লিখেছেন: নাজমুল হোসাইন
মানুষ নিজেকে নগ্ন দেখতে ভালোবাসে না!
অথচ প্রতিনিয়ত আয়না দেখে। নিজেকে খোঁজে। এই অন্বেষণের গভীরতার মধ্যে তারতম্য রয়েছে। ভিন্নতা রয়েছে উপাদানের মধ্যেও, মানে, একেকজন একেক বস্তুতে (উপাদানে) অন্বেষণ চালায়। কেউ কেউ খুঁজতে গিয়ে নিজেকেই ওই বস্তুতে লীন করে দেয়। তখন অন্যপক্ষ হিশেবে কেউ সেই ব্যক্তিকে খুঁজতে/বুঝতে গেলে লীন হয়ে যাওয়া বস্তুতে অন্বেষণ ব্যতীত বোঝা সম্ভব নয়।
উৎপলকুমার বসু। যিনি তাঁর কবিতায় মিশে আছেন। ফলে, আমার/আমাদের নিকট উৎপল একজন কবিতা, উৎপল একাধিক কবিতা, প্রকৃত (?) উৎপলকুমার বসু হলেন উৎপলকুমার বসু নামক ব্যক্তি দ্বারা লিখিত কবিতাসম্ভার।
এভাবে, প্রত্যেক কবিই তাঁর কবিতায় মিশে থাকেন। কিন্তু এমন কবি খুব কমই আছেন যাঁদের ক্ষেত্রে ব্যক্তি কবি ও (উপরের আলোচনা মোতাবেক) কবিতাব্যক্তিকে আলাদা করা যায় না। উৎপলকুমার বসু তাঁদের একজন।
প্রাসঙ্গিক একটি ব্যাপার: ব্যক্তি কবি ও কবিতাব্যক্তি— এই দুই ব্যক্তির মধ্যে আশলে কোনজন কবি? কে কাকে লেখে?
প্রাসঙ্গিক আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলি: কবিতাব্যক্তি (শব্দটাকে নয়) ব্যাপারটাকে আপনি জাদুবাস্তব বলবেন নাকি পরাবাস্তব বলবেন, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। ‘কবিতাব্যক্তি’ শব্দটা চিন্তাপ্রসূত, যার সাথে সম্পর্কিত আমার কবিতাবিষয়ক ভাবনা। শুরুতেই যেমনটা বলেছি: আমার মনে হয়, একজন ‘প্রকৃত’ কবি কবিতায় এতটা ঢুকে পড়েন, তাকে কবিতা থেকে আর পৃথকভাবে বোঝার উপায় থাকে না। এটা বুঝতে পারা যায় ‘প্রকৃত’ কবির কবিতা পড়তে পড়তে। অর্থাৎ, কবিতা একধরনের ব্লাকহোল। (প্রকৃত) কবিরা লিখতে লিখতে যেখানে অস্তিত্বহীন হয়ে যান। পাঠকরা পাঠ করতে করতে যেখানে অস্তিত্বহীন হয়ে যান। এভাবে, কবিতা হয়ে ওঠে অনেক ব্যক্তির এক-আধার/ব্লাকহোল/অন্ধকূপ। এই ব্যাপারটাকেই বলছি: কবিতাব্যক্তি। অর্থাৎ, ভালো কবিতা মানেই সেটা কবিতাব্যক্তি।
উৎপলকে নিয়ে কিছু বলতে এসে এসব বলার কারণ: যে-কয়েকজন কবিকে (কবিতাব্যক্তিকে!) না পড়লে আমার এসব চিন্তা স্পষ্ট হতো না, উৎপলকুমার বসু তাঁদের একজন। এজন্য, এই লেখাটা উৎপলকুমার বসুকে নিয়ে হলেও, এখানে, উৎপলও আংশিক। লেখাটা স্রেফ উৎপলকুমার বসুকে নিজে যেভাবে দেখেছি/দেখছি সেখান থেকে ভাবনাটুকু বলার একটা ফ্রেম।
❍
কবি মাত্রই সময় সচেতন। কবিতা লেখার কারণে আমার নিজের মধ্যে সময় সচেতনতা রয়েছে। এবং, রয়েছে সময়চেতনাও।
সময় সম্পর্কিত ভাবনাটা এরকম:
সময় হলো তীব্র গতিশীল একটা পথ। বস্তুগত, অবস্তুগত সমস্তকিছুই এই পথের উপর অবস্থান করছে। যেটা স্থির থাকতে চাইছে সময়ের সাথে তার ঘর্ষণ হচ্ছে। ঘর্ষণে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আর যেটা সময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে বা প্রবাহিত করে চলছে, তার আয়ু স্থূল কিছুর তুলনায় বেশি। খাপ খাইয়ে চলা বা প্রবাহিত হওয়া বা বিবর্তন এটা নির্ভর করছে উপাদানের উপর। যার মধ্যে বিবর্তনের যতটুকু উপাদান রয়েছে, সে ততটুকু সময় পর্যন্ত টিকতে পারছে। এভাবে একদিন অধিক পঠিক কবিতাও অপাঠ্য হয়, হবে।
উৎপলকুমার বসুর কবিতায় তাঁর সামসময়িক অন্যান্য কবিদের কবিতার তুলনায় পরিবর্তন/বিবর্তনের উপাদান অধিক পরিমাণে রয়েছে।
কবিতার ভাষা ইঙ্গিতবাহী। একেকটা শব্দ একেক মাত্রার ইঙ্গিত বহন করে। অর্থাৎ, সব শব্দের ইঙ্গিত বহন করার মাত্রা সমান নয়। আশলে সমান নয়, ব্যাপারটা ঠিক তা না। ভাষা ব্যবহারকারী প্রত্যেকেই ‘একটা শব্দের’ ইঙ্গিতের জানালা খুলে দিতে পারেন একেকরকমভাবে। কিন্তু সকলের খুলে দেয়ার মাত্রা সমান হয় না৷
উৎপলকুমার বসুর কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়: কবিতাগুলো সমকালীন কোনো কবির লেখা। যাকে বলে সদ্য ভূমিষ্ট। কবিতায় তাঁর খুলে দেয়া ভাষার ইঙ্গিতের জানালা দিয়ে তিনি বর্তমান সময় পর্যন্ত দেখতে পেরেছেন। আরো কতদূরের ভবিষ্যৎ পর্যন্ত তাঁর দৃষ্টি স্বচ্ছ ছিল, সেটা সময়ই বলে দিবে।
❍
কবিতাব্যক্তি উৎপলকুমার বসুকে কতটুকু বুঝতে পারা যাবে, এর উত্তর উৎপলই দিয়েছেন।
চলে যায় নৈশ ট্রেন দূরেঅর্ধেক জাগ্রত রেখে আমাদের
ধরা যাক, নৈশ ট্রেন হলেন স্বয়ং কবি। আর ‘অর্ধেক জাগ্রত’ পাঠক হয়ে রাতের আন্ধারের আড়াল নিয়ে চলে যাওয়া কবিকে (ট্রেনকে) বুঝতে চাই।
হয়তো, টের পাওয়া যাবে, ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দে, হুইসেলের শব্দে। কিন্তু, অর্ধেক জাগ্রত পাঠকের পক্ষে রাতের ট্রেনকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া অসম্ভব। সেই ট্রেন শুধু অনুভূতি জাগিয়ে দিয়ে যায়। স্নায়ুর মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে চলে যায়। হুইসেল বাজিয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের জড়তা কাটিয়ে দিয়ে যায়।
মন্তব্য