.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

উৎপলকুমার বসুর কবিতা: অন্য কন্ঠ অন্য স্ফুলিঙ্গের বহমান চিতাগ্নি

উৎপল কুমার বসুর কবিতা: অন্য কন্ঠ অন্য স্ফুলিঙ্গের বহমান চিতাগ্নি
লিখেছেন: রাফা ইসলাম আলমগীর

বালুকাবেলায় যখন আমরা হেঁটে যাই তখন পূর্ববর্তী পদচ্ছাপ নিরাকৃত হয় শুধু পরবর্তী পদচ্ছাপ মুদ্রিত হওয়ার জন্য রােলা বার্তের এই দর্শনকে শুষে নিয়ে যেন বেড়ে উঠেছে কবি উৎপলকুমার বসুর কবিতা সম্ভার। উৎপলকুমার বসুর কবিতাজগৎ এমন এক লুকোচুরির আদিগন্ত বিস্তৃত সীমাহীন কান্তারভূমি যেখানে কবিতায় উপস্থাপিত চিহ্নায়ক যে তাৎপর্য বয়ে আনে, পরবর্তী চিহ্নায়নকে সেই তাৎপর্যের আলােকস্নাত সৈকতভূমিকে ভেঙে দিয়ে জেগে ওঠে নতুন তাৎপর্যের সম্ভাবনাময় উপকূলরেখা। টুকরাে থেকে সমগ্রে আর সমগ্র হতে অসংখ্য টুকরােয় ভেঙে যেতে যেতে গড়ে ওঠে কবিতার এক নূতন ভূখণ্ড। 

উৎপলকুমার বসুর প্রথম প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ প্রকাশিত হয় ফাল্গুন ১৩৬৮তে। পঞ্চাশের দশকের তৃতীয় ধারা যাকে অ্যান্টি পেয়েট্রির ধারাও বলা যায়, উৎপলকুমার বসুর কবিতায় এ ধারার কিছু প্রকাশ অনেকে লক্ষ করেছেন। কিন্তু ঐ দশকে যে প্রকরণবাদী ভাবনার তীব্রতা লক্ষ করা গেছে কবিতায়, উৎপলকুমার বসু যে সে-পথ হতে এক স্বতন্ত্র পথে অভিসারী, তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’তেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। অনুভূতির নিবিড়তায় এই কাব্যগ্রন্থেই কবি স্পর্শ করতে পেরেছেন পাঠকের অতলান্ত সংবেদনা। প্রকরণ আর আঙ্গিকের নিয়ত দ্বিরালাপিক গ্রন্থনায় অ্যান্টি পােয়েট্রির ধারাস্নাত সময়ের অধিবাসী হয়েও নিজের জন্য কবি গড়ে নিলেন এক সময়াতীত পরিসর। 

কোনাে কোনাে রথ 
একা যায় ভ্রান্ত পথে-অন্ধকারে চালকবিহীন 

এই চালকবিহীন রথচক্রের নিঃসঙ্গ অভিপ্রয়াশ যেন তার ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিমায় প্রবেশের চাবিকাঠির অনন্য চিহ্নায়ক। এই চালকবিহীন রথচক্র চিহ্নায়কের মর্যাদা অর্জন করে নেয় যখন নিবিড় পাঠে তাঁর কবিতার স্বতশ্চল লিখনভঙ্গিমাকে চিনে নিতে পারি। 

যেখানে সুদীর্ঘ রাত ওড়ে নীল গন্ধের রুমালে। 
যেখানে জলের মতাে পরিসর, অফুরন্ত বায়ু 
ধুয়ে দেয় বনস্থলী, বালুতট দীর্ণ হাহাকার 

