লিখেছেন: মিলি স্বপ্নময়ী
গহর আলী। পেশায় মুয়াজ্জিন,বয়স পঞ্চাশ। বাপ-দাদার পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসরণ করে তিনি এ পেশায় নিযুক্ত আছেন প্রায় দেড়যুগ ধরে। অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ তিনি। জীবনে কখনো কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলেছেন তিনি এমনটা কেউ সাধারণত মনে করতে পারেন না, মসজিদ এর সাথে লাগোয়া একটি ঘরে তিনি তার স্ত্রী,পুত্র এবং কন্যা সমেত বসবাস করেন। তার দিন শুরু হয় কাকডাকা ভোরে, অবশ্য বলা যায় তার ও বেশ খানিকটা আগে তার দিন শুরু হয়, চারপাশে যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, আলো এই ফুটবে,ফুটবে অবস্থা, তখুনি তিনি জেগে উঠেন কোনো রকম এলার্ম এর শব্দ ছাড়াই। এটা তার দীর্ঘ বছরের অভ্যাস।তারপর ওযু করে যখন মাইকে সুরেলা কন্ঠে আল্লাহু আকবর বলে ঘুমন্ত সবাইকে জেগে তুলেন,তখনই তো শুরু হয় মোরগের কুকরু কু ডাক, পাখির কিচিরমিচির, আর ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের প্রাত্যহিক ইবাদতের সূচনা! এভাবেই দিন অতিবাহিত হচ্ছিল, এই নিয়মেই তিনি আজ ও ঘুটঘুটে অন্ধকার সময়ে জেগে উঠলেন অন্যদের জাগানোর দায়িত্ব নিয়ে,কিন্তু ঘরের বাইরে বেরিয়ে একি দেখছেন তিনি, অল্পবয়সী এক ছেলে তরতর করে মসজিদ এর দেয়াল বেয়ে মাইকের কাছে উঠে যাচ্ছে। চারদিকে আলো ফুটে উঠার আরো কিছুটা সময় বাকি,অন্ধকারে তিনি ভালোমতো চেহারা দেখতে পাচ্ছেন না, ঘর থেকে টর্চ এনে আলো ফেললেন ছেলেটার মুখ বরাবর। মুখ দেখে তিনি চমকে উঠলেন।এতো পাশের পাড়ার বিষ্ণু বাবুর ছেলে।এইতো সেদিন তার জন্ম হলো। সেদিন মানে ২০-২২ বছর আগেকার কথা আরকি। কিন্তু এত ভোরে সে এখানে কি করছে! কিছুতেই বুঝে উঠতে না পেরে তিনি গলা ছেড়ে ডাক দিলেন, "হ্যাঁ রে বিধু,এখানে কি করছিস বাপ? এই এত ভোরে,অন্ধকারে তুই ওখানে উঠেছিস কেন? নেমে আয় তাড়াতাড়ি।" গহর আলীর কথা শুনেই ছেলেটা নামতে শুরু করলো,কিন্তু অন্ধকারের কারনে তিনি ঠিক এতক্ষন বুঝে উঠতে পারেন নি যে,আরো গণ্ডাখানেক ছেলেপুলে আড়ালে ছিল,কারো কারো হাতে কিসের যেন বোতল, ডিব্বা আরো কিসব। ভালো করে বুঝতে পারছেন না তিনি,সবার মুখে আলো ফেলতেই কিছু অপরিচিত মুখ দেখলেন তিনি,শুধু বিধুটাই তার পরিচিত,এদের তো তিনি চিনতে পারছেন না,তবে সবাই কাছাকাছি বয়সের।কতই বা আর এদের বয়স হবে,এসব যখন ভাবছিলেন তখন বিধু কোথ থেকে যেন তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল,বাকি ছেলেদের খেয়াল করতে গিয়ে সে যে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গেছে, তিনি বুঝতেই পারেন নি,বুঝবেন ই বা কি করে,তার দেড় যুগের মুয়াজ্জিন জীবনে এরকম ঘটনা তো তিনি কখনো দেখেন নি, নিজের গায়ে কেরোসিন এর উৎকট গন্ধে তিনি বেশ ভীত হয়ে পড়লেন, “হ্যাঁ রে বাপ, কি করছিস এসব” বলে উঠার আগেই আগুনের লেলিহান শিখা তাকে গ্রাস করতে লাগলো, তিনি কিছু বলতে চাইলেন,কিন্তু তার বলা কথাগুলো যেন শুধু চিৎকার আর আর্তনাদ হয়েই বেরোতে লাগল।
