লিখেছেন: সুশান্ত বর্মন
সমকালে তরুণদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক কবির লেখা মর্ম ছুঁয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন জিনাত জাহান খান। লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। বের হয়েছে মাত্র তিনটি বই। ধারাবাহিক ভাবে পড়লে বোঝা যায় কবিতার অবয়ব দিনে দিনে তার কাছে কীভাবে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে কবিতার অরূপতা গ্রহণ করেছে অনায়াস রূপময়তা। তার মানে এই নয় যে, তিনি কবিতার অরূপসৌন্দর্যের সন্ধান জানতেন না। বরং প্রথম কাব্য থেকেই তিনি কবিতার অনুরণন পাঠক মননে ধ্বনিত করতে শুরু করেছেন। রসসন্ধানী পাঠক প্রতিটি কবিতা পাঠশেষে কবির পরবর্তী কবিতাগুলো সম্পর্কে আরো আগ্রহী হয়ে উঠতে চাইবেন।
অনেকের মতে কবিতার মধ্যে আমিত্বের প্রকাশ আধুনিকতার বার্তাবাহক নয়। একালে মানুষ নিজেকে ছাপিয়ে উঠেছে, আমিত্বের বৃত্ত সম্প্রসারন করেছে। এসব ভাবনা অমূলক নয়। তবে জিনাত জাহানের আমিত্ববাচক কবিতাগুলোর প্রকরণ অতটা অনগ্রসর নয়। বরং কবিতাগুলো নিজ গুণে ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠেছে; শব্দে, অলংকরণে আমিত্ব প্রধান হলেও সেই আমিত্ব পরিপার্শ্ববিযুক্ত নয়। তার আমিত্ব নিঃসঙ্গ নয়। ঘিরে থাকা সর্বব্যাপী অনুষঙ্গসমূহ তো আবর্তিত হয় সেই ব্যক্তি আমিত্বকে কেন্দ্র করেই। চারপাশের পুরুষপ্রবণ সমাজে লেখক নিজের স্বতন্ত্র্য সত্ত্বা/ সজ্ঞা উচ্চারণ/ প্রকাশ/সম্প্রসারণ করেন। শুধুমাত্র নারী হিসেবে নয়, ব্যক্তি হিসেবে তিনি যে স্বতন্ত্র আবেগ, অনুভূতি, চিন্তন দ্বারা চালিত হন তা আরও মূর্ত করে তোলেন। আর তার বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশন মোটেও অনাধুনিক নয়।
তার কবিমন সহৃদয়। আর সেজন্য সময়ান্তরের প্রতিটি বিচ্যুতি অথবা অভিঘাত তাকে আলোড়িত করে। সচেতন হয়ে ওঠেন প্রত্যাশিত পরিবর্তন সম্পর্কে। যার প্রভাবে শরীরী অবয়ব ও অনুভূতির নানান ভঙ্গিগুলো শব্দরূপ পায় তার কবিতায়। গভীর অনুধ্যানে মগ্ন কবি একের পর এক বলতে থাকেন নিজের কথা। প্রথম কাব্য “নীল কাছিমের দ্বীপ” (২০১৪) বইতে তিনি আমিত্বের বর্ণিল অবয়বে বৃত্তাবদ্ধ থেকেছেন। তার তরুণ ভাবনায় 'আমিত্ব' একটি প্রধান অনুষঙ্গ। তার উপস্থাপনাভঙ্গি পেলব। আমিত্বের বিকট প্রকাশ দিয়ে দিক্বিদিক সচকিত করে তুলতে চান নি। আবার নিজের আমিত্বকে ছাপিয়ে যেতে চান নি। মূলত আমিময় মহাকালের যাত্রী তিনি নন। তাই কবি নিজের আমি'র বৈচিত্রগুলোর শুধু বিবরণ দেন। তার শব্দচয়ন কোমল মার্জিত; প্রকাশভঙ্গি সহজাত।
‘আমি ও ছায়া কবিতায় মৃদুস্বরে স্বীকার করেন -
কবিতার অক্ষর নয়, আমি আঁকি ছায়াপৃষ্ঠা-১২