‘নীল গন্ধের রুমালে’ বাক্যাংশ যেন আমাদের জীবনানন্দীয় অনুষঙ্গে স্মৃতিতাড়িত করে। নীল গন্ধ শব্দে দৃশ্যগত অনুভূতি আর ঘ্রাণের অনুভূতির স্থান বদলে বিশেষ্য আর বিশেষণের যে বিপৰ্যাস তৈরি হয়েছে, কবিতায় এই ব্যাকরণ-অতিযায়ী শিল্প-শৈলীতে আমাদের সর্বাগ্রে জীবনানন্দের কথাই মনে পড়ে। কিন্তু উপস্থাপনার প্রক্রিয়া আমাদের চিনিয়ে দেয় উৎপলের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। সঙ্গে সঙ্গে উৎপলকুমার বসুর কাব্যভাষার আধুনিকোত্তর বয়নকেও চিনে নিই।

কীভাবে জীবনানন্দীয় প্রয়ােগরীতিকে অন্তর্বয়ন হিসেবে ব্যবহার করে জাগিয়ে তােলেন তিনি এক স্বতন্ত্র স্ফুলিঙ্গের বহমান চিতাগ্নি, সেই সত্যও উপলব্ধিতে তরঙ্গ তােলে ধীরে। কবিতাটির অন্তিম পঙক্তি ‘প্রতিটি বৃষ্টির পর ছিন্ন হও তুমি, ভালােবাসা।’ ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমে ফিরে আসার মতাে কবিতার পঙক্তির মূল কেন্দ্রীয় আকল্পে ফিরে আসা এতদিন আমরা লক্ষ করেছি; কিন্তু এখানে ধ্রুপদী রীতিও বিনির্মিত হলাে এক বিপ্রতীপতার অন্তর্ঘাতে। কবিতা শুরু হয়েছিল, ‘এখন বৃষ্টির পর আমি পাবাে’— দিয়ে। সাংকেতিক বৃষ্টির পর ভালােবাসার প্রাপ্তিতে যে কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই সাংকেতিক বৃষ্টির পরই ভালােবাসার ছিন্ন হওয়ার বার্তায় কবিতাকে বেঁধে দিলেন বিপ্রতীপতার এক মুক্ত শৃঙ্খলে। অর্থাৎ নিজের উপস্থাপিত ভাবশৈলীকে স্বেচ্ছায় ভেঙে দিয়ে এভাবেই কবি উৎপলকুমার বসু ক্রমশ এগিয়ে যান পুনর্নির্মাণের তরঙ্গবিক্ষুব্ধ স্রোতধারায়। পল হুভার সম্পাদিত পােষ্টমডার্ন আমেরিকান পােয়েট্রির ভূমিকায় পোষ্টমডার্ন কবিতার যে বৈশিষ্ট্যগুলির কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে 'Deconstruction of expression' অর্থাৎ অভিব্যক্তির বিনির্মাণ একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। কবি উৎপলকুমার বসুর কবিতায় লব্ধ এই উপস্থাপিতের বিনির্মাণ তার কবিতার আধুনিকোওর বয়নকে চিনিয়ে দিয়ে যায়। প্রাকৃত হাতছানির অমােঘতায় ‘চৈত্রে রচিত কবিতা যেন হয়ে উঠেছে মানবতার এক সান্দ্র পটভূমি। গত পূর্ণিমায়' কবিতায় কবি যখন বলেন:

জ্যোৎস্না এখানে নেই। তাকে কাল হাই ইস্কুলের পােড় বারান্দার পাশে রেখে গেছে। সে তার পুরনাে আধােনীল শাড়িটি বিছিয়ে ঐখানে শুয়েছিল।

প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ কীভাবে সমস্ত প্রচলিত ধারণাকে উল্টে দিয়ে পরাবাস্তুর ছোঁয়ায় কবিতা জুড়ে এক মগ্নচৈতন্যের মায়া বিস্তার করেছে, সে-দিকটি যদি লক্ষ করি তবে ধ্রুপদী কবিতার ধারা থেকে উৎপল বসুর কবিতার স্বতন্ত্র পরিসরটুকুও চিহ্নিত হয়ে যায় ঠিক নিসর্গ চেতনার কবি না হয়েও কীভাবে একজন আধুনিকোত্তর কবি প্রকৃতিকে তার মেধা আর সংবেদনার দ্বিরালাপিক মন্থনে গ্রহণ করেন, চৈত্রে রচিত কবিতা' যেন তারই নিদর্শন।

