লিখেছেন: দেবাশীষ ধর
সমকামি প্রেম, ভালবাসা, সম্পর্ক উপজীব্য কাহিনী নির্ভর সিনেমা যত হয়েছে দেখা যায় সেক্সুয়াল অধিকারকে স্বীকৃত দিতে সামাজিক বেড়াজালকে অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে বাস্তবিকতাকে সামনে নিয়ে আনা হয়ে থাকে। বিশ্ব চলচ্চিত্রে এর উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। ২০১৬ সালে রিলিজ হওয়া পরিচালক হানসাল মেহতার ১১৪ মিনিটের আলীগড় সিনেমাটি আমার কাছে একটু ভিন্নধাঁচের মনে হলো। কিছু মুভি আছে হৃদয়ে খুব করে গেঁথে যায় আলীগড় সেইরকম মর্মস্পর্শী সিনেমা যা আমাদেরকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেয়। এটি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভাষাবিদ ,মারাঠি সাহিত্যের অধ্যাপক রামচন্দ্র সিরাসের বায়োপিক থেকে নেয়া কাহিনী নিয়ে নির্মিত।তিনি একজন কবি লেখক হিসেবে পরিচিত। মারাঠি ভাষায় কবিতা লিখতেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটিশ সময়কালীন স্থাপিত ভারতের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। তৎকালীন মুসলিম চিন্তাবিদ স্যার সৈয়দ আহমদ খান সহ আরো অনেক শিক্ষাবিদরা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। যাই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে বলাটা আমার আলোচ্য বিষয় না আমার আলোচনার বিষয় আলীগড় সিনেমা নিয়ে।
অনেকে সিনেমাটি দেখে কেবল সমকামি বিষয়টিকে প্রধান বলে মনে করলেও সিনেমায় এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতির খেলা। গল্পে অধ্যাপক সিরাস আলীগড় শহরে বাস করে আসা দীর্ঘদিন ধরে একাকি, নিঃসঙ্গ একজন। মনোজ বাজপেয়ীর দুর্দান্ত পারফমেন্স সিরাস চরিত্রে, গল্পের ভেতরে ঢুকে যাওয়া নিজেকে একজন সিরাসের কাছে নিয়ে যাওয়া। এটা কেবল সিনেমা নয় যেন একটা কবিতার আয়োজন, কবিতার ভেতরে শান্তি। তরুণ জার্নালিস্ট দিপুর গ্যে’ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে রামচন্দ্র সিরাস বলেন ‘কইয়ি মেরে ফিলিংকো তিন অক্ষসরমে কেসে সামাসসাকতাহে’-যার অর্থ করলে-- ‘কেউ আমার ফিলিংকে তিন অক্ষরেতে কীভাবে বুঝতে পারে?’ এরপর কবিতার বুলিতে ডুবে যায় সিরাস।
সিরাস আসলেই ভীষণ একা শারীরিক মানসিকভাবে,বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শেষে একা একা শহরের পথে হেঁটে বেড়ায়, শহরের মানুষগুলোর জীবনযাপন দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দু একজন শিক্ষক তাঁর বন্ধু হলেও দিন শেষে সিরাস একাই।রাত হলে একা বাসায় বসে লতা মঙ্গেশকরের গান শুনে শুনে মদ্যপান করে নিজেই গান করতে থাকে আর কবিতা লিখে।কারন সে তো কবি, এটাই তাঁর একমাত্র পরিত্রাণ।আলীগড় শহরটা তার খুব আপন হয়ে গেছিল।যদিও বা শহরের মানুষগুলো তাঁকে ওভাবে আপন কারতে পারেনি।
প্রশ্ন এটা নয় যে সে গে’ কিনা, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারী সাহিত্যের অধ্যাপক তথা সমাজে তৃতীয় লিঙ্গধারী ব্যক্তিকে কি জঘন্য অপমান সহ্য করতে হয় এবং এটাকে সবাই প্রশ্রয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত মহল নীরব ভূমিকা পালন করে গেছে। সিনেমায় এটা বেশ প্রকট হয়ে উঠে। কারণ সমকামিতাকে এখনো এই উপমহাদেশে পুরোপুরি সমাজের সব স্তরের মধ্যে একটা কুৎসিত মনোভাবে বিচারিত করলেও কিন্তু গোটা পাশ্চাত্য জুড়ে ইউরোপ আমেরিকা লাতিন আমেরিকায় সমকামি এখন আইনসম্মতভাবে প্রায় স্বীকৃত।এটা অবশ্য এমনে এমনে হয়নি ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় দীর্ঘ সময়কার সমকামিদের আন্দোলন, তাদের আত্মত্যাগ, লেখক চিন্তাবিদ শিল্পীরা এটার পক্ষে দাঁড়িয়েছে বলেই তা সম্ভব হয়েছে।এবং এই আন্দোলনের গতিবেগ আরো বাড়ায় গোটা বিশ্বে সিনেমায় সমকামিদের প্রেম, যৌনতার অধিকারের বিষয়টাকে উঠে আনার মাধ্যমে।
