কশাইপাড়া; ব্রিজের গোড়ায় টিউবওয়েল- সরু শ্যাঁদলা পড়া চ্যানেল দিয়ে রেড ওয়াইনের মতো জলধারা নামে- টাটকা হিমোগ্লোবিনের মিশেল রঙ, ছ্যার ছ্যার শব্দে খালের ঘোলা জলে মেশে, ইন্ট্রারেসিকাল সঙ্গমের মতো- কিছুদূর গিয়ে খুনকায় রঙ বেমালুম মিলিয়ে যায় ঘোলা জলের শরীরের ভিতর। কলের শ্যাওলাহীন চকচক চৌকোণা সিমেন্ট বেদিতে একজন গরুর শিং, গোলগোল খোলা চোখ (যার মনি উপরের দিকে গিয়ে সাদা অংশ আরো বিস্তৃত লাগে) তৎসহ মাথা থেকে গরুর পুরু কাঁথার মতো ছালটা আলাদা করতে ব্যস্ত- পাখিদের সকালবেলার বেসমাররিক কুচকাওয়াজ ছাপিয়ে নলকূপের কর্কশ গলার ক্যাঁচক্যাঁচ রেওয়াজ- কূপের কালো লম্বা (শেষের দিকে ঢেউ খেলানো) হ্যান্ডেলে মুহুর্মুহু চাপ দিয়ে যায় কবির- এই কসরতে সাড়া দিতে বালক শরীরের পেশিগুলোও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে, পুরুষালী আমেজ চলে আসে গতরে-আরো; সাধ্যের অতিরিক্ত জোর দিতে চায় দুর্বল নলকূপের কাঙাল শরীরে- সদ্যো এক থাল পান্তা খেয়ে ওঠা ফুলন্ত গ্যাসবেলুনের মতো ফুলে ওঠা পেটটা এই সাধ্যাতিরিক্ত চেষ্টায় ভিতরে ঢুকে যেতে চায়- প্রায় প্রতিদিনই সকালবেলায় এই তার নিত্যকর্ম- বেশ উৎসাহে করে কবির। পাশে কাকেরা মৃত পশুর একটা চর্বির দলা নিয়ে টানাটানি করে, একখানা ধা দিয়ে ‘হুর বাইনচোত কাউয়া’ মেদের হলুদ তেলতেল দলাটা কেড়ে সিমেন্টের বেদিটায় ছুঁড়ে দেয় মনসুর(কবিরের বাপ)।
তারপর একখান ভোজালি ও গরুর পেটি হাতে নেমে যায় পিচ্ছিল নরম এঁটেলময় পাড়ে- খালের পানিতে ভোজালী ধরে প্যাঁচ খাওয়া ইন্টেসটাইনের ঠিক জায়গায় ঢুকিয়ে সোজা টেনে দেয়- অভ্যস্ত লাগেজের চেনের মতো স্বচ্ছন্দে নেমে যায়- খালের জলযোগে খালাস করে দেয় ভেতরের সব গোলযোগ- লোহা ও ইস্পাতের চমৎকার কর্মকুশলী স্বভাবে খড়রঙ কতকটা আধাতরল, তরল, মন্ড, রস বের হয়ে আসে- খালের পাক খাওয়া ঘোলা জলে মিশে ক্রমে খড় ও খড় থেকে হলুদ- এক সময় আলেয়ার মতো মিলিয়ে যায় রঙের কুশলী অত্যাচার- জল বাঁধাধরা মেয়ে মানুষের মতো, সবকিছু সহ্যজ্ঞানে নিতে জানে। থুক করে একদলা কফ-থুথু মেশানো জটলা ছুঁড়ে দিয়ে সেই দিকে মনসুর বলে ‘যা গু! যা!’(তুলনামূলক বালসুলভ শুনায়)। গরুর ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়া ফ্যাঁতরা নাড়িভুঁড়ি (যারে শিক্ষিত অনেকেই দোকানে এসে' ইন্টেসটোইন' বইলা গালি দেয়) ধুয়ে ধুয়ে মনসুর নাড়িভুঁড়ি থেকে আপাত পরিচ্ছন্ন সেই ইন্টেসটোইন এর রুপ দেয়।
শুক্কুর এর উদ্দেশ্যে একবার হাঁক দেয়-
‘কিরে নাটকির পুঁত এই কয়ডা মাল বাছতে বেইন্না রাইত বাজাবি?’