পাশের ঘরেই তো তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ঘুমন্ত আছে, তাদেরও এখন জেগে উঠার কথা, কিন্তু তিনি দেখলেন যে তার ঘর জ্বলছে,শুধু তার ঘর না, তার ধ্যান, জ্ঞান, কর্ম সবকিছু যেখানে হতো,সেই মসজিদ ও পুড়ছে! অথচ তিনি সারাজীবন প্রশ্নহীন ভাবে বিশ্বাস করে এসেছেন, আল্লাহর ঘর কখনো পুড়েনা! একজন খাঁটি মুসলিম কখনো আগুনে পুড়ে ঝলসে যায়না! কিন্তু এ কি হচ্ছে আজ! তার শরীর জ্বলছে,পুড়ছে।মাংস পোড়ার বিকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে,এতক্ষনে মোরগের কুক্কুড়ু কুও শুরু হয়ে গেছে,মোরগের ডাক ছাপিয়ে মানুষের ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি ছড়িয়ে পড়ছে,এরমধ্যে ও তিনি বহু কষ্টে খেয়াল করলেন ওই পাশের পাড়ার হরি,মীনা মাসি,গৌরব কাকা,সবাই,সবাই যে যার মতো করে জল ছিটাচ্ছে,কান্না করছে,তার স্ত্রী,পুত্র-কন্যাদের ঘরে জল ঢালছে,ওদের বের করতে পারবে কিনা কে জানে,ওরা কি এখনো বেঁচে আছে।বিধুটা কই গেলো? ছেলেগুলো কেও তো আর দেখা যাচ্ছেনা,অথচ পাশের হিন্দু পারার প্রায় সবাই ছুটে এসেছে। এরা সবাই কত পরিচিত মুখ,কত আপন! পূজা-পার্বণে কতবার যে এরা আপ্যায়ন করেছে নাড়ু-মোয়া দিয়ে,ঈদ -রোজাতে এদের সাথে কত সুখ-দুঃখের গল্প আছে,এরাই তো সবচেয়ে বড় আপনজন,কিন্তু বিধুটা এমন করলো কেন!? জীবনের শেষ মুহুর্তে, তীব্র মাংস পোড়া গন্ধ, দগদগে যন্ত্রণা নিয়ে গহর আলী চিৎকার করছেন, সেই চিৎকারের কোনো ভাষা নেই যেন, কিন্তু আকাশ কাঁপিয়ে তিনি যেন জানতে চাচ্ছেন, "তুমি কোথায় খোদা? তোমার ঘর পুড়ছে, পবিত্র গ্রন্থ পুড়ছে, তোমার ঈমানদার বান্দা পুড়ে যাচ্ছে, তুমি কেন আগুন কে পানি বানিয়ে দিচ্ছনা, তুমি কেন তোমার কিতাব রক্ষা করছো না, কেন মানুষ এর মন এর শয়তান দূর করছোনা! তুমি চাইলে সবই পারো! কেন তুমি ঘুমন্ত, কেন তুমি নিশ্চুপ!" "
অতঃপর গহর আলী ঘুমিয়ে পড়লেন,তার নিশ্চয় আর কোনো যন্ত্রণার অনুভূতি থাকবে না।
হরি,গোপাল,গৌরব,সাধন বাবু,মীনা মাসি সবাই হাহাকার করছে গহর আলীর ঘরের পাশে,মসজিদের পাশে।এই ধরনের ঘটনায় তারা বাকরুদ্ধ,কে কিভাবে, কেন কাজটা করলো সবার মনে এই প্রশ্ন।কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তাদের জানা নেই। ততক্ষণে পুড়ে যাওয়া কিতাব, আগুনে ঝলসানো গহর আলীর শরীর, মসজিদ এর ধ্বংসস্তুপ যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে তীব্র বিদ্রুপ করছে আর অট্টহাসিতে আকাশ কে কাঁপিয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে !
মন্তব্য