১৯৬৪ সনে প্রকাশিত উৎপল কুমার বসুর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পুরী সিরিজ'। সামালােচকদের মতে এখানে উৎপলকুমার বসুর ব্যক্তিচেতনা অমােঘ শক্তিতে পাঠককে বিদ্ধ করে। কিন্তু ব্যক্তিসত্তা এখানে ছুঁয়ে চলেছে অপরসত্তাদের অনুপস্থিত সত্তাটিকে যার সঙ্গে ‘জড়িয়ে আছে সেই সত্য যে ব্যক্তিগত নিশ্চেতনার মধ্যেও কোথাও না কোথাও একটা যৌথ নিশ্চেতনার দ্বিবাচনিকতা সক্রিয় থাকে। এই পুরী সিরিজ' কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ কবিতাটি যেন একটি আকরত্তের প্রবেশবিন্দু। প্রথম কাব্যগ্রন্থ হতে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে বিবর্তনের সূক্ষ্ম পথরেখাটি স্পষ্ট হয়ে যায় সমালােচকের মন্তব্যে এই কবিতার পাঠ যখন সমাপ্ত হয়, আমরা বুঝে নিই, যৌক্তিক কুবিন্যাসের প্রকাশ্যতায় পাঠকৃতি গড়ে ওঠেনি, চিহ্নায়িত পরাভাষায় অনুবের পরম্পরাকেই যুক্তির বদলে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বস্তুত উৎপলের কবি যত পরিণত হয়েছে, এই প্রবণতা ক্রমশ সূক্ষ্ম ও শানিত হয়ে উঠেছে। কবিজীবনের সূচনা-পর্বে বিবরণের আড়াল থেকে পরা-বিবরণকে আবিষ্কার রাই তার প্রধান অন্বিষ্ট ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে চিহ্নায়কের গ্রন্থনায় বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন বলে উৎপল সরাসরি পরাবাচনেই আশ্রয় করেছেন, বিবরণের আড়াল কিংবা প্রাথমিক আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।”
উৎসর্গ কবিতা পুনঃপাঠ করা যাক, 

হস্তচালিত প্রাণ তত সেই আধােজাগ্রত মেশিন 
আমাদের হুর রে 
‘বসন্তের এনেছি আমি হাবা যুবকের হাসি' 
ছিল ভালোবাসা 
ছিল অনিশ্চিত রেলড়াক ছিল মেঘের তর্জন 

কবিতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া যে ততদিনে ক্রম অগ্রসরমান, এই উৎসর্গ কবিতার চিহ্নায়কের গ্রন্থনায় দ্যোতিত ভাষাতীত ব্যঞ্জনা তারই সূর্যস্নাত স্মারক।