শুক্কুরের কাজ পছন্দ হয় না তার, বড়োই ধিমা- ছেলেটা বড়ো হলে শুক্কুররে আর কাজে রাখতো না সে- এইজন্যে ছেলেকে জবেহ'র সময় কাছে রাখে- টিউবওয়েল চাপা আসল কাজ না, আসল কথা দেখে দেখে শিখুক- এখন না শিখলে পরে ছুরি, চাপাতির কার্তুত বুঝতে সমস্যা হবে- এটা হলো প্রথম পাঠ, বর্ণমালা পরিচয়।
এখনই খেলাচ্ছলে দেখতে দেখতে তত্ত্বীয় আত্মস্থ হচ্ছে কবিরের- মাংসকে ইতোমধ্যে সে মাল বলতে শিখে গ্যাছে- কাটার পর মাথাটা হাতে নিয়ে চোখের পশম ধরে খোলে-বন্ধ করে; মজার খেলা- কয়েকদিন চামড়া নিয়ে খ্যালে- কাক ধাপড়ায়, কুকুর তাড়ায়- রক্তে, জলে নেয়েধুয়ে ওঠে- তারপর বাপের সাথে ডুব দিয়ে বাড়ি গিয়ে জামাকাপড় বদলে বাপের দোকানের দিকে যায়- ছেলের স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে মনসুর। ‘কসাইর পোলা কসাই ই হইবো, অইসব ইস্কুল-ফিস্কুল যতো তাড়াতাড়ি ছাড়োন যায় ততোই ভালা, এইতো জুম্মনের পোলা ইন্টার পাশ দিয়া ঘরে বইয়া ছিলো এতোদিন; বেকার, এহন না পাইরা বাপের দোকানে গিয়া বসে- তাও যদি কামডা পারতো? চাপাতি ধরলে হের হাত হোয়াশের রুগীর মতোন কাঁপে- আমার পোলার অন্তত সেইডা না হয়'।
গরুর লাল মাংস ও ধূসর ফাসার সাথে তেল-চর্বি মিলেমিশে একত্রে, পায়াটা ঝুলে আছে উল্টো বাদুরের মতো পোসচারে- তার গায়ে মাছির জটলা কালো হয়ে আসছে বারবার- কবির হুস, হুস করে তাড়াচ্ছে মাছি- রক্ত জায়গায় জায়গায় ছোপছোপ চেয়ে আছে, তাদের দেখে বর্ষায় আসবাবে গোলগোল ছাতকুড়ার কথা মনে পড়ে- সামনের চপিং উড, গোল রেইনট্রি গাছটার চাকতিতে মাংস কুচিয়ে যাচ্ছে মনসুর- এক চোখে সেই দিকে তাকিয়ে আছে কবির- বাপ তাকে বলেছে নজর দিয়ে দেখতে, প্রথম প্রথম ভয় পেতো, এখন মানিয়ে গ্যাছে- মানুষের স্বভাবই মানিয়ে নেয়া, যে না পারে সে বিলীন হয়ে যায়- ‘সারভাইভাল ফর দ্য এডাপ্টেড’- গণতান্ত্রিক মধুময় বাষ্পীয় যুগে এই নিয়ম। ওইদিকে ওজন করছে শুক্কুর- মধ্যে মধ্যে দু-একটা হাড়গোড়ের টুকরো ছুঁড়ে সে দিচ্ছিলো কাক-কুকুরের দিকে- মনসুর একটা বেখাপ্পা গালি দিয়ে ওঠে- একসাথে কইলজা ও হাত কেঁপে ওঠে শুক্কুরের। মনসুরকে সে প্রচন্ড ডরায়, বিশেষত চাপাতি হাতে মানুষটারে ভয়ানক লাগে শুক্কুরের। কালো কুচকুচে চুল, কোঁকড়ানো- মহাকালের মাথার মতোন দুই ঘাড় বেয়ে নামে, আরব্য রজনীর দৈত্যের মতো কালো শরীরের মেদ যেন উপচিয়ে পড়ে- পানের লাল আর লালা যেন টাটকা রক্তের মতো ঠোঁটের কোনায় জমে থাকে-
‘লাট-সাহেব পো কুত্তা কি তোর বাপ লাগে!’
