বানান রীতি শুদ্ধ নয় বলেই হয়ত আমার হাতে লেখা চিঠি তুমি পাও না। কাঁপা-কাঁপা হাতে তবুও লিখছি… সত্যের পিছনে আরো নিগুঢ় সত্য লুকিয়ে আছে; সাম্য আমাকে কলমে লিখতে বাধ্য করেছে… আমার হাতের লেখা প্রতিটি অক্ষর নাকি মুক্তোর মতো ঝকঝক করে; এই লোভেই লিখতে বসা। দেখতে চাওয়া— সত্যিই কি মুক্তো ঝরে চল্লিশোর্ধ হাত থেকে…!
তোমার কাছে ফিরে যাবার এত্তো আয়োজন করেও ফিরে যাওয়া হয়ে ওঠে না… তিলোত্তমা আমার… এও জানি— একদিন ফিরে যেতেই হবে, তোমার বুকে আব্বাকে নিজ হাতে শুইয়ে দিয়েছি। কত আপনজনকে তুমি ভালোবেসে আগলে রেখেছো। আমার শেষ আশ্রয় হয়ত তোমাতেই…
আব্বাকে যেদিন শুইয়ে দিলাম, এমন কষ্ট আর কখনো অনুভব করিনি… সেদিন জেনেছিলাম, কাঁদতে-কাঁদতে কান্নাগুলো ফুরিয়ে যায়, শরীরের প্রতিটি অংশ কান্নার জন্য তীব্রভাবে আমাকে অস্থির করে তুলছিলো, কাঁদতে পারছিলাম না! ক্যামন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিলো, নিজেকে এতো নিষ্ঠুর আর কোনদিন মনে হয়নি, শূন্যতায় মেতে উঠেছিল নিজের অস্তিত্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু…৷ তবুও উঠে দাঁড়িয়েছি তোমার কাছ থেকে… আজ অনেক অনেক দিন পর আবারো তোমার কাছে আব্বার পাশে শুয়ে পড়ার ইচ্ছাগুলো আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না…
মনে আছে সালটা ৯২/৯৩, বি ডি আর ক্যাম্প মোড় থেকে শহরের দিকে যেতে পার্কের দীঘি দেখে চমকে উঠতাম, এপার থেকে ওপারে সাঁতরাতে পারবো তো? অথচ সেই জলের দেহে শরীর ডুবিয়েছি বহুবার! কলেজ মোড়ে এসে বড় আব্বার “জোনাকি” হোটেলের পিছনে বসে অফিসার্স ক্লাবের ছায়ায় সমুচা-সিংগারা উৎসব… সে এখন শুধুই ভালো থাকার কথামালা…৷ ভালো আছো তো? অট্টালিকার চাপে!
মিতালি সিনেমা হলের সামনে আলি ভাইয়ের চানাচুর মাখা, চালতের আচার আমাকে এখনো লোভাতুর করে তোলে… সিগারেট খেতে শিখেছিলাম সিনেমা হলের ভিতরে নায়কের স্টাইল ফলো করতে গিয়ে… আহা! সময়! বক মার্কা কিংবা ফিল্টার ছাড়া স্টার সিগারেটের মাতাল করা সুবাস যেন মা টের না পায়, সেই ভেবে ডাক বাংলার দীঘিতে নিজেকে চুবিয়ে নিয়েছি শতদিন! ডাকবাংলার দীঘির পানি, সিনেমা হলে শাবানার চোখের পানি মিশে একাকার… শুধু কাঁদতে পারিনা আমি, বহুকাল… কান্নার চেয়ে কষ্ট উৎসবের কবিতা আমাকে ন্যুব্জ ক’রে দেয়।
মনে রেখেছি; রাতে, শহীদ মিনারের সামনের মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলো ভেঙ্গে দিলো কবরস্থানের সামনে মূর্তি রেখে জানাজা হবেনা বলে! সেদিন অবোধ মনের বারান্দায় যে ছবিটা বেঁধে রেখে প্রতিদিন থুথু দিতাম, পরে তিনিই তোমার দেখভালের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন, আর কোনদিন আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখিনি। বারবার মনে হত, বাবার স্মৃতি ভেঙ্গে দেয়া মানুষ আমার ভালো করবে কী করে? তবুও তোমার সরল সন্তানেরা তাকে মাথায় রেখেছিলো তুমুল ভালোবেসে...
তখন কবি ক’রে তুলছিলে, দাদা মোড় পার হতেই শরীরে কাঁপুনি পেতাম। ঢাকায় থাকা এক কবির বাড়ি নাকি খানিক পথ এগুতেই… শুনেছি কবির নিবাস একদা এখানেই ছিল… কবি!
কবির শরীরের গন্ধ পেতে চাইতাম। পেতাম না! দুঃখের শেষ ছিলো না! অবশেষে, পেয়েছি তার পিতার নিবাস, কবিকে পাইনি কোনদিন…
প্রেম শেখালে হৃদয়ের স্পন্দন দিয়ে, শিখিয়ে দিলে- ক্যামনে ভালোবাসতে হয়, রিভারভিউ মোড়ের পাবলিক লাইব্রেরির পাশের বাড়িতে শরীরের গন্ধ ছিটিয়ে, ডাক দিলে। উন্মাদের মত ছুটে গিয়ে শিখে গেলাম অনেক কিছুই, কিন্তু কীভাবে ভুলে যেতে হয়, সে মন্ত্র আমাকে আয়ত্ব করালে না, আজো প্রেমের ছন্দে দুলুনি খেতে-খেতে গড়িয়ে চলি, হামাগুড়ি দেই, হাঁটতে শিখিনি...
আব্বা যেমন শেখাতে পারেনি- “নিজেকে ক্যামনে ক্ষমা করতে হয়!” তুমি তেমনি শেখাতে পারনি- “ক্যামনে ভুলে যেতে হয়!” সুখী পাথর দিয়ে আমার বালকত্ব মেনে নিয়ে চলতে থাকি অবিরাম... আব্বার মৃত্যু বিষয়ক যত বিস্ময় খুঁজে পাই শ্যামল বালিকার হাসিতে! কিংবা, ধরলায় সেই কাশবনে হারিয়ে যাওয়া খয়েরি চাঁদের আলোয় আমাকে দেখি নৌকার মাঝির মতই, যে নৌকাগুলো আজো মায়াবী লাগে, বিস্ময়! শুধুই বিস্ময়!
(প্রচ্ছদ: ফিরোজ সরকারের আলোকচিত্র অবলম্বনে৷)
প্রযত্নে ধরলা
মাহফুজুর রহমান লিংকন
মাহফুজুর রহমান লিংকন
নাম না জনা ইচ্ছা
উত্তরমুছুনফের তোমাকে মন পাঠিয়ে দিচ্ছি
আবছা আর না বলা গল্প.......
খুবই ভালো লাগলো 🌷