লিখেছেন: আবু জাফর সৈকত
বাংলাদেশে (ঢাকায়) সরকারি আনুকূল্যে ‘ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস এন্ড ক্রাফট’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে। মূলত এটাই ছিল বাংলাদেশে শিল্প শিক্ষার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত।এমনটা ঘটার কারণও বহুবিধ। প্রাচীনকাল থেকে পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং প্রয়োজনীয় শিল্পায়ন না ঘটায় গ্রামীন চরিত্রই বর্তমান ছিল। স্থানীয়ভাবে তাই নাগরিক বুদ্ধিজীবী সমাজের বিকাশ এখানে ঘটেনি। মুঘল আমলে বাংলাদেশ ছিল মূলত শস্য ভান্ডার। এখান থেকে তারা কর ও নজরানা পেলেই খুশি থাকতেন। প্রাদেশিক রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও শিল্পপ্রেমী মুঘল শাসক শ্রেণী শিল্প চর্চার কোনো কেন্দ্র এখানে গড়ে তোলেনি। পূর্ববঙ্গের বৈরী প্রকৃতি এবং সুবেদারগণের অধিকাংশ সময় যুদ্ধ বিগ্রহে লেগে থাকতে হতো বলে সম্ভবত এ ব্যাপারে তারা বিশেষ নজর দিতে পারেনি।
তবে ঢাকায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু শিল্পকলার চর্চা হয়েছে যার নিদর্শন জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সেসময় ঢাকাকে বিষয় করে বিদেশী অনেক শিল্পীই ছবি একেছেন যদিও তা ছিল মূলত ডক্যুমেন্টেশন। ঢাকায় আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে শিল্পীররা জড়িত ছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন- জয়নুল আবেদীন, শফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান। প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক হিসেবে আরো ছিলেন- শিল্পী সৈয়দ আলী আহসান, শেখ আনোয়ার, হাবীবুর রহমান প্রমুখ।
আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক রাজনৈতিক গতিধারা যেমন বর্তমান তেমনি চরিত্র নির্মাণে পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষণ পদ্ধতি ও সমকালীন শিল্প চেতনা সক্রিয় ছিল। প্রাচীন কাল থেকেই শিল্প শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল মূলত কারিগর তৈরী। ইংরেজ আমলের শিল্পচর্চাও ছিল প্রশাসনিক কাজ কর্মকে সহজ করার নিমিত্ত। সময়টা ছিল শিল্প বিপ্লবের; যন্ত্রের নকশা, জ্যামিতিক অঙ্কন, জরিপ সংক্রান্ত অঙ্কন, স্থাপত্য, আসবাব ইত্যাদির পরিকল্পনা, অনুকৃতি, মডেল বা আদর্শ তৈরী, ছাপার জন্যে ধাতু বা কাঠের ফলকে খোদাই, লিথোগ্রাফ ছাপার জন্যে অঙ্কন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের বিদ্যা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বস্তুত অন্ন সংস্থানের নিশ্চিত উপায় হিসেবেই সে সময় শিল্প শিক্ষা করা হতো এবং অতিরিক্ত কিছুই ছিল না। উপনিবেশিক আমলেও এর ব্যাতিক্রম ছিল না। এ শিক্ষা পদ্ধতিতে তাত্ত্বিক বিষয় সবসময়ই উপেক্ষিত ছিল। কিন্তু একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, তত্ত্বগত জ্ঞান না থাকলে কারিগর দক্ষতা দিয়ে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায় না।
জয়নুর আবেদীন, শফিউদ্দীন আহমেদ, কামরুল হাসান প্রমুখ শিল্পীরা। ঔপনিবেশিক ভারতে সৃজনবিমুখ ঐ আবদ্ধ পরিবেশেই শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের সেই শিল্প ঐতিহ্য তো তারা এখানে বহন করে এনেছিলেন তাই পরোক্ষ একটা ছায়া সবসময়ই ছিল। এর মাঝেও আরো অনেক প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে ১৯৪৮ এর শেষ লগ্নে আর্ট কলেজে ক্লাশ শুরু হয়। সিলেবাস ছিল: ড্রইং, স্কেচ, জলরং, কাঠ খোদাই এবং ব্যবহারিক শিল্প। ভাস্কর্য এবং কোন রকম তাত্ত্বিক বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে অল্প কালের মধ্যে সিলেবাসের আমুল পরিবর্তন হয় আর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন-এর লন্ডনের বিখ্যাত স্লেড স্কুল অব আর্ট-এ এক বছরের (১৯৫১-১৯৫২) শিল্পচর্চা ও ইউরোপের বিভিন্ন শিল্প কেন্দ্রসমূহ ভ্রমণ ও তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও শিল্পীদের সাথে ভাব বিনিময়ের অভিজ্ঞতা। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল (১৯৫৬) ইউরোপে শিল্পে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান, ও নভেরা আহমেদ। এর পরেই আসেন আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, রশীদ চৌধুরী, মর্তুজা বশীর ও সফিউদ্দিন আহমেদ।
ইতমধ্যে আর্ট কলেজটি নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৩ সালে পূর্ণাঙ্গ কলেজে রূপান্তর হওয়ার পর তাত্ত্বিক বিষয় যোগ হয়। বিষযগুলো হলো- সাধারণ ইংরেজি, সভ্যতার ইতিহাস, শিল্পের ইতিহাস এববং সমাজতত্ত্ব। নতুন করে আরো দুইটি বিভাগ চালু করা হয়।