‘বিন্দুর চলার পথে’ কবিতায় তিনি নিজেকে স্থাপন করেন একেবারে অন্যমাত্রার বলয়ে-
জ্যোৎস্না বিভ্রমে নিজেকে, বিন্দু করে তুলে দেই পরম আহ্লাদে।… বিন্দু আমি, ঘোর লাগা টানে কোনায়-কোনায় মস্তিষ্ক রাজপথ ঘুরে, সরলরেখায় দাঁড়াই।পৃষ্ঠা- ১৭
বোধের সমান্তরালে তার আমিত্ব প্রকাশ পায় 'একটা রঙিন প্রজাপতি ও আমি', ‘আমিই সুহাসিনী', ‘আমি এবং আমার ব্যক্তিগত নীলবাক্স’, ‘কাঠগোলাপহীন যে শহর’, ‘আনন্দের দিকে’ প্রভৃতি কবিতায়।
তার ‘সামগ্রিক তবে একটা কিছু’ কবিতাটি কিছুটা ভিন্নমাত্রিক। যেন এক অনিবার্য ইচ্ছামালার অবয়বের মত। বারবার পড়তে, একেবারে মুখস্থ করে ফেলতে ইচ্ছা করে। কবিতায় বিবৃত কোন প্রত্যাশাই অক্ষম নয়। কবির মতো আমাদেরও কামনা সাতটি প্রসঙ্গের সাতটি অনুপম পরিণতি কাম্য হোক।
একটা রহস্য-গহ্বর মনোযোগে থাক আমাদের…একটা অলস শামুক সবুজ আলোয় উজ্জ্বল হোকএকটা রাজহাঁস ফিরে পাক তাঁর নীল জলের প্রসাদএকটা লাল ঘুড়ি পরীদের হাত ঘুরে জাদুর বাক্সে থাক…একটা মাছরাঙা দুপুর ভুলে কাঁটা-কম্পাস ঠোঁটে জন্মবৃত্ত আঁকুকএকটা কালো সন্ধ্যা রাতের গভীরে বোবা জোছনায় ভাসুকএকটা পাগল তাঁর হৃৎপিণ্ডে জ্যান্ত মাছ ডুবিয়ে রাখুক।পৃষ্ঠা- ৪৬
‘জল-যুবতী ও আল-ভোলা পথিক’ কবিতাটি পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়। জল যুবতীর বিবৃতি পাঠতৃষ্ণার প্রত্যাশা তৃপ্ত করে না। পাঠক প্রত্যাশা করে কবিতার শেষে কবি যে ঘোষণা দিয়েছেন তা যেন অসত্য হয়, ‘জল যুবতীর নদী হওয়ার গল্পটা নিছক একটা শাব্দিক কল্পনা ছিল’ একথা অনুচ্চারিত থাক। পাঠক মনে প্রশ্ন তৈরি হয় -কেন এমন হবে? এমন অন্যমাত্রার স্বপ্নগৃহ তার রচনায় অনায়াস, সহজসাধ্য। তার কবিতাগুলো যেন স্বপ্নের মত। অধরা কিন্তু অনিবার্য।
পুরুষ লিখিত কবিতায় কবিগণ নিজের শরীরের বিভিন্ন অনুষঙ্গগুলোকে অনায়াসে উপেক্ষা করেন। নিজের শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের কথা পুরুষ লেখকের রচনায় প্রায় অনুপস্থিত থাকে। নারী লেখকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্নরকম। নারী জীবনের অন্তরঙ্গে শরীরী দ্যোতনা অনিবার্য। অস্বীকার বা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। পরিপার্শ্বের অন্যান্য উপমান, উপমেয় বা উপমিতির মত শরীরের উপস্থিতি জিনাত জাহানের রচনায় অবাস্তব নয়। তবে, প্রচলিত প্রবণতার বিপরীতে তার অবস্থান। অন্যদের উচ্চারণে শরীরের প্রকাশ প্রকট, কিন্তু তার শরীরী রূপকল্প শালীন, শুধু উপস্থিতির জানান দেয়; মনোযোগকে বিভ্রান্ত করে না। মানুষ তো প্রধানত শরীরী। এই কায়ার মায়া তো অশরীরী নয়। কবি তার নিজস্ব স্বরে, ব্যঞ্জনায়, উপমাশৈলীতে শরীরের বহুবিদ প্রসঙ্গকে অনবদ্য করে তোলেন। ফলে মানবজীবনের