হুংকারে কবিরও কেঁপে ওঠে, বাপকে সে শুক্কুরের চেয়েও বহুগুণ বেশি ভয় পায়- এদিকে বাপের হাতে করে গাঢ় লাল অথবা খয়ার মাংসগুলো টুকরো হয়ে হয়ে একপাশে জমা হয়- সামনের পায়াটা ঝোলে- মাথাটা গোল কাঠটার একপাশে রাখা- চোখ খোলা আছে- মাছিরা ওড়ে- কুকুরেরা মুখ উঁচু করে চেয়ে আছে- কাকগুলো ঘেঁষতে চায়, কুকুরের ধাপড়ানিতে আবার সমঝে পেছনে সরে আসে- খরিদদাররা আসে- ‘গন্ধ!’ নাক চাপে, অনেকে আবার বলে ফ্যালে- ‘ছ্যাঁ, ড্রেনের চাইতে বদ গন্ধ’- কবির মনে মনে গালি দেয় 'মান্দারীরপুত'- এইসব গালি সে বাপের কাছ থেকে শুনেছে- বাপ যখন রাতের বেলা মেথর পট্টির গন্ধওলা বাংলা মাল খেয়ে বাঁধা মাগীর সাথে একরাত কাটিয়ে বাড়ি আসে- এসেই দরজায় ধড়াম বারি মারে সে ‘দুয়ার খোল মান্দারীর ঝি!’
ততোক্ষণে মা আর কবির একঘুম শেষ করেছে, মা তড়িঘড়ি উঠে বসে- দরজা খুলতে বেমক্কা মেদময় শরীরটা যার বাঁকে বাঁকে বিদেশি জার্সি গরুর মতো থলথল করে মাংস ও মেদ- সে শরীরটা শিল মাছের হেলে পড়ে ভিতরে- বাংলার গন্ধে ঘরটা ময় ময় করে- মাংসের কটু গন্ধ সয়ে যায়, তবু এই গন্ধ সয় না কবিরের, বমি পায়- তারপর মুড অনুযায়ী কোনোদিন বাপ শুয়ে পড়ে/ওই অবস্থায় মা ধরে শুইয়ে দেয়- অবস্থা আরেকটু ভালো হলে পাশের ঘরে নিয়ে যায় মাকে।
কখনো বউয়ের আপত্তি তোয়াক্কা করে না মনসুর- চাপাতি চালানো শক্ত হাতে চুল ধরে টেনে নিয়ে যায় পাশে, খিল টেনে দেয়- তারপর রান্নাঘরের থালাবাসন পড়ার শব্দ শোনা যায়- মায়ের কান্না, চিৎকার- ‘গ্যালাম গো! ছাইড়া দেও’- প্রতিবেশীরা এইসবে আর মাথা ঘামায় না- সয়ে গ্যাছে তাদের, বরঞ্চ মনসুরকে তারা একটু সমঝেই চলে- ভীষন বদরাগী লোকটা- গতরটাও ভয়ানক।
২
ঘুম ভেঙে যায় কবিরের, খাটের ওপর তরপানো জিওলের মত ফাল দিয়ে উঠে বসে- পাশের ঘর থেকে তহুরা দৌঁড়ে আসে- ‘কিতা হইছুন-আবার হপ্পন দেখছুন নি!’ পলকা প্লাস্টিকের গ্লাসটায়(যে গ্লাসটা তাদের নবজাতক শিশুর) পানি এনে স্বামীর সামনে ধরে, পিঠে হাত দিয়ে ঘষতে থাকে, উপর থেকে নিচ; ভার্টিকাল- ঢোক গেলার মতো একগ্লাস পানি যেন একবারেই গিলে ফেলে কবির- তারপর তিমির মতোন বড় বড় শ্বাস ছাড়ে।
