বাংলা প্রাণের দেশ, বাংলা গানের দেশ, জাদু ও প্রেমের দেশ, বাংলা এক মায়াবাস্তবতার দেশ...
সময়টা সম্ভবত ‘৯১ কিংবা ‘৯২। ঘুরে বেড়াচ্ছি উত্তর বাংলার বিভিন্ন এলাকায়-- পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ, দিনাজপুর, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের পল্লিতে পল্লিতে। এসব অঞ্চলের মৃত্তিকা কোথাও ঝুরঝুরে বেলে, কোথাও বেলে-দোআঁশ, আবার কোথাও-বা শক্ত, আঠালো লালমাটি। মাঠের পর মাঠ-কখনো সবুজ, দিগন্তপ্রসারিত অবারিত সবুজ গালিচা; আবার কখনো ধূসর, ঊষর-পুরনো, ময়লা, দাগদাগালিতে-ভরা, দাগটানা মানচিত্রের মতো। মাঝে-মধ্যে লোকালয়, জ্যোৎস্নায় ভিজতে থাকা কুঁড়েঘর, ভেঙে-যাওয়া হাট, মেঠোপথ, পথের পাশে চায়ের দোকান। শেষ-শীতের শুষ্ক আবহ, রুক্ষ ভূ-প্রকৃতি। এসবের মাঝেই হঠাৎ সুনীল শুশ্রুষার মতো দেখা মেলে কোনো পুষ্করিণীর কিংবা কোনো এক দীর্ঘিকার। কাকচক্ষুকালো জল; লোকে শখ করে নাম দেয়-- সাগর। রামসাগর, নীলসাগর, জয়সাগর, হুরাসাগর। অথবা ময়দান-আকারের এক দিঘি। ময়দানদিঘি। স্পষ্ট বরাভয়ের মতো বিরল দু-একটি নদী। শান্ত, স্বচ্ছ, শীর্ণকায়া, বালিবক্ষা, বঙ্কিমগতি। আঁকাবাঁকা গতিপথ। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে’। নদীর নাম মহানন্দা, বেরং, ডাহুক, ঘাঘট, বুড়ি যমুনা, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, কালিন্দী, আত্রাই...।
সেই আদিগন্ত-সমতল ভূ-আয়তনের এক কোণে পড়ে আছে একটি শহর। কুড়িগ্রাম। অখ্যাত, নিরীহ, ছোট্ট ও ছিমছাম। ধরলা নদীর বাঁকে। সে-নদীর প্রবাহ ইস্পাত-পাতের মতো চকচকে ও ক্ষুরধার। এই সেই নদী যেখানে ফাঁদে পড়ে বগা কাঁদে আর বগী ঘুরে-ঘুরে উড়তে থাকে তার চারপাশ ঘিরে। খুবই সাদামাটা, আটপৌরে এক বঙ্গশহর। কিন্তু অদ্ভুত এক মায়া ও কুহক সারাক্ষণ লেগে থাকে শহরটির গায়ে। সেখানকার ধরলা নদী সাড়া দেয় গ্রহ-উপগ্রহের আকুল আহ্বানে। উতলা হয়ে ওঠে। মাঝে-মধ্যে ঝোড়ো হাওয়ার উস্কানিতে বড়-বড় ঢেউ তুলে বয়ে যায়। আবার শান্ত হয়ে আসে যখন, তখন, মাছরাঙা আর পানকৌড়ি, দুই বৈমাত্রেয় ভাই, বাসা বাঁধে নদীর বুকে। স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ তারা কলহ করে। কুড়িগ্রামের বয়নকুশলী বাবুই পাখিরাও কী এক নাক্ষত্রিক কারণে থেকে-থেকে ভুলে যায় বয়নসূত্র হঠাৎ। আর শাস্ত্রবাক্যে-বাঁধা যত গৃহনারী-বিবিধ বেড়া ও প্রাচীর ডিঙিয়ে এসে ভিড় করে দাঁড়ায় নদীকূলে। তখন কী যে সপ্রতিভ হয়ে ওঠে তারা! প্রকাণ্ড ক্রিস্টালের মতো সপ্রতিভ।
এই সেই কুহকশহর কুড়িগ্রাম। শহরবাঁধের ধারে কংক্রিটের বড় একটা ব্লকের ওপর একদিন এক তারাভরা বসন্তসন্ধ্যায় শুয়ে আছি চুপচাপ। চারদিকে ধারাবাহিক অন্ধকার, হাওয়া ও নীরবতা। ওপরে নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে তখন অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে ছড়ানো নক্ষত্ররাজি। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে লীলালাস্য অবলোকন করছি নক্ষত্রজোনাকির। একসময় হঠাৎ ওজনহীনতার বোধ জাগে। যেন কুড়িগ্রাম তার আলাভোলা আধপাগলা ধরলাকে সঙ্গে নিয়ে ধরণীর সকল অভিকর্ষ ছিন্ন করে আস্তে-আস্তে উঠে যাচ্ছে ওপরে। উঠছে, উঠছে, মেঘ-মেঘান্তর ফুঁড়ে, বায়ুমণ্ডল ভেদ করে... কুড়িগ্রাম যেন এক অতিকায় পিরিচবাহন... দ্রুত ভেসে যাচ্ছে হালকা হাওয়ার ভেতর দিয়ে, কখনো হাওয়াহীনতা, কখনো-বা এক পূর্বাপর ভয়েড ও ভ্যাকুয়াম-রাজের মধ্য দিয়ে। কাত হয়ে তাকিয়ে দেখি নিচে এক ভয়াল-কালো গহ্বর। ভেসে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই... একসময় লাল-লাল বাষ্পের ঝাপটা এসে লাগল এক দমক... কেমন যেন একপ্রকার ঘ্রাণ! কী-কী যেন দেখতে পাচ্ছি চকিত ঝলকে, কীসের যেন স্পর্শ, কীসের যেন আস্বাদ-উদ্ভাস! একযোগে ঘনিয়ে আসছে সবগুলি ইন্দ্রিয়, কিংবা স্থানবদল করে চলেছে তারা মুহুর্মুহু... এইমাত্র কোনো এক নক্ষত্র-জংশনকে সাঁই করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল আমাদের এই পিরিচবাহন। কি জানি! এভাবে অনেকক্ষণ... কুড়িগ্রাম ভাসতে ভাসতে এত ওপরে উঠে যাচ্ছে যে, দূরের ধরিত্রী থেকে হয়তো এই কুহক-শহরকে মনে হচ্ছে আকাশের মুখে এক নিটোল তিলচিহ্ন। এক অপরিহার্য সৌন্দর্যবিন্দু। হয়তো-বা।
যেন বয়ে যাচ্ছে এক অপরূপ স্বপ্নভ্রমণের রাত্রি, সে-এক অপূর্ব শোভামেরাজ... মোহ জেগে উঠছে, ভেঙে যাচ্ছে, ফের জেগে উঠছে, নিশিডাকে, রাত্রিচারিতায়। এক দুর্দান্ত এপিফ্যানি-- মুহূর্তঝিলিকের মতো চকিত, গন্ধকাহিনির মতো স্নিগ্ধ।
মন্তব্য