এই অনিবার্য উপস্থিতিটির মন্ময়তা পাঠকের মনোযোগকে একেবারে কেন্দ্রের দিকে ধরে রাখে। পাঠক নিজেকে অতিক্রম করার অনুপ্রেরণা হারায় না। নারী হিসেবেই নিজের বিচিত্র আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, প্রতিক্রিয়া, মনোভঙ্গি কাব্যমধ্যে নিয়ে এসেছেন। তিনি সিক্তস্বরে নিজের অন্তর্গত টুকরো টুকরো প্রসঙ্গগুলো পাঠ করেন। প্রকাশ্যে আলোচ্য করে তোলেন গহীন জীবনের বিচ্ছিন্ন, তাৎক্ষণিক, টুকরো এলোমেলো বোধগুলোকে। পরিমিত শব্দবোধ লেখকের এক শৈল্পিক সম্পদ। এটা সবার থাকে না। অথচ জিনাত জাহানের কোন শব্দ, শব্দবন্ধ, বাক্য বাহুল্য মনে হয় নি। বরং তার পরিমিতিবোধ পাঠককে আরও অনুসন্ধিৎসু করে তোলে।
লেখক তার ‘নীল কাছিমের দ্বীপ’ বইটি বাবাকে উৎসর্গ করেছেন। বাবার কাছে নিজের লুকানোর কিছুই নেই। শৈশবের প্রতিটি দিনে বাবার সামনে তার সবকিছু ছিল উন্মুক্ত। লজ্জ্বা, দ্বিধার অতীত সে সময়ে পিতা আর তার মাঝখানে কোন আড়াল ছিল না। জন্ম থেকে শৈশব পর্যন্ত শরীরী ও মনোবিকাশের প্রতিটি পর্বে পিতার অবস্থান ছিল অগাধ, অবাধ, স্বতঃস্ফুর্ত, পরিব্যাপ্ত। আজ পরিণত বয়সে পিতার সংস্পর্শ আর সাবলীল নয়। তাই কবিতার আশ্রয়ে জানান তার পরিণত অবয়বের যাবতীয় অনুরণনসমূহ।
দ্বিতীয় বই ‘কথা বলা মাছ’ (২০১৫) কাব্যের প্রথম কবিতাটি মাত্র এক লাইনের। ‘যাত্রা’ নামক এই এক লাইন কতটা কবিতা হয়ে উঠেছে সেই ব্যাকরণিক বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় এই একটি লাইন পাঠককে এক দণ্ড চিন্তামগ্ন হতে বাধ্য করে।
কোন সরীসৃপ যাত্রাই অনিশ্চিত নয়পৃষ্ঠা-১
সত্যিই তো আমাদের যাত্রাপথ সর্পিল হয়েই থাকে। প্রাত্যাহিক বাস্তব জগতে আমাদের কোন যাত্রা কখনও সরল রেখায় চলে না। হাঁটাপথ বা বাহনে চেপে যেখানেই যাই না কেন, যাত্রাপথ বারবার আঁকাবাঁকা করতেই হয়। যাপিত জীবনের যাত্রাপথ তো প্রতিদিনই সাপের মত ভঙ্গি পরিবর্তন করে। আর মনেজগতের পরিভ্রমণের কথা বলাই বাহুল্য; মানুষ বরং এখন মনুষ্যজীবনের চাইতে সর্পজীবনেই অধিক স্বচ্ছন্দ্য। অর্থাৎ মানবজীবনের ভ্রমণপথের সকল মাত্রাকে কবি একটিমাত্র লাইনে বর্ণনা করে ফেলেন। আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। কারণ যা বঙ্কিম তার ভবিতব্য নির্ধারিত। যা সরল তাই বরং অনিশ্চিত হতে পারে।
প্রথম কাব্যে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ; একজন নারী তো বটেই। দ্বিতীয় কাব্যে তিনি মাতৃত্বের মর্ম অনুধাবন করেন।
মাদি পিঁপড়ের দলেপিছু নিয়ে জেনেছি -কেন বংশবৃদ্ধির পূর্বেতারা তাদের ডানা খুলে রাখে!পৃষ্ঠা- ২২
মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বিলুপ্তি তো এভাবেই ঘটেছিল। মায়েরা সন্তানের জন্য নেতৃত্বের বাসনা ত্যাগ করেছিলেন। পিঁপড়ে সমাজে মাতৃত্বকালীন স্থবিরতার জন্য মাতার নেতৃত্ব ত্যাগ করতে হয় না। কিন্তু মানবসমাজ ভিন্ন রকম। এখানে সুযোগ পাওয়ামাত্র নেতৃত্ব হাতবদল হয়। মায়েরা তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।
একান্ত আলাপচারীতার স্বরে তিনি কবিতা বলে যান। আমরা নিমগ্ন হয়ে শুনি। তিনি বেশ সাবলীল, অনবদ্য, সরল স্বরে স্বীকার করেন-
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি একজন মৃৎশিল্পীএখন জানলাম আসলে আপনি চিত্রশিল্পীপৃষ্ঠা- ২৪
‘সময়’ কবিতায় সময়কালের একটি সময় 'রাত ঠিক একটা' বাজলে কিছু বিশিষ্ট ঘটনা একটি করে ঘটতে শুরু করে। এক অলৌকিক অনুধ্যান যেন ‘রাত ঠিক একটা’ বাজার অপেক্ষায় থাকে; আর ‘রাত ঠিক একটা’ বাজলে চিত্রকল্পের রূপ ধরে আমাদের সামনে হাজির হয়। এক বিকট বাস্তবতা যেন বাঁকা হয়ে সময়ের দেয়ালে ঝুলতে থাকে। এই কবিতায় কবি মাত্র ছয় লাইনে যা বলেছেন তা আজকের প্রেক্ষিতে অনিবার্য আবার মহাকালের প্রেক্ষিতে মানবজীবনের নিয়তি। ‘নয় কিছু আর’ কবিতায় কবির ব্যক্তিগত বোধ সমকালীন সকলের অনুভূতিতে পরিব্যপ্ত। অথবা সকলের অনুভূতিকে নিজের করে নেয়াতেই যেন কবির সার্থকতা।
অবদমনের সমূহ পৃষ্ঠায় ঘুড়ি আঁকি একমনেআর সুতো ছাড়ি, সাদা এক সুতো দিতে থাকি ছেড়েপৃষ্ঠা- ৩৬
লেখকের অনেক কবিতাই এমন মর্মভেদী। প্রথম কাব্যে নিজের অবয়বের বাইরে তিনি তেমন অকপট নন। তা হয়ত সম্ভব ছিল না। মহামতি গোখল বলেছেন “প্রত্যেক লেখক নিজেকে বিনির্মাণ করে”। জিনাত জাহানও তাই করেছেন। তার উপস্থাপনের ভাষা ও ভঙ্গি ভিন্নরকম। অন্যদের মত আত্মপ্রচারের উৎকট প্রকাশ নয়। বরং নিভৃতে, পাতার মর্মর ধ্বনিময় নির্জন প্রতিবেশে তিনি মৃদু স্বরে কথা বলেন। দূর থেকে নয়, পাঠকের নৈকট্যে একান্তে অস্ফুটস্বরে নিজের কথার অনুরণন তোলেন।
‘আমি কখনওই মধ্যরাতের ট্রেন ধরতে পারি নি।’ কেউ কি পারে? হিরোডোটাস বলেছিলেন ‘একই নদীতে দুইবার অবগাহন সম্ভব নয়।’ এ তো সময়ের প্রবহমানতায় আমাদের অপ্রস্তুত অংশগ্রহণের কথা। মধ্যরাতের ট্রেন ধরা কি এতটাই সহজ, সময়ের পিঠে সওয়ার হওয়া তো সহজসাধ্য কাজ নয়।
লেখকের তৃতীয় রচনা “শর্তহীন দেবদারু” (২০১৮) কাব্যের ‘বুকশেলফ' কবিতার রূপকল্পটি অসাধারণ! পিতা ও মাতার অবয়বে বই ও বইয়ের আলমারির অনায়াস সাযুজ্য বেশ অনবদ্য ও নান্দনিক। পড়তে স্বস্তি লাগে, এক অপার ভাললাগা সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। এই কবিতায় বিবৃত গল্পটি এতই অসাধারণ যে কল্পনা করতেও আনন্দ লাগে। ইচ্ছে করছে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করতে। আপাতত শুধু সূচনা ও শেষাংশ পাঠে তৃষ্ণা মেটাবার চেষ্টা করা যাক।
