লিখেছেন: রোমেল রহমান
বাঘ একটা মানুষ তুলে নিয়ে আসে জঙ্গলে! তারপর হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করে বনের সব পশুপাখিকে এক যায়গায় করে! সবাই দেখে একটা অচেতন মানুষ! বাঘটা তখন আহ্লাদের সঙ্গে বলে, দেখো দেখো এই মানুষটারে দেখো! এইটা হইলো সেই অসুখে আক্রান্ত মানুষ যেই অসুখের যন্ত্রণায় সমগ্র দুনিয়ায় মহামারী শুরু হয়েছে! লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে! ভিড়ের ভেতর থেকে এক বান্দর বলে ওঠে, ওস্তাদ মানুষটা কি জীবিত না মৃত? বাঘ বলে, জীবিত! মারি নাই ওরে, ঘেটিও মটকাই নাই! ঘেটি মটকানো মানুষ দেখতে সোন্দর না! তয় খাইতে উত্তম! এক সজারু কয়েকবার কাশি দিয়ে বলে, মানুষটা তো দেখতে মানুষের মতো! এই বাক্য শুনে সবাই হেসে ফেলে! বাঘ বিরক্ত হয়ে বলে, মানুষ দেখতে মানুষের মতন হবে না তো কি সজারুর মতন হবে? তখন বাঘডাশা বলে, এই মানুষের শরীরের ভাইরাস কি আমাদের শরীরে লাগবে? মুখে করে জঙ্গলে কি ভাইরাস টেনে আনলেন আপনি? তাইলে কিন্তু খবর আছে! প্রশ্নটা বাঘের মনেও গেঁথে যায় এবং তার মনটা খারাপ হয়ে যায় এই জন্যে যে, মানুষটাকে আর খাওয়া হবে না, মনের মধ্যে খুঁতখুঁতানি ঢুকিয়ে দিয়েছে বাঘডাশা! কিন্তু বাঘডাশার এই প্রশ্নে সবার মধ্যে একটা নাড়াচাড়া পরে যায়! সবাই আরও কিছুক্ষণ ভাইরাস আক্রান্ত একজন মানুষকে দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে চলে যায়! এরপর দিন থেকে সবাই বাঘকে বর্জন করে কেননা সবার ধারণা বাঘের ঐ ভাইরাস হবে কেননা বাঘ তো মানুষটাকে মুখে করে তুলে এনেছে!! ব্যাপারটা যখন বাঘ টের পায় তখন তার ভীষণ কষ্ট হয়! নিজের ভাই বন্ধুরা সবাই তাকে দেখলেই পালিয়ে যাচ্ছে!
এদিকে বাঘের আতঙ্কে দুদিন অচেতন থাকার পর মানুষটার জ্ঞান ফেরে! তাকিয়ে দেখে একটা জঙ্গলে পরে আছে সে! তারমানে অসুখটা তাকে কাবু করতে পারে নি বা মেরে ফেলতে পারে নি কিংবা তার অসুখটা হয়নি! অযথাই তাকে ফাঁকা মাঠে ফেলে গিয়েছিলো গ্রামের লোকেরা! হাঁচি কাশি আর গলা ব্যথা হওয়ায় গ্রামের লোকেদের ধারণা হয় তাকে মারণ ভাইরাস আক্রান্ত করেছে, ফলে সবাই তাকে বর্জন করে এবং গ্রাম থেকে বের করে বনের কিনারার একটা ফাঁকা মাঠে ফেলে যায়! সারাদিন কান্নাকাটি করার পর সে টের পায় কেঁদে লাভ নেই তারচেয়ে বেঁচে থাকা জরুরী! ঠিক সেই মুহূর্তে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসে কেননা, বাঘ তার ঘেটি কামড়ে ধরে তুলে নিয়ে আসে আর সে টের পায় সবকিছু ক্রমশ ঝিরিঝিরি হয়ে আসছে! মানুষটা জ্ঞান ফেরার পর টের পায় ভীষণ ক্ষুধায় তার পেট মোচড়াচ্ছে! ফলে সে খাবারের সন্ধান করে আর চারদিকের গাছগাছালির মধ্যে পেয়ে যায় প্রচুর খাবার! আবডালে থাকা পশুপাখিরা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে থাকে মানুষটাকে! মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ বিনা টিকিটে দেখতে পাওয়া একটা দারুণ অভিজ্ঞতা! অন্যদিকে মনের দুঃখে সেই হিংস্র বাঘটা দিনে দিনে শুকিয়ে একটা বিলাই হয়ে যায় এবং মিউ মিউ স্বরে ডাকতে ডাকতে একদিন মানুষটার কাছে এসে একটু সঙ্গ পাবার জন্য লাফিয়ে কোলে উঠে ঘর্ঘর করতে থাকে! মানুষটা কিছু দিনের মধ্যে জঙ্গল জীবনে ভীষণ অভ্যস্থ হয়ে যায়, যেন অরণ্য পুত্র টারজান তার উপর ভর করে! লোকালয়ে ফিরে যাবার চিন্তা সে আর করে না, কেননা তাকে যারা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো সামান্য কয়েকটা হাঁচি কাশির জন্য তাদের কাছে, তাদের গ্রামে বা তাদের সমাজে ফিরে যাওয়ার থেকে এই অরণ্যবাস ভালো! কিন্তু জঙ্গলের পশুরা কেউ এটা মেনে নিতে পারে না কেননা পরম্পরায় তাদের সমগ্র জীবন জুড়ে