বাজার রোড; খুব ধীরে এগোচ্ছে কবির- হাতে চাপাতি ও গোশত সাইজ করার জিনিসপাতি রোদে গা এলিয়ে রূপসী’র বাকানো শরীরের মতো ঝিলিক দিচ্ছে- আজ রিকশাগুলো খুব বেপরোয়া ছুটছে- তাই আপেক্ষিক দ্রুত বেগে পাশ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে কবির- পাশেই ক্লে রোড সেখানের ডানের গলি, তারপর একটা বায়ে কাট নিলেই এসে পড়ে মাংসের দোকান- ক্লে রোড এলেই চারদিকে ছোটো বড়ো মসজিদের সমারোহ এসে পড়ে- কমপ্লেক্সের উপর দিয়ে শহরময় সাদা-অফ হোয়াইট মসজিদ গম্বুজেরা প্রাগৌতিহাসিক ডিমের মতোন ছড়িয়ে আছে- আর দৃষ্টি আরো ইনফিরিয়র ডিপ স্ট্যাকচারে চলে গেলে দেখা যায় ডিমগুলোর পাশ দিয়ে অডিমসুলভ ম্যামলিয়ান মানুষের আনাগোনা- আরো এগিয়ে গেলে- এক্সাক্ট মোড় ঘুরে এসে পড়ে মাংসের দোকানগুলো- কবিরের বংশপারম্পরিক ব্যবসা।
বড় গোল কাঠের গুঁড়ি সেইখানে সেইমতো বাধিত হয়ে আছে- পাশে জবেহ পশুর চামড়া ও শিং সম্বলিত মস্তকে কালো-সাদা চোখ কোয়েলের ডিমের মতো আধেকটা হা হয়ে পলকা সামিয়ানা ঝোলা আকাশের ফাঁকে মসজিদ কমপ্লেক্সের ঢিবিময় মাথাগুলোর পানে চেয়ে থাকে। মাংসেরা টুকরো হয়- একটা; তার সেই স্বপ্নের স্মৃতির মতোন বয়সী ছেলে সেইখানে পশুর মাথার পাশে ঠায় বসে থাকে- চিকন গলা, শ্যামলা গতর, গলায় কালো কৌতনে আঁটা তাবিজ আঁট হয়ে শ্বাসরোধ করার মতো- পাশে মাংসের ঢিবির উপর আরো টুকরো মাংসেরা এসে থাবা থাবা জমা হয়- মাছিরা সদলবলে জটলা করে, শ’য়ে শ’য়ে কম্পাউন্ড চোখে চারদিক তদারক করে- কবির মাংসের লাললাল কোয়াগুলোর দিকে চেয়ে থাকে- মৃত ইলিশের মতো দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে থাকে- আনারের মতোই লাল টকটক করে টুকরো গোশত- কমপ্লেক্সের ভাঙা দিককার সায়ানোফাইটাবিহীন ইটগুলো বর্ষায় ভিজে যেমন গাঢ থেকে গাঢ়তর হয়। এ মাংসের সাথে দৃশ্যত কোনো পার্থক্য নেই মানুষের মাংসের- লাল-লাল, কোঁয়াকোঁয়া রোঁয়া- তার মায়ের জবেহ হওয়া মাংসের মতোই, সেইদিন যেমন দেখেছিলো। স্বপ্নের অদৃশ্যত অংশ অথবা যে অংশ হয়তো ভুলে গেছিলো জাগার পর মনে পড়ে যায়- আকন্ঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে- রোঁয়া রোঁয়া ঘাম এসে জমা হয় নাসিকাব্রিজে।
মন্তব্য