আমাদের ঘরে কোনো বইয়ের তাক ছিল না। বই ছিল অনেক। আমি বাবাকেও বই ভাবতাম, মাকে ভাবতাম আলমারি।…মাঝখানে অনেকদিন বই পড়া হয়নি; তখন ডায়েরি লিখতাম। একদিন বাবাকে পড়তে ইচ্ছে করল; গিয়ে দেখি আলমারি ভেঙে বাবা পড়ে আছে ধূলার পৃথিবীতে। বাবাকে কোলে তুলে আমার আঁচল দিয়ে তার শরীরের সমস্ত ধূলা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।পৃষ্ঠা- ৯
এই কবিতায় কবি পিতাকে বই এবং মাতাকে বইয়ের আলমারির সাদৃশ্যে কল্পনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে পিতামাতার সাথে বা যে কোন মানুষের সাথে বই এবং বইয়ের আলমারির এমন সহজ তুলনা বিরল। বস্তুত বই এবং বইয়ের আলমারির সাথে কোন মানুষের সাদৃশ্য যে হতে পারে এমন ভাবনা বাংলা ভাষার খুব কম লেখকই ভেবেছেন।
লেখক নিজের পরিচয় নির্মাণেও কুণ্ঠিত নন। প্রথম কাব্যে এর যে আভাষ পাওয়া যায়, তা স্পষ্টতর হয়েছে তৃতীয় গ্রন্থে এসে। সেখানে তিনি স্বনামেই নিজেকে প্রকাশিত করেন। ‘পরিচয়’ কবিতায় শুধুমাত্র তিনটি লাইনে তিনি নিজের অন্তর্গত অবস্থানকে উন্মোচিত করেন। বিবরণ দেন সমান্তরাল স্বকীয়তার। তিনটি আলাদা লাইন, কিন্তু আলাদা সংখ্যাক্রম নয়। তিনটি লাইনেরই ক্রমসংখ্যা ১ ব্যবহার করে তিনি তিনটি পরিচিতিকেই সমান উপযোগীতা দিয়েছেন। অভূতপূর্ব চরিত্রের কবিতাটি একটু দেখে নেয়া যাক-
১। আমি রাখাল বালিকা! পুরুষের দায়িত্ব বুঝে নিতে পৃথিবীতে এসেছি…১। আমি জিনাত জাহান খান। পাখি হয়ে নয়, নিজের পরিচয় নিয়ে উড়ে যেতে চাই…১। আমি নারী, আমি ডাকাত ভালোবাসি।পৃষ্ঠা- ৯
সত্যিই কি তাই? প্রশ্নটি অনিবার্যভাবেই উত্থাপিত হয়। তিনি নারী বলেই কি ডাকাত ভালবাসেন? নাকি এ তার নিজের একার একান্ত পক্ষপাত। প্রথম লাইনে বরং কবিকে রাখাল নয় ডাকাতসুলভ মনে হয়। সেজন্যই কি তৃতীয় লাইনে সত্যিটি স্বীকার করে নেন? তবে এটাও তো ঠিক যে, মানুষ তার অবস্থানগত সময়কাল ও বাস্তব জগতকে উপেক্ষা করতে পারে না। শুধুমাত্র নিজের মতো করে বদলে নেবার চেষ্টা করতে পারে।
এই কাব্যের একটি বেদনাবাহী কবিতা 'কাকতাড়ুয়া'। প্রচলিত কবিতার মত ভঙ্গুর লাইনে এই কবিতা লেখা নয়। ঝরণাধারার মত টানা বাক্যে তিনি ধারাবাহিকভাবে বক্তব্যের মত করে কল্পনা বর্ণনা করেছেন। টানা গদ্যে লেখা বাক্যগুলো কবিতা হয়ে উঠেছে প্রসঙ্গ আর উপস্থাপনের বিশিষ্টতায়।
ফসলী ক্ষেতে পাখির আক্রমণ ঠেকাতে বুদ্ধিমান কৃষক কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করে। খড় এবং কাঠি দিয়ে তৈরি করা মানুষের অবয়বের নিষ্প্রাণ পুতুল সে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নিষ্ক্রিয় থাকাটাই তার কাজ। উপস্থিতি ছাড়া কাকতাড়ুয়ার আর কোন অভিব্যক্তি নেই। পুতুল জীবনে আসলে সক্রিয় হবার কোন উপায় থাকে না। জিনাত জাহান এই কবিতায় কাকতাড়ুয়ার আড়ালে বর্ণনা করেছেন নিজের জীবনসমগ্রতাকে। প্রথম লাইনে কবি নিজের পরিপার্শ্বের বিবরণ দেন এভাবে-
