আমি মনে মনে চাইলেই হয়, তুমি আমার হাত ধরো। এই আনন্দ আমি লুকিয়ে রাখি আমি আমার দীর্ঘশ্বাসের ভিতর। এই রকম একটা দীর্ঘশ্বাস ‘কাসাব্লাংকা’ সিনেমায় আছে। ‘আ কিস ইজ স্টিল আ কিস। আ শাই ইজ জাস্ট আ শাই।’
তখন কলেজে পড়ি। একদিন একটা মিউজিক ভিডিও দেখি। একটা সিনেমার গান। ভিডিওটার চেয়েও গানটার লিরিক ভয়াবহ সুন্দর। গানটার একটা লাইন ছিল, ‘আ কিস ইজ নট আ কিস উইদআউট ইওর শাই...’। এটা ‘কাসাব্লাংকা’ সিনেমার গান। তোমার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া চুম্বন আসলে চুম্বনই হয় না—এই জাতীয় কথা আমার বুকের ভিতর হাহাকার হয়ে কাঁটার মতো বিঁধে যায়। আমি সিনেমাটা দেখার জন্যে খুঁজতে থাকি। কিন্তু শহরতলির ভিডিও লাইব্রেরিতে সেটা অনেক খুঁজেও পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ফার্স্ট ইয়ারে সিনেমাটা খুঁজে দেখে ফেলি। না, সিনেমাটার মধ্যে গানটা নেই। ওটা আসলে সিনেমাটা নিয়ে বানানো গান। তবে সিনেমাটিতে আরেকটি গান আমরা পেয়ে যাই, ‘অ্যাজ টাইম গোজ বাই’। এই গানটা আরো ভয়াবহ। আমি শুনতে থাকি। আর আমার বুকের ভিতর মাইলের পর মাইল ফাঁকা হয়ে যায়। ‘তুমি কে আসলে, কোথায় ছিলে তুমি এর আগে?’
আমার চোখে ভাসতে থাকে চুম্বন করতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে মদের গ্লাস। কিংবা হামফ্রে বোগার্টের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে অবশেষে আবেষ্টনে ভেঙে পড়ছে ইনগ্রিড বার্গম্যান। তার দীর্ঘশ্বাস থমকে যাচ্ছে কিংবা বলছে, ‘আমাকে চুমু খাও, চুমু খাও আমাকে শেষবার যেমন খেয়েছিলে।’
২
‘জানো তো, তোমার বাম পাঁজরের হাড় থেকে আমার জন্ম। পাঁজরের হাড় তো কার্ভ। তাই আমি কুঁজো হয়ে হাঁটি। যেন বা ইউমেজি থিমে ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’। মনে হয় শুনতে শুনতে মরে যাই। আর ভাবলাম, হাঁটতে হাঁটতে পথ যেখানে শেষ হবে সেইখানে বনপলাশির মতো ফুটে আছে তোমার মুখ। সেই মুখ দেখে ক্লান্তি চলে যায় জানি। তুমি হলে আমার একমাত্র আনন্দগান।’
‘আমাকে আরেকটা বাঁশবন এঁকে দাও তবে।’
‘তোমাকে বাঁশবন নয়, জিরাফ একে দিব, কালো নয়—রঙিন। তবে প্রাইম কালার কালো, যেহেতু আমি কালো। আমি আসলে জিরাফের অ্যাসেন্স আঁকব। ধরো একটা জিরাফ হয়ে গেল ইউমেজি থিম, সেইটা আঁকব।’
‘আচ্ছা।’
‘আমার শুধু মনে থাকে তুমি আর তোমার কুঁজোশ্রাবণ একদিন ওয়ং কার-ওয়াইর ফ্রেমে ঢুকে গিয়েছিল যেদিন পৃথিবীতে গভীর বৃষ্টি নেমেছিল।’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ এই কারণে যে তুমি ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ সিনেমাটা আমাকে তোমার পাশে বসে আমাকে দেখতে দিয়েছ।’
‘তোমার কাছে ওয়ং কার-ওয়াইয়ের বানানো সব থেকে প্রিয় সিনেমা এটা?