ঢাকার আদিবাসীরা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকার মানুষ যেন দুই জগতের বাসিন্দা। দক্ষিণের প্রতাপ তখনো প্রবল। ভাষা ছিল উর্দু ও বাংলা মিশ্রিত শঙ্কর প্রকৃতির। এই সময় আর্ট কলেজের ছাত্রদের পুরনো ঢাকায় প্রবেশ ছিল জীবন বিপন্ন হওয়ার সামিল। আর্ট কলেজ ও এর শিল্পী এবং সাধারণ মানুষের মাঝে যে মানসিক ব্যবধান গড়ে উঠেছিল আজ এতকাল পরেও এর অবসান ঘটেনি। পরবর্তীতে কলেজটি নবাবপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সরিয়ে আনা হয়। প্রকৃতপক্ষে এরপর থেকে ঢাকা আর্ট কলেজ ঘিরে ধীরে ধীরে একটি শৈল্পিক পরিবেশ গড়ে উঠতে থাকে। সমাবেশ ঘটে প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিক, সঙ্গীত শিল্পী ও অন্যান্য শিল্পানুরাগীদের এবং এদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে শিল্পীদের প্রথম গ্রুপ ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’। গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯৫১ সালের ৬ই জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লিটন হলে। যদিও অংশগ্রহনকারী শিল্পীরা ছিল তখনো ছাত্র। চিত্রগুলো সেই সময়ে সংবাদে তেমন আলোচনায় না এলেও এই প্রদর্শনী ছিল নতুন একটি সময়ের যাত্রা।
একটা বিষয় আলোচনায় আনতেই হয়- ঢাকা আর্ট গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনী যখন অনুষ্ঠিত হয় তখন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে উঠছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতির এই সংকটকলীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি শিল্পীরা তাঁদের বক্তব্য ও শিল্পকর্মে একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থা গ্রহন করেছিল। ১৯৫২ সালের ১১ই মার্চ অনুষ্ঠিত ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় প্রদর্শনী এবং ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা আর্ট কলেজের প্রথম বার্ষিক প্রদর্শনী উপলক্ষে সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পুস্তিকার কোথাও জাতীয় সংকটের সামান্য লক্ষণ দৃষ্টি গোচর হয়নি। ভাষা আন্দোলনের শৈল্পিক প্রতিক্রিয়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বাইরে খুব একটা দেখা যায়নি। পাকিস্তান পর্বে চিত্রশিল্পের বিষয় বা বক্তব্য ছিল প্রধানত অরাজনৈতিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ। এর কারণ স্পষ্টতই সরকারি অর্থনৈতিক সহায়তা কমে যাওয়ার ভয় এবং নিয়ন্ত্রণ।
’৬৫ পরবর্তী ৬ দফা দাবি ও ৬৯ এর গন আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ‘জয়নুল আবেদীনের ‘নবান্ন’ চিত্র প্রদর্শনী ও ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ শ্লোগানের সমধর্মী সাহসী শিল্পকর্ম ৬৪ ফুট দীর্ঘ স্ক্রল কিংবা ৭০ এর উপকূলীয় ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রভাবিত ৩০ ফুট দীর্ঘ স্ক্রলটিকে রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে বিশ্লেষণ করা যায়, মানবিক তো অবশ্যই। একইভাবে বলতে পারি ‘৪৩-এর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা’র কথা।
চিত্রকলার আঙ্গিক, বক্তব্য ও মাধ্যম বিবেচনায় মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য ঐ সময়ের ছবিতে খুঁজে পাই-
- লোকজ ঐতিহ্য নির্ভর আধুনিকতা
- জীবন ও নিসর্গ নির্ভর সম-বাস্তববাদী ও পরাবাস্তববাদী
- ইউরোপীয় সমকালীন আধুনিক বিভিন্ন ইজম
- বিশুদ্ধ বিমূর্ত আঙ্গিক
সূচনালগ্ন সময় হিসেব করলে চারুকলা প্রতিষ্ঠানের যাত্রার পথটা প্রতিকূলই ছিল। সঙ্গত কারণেই প্রচলিত সমাজের সাথে যুদ্ধ করে করে শিল্প যোদ্ধাদের শক্তি অনেকটাই ফুরিয়ে গিয়েছিল যা ফিরে আসতে আসতে অনেকটা সময় লেগেছে। একজন সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে নিজস্ব শিল্পভাবনা তথা শৈল্পিক-ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য নির্মাণের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন ঐ সময়ের শিল্পীরা। কারণ তারা অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং প্রতিযোগিতার খোলা বাজারে পৃষ্ঠপোষকের কাছে গ্রহণীয় শিল্পী শৈলী নির্মাণের উপর শিল্পীদের শৈল্পিক ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভরশীল। তথাপি এই সময়ের শিল্পীদের অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও জাতীয় সংকটে চঞ্চল উপস্থিতি নগণ্যই।
মন্তব্য