আমাকে ঘিরে ধরেছে যে ঘর, তার পাশে বারান্দাপৃষ্ঠা- ১৯
একজন মানুষের উপস্থিতি নির্দেশে এটুকুই যথেষ্ট। মানুষকে আর যা কিছু ঘিরে রাখে সেসব বাহুল্য মাত্র। একটি ঘর ও তার সাথে থাকা একটি ছোট বা বড় বারান্দা – প্রচলিত প্রত্যাশা এর বেশি নয়, প্রাপ্তিও এতটুকু। লেখক প্রচলিত এই প্রাপ্তির মায়ায় আবদ্ধ থাকতে চান না। তিনি অকপটে নিজের মনের গহীন ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বলেন-
আমি বেরিয়ে যেতে চেয়েছি এইসব প্রচলিত থেকে যাওয়া থেকে।পৃষ্ঠা- ১৯
এই যে ‘প্রচলিত থেকে যাওয়া’, তা লেখকের ইচ্ছাসমগ্রের প্রতিরূপ নয়। কেন না কাকতাড়ুয়ার স্থবিরতা জীবনযাত্রার সমার্থক নয়। ভ্রমণাকাঙ্ক্ষার শেকড়ে থাকে সক্রিয় জীবনবোধ। সে জীবনবোধ কেমন তা লেখকের কাছে যদিও স্পষ্ট নয়। যে শীতকালে ভ্রমণ জনপ্রিয়, সেই শীতকাল নিজেই তো কুয়াশার প্রকোপে ফ্যাকাসে, অস্পষ্ট। অবারিত দৃষ্টিসীমা বাধ্য হয় সংকুচিত থেকে যেতে। প্রত্যাশিত মনোবিচরণ থেকে যায় সীমাবদ্ধ, অর্গলবদ্ধ। আত্মরতির বৃত্তে নিরন্তর ঘুরতে থাকে বন্দী মানুষ। আর সেজন্যই বোধহয় শত্রু কাকতাড়ুয়ার ঘাড়ে মাথায় নিরুপায় কাক বসতে পারে নিশ্চিন্তে।
তোমাকে যে তাড়াতে চায় তাকেই ভালোবাসো, কাক।পৃষ্ঠা- ১৯
উপায় তো নেই, ধূ ধূ জমিতে কাকতাড়ুয়া ছাড়া কাকের বসার মত কোন কাঠামো বা সজীব গাছ তো না থাকারই কথা। তবে সেকথা লেখক খোলাসা করেন নি। তার ভ্রমণাকাঙ্ক্ষা কেন ব্যর্থ হল তার বিশ্লেষণ এড়িয়ে গেছেন। কবিতার কোথাও এই রহস্য আর খোলাসা হয়না।
জিনাত জাহানের শব্দচয়ন মার্জিত; চিন্তাকাঠামো গভীর অনুধ্যানপ্রবণ। দুয়ে মিলে তার কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। আবেগবিচ্ছুরিত ঐশ্বর্য তার কবিতার প্রাণ। তিনি নিজে যেভাবে কবিতাকে অনুভব করেছেন, অন্যের অনুকরণ বা অনুসরণ নয়, নয় ভাষায়, নয় প্রকরণে, প্রকাশ করতে চেয়েছেন একান্ত নিজস্ব স্বরে।
প্রথম কাব্যে নিজেকে ভাঙচুর করে দ্বিতীয় গ্রন্থে আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীকে। তৃতীয় কাব্যে এসে দেখা যাচ্ছে কবি নিজের গহীন অন্তর্গত কাঠামো খুঁড়ে চলেছেন। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন আমিত্বের সান্নিধ্য। পাঠকের প্রাপ্তিযোগ তাতে বেড়েছে বই কমেনি। পুরুষ লেখকদের আমিময়তার ডমরু তো এখনও ক্লান্তিহীন বেজে চলছে। উত্তরাধুনিক এই যুগে বাংলা সাহিত্যের বিষয়ানুগ বিন্যাস ও প্রসঙ্গের উপস্থাপন তো এখনও নির্বিবাদী ও ব্যক্তিমুখী। সম্মিলনের বার্তা এখনও দূরাগত আভাষ মাত্র। অতএব তার নারীত্ব তার আমিত্বের চাইতে অধিক প্রাধান্য পাবে কী না তা বিবেচ্য হিসেবে গ্রহণ করা অতিশয়োক্তি মাত্র।
