উৎপলকুমার বসু ৩ আগস্ট, ১৯৩৭ সালে কলকাতায়, ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। হাংরি আন্দোলনের একজন অন্যতম কবি ও সাহিত্যিক। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি মৃত্যুবরন করেন ৩ অক্টোবর, ২০১৫ সালে কলকাতায়। রচনা করেছেন অসংখ্য সব অসাধারণ কবিতা ও গদ্য। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পুরী সিরিজ’ প্রকাশের পর দীর্ঘ একযুগ তাঁর কোনো লেখালেখি দেখা যায়নি। এই মহাবিরতির পর, তিনি লিখলেন তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আবার পুরী সিরিজ’। শর্ত ভেঙে ভেঙে সৃষ্টির উন্মাদনায় প্রাণ সঞ্চার করেছেন প্রতিটি কবিতায়। তাঁর কবিতা আহ্বান জানায় নতুন জার্নির; অতিক্রম করে কল্পনা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। এবং উপলব্ধির শব্দে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়— নতুন করে ভাবার জন্য...
বস্তুগত চিন্তার মধ্য দিয়ে কল্পনার জগতকে অতিক্রম করে আরো বড় বাস্তব উপলব্ধিতে নিয়ে যায় তাঁর কবিতা। পাঠক ভাবতে থাকেন এরপর আর কতদূর যাওয়া যায়? উৎপলকুমার বসু তাঁর কবিতায় রেখেছেন পাঠকের নিজস্ব চিন্তা করার অফুরন্ত স্পেস। পাঠক তাই তৃপ্ত হয়েও খুঁজে চলেছেন নিজস্ব অনুসন্ধান...
হে সমুদ্র, অন্ধকারে, বিবাহের দ্রুত আয়োজন হল প্রত্যেক বিবাহে—একই সঙ্গে প্রেম ভালোবাসা হল— সন্তানের জন্ম হল— উত্তরোত্তরআমরা বিবাহ ছেড়ে আরো দূর বিবাহের উৎসবে চলে যেতে চাই।(আমার আত্মার মাঝে)
কবিতার এই অশেষ পঙক্তিমালা পাঠকের মনে জাগিয়ে দেয় গভীর শূন্যতা। অথচ পরক্ষণেই এই শূন্যতা ভেদ করে আশা ও আকাঙ্খায় জেগে ওঠেন পাঠক এবং নিজেকে খুঁজতে থাকেন জীবনের গভীরে প্রবেশ করে করে...। কবিতার আহ্বানে পাঠক নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ান। আর এভাবেই উৎপলকুমার পাঠকের সংবেদনে বুনে দেন টুকরো টুকরো স্মৃতি...
রূপনগরেতে চলো।সে-দেশে ধুলোয় সবার নিভৃত নাম লেখা আছে।যে-নামে তোমায় পুরনো বন্ধুরা চেনে এখনি বাতাসসেই নাম ডেকে গেল। রূপনগরের পাঁচিলে না হয় বোসোকিছুক্ষণ— দুটি পায়রার পাশাপাশি।”(প্রান্তর থেকে। কাব্যগ্রন্থ: চৈত্রে রচিত কবিতা)
এই পায়রা দুটি যেন পাঠকেরই মনের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া একজোড়া পায়রা যারা রূপনগরের পাঁচিলে বসে আছে। কোথায় সেই রূপনগর! যেখানে কবি পাঠককে নিয়ে যেতে চান। সেই রূপনগরের ধূলা গায়ে মেখে পাঠক যেন নিজের নাম পুনরুদ্ধার করতে থাকেন।
জ্যোৎস্না এখানে নেই। তাকে কাল হাই-ইস্কুলেরপোড়ো বারান্দার পাশে দেখা গেছে। সে তার পুরনোআধোনীল শাড়িটি বিছিয়ে ঐখানে শুয়েছিল।‘তুমি কোন্ ঘর ছেড়ে এলে? কোন দুঃখে? কোথায় চলেছ?’কে যেন শুধালো তাকে। তার অস্ফুট উত্তরহাজার ডানার শব্দে, নামতা-পড়ার শব্দে, নিরুত্তরেচাপা পড়ে গেল—”(‘গত পূর্ণিমায়। কাব্যগ্রন্থ: চৈত্রে রচিত কবিতা)
