকটু বড় হলে মামাদের বন্ধু আলম বদ্দা’র সাথে দাবা খেলা শিখে ফেললাম। তখন দিনরাত দাবার চালের চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরতো, কিন্তু কিছুতেই জয় আসতো না। দাবা খেলত বলে আলম বদ্দার নাম হয়ে গেল কাসপারভ। আরও কিছুদিন পরে তারা মেতে উঠলো ক্রিকেটের আনন্দে। দল বেঁধে দেউড়ি ঘরে একব্যান্ড রেডিও চালিয়ে সকলেই বিশ্বময় চলমান টেস্ট ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শুনছেন আর উত্তেজনায় টগবগ করে উঠছেন—কিংবা আফসোসে কাতর হয়ে পড়ছেন়। পরে নিজেরাই গঠন করেন সেঞ্চুরি ক্রিকেট দল। এর মধ্যেই তারা কেউ হয়ে পড়লেন ওয়ালিম বারী, কেউ গাভাস্কার, কেউবা ইমরান খান। এই হুজুগ কাদের পরবর্তীতে একটি সাংগঠনিক স্থিরতার নিয়ে এসেছিল। তারা চালু করেছিলেন সেঞ্চুরি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। দূর দূরান্ত থেকে ক্রিকেট দল এসে দিনব্যাপী খেলায় অংশ নেয়। আমিও একসময় স্কুল জীবনের শেষদিকে তাদের সাথে ক্রিকেট খেলতে নেমেছিলাম। তবে, আমার নাকি রিফ্লেক্স বলে কোনো জিনিষ ছিল না। তারা আমাকে মাঠের একেবারে শেষ মাথায় বল পাহারা দিতে দাঁড় করিয়ে দিত। কিন্তু আমি দূর ধাবমান গাড়ির হর্ন কিংবা পাশ দিয়ে তরুণতর কারও দৌড়ে যাওয়ার দিকে মগ্ন তাকিয়ে থাকতাম বলে বলটি প্রায়শ আমাকে পাত্তা না দিয়ে সীমানা অতিক্রম করে যেত। আর ব্যাটিং, সে তো এক বলের মামলা। তবে জীবনে একবার শেষ মুহূর্ত ব্যাট ধরে নিজের অজান্তেই ঘটে যাওয়া ব্যাটবলের সংঘর্ষে চার পিটিয়ে দলের জয় আনতে পেরেছিলাম। সেই প্রথম এবং শেষ। এর বাইরে আমার কোনো কৃতিত্বের স্বাক্ষর ক্রিকেট জগত আর দেখতে পায়নি। মামাদের দল আমার আলস্য এবং ভাবালুতায় অতিষ্ট হয়ে পড়লেও বাদদিতেন না। তবে আমার নাম রাখলেন “আইলসা”, যারা একমাত্র এবং চরম অর্থ হচ্ছে ‘অলস’। সত্যি বলছি, সে আললেমি আজও আমাকে ছেড়ে গেল না। 

সকাল ১০:১৯
০৯-১১-২০২০


মন্তব্য

BLOGGER: 1
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,25,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: জিললুর রহমানের আত্মজীবনী (পর্ব ৯)
জিললুর রহমানের আত্মজীবনী (পর্ব ৯)
জিললুর রহমান। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। জন্ম, নিবাস, কর্ম বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায়। পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষক।
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgu6QOtuFx3-mmQizLh37oKfbgURloYGrxS1b4ktngdyqE15Un90Zo0YnRI-nLuKkQmStuThOlPPqB2mvupRQoF4i2NiZY6Hg4aFLWhrKObjK24UUqN5gur05H7IOgRVM9pWsCKCSxkTxI/w320-h160/%25E0%25A6%259C%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%259C%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%2580.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgu6QOtuFx3-mmQizLh37oKfbgURloYGrxS1b4ktngdyqE15Un90Zo0YnRI-nLuKkQmStuThOlPPqB2mvupRQoF4i2NiZY6Hg4aFLWhrKObjK24UUqN5gur05H7IOgRVM9pWsCKCSxkTxI/s72-w320-c-h160/%25E0%25A6%259C%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B0-%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%259C%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A8%25E0%25A7%2580.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2020/11/Zillur-Rahman.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2020/11/Zillur-Rahman.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy