তন্ময় গল্পদাদুর পড়ার টেবিলে থাকা বইটিতে চোখ বুলায়। কী যে কঠিন সব শব্দ! — “কুক্ ক্রিয়ামূলের বংশে জাত শব্দ ‘কুকুর’। কুক্= ক-এর করণ। কুক= কু (শব্দ) করে যে।
‘কুকুর’: √কুক্ (আদান) + উর (উরচ্) — কর্ত্তৃবাচ্য)। (ব.শ)। কুক্-এর নবরূপে উত্তীর্ণ সত্তা রহে যাহাতে। / যে খাদ্য গ্রহণ করে (দেয় না)। (ব.শ)। সারমেয়, যদুবংশীয় অন্ধকরাজের পুত্র, কুকুরের অপত্যগণ, কুকুরবংশীয় ক্ষত্রিয়গণ, দশার্হ দেশ, দশার্হবাসী যাদবগণ, গ্রন্থীপর্ণী-বৃক্ষ, হেয় ব্যক্তি, নরাধম। (ব.শ)।”
হঠাৎ করেই কুকুর শব্দটিতে তার চোখ আটকে গেল। তন্ময়ের বাবা, তন্ময়ের জন্য একটি কুকুরছানা এনেছিলেন একবার। তাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব তন্ময়েরই ছিল, কুকুরটাকে সে মাংস খেতে দিত। একদিন মজার ছলে মাংস নিয়ে সে কুকুরটাকে লোভাচ্ছিল, খেতে দিচ্ছিল না, রেগে গিয়ে কুকুরটা হঠাৎ-ই তন্ময়কে কামড়ে দেয়। কুকুরটাকে এরপর সেই বুড়িগঙ্গা পার করে বহুদূর গ্রামে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। কিন্তু সে বুড়িগঙ্গা সাঁতরে ঠিক চলে আসে, তাকে বাসায় ঢুকতে দেওয়া হত না, কুকুরটার চোখে জল দেখেছিল তন্ময়। আবার বড় চাচাও কুকুর পালেন, বিদেশী জাত, বাঘা তার নাম। বাড়ী পাহাড়া দেয়। তবু যাই হোক, কুকুরের সাথে কেন মানুষের তুলনা হবে, তন্ময় ভেবে পাচ্ছিল না।
“কী দাদু! কী ভাবছ?”
গল্পদাদুর দিকে তাকায় তন্ময়— “দাদু, কুকুর মানুষের উপকার করে, কিন্তু তবু সে নীচ প্রাণী, তাকে কেন মানুষের সাথে তুলনা করা হল?”
দাদু হেসে বলেন, “তাহলে তোমাকে কুকুর বিষয়ক উপাখ্যান শুনাতেই হয়, বলছি শোন।” গল্পদাদু মুখে আয়েশ করে একটা পান পুরে দেন। তারপর বলতে থাকেন—
“ধর ক হল যে করে, কারী। এই ক যে অবস্থানে আছে তা থেকে উপরে বা নীচে আনা হলে তা হয়ে যায় কু। কুক্ হল কু-এর করণ, কু করে যে সে হল কুক। আমরা জানি ইংরেজীতে cook হল রান্না করা। রান্না মানে কী! যে কোনও বিষয় তার উপকরণাদি দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গ্রহণ উপযোগী করা। সেটা খাবার রান্না হতে পারে, আবার পণ্য সামগ্রী হতে পারে, এই যেমন একটি বই, তা পড়ার উপযোগী করে তোলাও এক ধরণের রান্না।”
তন্ময় হা করে তাকিয়ে থাকে গল্পদাদুর দিকে। “তা দাদু, কুকুরকে মানুষের সাথে তুলনা করা হয়, এটা তুমি কোথায় পেলে?”
“ওই যে বইতে, নরাধম, হেয়ব্যক্তি এসব লেখা।” দাদু বলেন, “হুম, মানুষ মানুষকে গালি দিতে পশুর সাথে তুলনা করে, এর কারণ আছে বটে। মানুষ যখন যৌথসমাজে বাস করত, তখন সবার খাবার একসাথেই তৈরি হত, সবাইকে সমান ভাগ করে দেওয়ারই নিয়ম ছিল। কিন্তু কেউ কেউ তো ছিলই যে কিনা অন্যের খাবারটা নিজেই নিয়ে নিত। যা সকলের জন্য কুক্ করেছে, কিন্তু কাউকে না দিয়ে নিজেই খেয়ে নিচ্ছে; পশু কুকুরও তাই করে, সে অন্য কুকুরকে খাবার দিতে চায় না। মানুষের মধ্যে এমন চরিত্র যার, তাকে কেউ পছন্দ করে না। তাকে হেয় করে কুকুর স্বভাবের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আজকের দুনিয়ায় এটা বেশী দেখা যাচ্ছে সর্ব্বক্ষেত্রেই মানুষ কুকুরের মত কামড়াকামড়ি করে চলেছে, কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দিতে চায় না। কুকুর যারা তারা পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরবিরোধী কাজে দীর্ঘকাল এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে থাকে, যে তার থেকে সহজে মুক্তি মেলে না।”
গল্পদাদু একটানা বলে একটু থামেন। তন্ময়ের চোখে জানার তৃষ্ণা, দাদু তাই আবার শুরু করেন, “কোন মানুষ অল্পতেই বেশী উত্তেজিত হয় এবং প্রচণ্ড রেগে যায়, এদের কী বলে জানো?”
তন্ময় মাথা নাড়ে, সে জানে না।
“ওদের বলে কুকুরমুখ বা কুকুরমুখী। কুকুরের ঘুম খুব পাতলা, অল্প শব্দ পেলেই ওদের ঘুম ভেঙে যায়, মানুষের ক্ষেত্রে এমন হলে বলে কুকুরনিদ্রা। কোন কোন মানুষ খুব একরোখা হয়, তারা যেমন গোঁ ধরে, তাকে বলে কুকুরগোঁ; ইংরেজীতে যাকে বলে doggedness। দুষ্ট লোককে উপযুক্ত শাস্তি দিতে মানুষ 'যেমন কুকুর তেমন মুগুর' কথাটি ব্যবহার করে। কুকুরের মাথায় ঘা হলে, কুকুর পাগল হয়ে যায়, অস্থির হয়ে চারদিকে দৌড়ে বেড়ায়। তেমনি কোন মানুষ হঠাৎ দুঃশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়লে লোকে বলে কুকুরপাগল। কুল (বংশ) ত্যাগ করলেও কুকুর বলে, কু (কুল) কুর্ (ত্যাগ করা)। এরকম অনেক শব্দ আছে যা কুকুর দিয়ে হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হল কুকুরচিতা হল বনগাছ, আর যে গাছের ফুল চূড়ার মত গুচ্ছাকার হয়, তাকে বলে কুকুরচূড়া। এক ধরনের বুনো ছোট গাছ আছে যার গায়ে কুকুরের তরল বর্জ্জ্যের গন্ধ করে, তাকে কুকুরমুতা বলে।”
তন্ময় তন্ময় হয়েই শুনতে থাকে, তার মনে তখন অন্য প্রশ্ন। সে বলেই ফেলে, “দাদু, কুকুরকে তো সারমেয় বলে, কেন বলে?”
দাদু এবার উত্তর দেন, “শোন দাদু, কুকুরের সঙ্গে মানুষের পরিচয় নিয়ে দ্বিমত আছে। কারও কারও মতে প্রায় লক্ষ বছর আগে কুকুর মানুষের সঙ্গী হয়। কারও কারও মতে প্রায় পনের হাজার বছর আগে, এক প্রকার নেকড়ে মানুষের শিকারের সঙ্গী হত। মানুষ তখন শিকার করেই খেত। এই নেকড়েই মানুষের সাথে থাকতে থাকতে ক্রমে গৃহপালিত হয়ে যায়, যেটি আজকের এই কুকুর। কুকুর শ্বাপদ, স্তন্যপায়ী, মাংসাশী প্রাণী। এদের ঘ্রাণশক্তি প্রবল বলে, সহজেই কোন কিছু খুঁজে বের করতে পারে। সারমেয় সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ যে অপরাধী শনাক্ত করতে পারে, কোন কিছু খুঁজে বের করতে পারে। প্রাচীন বিভিন্ন গ্রন্থে গরু চুরির কথা লেখা আছে। আগে গরুই চুরি হত বেশী। ঋগ্বেদের ১০৮ সূক্তে উল্লেখ আছে, একদল বেনে দেবতাদের গরু চুরি করে। তখন এক কুকুরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই গরুকে খুঁজে বের করার জন্য, সেই কুকুরের নাম ছিল সরমা। সেই সরমা থেকেই সারমেয় হয়েছে। কুকুরের আরেক নাম সেজন্য সারমেয়, কুকুরের ঘ্রাণশক্তি কাজে লাগিয়ে গোয়েন্দারা বা অন্য প্রশিক্ষিতরা বহু রহস্য উদঘাটন করতে পারে, হারানো জিনিস উদ্ধার করতে পারে।”
“দাদু, শ্বাপদ অর্থ কী?”
“যে সকল জীবজন্তুর পা কুকুরের মত, তাদের শ্বাপদ বলে। সংস্কৃতে শ্বা অর্থ কুকুর। কাজেই শ্বাপদ হল কুকুরের পা।”
শব্দের এই কারিগরী দেখে তন্ময় অবাক।
“দাদু, তুমি এসবই বই পড়ে জেনেছ?”
দাদু হাসেন, “অনেক কিছু মানুষ লিখে রেখেছে, যা পড়ে জানা যায়। আবার অনেক কিছু যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে রচিত গল্প, কবিতা, গানের মাধ্যমে প্রাচীনকাল থেকে এ পর্য্যন্ত এসে পৌঁছেছে। তোমার যদি জানার আগ্রহ থাকে, তবে তুমি যে কোন স্থান থেকে শিখতে পার।”
গল্পদাদুর সামনে চা রাখা হয়েছে, সাথে মুচমুচে নিমকি ভাজা। তন্ময়ের জন্যও চা এসেছে। তন্ময় এক টুকরো নিমকি হাতে নেয়, দাদুর ঘরভর্তি সারি সারি বইয়ের আলমিরা দেখতে থাকে।
মন্তব্য