এক.
কুমারী পাথর ছুঁলাম বুকে। তারও অণুর ভেতরে থাকে পরিহার্য শব্দের ক্রন্দন। বোঝা যায়, ক্রোধ আর ক্রন্দনে মূলত তফাৎ নেই। অথবা ভ্রান্তির মতো এদের কোনো সরলতা থাকে না। তবু ভ্রান্তি কিংবা আরো যতো আমাদের বয়সী শব্দগুলোর স্বাভাবিক দু'একটি 'বেদনার মতো' আছে। হতে পারে আলাদা হয়ে যাওয়ার বেদনা সেসব। তুলো হতে তুলো আলাদা হয়ে যাচ্ছে রোজ। তুলোরা যখন একটি করে বীজ বুকে নিয়ে ভাসতে থাকে, ভেসে যায় অরণ্য থেকে আরেক অরণ্যে কিংবা ভেসে যাচ্ছে, কেবলই ভেসে যাচ্ছে, তখন বীজের ইচ্ছা অনিচ্ছা নিয়ে কোনো কথা হতে পারে না। কিন্তু আদতে একটি বীজ-ই ভেসে যায় তো। তারও আছে ছেড়ে যাবার বেদনা, ক্রন্দন, ভ্রান্তি।
আমার খুচরো স্বভাব। মহাকাশ কিংবা বড়সড় পাহাঢ় নিয়ে ভাবতে পারি না। সুতরাং একটি কুমারী পাথর বুকে নিয়ে এইসব ভাবছি। ভাবছি আমার বস্তুনিষ্ঠ বিকেল। এই নরোম রোদ্দুরে শিশুর পা থেকে তার মাথার চেয়ে বড় একটি ফুটবল কেমন গড়িয়ে যায়। গড়িয়ে যাচ্ছে কোথায়? ওইদিকে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে কোনো গাঁজাখোর যুবক। তার সম্মুখে গতিশ্লথ বল। বলে তার ঈশ্বর নেই। মনের ভেতর সে হয়তো বেহালার ছেঁড়া তার জুড়ছে বিরহী আঙুলে। আর ভাবছে এবার কনকনে শীতে একটা বরষার গান হবে...
গানে আর কবিতায় এতো জল কেন? এতো জল কোত্থেকে আসে? আহা, আমাদের সম্পত্তিতে কতো শব্দের জলযোগ আছে!
একবার সমুদ্রের দিকে যাবো। শুনেছি সমুদ্রের ভিন্নরকম একটা শব্দ আছে। শব্দের ফেনা জমে থাকে পায়ের কাছে। তাই সাবধানে পা ফেলতে হবে। এছাড়াও আমি একটা গোপন কথা জানি। মূলত কথা নয়, একটা দৃশ্য, স্বপ্নে দেখেছিলাম। সামুদ্রিক পাথরে শামুক ঠুকলে শব্দ থেকে জন্ম নেয় পাপ। সেই পাপ হলো ঈশ্বরের সন্তান। আর স্বপ্নজাত সত্য হলো এই— শব্দই ঈশ্বর। মিথ্যেও হতে পারে। সে দায় আমার কিংবা আমার চিন্তার নয়। কিন্তু—
আমি পুণ্য তীর ছেড়ে দিয়ে ক্রমশই পাপসমুদ্রের দিকে ভেসে যাই।
দুই.
বুঝেছি সমস্ত নৌকো একই দিকে চলেযদিও বিভিন্ন চলা, বহু দ্বীপের আশ্রয়।
একবার কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছি। নামকরা একটা বাসে। উঠবার সময় দেখেছিলাম পেছনের চিরধরা গ্লাস, খানিকটা মাকড়সার জালের মতো। টিকেটে উল্লেখ আছে এয়ার কন্ডিশন। অতএব, থু ফেলার মতো ফাঁক ফোঁকর নেই। একেবারে ঢালাই করা ব্লাক উইন্ডো। যাচ্ছি। সামনে একটা গোলাপি বাস, পেছনে হলুদ ট্রাক। তারও সামনে, তারও পেছনে আরো অনেক গাড়িটাড়ি আছে নিশ্চয়। কোথায় যাচ্ছে সব? ঢাকায়? কেন যাচ্ছে? কেবলা’র সাক্ষাতে? আহা কেবলা, ধরণীর মাধুরী কাগজ!
পাকা রাস্তায় থাকে উন্নয়নের খাল। সুতরাং একটু নড়েচড়ে দোল খেতে খেতে যাচ্ছি। ভাবছি রাতের গভীরে ভোর, ভোরের গভীরে সকাল, ....সন্ধ্যা, সন্ধ্যার গভীরে আমার সমুদ্রে যাবার সাধ।
তোমার কাছে যাবার কথা থাকে, সমুদ্র! থাকুক। আজ অন্যকিছু ভাবা যাক। এই যে হাতের নোটবুক, নোটবুকে লেখা, ফিরে আয় হারামজাদা। কে লিখলো, আমি? আমার মনে নেই। কাকে লিখলাম, আমাকে? আমি কোথায়? কোত্থেকে ডাকছি? এই আমি কোথায়, কোন দ্বীপে? আছি কোন নৌকোয়?
নাহ্! আর ভাবা যাচ্ছে না। নিজের উপর রেগে যাচ্ছি ভীষণ! ভীষণ রেগে যাচ্ছি! রাগ? না, এটা ক্রোধ হবে! কেউ বলেছিলেন, 'কত-না রুদ্ধ ক্রোধ বাক্সে লুকানো থাকে...'। বাক্সটা কি জিনিস গো?
তিন.
ঘটনা হলো কিছু শব্দ নিয়ে আমার মানসিক পীড়া আছে। বিশেষত নামপদের উচ্চারণে আমি অদ্ভুতরকম চিন্তিত। এমনকি নিজের কমলা কালার নামটি নিয়েও যতো টানাপোড়েন। চারপাশে কতো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। পদাহত চিৎকার। শুনতে ভালো লাগে না। মানসিক ক্ষতি হয়। তাই নিঃশ্বাসে তুলেছি দেয়াল। মাঝখানে একান্ত দোসর, আমার নাম— ধৈর্য।
ধৈর্যই আমার নাম—চতুর্দিকে তুলেছি দেয়াল,যখন আঘাত এসে পড়ে শুধু শব্দের, ক্ষতির।
নিজের ভেতর এমন কাব্যকথা পেয়ে গেলে 'নিজ' হয়ে যায় পরিজাত আয়াত। নিজেকে তখন, কেবল তখন উচ্চারণ করতে ভালো লাগে। দুঃখ তখন রঙহীন হয়ে যায়, কখনো শব্দ যেমন বর্ণহীন বর্ণনা।
নয়তো কোন এক 'আমি' এসে আমাকে বলে, 'মূক তুমি তাকিয়ে রয়েছ ঠান্ডা ভাতের থালার দিকে'। তারপর 'গভীর উদ্বেগ নিয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়'। সাতখানি ঘুম আমাকে ঘিরে থাকে...
মন্তব্য