‘আমারও। আমার তার সব প্রিয়। কিন্তু সব থেকে বেশি প্রিয় ‘চুংকিং এক্সপ্রেস’। সম্ভবত এটা আমার দেখা ওর প্রথম সিনেমা। সেই কারণে হয়তো। একটা ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলাম। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে এই সিনেমা দেখেছিলাম।’
‘চুংকিং এক্সপ্রেস আমারও প্রিয়।’
‘দুইটা দুই রকম সিনেমা।’
‘হয়।’
‘ক্রিস্টোফার ডয়েলের ক্যামেরাতেই ওয়াই পরিণতি পায়। ডয়েল আর ওয়ং কার-ওয়াই হচ্ছে পরস্পর অন্তরাত্মা।’
‘ডয়েল আমাকে কোনোদিন বলেছিল, ‘আই ফিল লাইক আ পিস অফ নিয়ন, আইম জাস্ট আ গ্যাস ইনসাইড আ টিউব।’ এই কথা শুনে আমার নিজেকেও নিয়নই মনে হয়েছে।’
‘আমার বোর্ডিংপাস ভিজে গেছে দেখ। তুমি কি আরেকটা করে দিতে পার?’
‘হ্যাঁ, পারি। তুমি কোথায় যেতে চাও, বল।’
‘তুমি যেখানে নিয়ে যাবে, আমি চলে যাব।’
‘বোগাস।’
‘চুংকিং এক্সপ্রেস’-এর শেষ দৃশ্য থেকে।’
‘দেখ আবার ভালো করে। যত্তসব!’
৩
গীতবিতান বলে, ‘গীতবিতান ভীষণ আলসে হয়ে গেছে। সারাদিন খালি সিনেমা দেখেছে, ‘দ্য কিং অ্যান্ড দ্য ক্লাউন’, ‘দ্য পারফিউম অব মেমোরি’...। আচ্ছা, ‘লাইফ ফ্রম ঢাকা’ বলে একটা সিনেমা নাকি ইউরোপের কোনো ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পাইছে, জানো? পরিচালক নাকি আমাদের ইউনিভার্সিটির?’
‘ট্রেইলার তো ভালোই। কিন্তু ছেলেটা ঢাবির, চবির নয়। সে এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার হিসেবে আছে। আদনান নামে আরেকজন আছে। সে চবির।’
‘কিন্তু আমি যে আদনানকে চিনি সে এই ছেলে নয়। আচ্ছা, গীতবিতানের সবুজ পাথরটা কেমন আছে?’
‘আমায় ছুঁয়ে দেখ, আমায় ছুঁয়ে দেখ—আমার সমস্ত শরীরে ভালোবাসা...’ সুবর্ণা যখন ‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে এই কথাটা বলে তখন আমার নিজেকে সুবর্ণা মনে হয়। এখন আর সুবর্ণাকে ভালো লাগে না।’
‘হুঁ, আবার এলো যে সন্ধ্যা...।’
‘শোন, আমি অভিনয় বিচার করি সুচিত্রা সেনকে দিয়ে। সুচিত্রা হলো পৃথিবীর সব থেকে বড় অভিনেত্রী।’
‘হুঁ, আমিও।’
‘আর এখন দেখ বিকল্পধারার সিনেমার নামে যা বানাচ্ছে তার অধিকাংশ ঠিক টেলিফিল্ম কিংবা টিভি নাটকও হয়ে উঠছে না। বিকল্পধারার দরকার কী? মেইনস্ট্রিমটাই ভালো করে করলে হয়।’
‘শেখ নিয়ামত আলী ‘দহন’ বানিয়েছিলেন, ওটাও তো মেইনস্ট্রিম সিনেমা ছিল না। তাই বলে সেই সিনেমা দিয়ে কি বাংলা সিনেমার কোনো উৎকর্ষ সাধিত হয়নি? পাবলিক গ্রহণ করেছে, না করেনি? আলমগীর কবীর, তারেক মাসুদ কেউ মেইনস্ট্রিম সিনেমা বানায়নি। তাহলে এরা বাংলা সিনেমার উৎকর্ষ সাধনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি বলছ?’
