পারসিয়ান লোকগাঁথায় প্রচলিত বিশ্বাস বা মিথ অনুযায়ী এক রহস্যময় পাথর আছে, যে পাথরের কাছে কোনো মানুষ উজাড় করে তার অবদমন করা সব দুঃখ, অবর্ণনীয় জীবন যন্ত্রণার কথা বলতে পারে। নিশ্চুপ সে পাথর দিনের পর দিন সেসব অসহনীয় কষ্ট নিজের মধ্যে শুষে নিতে থাকে এবং কোনো একদিন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সেদিন সে মানুষ জাগতিক সব দুঃখ-কষ্ট থেকে চিরতরে মুক্তি পায়।
আফগান দারি ভাষা এবং ফারসি ভাষায় অভিন্ন শব্দ "সাঙ্গ-ই-সাবুর" বা "দি প্যাসেন্স স্টোন" হচ্ছে সে রহস্যময়ী মুক্তি পাথর। লোকগাঁথার এ পাথরের নামানুসারে আফগান সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা আতিক রাহিমী ‘দি প্যাসেন্স স্টোন’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন একই নামে তাঁরই উপন্যাস অবলম্বন করে। আতিক রাহিমী, যিনি সোভিয়েত আমলে রুশ আগ্রাসনের ফলে কাবুল থেকে পাকিস্তানে শরণার্থী হয়ে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে পরবর্তীতে ফরাসী নাগরিকত্ব লাভ করেন। তাঁর ‘এশেজ এন্ড আর্থ’ উপন্যাস ইয়োরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকায় বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। বলা বাহুল্য, ‘দি প্যাসেন্স স্টোন’ সে ধারবাহিকতার পরবর্তী সফল উপন্যাস এবং সিনেমা ‘দি প্যাসেন্স স্টোন’।
ধরে নেয়া যায়, যুদ্ধ বিধ্বাস্ত আফগানিস্তান বা সে রকম মধ্য প্রাচ্যের কোনো এক মুসলিম দেশের প্রেক্ষাপটে সিনেমার পটভূমি। কারণ সিনেমার কোথাও কোনো শহর বা দেশের নাম বলা হয়নি। একজন নামহীন নারী, যিনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম আবহ-সংস্কৃতিতে বড় হয়ে ওঠা, পুরুষতান্ত্রিক শাসন- যাপনের যাঁতাকলে কিভাবে নিষ্পেষিত হয়ে জলাঞ্জলী দিয়ে যায় যায় নিজের সাধ-আহ্লাদ, প্রেম, যৌনতা, স্বপ্ন এবং ক্ষমতা; তার-ই প্রতিভূ স্বগতোক্তি বয়ান যেন। গল্পের নারী যেন একক না হয়ে সমগ্র বোরখা সংস্কৃতির নিপীড়িত নারীদের হয়ে বলে যায় আত্মজৈবনিক আলো-অন্ধকারের পর্দার কথা।
গুণী এবং ইরানে বিতর্কিত অভিনেত্রী গুলশিফতেহ ফারাহানীর অনবদ্য স্বগোতোক্তি বয়ান অভিনয় অভিব্যক্তিতে মর্মে স্পর্শ করার মত দর্শক হৃদয়ে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর তুলির আঁচড় কেটে যায় যেন।
গৃহযুদ্ধ তথা জিহাদ-মুজাহিদীন লড়াইয়ে লন্ডভন্ড শহরের সবাই যখন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে, দেখা যায় তখনো ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রায় কোমায় চলে যাওয়া অচেতন স্বামীর সেবা-শুশ্রুষা করে জীবন ফেরানোর চেষ্টা করে যায় গল্পের নারী। দু'সপ্তাহের মধ্যে অবস্থার উন্নতি হবার কথা থাকলেও ষোলোদিন পেরোনোর পরও স্বামীর অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। জীবন-মৃতের আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলে গল্পের নারী একাকী স্বগোতোক্তির মত কথা বলে যায় তার আত্মজৈবনিক নানান স্মৃতি কথা। উঠে আসে নারী জীবনের গহীন থেকে অবদমন করা সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-হতাশার গল্প। তার অচেতন স্বামী নিশ্চুপ পাথরের মত সেসব গল্প শুনে যায়। যদিও কোনো কিছুতে তার সাড়া মেলে না।
দেখা যায়, মাত্র সতেরো বছর বয়সে নিজের চেয়ে বয়সে অনেক বড় যুদ্ধব্যস্ত স্বামীর ছবির সাথে গল্পের নারীর বিয়ে হয়। যুদ্ধ ফেরত বীর স্বামী ঠিক প্রেমিকা বা স্ত্রীর পরিবর্তে যৌনদাসীর মত তার সাথে যৌন জীবন যাপন করে। যেন নারী জীবন আর মানুষ জীবনে বিস্তর ফারাক! গল্পের নারীর বয়ান অনেকটা এমন, "পতিতার সাথে যৌন সম্ভোগ অপরাধ নয় বরং স্ত্রীর সাথে পতিতার মত যৌন সম্ভোগ করা ধর্ষণের মত অপরাধ"।
ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ অচেতন স্বামীকে নিয়ে যখন সেবা-শুশ্রুষায় অর্থকষ্টে কোনো রকমে দিন যাপন করে গল্পের নারী, তখন তার স্বামী-পরিজন নিকট আত্মীয়রা তাকে একা ফেলে চলে যায়। এদিকে নারীটি স্বামীর বেঁচে ওঠার আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে থাকে আর একে একে বাঁচার সব পথ রূদ্ধ থেকে রূদ্ধতর হতে থাকে। শহরে গোলাগুলি, বোম্বিং বাড়তে।থাকে। স্বামীর বিপক্ষ গ্রুপ শহর দখল নিতে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে একদিন দুজন সৈনিক সে নারীর ঘরে প্রবেশ করে। ইতোমধ্যে অচেতন স্বামীকে কোনোরকমে লুকিয়ে রেখে নারীটি সৈনিকদের কাছে নিজেকে একা বসবাসকারী পেশাদার দেহ পসারনী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে। কোরান পরিপন্থী এমন ঘৃন্য কাজের জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ সৈনিক তাকে ধীক্কার জানিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত তরুণ সৈনিক পরে সে নারীর কাছে ফিরে আসে, অর্থের বিনিময়ে নারীটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চায়।.....
আশ্চর্য জনক ভাবে, সে নারী একদিন নিজের ভেতর সে তরুণ সৈনিকের প্রতি প্রেম অনুভব করে। এবং তরুণ সৈনিককে সে মমতার সাথে প্রেম-যৌনতা যত্ন করে শেখায়।
এভাবেই গল্পে নারী মানসের বিচিত্র আত্মজৈবনিক পাতা উড়তে থাকে এবং সব গল্প, মনের কথা স্বগোতোক্তিতে কখনোবা একাকী কথোপকথনে নারীটি তার অচেতন স্বামীর কাছে বলতে থাকে। যেন আক্ষরিক অর্থে তার স্বামী-ই তার সাঙ্গ-ই -সাবুর পাথর, যে নিশ্চুপে নারীটির সমস্ত কষ্ট-নির্যাতন শুষে নিয়ে হয়ে ওঠে "দি প্যাসেন্স স্টোন!"
সিনেমার সবচে শক্তিশালী দিক হচ্ছে এই যে, মিথের দেবতা বা দেবীর মত এ মাধ্যমের অনেকগুলি হাত বা অনেকগুলি অস্ত্র থাকে দেবী দূর্গা মত। গল্প, অভিনয় অভিব্যক্তি, আবহ, আলো, রঙের ব্যবহার, চিত্রায়ণ, গল্পের গতি... সব হচ্ছে একজন নির্মাতার যেন এক একটি অস্ত্র ধরা হাত। কিংবা দশ হাতে ক্যানভাস সাজানোর বৈচিত্র্যময় উপকরণ। আতিক রাহিমী দেবতা বা দেবীর মত সে নিপুণ শিল্পীর কাজটি করেছেন "দি প্যাসেন্স স্টোন" সিনেমায় বলা বাহুল্য।
মন্তব্য