এই সচেতনতা কবি নিজেও ধারণ করেন। আর সেজন্য পুরুষ কবিদের রচনায় যে প্রসঙ্গগুলো থেকে যায় অনুচ্চারিত, সেই প্রসঙ্গগুলো তিনি নিজের রচনায় চিহ্নিত করেন, উল্লেখ করেন অবলীলায়। কোন অজুহাতে এড়িয়ে যান না। কোন কুসংস্কার, কোন অতীত বা ভবিষ্যতমুখীনতা তাকে বিরত রাখতে পারে না। তিনি অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে উল্লেখ করে যান নারীকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রসঙ্গ, অনুভূতি, উপাদান, অনুষঙ্গের নাম। ভ্যানিটি ব্যাগ, মাতৃত্ব, ডিম্বাশয়, তলপেট, অরগাজম, ঋতুচক্র, নাভীমূল, গ্রীবা প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেন নির্দ্বিধায়। কোনরকম যৌনগন্ধ না ছড়িয়েই শব্দগুলো তার যথাযথ অর্থ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। কোনরকম বাহ্যিক বলপ্রয়োগ ছাড়াই লেখক মানবীয় প্রস্তাবনার আহ্বানে পাঠককে শব্দগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন।
শুধু বিশেষ অনুভূতির বাস্তবায়ন নয়, তিনি নতুন শব্দ বা শব্দগুচ্ছ তৈরিতেও সিদ্ধহস্ত। তার রচনায় ভাললাগার মতো বেশ কয়েকটি শব্দগুচ্ছ আছে। এগুলো আমাদের সামনে অভিনব ভাবব্যঞ্জনা উপস্থাপন করে, জানিয়ে দেয় লেখকের শব্দশ্লিষ্ট জীবনের নানারকম অর্থময়তা। কয়েকটি শব্দগুচ্ছের উল্লেখ করি-
বর্ণচোরা তৃষ্ণা, বৃষ্টিপাতা-১২, ছায়ার অতীত, রোদের অভিপ্রায়, জন্মকেন্দ্র, দুপুরফুল, রাত্রিপাপড়ি, ঝিনুকবাস, অন্ধকারের ঘ্রাণ, স্লিভলেস ঘটনা, শামুক অতীত, শঙ্খরোদ, নগরপিপাসা, নিঃসঙ্গে বিসর্গ, বজ্রকুসুম, সুরবর্ষা প্রভৃতি। ভিন্নভাবের শব্দযোজনার সামর্থ সকলের থাকে না। বাঙালিদের মধ্যে পুনরাবৃত্ত চিন্তাচর্চার বিশেষ গুণটি দুর্লভ। জিনাত জাহানের মধ্যে এই বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ আছে বলে মনে হয়। আবেগের প্রাবল্যে অনিয়ন্ত্রিত বিনির্মাণ নয়, তার সাথে চিন্তার সংযোগ প্রয়োজন। লেখকের রচনাসাফল্য সেই নিষ্ঠার বার্তাবাহক।
তার রচনার কোন কোন অংশে উপস্থাপিত বিষয়ে ধ্বংসাত্মক হওয়া যেতে পারে। আপাতত একটি প্রসঙ্গ উপস্থাপন করলে বিষয়টির অনুধাবন সহজ হবে। 'কথা বলা মাছ' কাব্যের 'দৃশ্যমান গোপনীয়তা' কবিতায় তিনি এক পর্যায়ে উচ্চারণ করেন-
সেই ফুলে থাকা অংশে বসে দিগন্তের ঘাস নিয়ে যদি ঘটনা ঘটাতে থাকি, তাহলে ব্ল্যাকহোলের উজ্জ্বল আলোয় দৃশ্যমান গ্যালাক্সির অসংখ্য ছায়াপথের একটি পথ হবে আমাদের।পৃষ্ঠা- ১৫
