লিখেছেন: সুজন ভট্টাচার্য
'বেচারা রিফিউজি, এতো বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে বাঁচার জন্য ইংল্যান্ডে আসলো কিন্তু সরকার তাদের তেলাপোকার মতো শিকার করছে' এটি মেক্সিকান চলচ্চিত্রকার আলফনসো করনের 'চিল্ড্রেন অব ম্যান' চলচ্চিত্রের একটি সংলাপ! বোধহয় একটি সংলাপই চলচ্চিত্রের গতিপথ নির্ধারণ করে দিতে পারে। এই একটি সংলাপেই আমরা চিনতে পারি জেস্পারকে। মাইকেল কেইনের অনবদ্য অভিনয় এবং এই জেস্পার চরিত্রটির মাধ্যমেই আলফনসো করন চিনিয়ে দেন একটি মাস্টারওয়ার্ক যার নাম 'চিল্ড্রেন অব ম্যান'।
চিল্ড্রেন অব ম্যান দেখার অভিজ্ঞতা
২০০৬ সালে রিলিজ হওয়া সিনেমাটি খুব একটা সারা ফেলেনি তখন। এটি নির্মাণ করতে খরচ হয় ৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়। ঘরে তুলে নেই মাত্র ৬৯ মিলয়ন। ২০০৬ এর বিশ্বপরিস্থিতি আসলে এই ছবির মাথামুণ্ড বুঝেনি।রাজনীতি, বিশ্বায়ন, রিফিউজি ক্রাইসিস, ইসলামিক মিলিটেন্সি, বন্ধ্যাত্ব এই বিষয়গুলো সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ছিলো অবাস্তব! অডিয়েন্স ইমিগ্রেশনের মতো একটি বিষয়কে চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে মেনে নিতে পারেনি।অথবা তারা বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলো না।কিন্তু এখন প্রায় ১৪ বছর পর এই সিনেমা পরিণত হয়েছে এক অদ্ভুত রহস্যে! পাতার পর পাতা রিভিউ হচ্ছে। স্লাভো জিজেকের মতো তাত্ত্বিক গুরুরা এই চলচ্চিত্রটিকে গত ২০ বছরে মধ্যে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সেরা হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। বিনা বাক্যে বলে দিচ্ছেন এই সিনেমা একুশ শতকের পলিটিক্যাল মাস্টারপিস! আমার কাছে প্রথমবার এই চলচ্চিত্রটি দেখার অভিজ্ঞতা ছিলো খুবই ব্যক্তিগত এবং আবেগপ্রবণ! এই সিনেমাটি দেখে শেষ করার পর কান্না থামাতে পারিনি। তখন এই কান্নার কারণ ছিলো নিতান্তই আবেগজাত কিন্তু এখন এসে বুঝতে পারি সেই সময়কার কান্না ছিলো বাস্তবিক। সেই সময় এটি আমাকে মানসিকভাবে আক্রান্ত করেছিলো। কিছু বছর পরে সিনেমাটি আবার দেখতে গিয়ে বুঝেছি এটি এমন একটি সিনেমা যা কিনা বিশ্বের মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ কালকে বিস্ময়ের সাথে দেখিয়ে দেয়।
স্লাভো জিজেক তাই বলে ফেলেন,
With the alarming international immigration crisis, the constant worldwide terrorist attacks, and endless turmoil in Middle East, the time has come again to talk about Children of Men.
চিল্ড্রেন অব ম্যান, চৌদ্দ বছর পরের বাস্তবতা!
নির্মিত হওয়ার অনেক বছর পরে কি করে একটি সিনেমার রাজনৈতিক বাস্তবতা এতো ইম্পরটেন্ট মনে হয়? এই প্রশ্নের উত্তরও আমরা পেয়ে যায় স্লাভোই জিজেকের কথায়! জিজেক বলেন, "The world feels like it's caught in a downward spiral, and my head spins as I keep asking myself the same question: Are we living in the dawning of Children of Men?" জিজেক আসলে উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রশ্নই করেন!আলফনসো করন এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন পিডি জেমসের ১৯৯২ সালে লেখা একটি উপন্যাসকে ধারন করে।এই সিনেমার প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ২০০৫ থেকে ২০২৭ সালের বিশ্ব পরিস্থিতিকে সামনে রেখে। পৃথিবীতে ২০ বছর ধরে চলমান মনুষ্যবন্ধ্যাত্বকে মৌলিক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে সিনেমাটি।এই বন্ধ্যাত্ব আসলে একটি অনুমান! মনুষ্য প্রজাতি সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম।মানববন্ধ্যাত্ব সভ্যতাকে অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে।দলে দলে মানুষ বাঁচার জন্য পারি জমাচ্ছে একমাত্র সংগঠিত দেশ গ্রেট বৃটেনে।বিশ্বের বড় বড় দেশ, শহর প্রায় ধ্বংসস্তুপ।ব্রিটিশ সরকার প্রাণ বাঁচানোর দায়ে আশ্রয় নেওয়া রিফিউজিদের উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেছে। লন্ডনের অলি গলিতে খাঁচার মধ্যে বন্দি করা হচ্ছে ইমিগ্রেন্টদের।সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের যেকোনো মূল্যে ফেরত পাঠাতে চায় তাদের ফেলে আসা ধ্বংস প্রায় স্বদেশে! সরকার ও নিরুপায় যেহেতু ভীষণ অর্থনৈতিক সংকট গ্রাস করছে! বিদ্রোহীদের সাথে সীমান্তে লড়াই করতে হচ্ছে বৃটিশ সেনাবাহিনীকে।অভ্যন্তরে 'সিভিল প্রোটেকশন' এর আড়ালে মানবাধিকার গ্রুপগুলো অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে এবং ইসলামিক মিলিটেন্টরা বোমা ফাটিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ত লোকালয়ে! এমন একটি পরিস্থিতিতে এককালের রাজনৈতিক কর্মী থিও ফেরন (ক্লাইভওয়েন) অস্থির ঘুরে বেড়াচ্ছেন! হতাশ বিধ্বস্ত ফেরন সরকারের নেওয়া সেচ্ছা আত্মহত্যা প্রকল্পে (যারা সেচ্ছায় মরতে চায় তাদের সরকারি সহায়তা) গ্রহণ করবে কিনা ভাবছে! এই সিনেমায় ফেরনের সংলাপের মধ্যেই এই হতাশার কথা উঠে আসে।
ফেরন বলে,
I can't really remember when I last had any hope, and I certainly can't remember when anyone else did either. Because really, since woman stopped being able to have babies, what's left to hope for?
স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে যেনো।এমন অবস্থায় থিও ফেরনের সাথে একদিন লন্ডনের আন্ডারপাসে দেখা হয়ে তার স্ত্রীর! জুলিয়ান (ফেরনের স্ত্রী) তখন একটি বিদ্রোহী গ্রুপের নেত্রী! তারা সন্তানসম্ভবা এক রিফিউজি মেয়েকে অর্থের বিনিময়ে সীমান্ত পারি দিয়ে একটি জাহাজে তুলে দিতে চায় কিন্তু পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না! এই অবস্থায় জুলিয়ান এই দায়িত্বটা থিওডর ফেরনকে দেয়।ফেরনের আর্থিক দুরাবস্থার সুযোগ নিতেই চাই জুলিয়ান।ফেরন বুঝে এটাই তার শেষ আশা! কি নামের মেয়েটিকে নিয়ে শুরু হয় এক অবিশ্বাস্য কাহিনী!আমরা দেখি 'হিউম্যান প্রোজেক্ট'! বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মানব শিশু খুঁজতে থাকা একটি জাহাজ।জাহাজের নাম 'টুমরো'!
সিনেমা, রাজনীতি এবং বর্তমান বিশ্ব
বর্তমান সময়ে এসে হিউম্যান ইন ফার্টিলিটি এখনো প্রধান সমস্যা না। কিন্তু দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মধ্যপ্রাচ্যের ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে ভীষণ দারিদ্র আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে চিল্ড্রেন অব ম্যান।গত কয়েক বছরের বিশ্বসংবাদ মাধ্যমে উঠে আসা ঘটনাগুলোতে চোখ রাখলে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, ব্রাসেলসের স্টেশনে লকডাউন, বোমা হামলা। প্যারিস হামলা, উত্তর ইউরোপে শরণার্থীর ঢল, হাউজ অনুমোদন দিয়েছে কঠোর ইমিগ্রেশন পলিসি, মার্কিন রাশিয়ার বোমায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যাচ্ছে সিরিয়াতে ইত্যাদি ইত্যাদি।ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী ভাষনে বলছেন, 'আই এম পুটিং পিপল অন নোটিশ দ্যট আর কামিং হিয়ার ফ্রম সিরিয়া এজ পার্ট অব দিজ ম্যাস মাইগ্রেশন, দ্যট ইফ আই উইন দ্য আর গোয়িং ব্যাক'! এই ভাষণ বাক্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রায় ১৪বছর আগে নির্মিত একটি সিনেমার কাহিনীকে! ইরাক যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ, লেবাননে সংকট, ধ্বস্ত লিবিয়া, ইয়েমেনে শিয়া-সুন্নি সংকট শেষে সিরিয়ান সিভিল ওয়ার।লাখ লাখ বিপর্যস্ত মানুষ! যারা প্রাণে বেঁচে যাচ্ছে তারা বিপদসংকুল সমুদ্র অতিক্রম করে ভিড়ছে নর্থ ইউরোপের উপকূলে! এই শতাব্দীর সবচাইতে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে শরণার্থী সংকট।ইউরোপের ছোট রাষ্ট্রগুলোতে শুরু হয়েছে তীব্র মন্দা।ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব! ইউনাইটেড কিংডম ঘোষণা দিয়েছে, তারা মাত্র ২০,০০০ শরণার্থী নেবে। পোলেন্ড, হাংঙ্গেরীর মতো রাষ্ট্র দায়িত্ব নিতেই অস্বীকার করছে। জার্মানি প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে একঘরে।ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম! একদিকে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী খেলা অন্যদিকে তীব্র রিফিউজি ক্রাইসিস। একদিকে যুদ্ধ এবং মৃত্যু অন্যদিকে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের একের পর এক বোমা হামলায় বিপর্যস্ত মানবতা। বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন আলফনসো করন আবিষ্কার করেন পিডি জেমসের উপন্যাসে! বহু বছর আগে নির্মিত সিনেমাটি এই সব অর্থে হয়ে ওঠে মাস্টারওয়ার্ক।
আলফনসো করনের সিনেমা কী হতাশার নাকি হিউম্যান প্রোজেক্ট থেকে টুমরো?
পুরো সিনেমাটিতেই করন একই ধরণের কালারটোন ইউজ করেন! গ্রেইশ, গ্লুমিইমেজ।অবিশ্রান্ত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি! কাদামাখা ধোঁয়াটে সিকোয়েন্স।ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে সময়কে ধরে রাখা।এই ইমেজ ক্রিয়েট করার মাধ্যমে আলফনসো যেনো বিকট এক কুৎসিত ভবিষ্যৎ -কে দেখাতে চান।এটি কী সত্য?দর্শকের ভুল ভাঙবে যখন চলচ্চিত্রটির শেষ দৃশ্যে আমরা আসবো।
এই প্রসঙ্গে করন নিজেই বলেন,
আমি ওইসব সুন্দর ফটোগ্রাফগুলো এমন ভাবে নিয়েছি যেনো সবাই ভাবে ওগুলো অন্য গ্রহ থেকে নেওয়া।তুমি দূর থেকে যেনো মেঘ দেখছো কিংবা ভিন্ন কোনো কন্টিনেন্ট! এগুলো ব্যবহার করেছি কারণ মানুষের গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করেছি কারণ আমরা একদিকে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছি আবার অন্য দিকে সবার জন্য নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করছি।পুরো ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে মানুষের এটাই জিজ্ঞাসা হওয়া উচিত! আমরা কি করছি ওইসব মানুষদের সাথে যারা ইমিগ্রেন্ট, রিফিউজি এবং রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী?
আলফনসো করণ ফিল্মমেকার ম্যাগাজিনকে বলেন,
This is something happening now-the near future is now. I think all of us working on the film thought that you have to get the human experience to get to the social and political ---- it's something that needs compassion more than an ideology.
মুভি ওয়েভের সাথে অন্য একটি সাক্ষাৎকারেও করন উল্লেখ করেন,
I have a very grim view, not of the future, the present; I have a very hopeful view of the future...... I believe an evolution is happening; together with all this greenness an evolution is happening, an evolution of the human understanding that is happening in the youngest generation. I believe that the youngest generation, the generation to come, is the one that is going to come with new schemes and new perspective of things.
মন্তব্য