এবার ভারতের কথায় আসি।ভারতেও সংবিধানের আইনেও সমকামিদের অধিকার পেতে কম বেগ পেতে হয়নি।কেউ সমকামি হলে বা সমকামে আচরণ করলে তাঁকে যাবজ্জীবনের মতো কঠিন শাস্তি দেয়া হতো। ২০০৯ সালে দিল্লী হাইকোর্ট সমকামিদের বৈধতা দিল। কিন্তু আবার বিজেপি সরকার ধর্মীয় বিধিনিষেধ দিয়ে সমকামকে অপ্রাকৃতিক যৌন সঙ্গম মনে করতো।এটাকে তারা অপরাধ বলে গণ্য করতো যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে আবার একে অবৈধ ঘোষণা করলে ভারত জুড়ে আবার আন্দোলন শুরু হয় সমকামিদের। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট এটাকে পুনর্বিবেচনা নিয়ে শেষমেশ সমকাম যে বিজ্ঞানসম্মত এই বিবেচনায় করে ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বরে সমকামিতা পুনরায় বৈধতা পায়।
এর আগে সমকামিতার সিনেমাগুলোর মধ্যে ফায়ার (১৯৯৬) সিনেমায় দেখি পারিবারিক সংস্কারের মধ্যে থেকে রাধা আর সীতা প্রতিনিয়ত তারা তাদের কাছের মানুষের কাছ থেকে ভালবাসাহীন কামের পরিত্রাণ থেকে মুক্তি পেতে নতুন করে প্রেমে পড়ে দুজন দুজনের খুব, শারীরিকভাবে মানসিকভাবে তারা মিলিত হয়।এই দু’ চরিত্রে নন্দিতা দাস আর শাবানাজমী দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। সিনেমায় সীতার চরিত্রটি বিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল আর তাতে রাধা যুক্ত হলো একসাথে।সিনেমাটি তখন ভারতে নিষিদ্ধ করেছিল।এরপর আলীগড় আরো কিছু ভিন্নভাবে এসে আমাদের দাড় করাল যখন সমকামিতা সারা বিশ্বে জয়জয়কার। এখানে পরিচালক হানসাল মেহতা খুব দক্ষতার সাথে আইনি বিষয়গুলো সিনেমায় আদালতে স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করেন। সেই সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যদি হোমসেক্সুয়াল করেও থাকে তাহলে তাতে কেন এটাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হবে? যেখানে তখনো পর্যন্ত আদালতে সিরাস পক্ষের উকিল দিল্লী হাইকোর্টের আইনে সমকামিতার বৈধতা কথা বলেন। আর বিপক্ষের উকিল পেশ করেন, ‘আলীগড়ের এই আইন প্রযোজ্য নয় বলে খারিজ করে দেয়’। এই স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে নির্মাতা খুব কৌশলে রাষ্ট্রের সিস্টেম এবং আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
আর চমৎকার অভিনয় করেন রাজকুমার রাও, জার্নালিস্ট দিপুর চরিত্রের জন্য একেবারে পারফেক্ট। সিরাসের এ যাত্রায় আসাটা সম্ভব হয়েছে সিরাসকে নিয়ে দিপুর প্রতিবেদনের মাধ্যমে। সিরাসকে যোগ্য সম্মান দিল দেশের চিন্তাবিদরা।তার পক্ষে সাপোর্ট দিয়ে স্বাক্ষর দিল যার ফলে কেইসটি আদালতে উঠলো। যেখানে ১৭৫ বছরের ঐতিহ্যের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মনে করে সিরাস একজন অপরাধী। তাঁর উপর শারীরিক মানসিক নির্যাতন করা হয়, তাঁকে বিশববিদ্যালয়ের দুর্নামের ভাগী হতে হয় যা লজ্জাজনক।সেটার অভিব্যক্তি দেখা যায় পুরো সিনেমায়।