‘অবশ্যই উৎকর্ষ সাধন করেছে। কিন্তু ওই লেভেলের বিকল্পধারার কাজ এখন কজন করছে?’
‘আলমগীর কবির মেইনস্ট্রিম সিনেমা বানিয়েছে একটা ‘মহানায়ক’ ওনলি ওয়ান। তাও ফ্লপ। কবীরের শেষ সিনেমা ছাড়া বাকিগুলি আমজনতা সহজে গ্রহণ করে নাই। ধরো ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’ বা ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ সাধরণের বোধগম্য নয় কিন্তু ‘হ্যাপি টুগেদার’ কিংবা ‘গ্রান্ডমাস্টার’ সাধারণের বোধগম্য।’
‘হ্যাপি টুগেদার’ কখনোই সাধারণের বোধগম্য না। এটার একটা বিশাল মেটাফোর আছে। হংকং-এর রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি জানাশোনা না থাকলে সেই মেটাফোরটুকু সাধারণ ধরতে পারবে না।’
‘মেটাফোর না বুঝেও সিনেমাটা বোঝা যায়।’
‘মেটাফোরটুকু না বুঝতে চাইলে এটা নিছক একটা প্রেমের সিনেমাই মনে হয় কিংবা অ্যালাইনেশনের সিনেমা।’
‘একটা বাণিজ্যিক ছবিতেও অনেক মেটাফোর থাকে সেটা তো আর সকলের বোঝার দরকার নাই।’
‘আমার কথা হচ্ছে মেইনস্ট্রিমের সিনেমা কী? ফারুকীর ব্যাচেলর কি লোকে বুঝে নাই? যদি বুঝে তাহলে সেটা মেইন স্ট্রিমের সিনেমা হবে না কেন? মনপুরা’ও তো চেষ্টা ছিল। ব্যবসাও করেছে। লোকে তো নিছেও। সেটা কি চেষ্টা না?’
‘মনপুরাকে তো আমি খারাপ বলতেছি না। ধরো, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এইটা হইলো মেইনস্ট্রিম।’
‘তোমার থিওরি আমি মানতে পারলাম না। কিংবা সত্যজিতের সব সিনেমা? হোয়াট অ্যাবাউট ওয়াং কার-ওয়াই, গদার, ডেভিড লিঞ্চ, হোদোরস্কি, কুবরিক? এরা কি মেইনস্ট্রিম, নাকি না?’
‘না।’
‘তাহলে তো তোমার কথায় দাঁড়াচ্ছে যে এদের চলচ্চিত্র কোনো উৎকর্ষ সাধন করে নাই।’
‘করেছে। তোমাকে আমি ঠিক বুঝাতে পারছি না যে আমি কী বলতে চাইছি।’
৪
‘আচ্ছা, আজ কি ঋতুপর্ণের জন্মদিন? সেও কন্যা! আশ্চর্য!’
‘তোমাকে তো তো আগেই বলেছি যে ঋতু কন্যা। তুমি সব ভুলে যাও।’
‘ঋতুপর্ণ, উত্তম, সালমান শাহ সবাই কন্যা! আজকে আমি তিরিশটা ড্রইং করেছি। আর কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি। নিজেকে একটা ছেলে ভাবতে ঘেন্না লাগতেছে।’
‘কেন! ঋতুও তো ছেলে হয়েই জন্মেছিল। তাতে ঘেন্না লাগার কী আছে?’