উৎপলকুমার বসু একটি গল্প যেন শুরু করলেন কবিতায়— জ্যোৎস্নার গল্প। আর এই জ্যোৎস্নার গল্পে কল্পনা ও বাস্তবতার রসায়ন ঘটিয়ে দিলেন ব্যাপক আন্তরিকতায়। চিত্রকল্পের স্পষ্টতা নিয়ে পাঠক ডুবে যেতে থাকেন নীরবতায় “হাজার ডানার শব্দে, নামতা-পড়ার শব্দে, নিরুত্তরে”।
আজ আছি চিরন্তন রৌদ্রে ও হিম-সকালেরআবরণ উদ্ভাবনে— যে-প্রহর বাজে না চকিতেকেবলই বুকের তলে ক্ষয়ে যায়, অজ্ঞান, অলক্ষ্য যাত্রায়,পুরনো পাতার শব্দে, ঝরে পড়া অঘ্রানে, শীতে।”(কেবল পাতার শব্দে। কাব্যগ্রন্থ: চৈত্রে রচিত কবিতা)
অদ্ভূত শূন্যতার মাঝে প্রাণ সঞ্চার করে প্রত্যেকটি পঙক্তি। পঙক্তিগুলো নিজেরাই যেন এক একটি পাতা, পুরানো পাতা যাদের শব্দে ঝরে পড়ে অঘ্রান ও শীতের অশেষ আহ্বান। তাঁর কবিতায় শব্দে শব্দে সুর খেলা করে। এক প্রেমময় আহ্বানে-আকুতিতে বাজতে থাকে টুপটাপ টুপটাপ...। বুকের নিচে বয়ে যায় চিরন্তন রোদ ও হিম সকাল। বুকের নিচে ক্ষয়ে যায় অজ্ঞান ও অলক্ষ্য যাত্রা।
কাঠুরেদের মতো মনে হয় আমারও প্রতিশ্রুতি ছিল বন্য ও আরণ্যসম্পদ হেলায়অগ্রাহ্য করে আমি শহরে এসে বুঝেছিলাম আমার প্রতিশ্রুতি ছিল নিতান্তই নাগরিক অর্থাৎ আমি রাজকমলকে লিখেছিলাম ভবিষ্যতে দেখা হবে, তখন দু’জনে মদ মুখে রেখে কথা বলব কাকে বলে মদ, তখন কবিতা সামনে রেখে কথা বলব স্বপ্ন কাকে বলে, অথবা কিছুই ঘটবে না সেদিন, তৃতীয় যে-কোনো লোকের কথা মন দিয়ে শুনব সেবার, মাতৃসদনের সামনে হাওয়াগাড়ি দেখার সিদ্ধান্তে বহু বালকের ভিড় হল, খুঁড়ে তোলা টেলিফোন গর্তে তারা নেমে গিয়েছিল, কিছু একটা ঘটবে তা হলে, কী বলেন?(রাজকমলের স্মৃতির উদ্দেশে। কাব্যগ্রন্থ: আবার পুরী সিরিজ)
কোনো দুর্বোধ্যতা না রেখেই কবিতার এই পঙক্তিগুলোয় সমাজবাস্তবতা প্রকাশিত হয়েছে। আর সহজাত সংবেদনশীলতা ছড়িয়ে গেছে মানবিক স্পন্দনে!
কবিতার প্রতিটি শব্দ বহন করছে শবদেহ। আর বয়ে নিচ্ছে নাগরিক জীবনের অন্তর্গত হাহাকার। যেখানে যুদ্ধ শেষে পড়ে আছে শান্ত ফসলের ভূমি। আর যে ভূমির পাশে পাঠক কেবল নিস্তব্ধ দর্শক!
উৎপলকুমার বসুর কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক ডুবে যেতে থাকবেন হাজার ডানার শব্দে। ডুবে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াবেন পাঠক। হাঁটতে থাকবেন নতুন জন্ম নেয়া পথে, ভাবনায়... যেখানে পাঠক নিজেই একজন কবি যাঁকে জন্ম দিলেন স্বয়ং উৎপলকুমার। তাঁর কবিতা আমাদের মনে জাগিয়ে দেয় সৃষ্টির উন্মাদনা। সম্পূর্ণ নিরুত্তর করে আমাদের মনে জন্ম দেয় হাজারো প্রশ্ন...
কবি তানজিন তামান্নার আলোচনাটা খুব ভালো হয়েছে। পড়ে ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনআপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ চঞ্চল। আপনার পড়ে ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম...
মুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনআলোচনার গাঠনিক দিক ভাল!
মুছুনচমৎকার গদ্য৷ তানজিন তামান্নার কবিতা পড়েছিলাম বিন্দুতে৷ ভালো লেগেছিলো৷ ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা৷ এবার গদ্য পড়েও হতাশ নই৷ লেখকের জন্য শুভকামনা
উত্তরমুছুনপড়েছি,অনেক ভালো লেগেছে।
উত্তরমুছুন