‘বসন্তে এনেছি আমি হাবা যুবকের হাসি' পরিচিত শব্দকে কেমন করে অপিরিচিত ভাষায় রূপান্তরিত করতে হয়, সেই সত্য যেন তার চিরকরায়ত্ত। ‘বসন্ত' এবং ‘সেলাই মেশিন’ শব্দদুটি যুগপৎ যেন এক কাব্যিক মূর্ছনা তৈরি করেছে গােটা কবিতা জুড়ে। 'বসন্তে হাবা যুবকের হাসি' বাক্যাংশ অপরিচিতির লাবণ্যে এক রােম্যান্টিক আবহ যেন তৈরি করেছে। কিন্তু কবি উৎপলকুমার বসুকে মােটেই রােম্যান্টিক কবি বলা যায় না। এবং তার কবিতার কোথাও কোথাও যে রােম্যান্টিক সুর বেজে ওঠে, তা অন্য রােম্যান্টিক কবিতার মতাে নয়। এর মাত্রাগত একটা তফাত আছে। রােম্যান্টিক কাব্যের ভাষাকে স্বীকরণের মাধ্যমে সেই ভাষাকে তিনি বিনির্মাণ করে নেন পরাভাষায় রূপান্তরের মধ্যে। পুরী সিরিজ পর্যায়ে সুরের মূর্ধনায় যে সাংগীতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে, সেই শব্দের স্বরলিপিতে অবগ্রহের মতাে ছেদ আর ধারাবাহিকতার দ্বিবাচনিকতাকে রক্ষা করেছে উৎসর্গ কবিতার বারবার আছড়ে পড়া শব্দ ‘হুর রে'। চিতচোর মনচোর জলে যেতে সই পারবােনা লাে তখনই তােমার চিঠি এল পেলাম অনিশ্চিত ডাক লােম উপহার সেবার জন্মদিনে রিবনে বাঁধা রবীন্দ্রনাথ পড়িনি এখনাে সময় কোথায় বাবা ‘পড়িনি এখনাে সময় কোথায় বাবা বাক্যাংশ যেন এলােমেলাে আঙ্গিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই উপস্থাপিত এলােমেলাে আপাত-শিথিল উচ্চারণ। রবীন্দ্রনাথ, যিনি বাঙালির কাছে শুধু কবিমাত্রই নন, এক সাংস্কৃতিক চিহ্নায়কের মর্যাদা অর্জন করে নিয়েছেন এই সময় কোথায় বাবা' উচ্চারণে যেন কবি উৎপল কুমার বসু চিরপূজ্য এই সাংস্কৃতিক চিহ্নায়কেরও বিনির্মাণ করলেন ব্যক্তিগত লিখন-ভঙ্গিমাকে বাদাম পাহাড়ে হারানাের অমােঘ আকর্ষণে। এক বিচূর্ণিত সত্তার অভিব্যক্তি যেন স্বপ্নময় হয়ে ওঠে এর পরবর্তী শূন্যায়তনে। পরবর্তী পঙক্তিতে কবি যখন লেখেন ‘আজ গন্ধক মেশানাে জলে স্নান করে জেলঘুঘুদের আত্মা’ এখানে কবির সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও যেন এসে দাঁড়ান অধিবাস্তবের সাধিত জ্যোৎস্নায় । কিন্তু পরবর্তী শূন্যায়তনের পরে যখন লেখেন-

আর কি চাইতে পারাে কলকাতায় তাঁতকল ছাড়া।
তুমি চেয়েছ কবিতা 

আর কি চাইতে পার কলকাতায় বাক্যাংশের উপস্থাপনায় অধিবাস্তবের সঙ্গে বাস্তব যেন মিশে গেল এক দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়ায়। গােটা কবিতা জুড়ে বারবার শুধু বাস্তব আর অধিবাস্তবে যাওয়া আসার খেলায় কবিতাটি যেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অন্য ক্রিয়ার জন্ম দিল। কবিতায় আপাত-অসংলগ্ন বাকবিন্যাসকে যদিও প্রথম পাঠে অসংলগ্ন মনে হয় তবুও নিবিড় পাঠে যখন কবিতার আকরণণাত্তর বহুমুখি বিন্যাস আর প্রবেশ-নির্গম বিন্দুকে চিনে নিই তখন কবিতার অন্তর্লীন যৌক্তিক পারম্পর্য চেতনায় অভিঘাত করে যায়। তেমনই তরঙ্গ তােলে এই কাব্যগ্রন্থেরই- ৪ সংখ্যক কবিতার কিছু উচ্চারণ।