এখানে কি নতুন কোন অপার্থিব দৃশ্য তৈরির চেষ্টা হয়েছে? তাহলে প্রচেষ্টাটির প্রশংসা করি, কিন্তু দৃশ্যপটটি অতোটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে মনে হয় না। এখানে ব্লাকহোলের আলোকজ্জ্বল চিত্রের বর্ণনাটি ঠিক যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ব্লাকহোলের আলো, তাও আবার উজ্জ্বল? এটা কল্পনাতিরিক্ত দোষে দুষ্ট বলে মনে হচ্ছে। দৃশ্যমান গোপনীয়তার আরও উপযুক্ত ভাবচ্ছবি কল্পনা করা যেত। বৈজ্ঞানিক সূত্র ও সত্যতা বিষয়ে লেখকের আরও সচেতনতা প্রত্যাশা করি। অনেকে শিল্পের অজুহাতে ব্লাকহোলের মধ্যেও আলো খুঁজে পেয়ে কবির দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করতে পারেন। কবিকে সেইসব বিশ্লেষককে স্তাবকদের কাতারে রাখতে অনুরোধ করব।
জিনাত জাহান খানের কবিত্বের সৌন্দর্য হিসেবে একথা বলা যায় যে তিনি একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র স্বর ও সুর খুঁজে পেয়েছেন; নির্মাণ করতে পেরেছেন আত্মমগ্নতার এক অন্য জগৎ। যেখানে তিনি নিজের পরিপার্শ্ব তথা ব্যক্তি, পরিবার, পরিচিতবলয়, বস্তুজগৎ সকলকে নিয়ে এক বর্ণিল, বৈচিত্র্যময়, চিন্তাজাগানিয়া কাব্যভাষার এক অসাধারণ রূপময়তা উপস্থাপন করেছেন। এক অসংকোচ ভাবকল্প সেই শব্দজগৎকে নিরন্তর মুখর করে তোলে। কবিতা অনুসন্ধানী পাঠকের প্রত্যাশা এর বেশি তো নয়।
কবি সম্পর্কে
কবি জিনাত জাহান খান। ১৯৭৮ সালের ১০ আগস্ট, বাংলােদেশর বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বরিশালেই তাঁর বেড়ে ওঠা, দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর এবং বর্তমানে একটি ডিগ্রি কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োজিত আছেন। প্রকাশিত কবিতার বই তিনটি। প্রথম বই ‘নীল কাছিমের দ্বীপ’ (শুদ্ধস্বর, ২০১৪), ‘কথা বলা মাছ’ (চৈতন্য ২৯১৫) ও ‘শর্তহীন দেবদারু’ (জেব্রাক্রসিং, ২০১৮)।
খুব সুন্দর এবং সুখপাঠ্য বিশ্লেষণ।
উত্তরমুছুনলেখাটা অনেক বড় তবুও বিরক্তি আসেনি একটুও।
কবি এবং প্রবন্ধকার -
শ্রদ্ধাসহ ভালোবাসা জানবেন ।
প্রিয় কবির আলোচনা সুন্দর হয়েছে।
উত্তরমুছুনএকজন তরুণ কবিকে নিয়ে এত সমৃদ্ধ আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না৷ এমন লেখা পড়তেই বারবার বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ লেখককে ধন্যবাদ৷
উত্তরমুছুনএমন বিশ্লেষণ একজন তরুণ কবির জন্য অনেক বড় পাওয়া৷ অনেক বড়৷ বাংলাদেশে এটা হচ্ছে৷৷ বিন্দু করছে৷ বিন্দুর জন্য ভালবাসা৷
উত্তরমুছুনএই কবিকে দেখেছি খুব কাছ থেকে,,,,শাসন ও ভালোবাসা পেয়েছি,,,,চিরজীবন হৃদয়ে অম্লান থাকবে মাতৃতুল্যা এই প্রিয় শিক্ষক।
উত্তরমুছুনকবিতার ভাষা ও সাবলীল সুন্দর গাঁথুনি অপূর্ব।
বিখ্যাত কবি হোক আমার প্রিয় ম্যাম এ কামনা করি🥰🥰।