সাল ২০০৭। তারিখ ৩০শে ডিসেম্বর। আমাদের উত্তরবঙ্গের মালদা জেলার 'ছুটি' সাহিত্য বাসরের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ও সম্মানিত অতিথি কবি হয়ে এসেছিলেন উৎপলকুমার বসু। আমি তখন কোলকাতায় থাকি। স্বাভাবিকভাবেই নিজের জেলার এত বড় মাপের অনুষ্ঠানের কিছু দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো। কোলকাতা থেকে সেইবার আমাদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন কবি উৎপলকুমার বসু, কবি ও গল্পকার নবারুণ ভট্টাচার্য, কবি অনিক রুদ্র। এদিকে জেলার কথা সাহিত্যের নক্ষত্রপুরুষ অমিত গুপ্ত, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সন্তোষ কুমার চক্রবর্ত্তী। মঞ্চে যেনো হাজার তারার আলোর রোশনাই! এই সমস্ত আয়োজনেরও একটা পূর্ব প্রস্তুতি থাকে। সেই প্রস্তুতিরই একটি প্রাক খসড়া ছিলো নবারুণ ভট্টাচার্য আর উৎপলকুমার বসুকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া যায় মালদহে। যাই হোক, নবারুণ দা'র সাথে পূর্বপরিচয়ের সুত্র ধরে, ওনাকে আনতে খুব বেগ পেতে না হলেও উৎপল বসুকে আনতে রীতিমতো কালঘাম বেড়িয়ে গিয়েছিলো। একে তো আমি তখন তার লেখার সাথে খুব কম পরিচিত। দু’-একটা লিটল ম্যাগাজিন আর দেশ পত্রিকা ছাড়া আর কতটুকুই বা পড়তে পারি সেই সময়ে! কেননা, পড়া মানে তো আজকের সময়ের মতো গুগলে যাওয়া নয়!
সে যাই হউক। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজের আড্ডার সৌজন্যে চলে গেলাম সোজা গোলপার্কের ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেনের ফোর্থ ফ্লোরে। আগে থেকে বলে রাখার সুবাদে কবি নিজেই দরজা খুলে আবাহন করলেন। কতকিছুই ভেবেছিলাম আগে। বিদেশে দীর্ঘদিন ছিলেন তিনি। বড় চাকুরি! হয়তো খুব রাশভারী হবেন। কিম্বা আপাত দৃঢ়তা এতই বেশি হবে যে, এক বলেই আমার, ওনার প্রতি আবেদন হয়তো আউট হয়ে যাবে। এইসবই ছিলো সেদিন আমার ভাবনায়। অত্যন্ত সাদামাটাভাবে সজ্জিত বৈঠকখানায় তখন আমি আর অধ্যাপক বিকাশ রায়। বিকাশই পরিচয় করে দিলো আমার সাথে - উৎপলদা, ইনি শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস। মালদা জেলার কবি হলেও বর্তমানে কোলকাতাতে থাকেন। আমাদের বসতে বলে উনি ভেতরে গিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে ফিরে এলেন। আলাপচারিতায় ধীরেধীরে আমার প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেওয়া বা এরপর থেকে ম্যাণ্ডেভিলার শুক্রবারের আসরে নিয়মিত যোগদান এবং আমৃত্যু কবি'র অপার ও অসম্ভব মেটাফর শব্দবন্ধের দৃঢ়তার সাথে জড়িয়ে যাওয়া, এসব নিয়ে অন্যসময় আলাপচারিতা নিশ্চয়ই করা যাবে! তবে ওই যে বৈঠকখানা ঘর আর মাটিতে থাক করে রাখা ‘সুখ দুঃখের সাথী’ থেকে খপ করে একটি বই তুলে নিয়ে প্রীতি ভাজনীয়া শর্মিষ্ঠাকে - উৎপলকুমার বসু, আজও আমার পড়ার ঘরের বইয়ের তাক থেকে উঁকি মারে মাঝেমধ্যেই।
ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছি-
গিয়েছিলাম মনে মনেমথুরা ভ্রমণেযেন বা উড্ডীন পাখিনিজেকেই ভেবে রাখিঅথচ আসীনআমি কৃষ্ণের অন্তর্গত, যেন জলাশয়ে মীনঅক্ষরে নিবন্ধ কবি।
চমকে উঠেছিলাম গম্ভীর আওয়াজে-- ‘এই নাও চা। আজ বাড়িতে কেউ নেই। তাই এর বেশি আর কিছু...’
আমার দুটো চোখ তখন ওই শেষ মীন অক্ষর থেকে সরাসরি কবির উদ্দেশ্যে - একটি সুগভীর জলাশয়ের কালো'র অন্তর্গত (কৃষ্ণ ) জলের ভেতরে মীন বা মাছ অক্ষর হতে পারে?
কবি বললেন- ‘হ্যাঁ পারে। অসংখ্য মাছ আর অসংখ্য অক্ষরে অক্ষরে সাজানো জীবমণ্ডলে আমরা কৃষ্ণময়।’ বললাম- তাহলে ‘মীন অক্ষর!’ মাঝে হাইফেন নেই কেনো?