এ সব সমুদ্রতীর বারবার ব্যবহৃত হয়ে গেছে, লক্ষ্য করাে বাক্যাংশকে যেন বিনির্মাণ করে নিলেন নবম পঙক্তির ‘পাটিগণিতের পাতা ছিড়ে খায় উই’ বাক্যাংশ দিয়ে। পাটিগণিত যেন সব শৃঙ্খলা আর প্রচলিত অভ্যাসের, প্রচলিত বিধিবিন্যাসের চিহ্নায়ক। পাটিগণিতের ছেড়ার উল্লেখে সকল আকরণ আর প্রচলিত কাঠামােকে ভেঙে দেওয়া সংকেতিত। ছবির মতাে, সঙ্গীতের স্বরলিপির মতাে একের পর এক শব্দ আর নব্য চিত্রকল্প সাজিয়েছেন এবং কীভাবে বহুমুখি উপকরণ এসে একজায়গায় Juxtaposed' হয়ে যাচ্ছে তা অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনায় নিষ্ণাত পাঠকের চেতনায় ধরা পড়ে। পুরীসিরিজে’রই সম্প্রসারণ আবার পুরী সিরিজ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সনে। আবার পুরী সিরিজ’-এর কবিতাগুলিতে উৎপলের বাচনবিশ্বের সঞ্চালক চিহ্নায়ন প্রকরণ ব্যাপকতর ও গভীরতর হয়েছে। পাঠকৃতির আকরণােত্তর প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে আরাে। এবারও কবিতা দিয়ে রচিত হয়েছে উৎসর্গ। চৈত্রে রচিত কবিতা'র কেবল পাতার শব্দে’ নামক বয়ানটি সামান্য পরিমার্জনা সহ ব্যবহৃত হয়েছে এইজন্যে। রূপান্তর বা পাঠান্তর অনুশীলন করে বুঝি, স্বরন্যাসে সূক্ষ্ম পরিবর্তন তাৎপর্যের বিস্তারে উৎকর্ষ এনে দিতে পারে।
এই কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ কবিতায়

কেবল পাতার শব্দে আমি কাল জেগেছি সন্ত্রাসে।
ভেবেছি সমস্ত দিন এত লেখা, এত প্রশ্ন, এ-কথন
তারও পিছে কোটি কোটি চিহ্ন তীর শমাের শিখরে
উঠেছে চাষের গান, স্বপ্নে দেখা মায়ের মতন

কবিতাটি পাঠে আমরা বুঝি রোঁলা বার্ত কেন পাঠকৃতিকে 'a galaxy of signifiers এর সঙ্গে উপমিত করেছেন। স্বপ্নে দেখা মায়ে’র উল্লেখে যেন উৎসের ইঙ্গিত প্রতিচ্ছন্ন। এ প্রহর বাজে না চকিতে কেবলই বুকের তলে ক্ষয়ে যায় অজ্ঞান, অলক্ষ্য যাত্রায়, হলুদ পাতার ঝড়ে, নেমে আসা বাৎসরিক শীতে “কেবলই বুকের তলে ক্ষয়ে যায় অজ্ঞান বাক্যাংশের কাব্যিকতা একাধারে আমাদের যেমন স্পর্শ করে ঠিক তেমনি ‘অলক্ষ্য যাত্রা'র ইঙ্গিতে এক অনিরুদ্ধ সম্ভাবনার চিহ্নায়ক যেন চিহ্নায়িতের সব আকরণকে ভেঙে দেয় অবলীলায়। ‘নীলকুঠি কবিতার সমবায়ী উচ্চারণ যেন এই সত্যের নির্যাসে স্বপ্নস্নাত। তােমার সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত রমণীয় আলােছায়াময় টানা দিনগুলি গােল বারান্দার দিকে চেয়ে থেকে চোখে জল আসে স্মৃতিকাতরতার ছদ্মবেশে কবি পাঠকসত্তাকে এভাবেই মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। সকালে পায়ের কাছে অ্যাসিডের মত তীব্র রােদ এসে নামত ‘অ্যাসিডের মতাে তীব্র রােদ’ এর উপমায় কবি কাব্যিক পরিসরের কাঠামােকে অকস্মাৎ বিনির্মাণ করলেন। এর পরে বাতাসে নরম মাংস পােড়ার গন্ধ যেন সব পূর্বাগত ধারণাকে পাল্টে দিয়ে এক নতুন চিহ্নায়িতে পৌঁছানাের যাত্রাপথকে অভিষিক্ত করল। এভাবে উৎপলকুমার বসুর কবিতাপাঠে পাঠকসত্তাও যেন বারবার পুনর্নির্মিত হয়। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত লােচনদাস কারিগর’ উৎপল বসুর বাঁক-ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছে। বিদেশ থেকে ফিরে দেশিয় সবকিছুকে যেন নতুনভাবে দেখছেন। 