‘বাদ দাও। কথাটা অন্য কারণে বললাম। পৃথিবীতে এত মানবিক বিপর্যয় আর নিতে পারছি না।’
তুমি আর আমি এক বই থেকেই ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘ফার্স্ট পার্সন’ পড়ছি। তুমি বামপাশের পৃষ্ঠা, আর আমি ডান পাশের। আমি পড়তে পড়তে তোমাকে বললাম, ‘আই লাভ ঋতু।’
তুমি বললে, ‘আমিও...।’
‘ফার্স্ট পার্সন’ পড়তে পড়তে আমার মনে হলো ঋতুকে আমি কেবল তার সিনেমার জন্যে ভালোবাসি না। কেনো ভালোবাসি বুঝতে পারছি না।’
‘তুমি তো অর্ধনারীশ্বর, তাই ঋতুকে ভালোবাস।’
‘জানো তো ঋতু একদিন ঘুম যাওয়ার পর, আর ঘুম থেকে ওঠেনি কোনোদিন। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় আমিও একদিন ঋতুর মতো ঘুমের ভিতর মরে যাব। পাশ ফিরে শুয়ে আছি তুমি দেখবে। শুধু নিশ্বাস পড়বে না।’
৫
‘ফার্স্ট পার্সন’ শেষ?
‘হয়।
‘কেমন হলো পড়তে?’
‘ভালো। ঋতুর সঙ্গে আমার অনেক বিষয় মিলে গেছে। জীবনযাপন আর অভ্যাসের ক্ষেত্রে। শখ আর ইচ্ছার ক্ষেত্রে। আমি ঋতুকে ভালোবাসি।’
‘আমিও ।’
‘গতবার কলকাতায় গিয়ে টালিগঞ্জে গিয়েছিলাম, তুমি জানো।’
‘হুঁ।’
‘মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশনে নেমে, হেঁটে হেঁটে আইল্যান্ডে উত্তম কুমারের একটা ভাস্কর্য পার হয়ে কিশোর কুমার পার্কে একটু জিরিয়ে গেলাম ফিল্ম টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে।’
‘হয়।’
‘ওইদিন সব বন্ধ ছিল। কেবল গেট থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম। সুচিত্রা সেন, ঋত্বিক ঘটক আর ঋতুর প্রতিকৃতির ম্যুরাল, টাইলস ভেঙে করা। জানালাম ওই বিল্ডিং-এ ঋতুর নামে একটা ফ্লোর আছে।’
৬
আচ্ছা, তুমি গদারের ‘ব্রেথলেস’ সিনেমাটা দেখেছিলে? দেখেছো নিশ্চয়ই!’
‘না তো!’
‘তাহলে আজকেই দেখে ফেলো। এই সিনেমা থেকে প্রথম আমি শিখি ঘাড়ে চুমু খাওয়া। চুমু খাওয়ার সেই সৌন্দর্য। সিনেমার ইতিহাসে ‘ব্রেথলেস’ একটা ঘটনা। এই সিনেমার পর সিনেমা আর আগের মতো থাকেনি, এমন বলা হয়ে থাকে। তবে সিনেমার নায়ককে দেখা যায় বারংবার হামফ্রে বোগার্টকে নকল করতে। নায়কের নাম আর সে যেখানে যেতে চায় সেই জায়গার নাম বারবার বদলে যায়। এর শুটিং হয় রাস্তায়, যেখানে চরিত্রগুলি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। সাধারণ মানুষ ক্যামেরার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে এমনকি চরিত্রগুলির সঙ্গে কথাও বলতে দেখা যায়। সিনেমার ন্যারেটিভহীনতার সূত্রপাত খুব সম্ভবত এই সিনেমায়ই। পঞ্চাশ দশকে একদল তরুণ ফিল্মমেকার টিপিকাল ধারা ভেঙে নতুন এক ধারা তৈরি করে, যা সিনেমার ইতিহাসে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। কোনো দায় নয়, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা শিল্পীর মধ্যে যে আত্মসচেতনতা তৈরি করে তা থেকেই আধুনিক প্রযুক্তি, শিল্প, দর্শন আর সাহিত্য মিশিয়ে তৈরি হয় সিনোমার নতুন নিরীক্ষাধর্মী কাল। যার নাম ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ। ‘ব্রেথলেস’ এই নিউ ওয়েভেরই শস্য। আচ্ছা, তোমার প্রাক্তন কখনো তোমাকে ঘাড়ে চুমু খেয়েছিল?’
মন্তব্য