মূল কথা হচ্ছে তারা চেয়েছিলেন সিরাসকে যেভাবে হোক ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়া আর এক্ষেত্রে সিরাসের হোমসেক্সুউয়ালিটিটাই প্রধান ভূমিকা নেয়, তাতে তারা সফলও হয়েছিল।সিরাসকে বরখাস্ত করা হলো। তাঁকে কোয়ার্টার ছেড়ে হোটেলে উঠতে হয়, সেখানেও একা তাঁকে বেশিদিন থাকতে না দিলে ফের আরেক বাসায় গিয়ে উঠে।যদিও বা এর পেছনে যে নগ্ন রাজনীতিও গভীরে কাঠি নাড়ছিল তাও পরিস্কার হয় আরো যখন দিপু সেই রিক্সাওয়ালাকে খুঁজতে গিয়ে গুণ্ডাদের দ্বারা প্রহার এবং বিতাড়িত হয়, যেন কিছু একটাকে চাপা দেয়া হচ্ছে।
সিনেমার বেশ কয়েক জায়গায় যে বিষয়টি আমাকে আরো টেনেছে সিরাসের কবিত্বপনা, আদালতের এক কোণায় বসে বসে সিরাস ওইসব মোকাদ্দমার মধ্যে তার কবিতার বইটির অনুবাদ করে লিখে চলেছেন যা পরে বইটি প্রকাশ হলে দিপুকে উপহার দিয়েছিল। এরপর কবি সাহিত্যকদের আড্ডায় কবিতার শব্দে ছন্দে সিরাস নিজেকে ভাসিয়ে দিল।এইভাবে তাঁর কবিতার শক্তি তাঁকে প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখছে তাঁকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে।ক্যাম্পাসের উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সিরাসের নীরব বিদ্বেষ।
সিনেমায় গল্পের গভীরতাকে আরো চমৎকৃত করে ক্যামেরার কাজ, দৃশ্যে দেখা যায় সিরাস দুপাশে জানালা বন্ধ করে ঠিক সদর দরজাটি বন্ধ করে এর সামনে দরজাটিকে পেছনে রেখে চেয়ারে বসে আলো অন্ধকারের ছায়ায়।এইখানটায় মনে হতে থাকে একটা কবিতার চিত্রকর্ম যেন দেখতে পাই। স্থির ক্যামেরায় প্রতিটি আসবাবপত্র, তাঁর মাথার পেছনে দরজায় ঝুলে থাকা ব্যাগ আর সিরাস চেয়ারে বসে মাথাটা ডানদিকে একটু হেলে স্থির ভঙ্গিমায় দৃষ্টিতে সিরাসের ভেতর এক ধরনের কষ্ট, যন্ত্রণা, আশঙ্কা, ভয়, দুর্বলতা প্রতিটি ধীর ম্যুভমেন্টে যেন হাসনাল মেহতা আড়ালে অনেক কিছ ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন।যেমনটা আপনাদের সিস্টেমকে পেছনে রেখে আমি আমার জায়গায় সঠিক।সিরাস ক্রমাগত লড়াই করে যাচ্ছে এইভাবে।আর এই প্রতিটি দৃশ্যের অবয়বে চালচলন ভঙ্গিমায় অনুভূতিতে বাজপেয়ী তাঁর সেরা কাজটা করেছেন যা গল্পের স্বতঃস্ফূর্তটাকে চরিত্রটি আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে।ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক গল্পের সাথে মিলিয়ে আবহ যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই সাবলীল ছিল।
তবে কেন সিরাস আত্মহত্যা করলো? এই জায়গায় পরিচালক যতটা দেখাতে পেরেছেন মনে হলো কোনরকমে মৃত্যুটাকে বোঝানো হয়েছে দুর্বলভাবে, হয়তো বা গল্পের শেষটা আরেকরকম হতে পারতো।কিন্তু যেহেতু এটা বায়োপিক তাই এই ক্ষেত্রে সিরাসের মৃত্যুটা কি আসলে আত্মহত্যা! কেইস জিতার পর আত্মহত্যার কি কারন থাকতে পারে? এখানে কি নোংরা রাজনীতির খেলা ছিল তা আরেকটু স্পষ্ট করা উচিত ছিল।এখানটায় এড়িয়ে গেছেন বলে মনে হলো কিংবা হয়তো বা অজানা ছিল।এবং এর মধ্য দিয়ে সিনেমা দর্শকের সামনে শেষ হয়ে গেলেও দর্শকের মনের ভেতর এটার স্পীড চলতে থাকে যা হানসাল করতে পেরেছেন। হতাশা, দুঃখ, প্রেম, একাকীত্ব, যৌনতা, বিষণ্ণতা, নীরব বিদ্বেষ, ক্ষমতার দাপট, সফলতা সব কিছু মিলিয়ে সিনেমাটি মাস্টারপিস।
আন্তর্জাতিকভাবে এর অনেক প্রদর্শনী হয়। দশম এশিয়া প্যাসিফিকে মনোজ বাজপেয়ী সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান।
মন্তব্য