১৯৮৬ সনে প্রকাশিত হয় ‘খণ্ড বৈচিত্র্যের দিন' কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গে কবি লিখেছেন ‘আমি জলের ভিতর ডুব দিয়ে যে-সব মাছগুলিকে দেখতে পাই তাদের নাম জানি না কিন্তু জানি তুমি বহুদিন দেশ ছেড়ে চলে গেছ জলের উপর ঝরছে পাতা— তার উপর ভাসছে মাছ— তার উপর উড়ছে নিশান নিঃসঙ্গতায় এবং তােমার অনুপস্থিতির সুযােগে আধুনিকোত্তর চিহ্নতত্ত্বে চিহ্নায়কের যে অন্তহীন ক্রীড়ার উল্লেখ রয়েছে, ‘খণ্ডবৈচিত্র্যের দিন’ কাব্যগ্রন্থে সেই চিহ্নায়কের অন্তহীন ক্রীড়া যেন সদাউচ্ছল। উৎসর্গ কবিতার ‘জলের উপর ঝরছে পাতা-তার উপর ভাসছে মাছ- তার উপর উড়ছে নিশান'। একটি চিহ্নায়ক যেন পরবর্তী চিহ্নায়ককে তৈরি করছে। মাতা বিন্ধ্যাচলগামী’ কবিতাতে বিপ্রতীপতার আয়ােজনে যেন বিপ্রতীপ সময়ের চিহ্নায়িতকে কবি একটি আধারে ধরে রাখতে চাইছেন। ঘূর্ণিমান, লাফ দেওয়া, ভেসে যাওয়া পুরুষের মতাে। চরাচরে যাকে স্থির মনে হয়, যাকে খোড়াও অন্ধ বলে উপহাস করা চলে যে পারে না উড়ে যেতে, দৌড়ে যেতে, ভেসে যেতে শূন্যের ভিতরে অথচ সে ভাসমানতায় ভরা, লাফের আহ্লাদ আর ঘূর্ণির চোরাটান সে নিজেই- তবু তাকে পর্যুদস্ত হতে হয় পাশাপশি বিপ্রতীপ ভাবনার সংস্থাপনে যে 'Binary reversal' বা দ্বিরাবর্তন সংগঠিত তাতে কবিতায় স্থিতিস্থাপকতার ছন্দ নিরবচ্ছিন্ন সৌন্দর্যে ভাষার এবং ভাবনার বহমানতাকে করে তুলেছে অনিবার্য।