মানুষ বিষয়ক ভীতি প্রবাহিত আছে! মানুষ মানেই গাছকাটা, পশু শিকার নৈলে ধরে ধরে রান্না করে খাওয়া অথবা ফাঁদে আটকে বিক্রি করে দেয়া! ফলে পশু পাখিরা সিদ্ধান্ত নেয় মানুষটাকে ক্রমাগত বিরক্ত করে কিংবা ভয় দিয়ে নদী পার করে দিতে হবে! পরদিন থেকে দেখা যায়, বনের পাখিরা মানুষটার মাথায় পায়খানা করে দিচ্ছে, বানরেরা ডাল থেকে খ্যাঁকাচ্ছে, ভেংচি দিচ্ছে, ফলফলাদি ছুঁড়ে মারছে তার গায়ে, সাপ ফোঁস দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে! এইসবের মধ্যে মানুষটা উপলব্ধি করে এগুলো নিয়েই বাঁচতে হবে অন্তত গ্রামে ফিরে গণধোলাই খেয়ে মরা কিংবা না খেয়ে মরার থেকে এদের খাবার হলেও ক্ষতি নেই! ফলে পশুপাখি তাড়াতে আদিম মানুষের লাইনে নেমে পড়ে মানুষটা! দুটো পাথর ঠুকে আগুন জ্বালায় কিন্তু দুর্ভাগ্য আশকারা পেয়ে ধীরে সেই আগুন সমস্ত বনে ছড়িয়ে পরে! ফলে পশুপাখিরা পাগলের মতন পালাতে থাকে! তারা নেতাকে জিজ্ঞাস করে, কোনদিকে যাবো? নেতা বলে, যার যেদিকে খুশি যাও আগে জানে বাঁচো! ফলে অরণ্যের চারদিকের গ্রামে মফস্বলে শহরে বন্দরে বাঘ শেয়াল বানর হরিণ সাপ সজারু বন বিড়াল বিচিত্র পাখি হাজির হয়! পণ্ডিত মানুষেরা প্রথম প্রথম আমোদ পায় তারা বলে, প্রকৃতি নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে... মানুষ আর জন্তুকে একসাথে বসবাস করতে বলছে! পাশাপাশি আতংক নাজেল হয় কেনোনা হিংস্র প্রাণীদের আগমনে গৃহবন্দী মানুষেরা দরজা খুলতে ভয় পায়! বিড়ম্বনায় পরে অনেকেই! একদিন শহরের ডিসি অফিসে এসে চেয়ারে বসতে গিয়ে দেখে এক বিষধর সাপ তার চেয়ারে বসে ফণা তুলে আছে! একজন জনপ্রতিনিধি রাতে শোবার ঘরে ঢুকে দেখে তার বিছানায় একটা শেয়াল শুয়ে আছে! একজন নামজাদা ব্যবসায়ী দেখে তার গোসলখানায় জলশূন্য বাথটাবে একটা শূকর কাদা খুঁজতে এসে বিব্রত দাঁড়িয়ে আছে! ফলে খুব দ্রুত চারদিকে একটা অস্বস্তি জারি হয়!
ওদিকে সমস্ত অরণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আর অঙ্গার হয়ে যাওয়া বনের মধ্যে নিঃসঙ্গ বাবা আদমের মতো মন খারাপ করে বসে আছে সেই মানুষটা! কোলে তরা ডোরাকাটা বিড়াল! নিজের বোকামির তারিফ করতে করতে সে স্বপ্ন দেখে একদিন নিশ্চয়ই একজন হাওয়া বিবি আসবে এখানে আর এই অরণ্যে তারা দুজন আবার সবুজ ফলাবে! ঠিক তখন গ্রামে শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া পশুদের যন্ত্রণায় মানুষেরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে তুমুল! মহামারীর বন্দিত্বের মধ্যে এই যন্ত্রণা তারা নিতে পারে না! কেননা বাঘের ভয়ে হাট বাজার খোলা বন্ধ! আবার হাতি, বানরের যন্ত্রণায় বাগানের কলা শেষ কিংবা হরিণেরা ফসল ক্ষেতে হানা দিয়ে সব নষ্ট করে গেছে! যদিও প্রথম প্রথম কদিন মানুষেরা এইসব পশুপাখির ছবি তুলে ফেইসবুক টুইটারে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের হৃদয়ের উচ্চতা উড়িয়েছিল! ফলে পশু পাখি থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসন এক উচ্চতর মিটিঙয়ের আয়োজন করে সিদ্ধান্ত নেয়, শহরে এবং গ্রামে আগুন জ্বালানো হবে ঘরে ঘরে, আগুন দেখলে সব পশু পাখিরা ভয়ে জঙ্গলে ফিরে যাবে! কিন্তু আগুন জ্বালাবার পর দেখা যায়, আগুনের লেলিহান শিখা খেয়ালে বা বেখেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে বাসাবাড়িতে এবং মুহূর্তে সব ছাই হয়ে যেতে শুরু করে! অপর্যাপ্ত দমকলের মুখোমুখি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না আগুন! ফলে মানুষ এবং পশু পাখিরা এক সাথে পালাতে শুরু করে শহর গ্রাম বা মফস্বল থেকে এবং কোথাও তারা একটু অরণ্য খুঁজে পায় না!
১২ মে ২০২০
মন্তব্য