কবি উৎপলকুমার বসু বললেন- ‘দেখো, ওই মীন আর অক্ষর এর মাঝে একটি হাইফেনের অভাবে আমি কৃষ্ণের অন্তর্গত, যেন জলাশয়ে মীন -একার্থ বোধক। আর অক্ষরে নিবদ্ধ কবি আর এক অর্থ বোধক।
কবিতা তো পাঠকের জন্য। যে যেভাবে নেয়, কবিতা তেমনভাবেই ধরা দেয় তার কাছে।
ইতিমধ্যে কাঙ্ক্ষিত ৩০শে ডিসেম্বরের অনুষ্ঠান শেষ করে পরের দিন জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র গৌড় ও আদিনা ঘুরিয়ে দিয়ে কোলকাতায় রওনা করিয়ে দিয়ে কয়েকদিন পর আমিও ফিরে গিয়েছিলাম কোলকাতায়। ততদিনে সম্পর্কের সুতোটা আগের চেয়ে মসৃণ হয়েছে। ইতিমধ্যে একদিন ফোন করলেন- কাজ না থাকলে চলে এসো। বললাম- এই তো আপনার ঘরের পাশেই ঢাকুরিয়ায় আমার বাসা। অটোতে চাপলে পাঁচটাকা দরের পাঁচমিনিটের মতো পথ! ফোনের অপর প্রান্ত থেকে হাসির শব্দ।
যথারীতি দরজা খুলে সাদর আমন্ত্রণ...
আমি পড়তে শুরু করলাম (গিয়েছিলাম মনে মনে'র অপঠিত অংশটুকু)
যেন শৃঙ্খলিত চিত্রী ও ছবিদুই দূরান্বয়ী গ্রহতবু এক স্থিতি, অস্থিরতা সহ।আনন্দবায়ু, তুমি আমার সারথি।ঢেকে রাখো পথ- আমি যে পথের পথী।।উড্ডীনে ভরে আছে আমার আলয়।ঝড়বৃষ্টি হয়সূর্য ওঠে এই ঘরে, রাত্রি নামে।তর্কে ও বিশ্রামে।এই যেন বুদ্ধি পাইপ্রকৃতির অন্তর্গত আমরা সবাই-রোদ্দুরে পুড়েছি কত- বর্ষায় ভেসে গেছে গেহ,তবু যায় না সন্দেহঅলৌকিক দেহযন্ত্র কেন ভ্রমে কাজ করে,কেন মিথ্যা আমার অক্ষরে?
কিছুক্ষণ আলপিনের নিস্তব্ধতা ভেদ করে উনি বললেন- ‘বলো।’
বললাম- আমি কৃষ্ণের অন্তর্গত (দ্বিতীয় সর্গে)
আবার শেষ সর্গের প্রথম লাইনে প্রকৃতির অন্তর্গত আমরা সবাই...
আমি থেকে আমরা সবাই কৃষ্ণভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছি, এটা অন্তত হাংরি (১৯৬১) আন্দোলনের বস্তুবাদী কবির কলমে- ভাবা যায় না!
আর প্রশ্ন? উৎপলকুমার বসু বললেন।
বললাম- আনন্দবায়ু, তুমি আমার সারথি, ঢেকে রাখো পথ..
আমি বললাম- এত ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে এই কয় লাইন থেকে! কেনো?
উনি বললেন- আর কোনো প্রশ্ন?
হ্যাঁ। আমি বললাম শেষ প্রশ্ন- ওই যে অলৌকিক দেহযন্ত্র কেন ভ্রমে কাজ করে, কেন মিথ্যা আমার অক্ষরে? আবারও এই শেষ লাইনের শেষ শব্দ হলো অক্ষর। আর শুরুতে মথুরা ভ্রমনের উড়ন্ত পাখিটা কৃষ্ণ জলাশয়ের মীন অক্ষরে নিবন্ধ কবি।
আমার প্রশ্ন হলো- এই দুই-ই রূপকার্থে ‘অক্ষর’ থেকে সরাসরি কবির কলমে যে মথুরা ভ্রমণের এক মহাকালের যাত্রা দেখতে পাচ্ছি, তাতে করে কি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, হাংরির কবি উৎপল কুমার বসু বার্ধক্যের বানারসী খুঁজে চলেছেন?
হা হা করে মৃদু অথচ গম্ভীর হাসিতে ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেনের ফোর্থ ফ্লোরের সামনের অংশটা তখন থরথর করে কাঁপছে। আর কবি উৎপলকুমার বসু তখন বলছেন- আরে, নামকরণ টা তো দেখো আগে!
আমি- (স্বগতোক্তি) সত্যিই তো! এটা তো ভাবা উচিত ছিলো আমার আগেই-
কবিতার নাম: গিয়েছিলাম মনে মনে
কবি: উৎপল কুমার বসু
মন্তব্য