১৯৯৫ সনে প্রকাশিত হয় ‘সলমা জরির কাজ’ কাব্যগ্রন্থটি। বলতে দ্বিধা নেই যে, এটা এমনি একটা text যার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘভ্রমণ ও নৈকট্য লাভের আকাঙ্ক্ষা। পাঠ ও পরা-পাঠের সাথে এর রয়েছে গভীর সম্পর্ক! যার পঠন সহজ কিন্তু গূঢ়ার্থ চেনা সহজ নয়। বার-বারই তাকে পড়তে হয়। মিডলক্লাস ও তার মূল্যবােধ সম্পর্কে জানতে হয়। এই Textকে মনে হয় অথর ও রিডারের মধ্যে সেতু সংযােগকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সংযােগকারীর ভ্রমণও তখন তাৎপর্যময় হয়ে উঠে ‘সলমা জরির কাজ’ কাব্যগ্রন্থে যে অনির্দেশ্য ভ্রমণের সংকেত দ্যোতিত সেই সংকেত আমাদের আবার রােলা বার্তের জীবনদর্শনকে মনে করিয়ে দেয়। রােলাঁ বার্ত আজীবন গন্তব্যের চেয়ে যাত্রার ছন্দকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এই কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ-পত্র : আমাকে নাচতে দাও, ওগাে ওই পাথরটুকুর ওপরে ঘূর্ণিপাকের মত জায়গা ছেড়ে এই উৎসর্গপত্রে কবিতার প্রচলিত কাঠামাে ভেঙে এক নতুন আঙ্গিক উপহার দিলেন কবি। গদ্য আর পদ্যের আঙ্গিকগত ব্যবধান যেন কবি লহমায় ঘুচিয়ে দিতে চাইলেন এখানে। কিন্তু আগাগােড়া এক স্বপ্নময় অভিপ্রয়াণের বার্তায় বাস্তবের জীর্ণ, অভ্যাসতাড়িত কাঠামােয় যেন কবি অন্তর্ঘাত করলেন কৌশলে। এই অন্তর্ঘাত প্রবণতা যেন উঠে আসছে ‘Text' এর অতলান্ত গভীর হতে। গদ্য আর পদ্য যেন একে অন্যকে বিদ্ধ করছে। '২' সংখ্যক কবিতায়,

বাঘের আঘ্রাণ
সক্তি ও ভাতে
জ্বালানী আঘাতে
শিখা লেলিহান

পরপর সাজানাে নানা উৎসজাত রূপকচূর্ণ দিয়ে কীভাবে খুলে যায় চিহ্নায়কে প্রবেশের বহুমুখি গবাক্ষদ্বার, ‘সলমা জরির কাজ’ কাব্যগ্রন্থে কবি যেন সে সত্যের সহস্র কোরক মেলে ধরলেন। এই কৃৎকৌশল আসলে নিরবচ্ছিন্ন অন্বেষণের। এই সমাপ্তিবিহীন যাত্রায় যে মুক্তপাঠ। উন্মােচিত হয়েছে, এ যাত্রা তার আজীবনের। এ যাত্রা অন্তহীনতার; এই নিরবচ্ছিন্ন অভিপ্রয়াণে পাঠকও চিরপথিক।

উত্থানসূত্র:
  • কবিতায় রূপান্তর, তপোধীর ভট্টাচার্য, সাহিত্যলোক,কলকাতা, পৃষ্ঠা: ৩১৮,৩২৫
  • লোক, অনিকের শামীম (সম্পা.) আমির খসরু স্বপন (লেখক) ঢাকা, ফেব্রুয়ারি-৪, পৃষ্ঠা:১১৫

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,25,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,298,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,17,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,11,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,13,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,150,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: উৎপলকুমার বসুর কবিতা: অন্য কন্ঠ অন্য স্ফুলিঙ্গের বহমান চিতাগ্নি
উৎপলকুমার বসুর কবিতা: অন্য কন্ঠ অন্য স্ফুলিঙ্গের বহমান চিতাগ্নি
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiW-l_2ZUa6TwZBy17wf32hriakSzB7sfLybUY48yrBDYFYvIxx0adUW46jNuQoHhDtU7tbnZ1CEkMHKQlmKf0Ak0O7xq8MzOATTW2IfUjohdr9e_LQ3XOw9nI7LP9PwPmwEEFgHTISvVE/w640-h320/%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AB%25E0%25A6%25BE-%25E0%25A6%2587%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%2597%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25B0.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiW-l_2ZUa6TwZBy17wf32hriakSzB7sfLybUY48yrBDYFYvIxx0adUW46jNuQoHhDtU7tbnZ1CEkMHKQlmKf0Ak0O7xq8MzOATTW2IfUjohdr9e_LQ3XOw9nI7LP9PwPmwEEFgHTISvVE/s72-w640-c-h320/%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AB%25E0%25A6%25BE-%25E0%25A6%2587%25E0%25A6%25B8%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AE-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%2597%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%25B0.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2020/08/blog-post_7.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2020/08/blog-post_7.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy