কোরাকাগজের খেরোখাতা
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্যে আমি সরাসরি প্রথম শ্রেণীতেই ভর্তি হই। সে যুগে সেরা ইশকুলে ভর্তি হবার জন্যে প্রতিযোগিতা বা মা-বাবার চাপ কিংবা প্রস্তুতি গ্রহণ এমন কিছুই ছিল না। নিয়ম ছিল, পাড়ার ইশকুলে ভর্তি হওয়া। ঘর হতে দু’পা ফেলেই যাতে ইশকুল যেতে পারে বাচ্চারা। এখনকার মতো গাড়ি চড়ে ইশকুল করার ব্যাপার আমাদের ছিল না। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো এক সকালে বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন ইশকুলে ভর্তি করানোর জন্যে। মনে বেশ উৎসাহ ছিল। খুশি খুশি ভাব নিয়ে বাবার হাত ধরে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে উপস্থিত হলাম। বাবার সাথে কি সব আলাপ হলো, আর আমার ভর্তি হয়ে গেল। এরপর, এক দপ্তরিকে ডেকে হেড স্যার আমাকে দেখিয়ে প্রথম শ্রেণীর কক্ষে নিয়ে যেতে বললেন। বাবাও বেরিয়ে এলেন রুম থেকে। তারপর দেখি বাবা আমাকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন, আর দপ্তরি আমাকে টানতে টানতে শ্রেণীকক্ষে নিয়ে যাচ্ছেন। চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম। যেন অকস্মাৎ পরিত্যক্ত হয়ে গেলাম, এমন একটা অনুভূতি কাজ করছিলো মাথার ভেতরে। আমাকে একটি বেঞ্চিতে বসিয়ে দিয়ে দপ্তরি চলে গেলেন। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। এর মধ্য ক্লাসে কেউ একজন কিছু পড়াচ্ছিলেন, আমার মনে নেই, কানেও যে ঢুকেনি কিছুই সে ব্যাপারেও নিশ্চিত। একটু পরে ঘন্টা বাজলে শিক্ষক নির্গত হলেন আর অন্য ছেলেমেয়েরা আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। যেন আমি চিড়িয়াখানায় নতুন আমদানীকৃত কোনো বাঁদর। অন্য বাঁদরেরা সঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না, কতোটা বাঁদরামী করা যাবে আমার সাথে। দু’একজন ভাব জমানোরও চেষ্টা করেছিলো হয়তো। পরিবারের আশ্রয় থেকে প্রথম বিযুক্তির ভার আমার এমন দুর্বিসহ মনে হয়েছিলো, এই কথাগুলো তাই খুউব মনে আছে।
সবচেয়ে বেশি মনে আছে যে ঘটনা, তার দিকেই যাই। এর পরের ক্লাসে যে শিক্ষক এলেন তাঁর চেহারা মনে নেই। তবে এসেই একের পর এক ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া ধরতে লাগলেন। যে পারে না, তাকে তুলে দিচ্ছেন বেঞ্চের ওপর। কানে ধরে হাঁটু হাল্কা ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমি যদিও একটু বিচলিত হলাম, তবু মনে করলাম, আমি তো আজ প্রথম এসেছি, আমাকে কিছুই করবেনা। আমি তো জানিই না, কী পড়া ধরছেন স্যার। কিন্তু যখন আমার পালা এলো, বললাম, আমি তো আজ নতুন এসেছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অগত্যা দাঁড়াতে হলো বেঞ্চের ওপরে কানে ধরে হাঁটু ভাঙা ‘দ’ হয়ে। মানুষ আর সব ভুলে যায়, কিন্তু অপমান কখনও ভোলে না। আমিও সেই বিভীষিকাময় অপমান আজও ভুলতে পারিনি। ইশকুলের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা বললেই কান লাল হয়ে যায়, চোখ অশ্রুসিক্ত হয় ওঠে। আমি সেই শিক্ষকটির নাম আর চেহারা ভুলে গিয়েছি বটে, কিন্তু তাকে ক্ষমা কোনোদিন করিনি, করতে পারিনি। আমার চোখ দিয়ে দরদর করে সেদিন গড়িয়ে পড়েছে কতো জল— কেউ তার হিসেব রাখেনি, আমি কেবল হাঁউ মাউ করে গলা ছেড়ে কেঁদেই গিয়েছিলাম ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডেকে ডেকে। কেউ তাতে কর্ণপাত করেনি ঘন্টা না বাজা পর্যন্ত। ভাগ্যিস সেই ক্লাসটিই সেদিনের শেষ ক্লাস ছিল। ছুটির ঘন্টা বেজে উঠতেই শিক্ষক বেরিয়ে গেলে আমি আস্তে ধীরে নেমে ক্লাসের বাইরে বের হয়ে দেখি আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন। খুব অভিমান হয়েছিল সেদিন আব্বার ওপর। আব্বাকে কিছু কি বলেছিলাম? নাহ্, মনে নেই। সম্ভবত আশ্রয়ের নিশ্চিন্তি পেয়ে দুর্ভোগের কথা বলাই হয়নি।
আমার ইশকুলে যাবার জন্যে মেইন রোডে উঠতে হতো না। আমাদের গলির ভেতরেই একটি চিকন উপগলি ছিল। কোনোরকমে ২জন মানুষ পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারবে। কোথাও কোথাও আরও চিকন। সেই গলির ভেতরে একটি চাপাকল বা টিউবওয়েল ছিল। পুরা পাড়ার লোক সেই টিউবওয়েল বা পাইপ থেকেই খাবার পানি সংগ্রহ করতো। সে যুগে ঘরে ঘরে ওয়াসার লাইন ছিল না। আমাদের বাসার পেছনদিকে একটি চাপাকল থাকায় আমাদের সেই পাইপের গলি থেকে পানি আনতে যেতে হতো না। প্রতিবেশীদের দেখেছি, পুকুরের পানি দিয়ে ধোয়াধুয়ির কাজ চলতো। আর খাবার জন্যে পাইপের পানি। তাই এই উপ-গলিটির নাম হয়ে গেল পাইপের গলি (চট্টগ্রামের ভাষায় ফাইফঅর গল্লি)। আমরা সেই চিকন আঁকাবাঁকা পাইপের গলির ভেতর দিয়ে লোকজনের ঘরবাড়ির উঠোন কী দুয়ারের সামনে দিয়েই গলির অপর মাথায় বেরিয়ে গেলে দেওয়ান বাজারের সিএন্ডবি কলোনির সামনে গিয়ে পড়তাম। তারপর একটু ভিতর দিকে গেলেই আবুল কাসেম প্রাথমিক বিদ্যালয়। কে এই আবুল কাসেম কোনোদিন জানতে পারিনি। সে অনুসন্ধিৎসাও ছিলো না। আমরা অবশ্য তাকে ‘আবুইল্যার মা’র ইশকুল’ বলেই ডাকতাম। একতলা পাকা বাড়ির কয়েকটি কক্ষ, সামনে একটি ছোট মাঠ। অবশ্য সেসময় এই মাঠকে অনেক প্রশস্ত— বিস্তৃত মনে হতো। রাস্তা থেকে গেট দিয়ে ঢুকলেই মাঠ, মাঠের পূর্ব প্রান্তে ইশকুল ঘর। মাঠের পশ্চিম প্রান্তে একটি মসজিদ। এবং উত্তর দিকে ছিল কতকগুলি টিনের চালার মেস। একটু বড় হলে জেনেছিলাম সেই ব্যাচেলর কোয়ার্টারের পেছনের পাকা ফ্যামিলি বাড়িগুলোর পেছনের সীমানা দেওয়ালের ওপাড়েই আমাদের গলি, আমাদের বাসার প্রায় বিপরীতে। সেই দেওয়াল টপকেও কতোবার বাসায় ফিরেছি, যখন কিছুটা লম্বা হয়ে উঠেছিলাম। অনেক ব্যাচেলর সেইসব টিনশেডের মেসে থাকতেন। তাদের কেরোসিন চুলার স্টোভে মাছ আর তরকারী রান্নার ঘ্রাণ যখন আমাদের নাকে এসে লাগতো, আমার খুব খিদে পেতো তখন।
ইশকুলটি পরিচালনা করতো সিএন্ডবি কলোনির কর্তৃপক্ষ। ইশকুলের পেছনে পূর্বদিকে বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল উঁচু ছাদ-অলাকতোগুলো দালান লম্বা লম্বা সারি বাঁধা, পরে জেনেছিলাম ওটা ছিল সিএন্ডবি’র গোডাউন। আমি তখন তো বুঝিইনি এখনো বুঝি না, যেখানে জিনিষপত্র এনে জমাতে জমাতে উঁচু স্তুপ করে রাখা হয়, তার নাম আপ না হয়ে ডাউন হয়ে গেল কেন! আর এইগো-ই-বা কেন? এখানে তো জিনিষপত্র জমা থাকে। তাই ‘গো’র বদলে ‘স্টে’ রাখলেই ভাল হতো। অতএব, পুরো নাম দাঁড়ানোর কথা — ‘স্টে-আপ’। আমি তো তখন শিশু, আর এখন প্রায় বৃদ্ধ, তাই কোনো অবস্থাতেই আমার কথা কেউ কানে নেবে না। গোডাউন ক্রমাগত নীচের দিকেই যেতে থাকবে। যাই হোক, সেই গোডাউনের পেছনে চাক্তাই খাল, আর খাল পাড় দিয়ে যে রাস্তাটা উত্তরদিকে গিয়েছে, ওটা দিয়ে গেলেই আবার ঘুরে আমাদের বাসায় পৌঁছানো যায়। কিন্তু এই সামান্য জ্ঞানটি অর্জন করতে যেদিন প্রথম সেই পথ ধরেছিলাম, জানি না ঠিক কোন্ ক্লাসে তখন পড়ছি, নিজেকে কলম্বাস টলম্বাস জাতীয় কিছু মনে হয়েছিল। এমন বিস্ময় এসে জীবনকে মাঝে মাঝে সুন্দর করে তোলে। আসলে তো প্রতিটি মানুষই একেকজন ডিসকভারার। এটা ইংরেজিতে বলার কারণ হলো, বাংলায় ইনভেনশন এবং ডিসকভারি দুটো শব্দকেই আবিষ্কার হিসেবে অনুবাদ করা হয়। কিন্তু দুটোর মধ্যে বেশ ফারাক রয়েছে। টাঙস্টেন বাতি বা টেলিফোন বা কম্পিউটার আবিষ্কার হচ্ছে ইনভেনশন। আর আমেরিকা কিংবা ভারতবর্ষ আবিষ্কার হলো ডিসকভারি। অর্থাৎ যা কিনা আগে থেকে উপস্থিত ছিল অথচ কারও জানা ছিলো না, তা আবিষ্কার করাই ডিসকভারি। এরকম কতো ডিসকভারি নিজের ভেতর নিজে আজীবন করে এলাম তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সূর্যের চারিদিকে যে পৃথিবী ঘুরছে, এটা কি গ্যালিলিওর ইনভেনশন না ডিসকভারি, যখন প্রথম জেনেছিলাম, বুঝিনি। কিংবা বিগ ব্যাং বা ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার? অথবা কোয়ান্টাম আলোক-কণা আবিষ্কার? এখনওকি বুঝতে পারছি?
এই যে চাক্তাই খাল, সেদিন, মনে হয়েছিল অনেক বড় এবং বহতা নদীর মতো। ছোট্ট ডিঙ্গি ও সাম্পান আসে যায়, এবং পাহাড়ী বাঁশের স্তুপ ভেলার মতো লগি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। আজ আর আমার বাচ্চাদের বললে একথা তারা বিশ্বাস করবে না। এই খালের উপরে একটি পাকা ব্রিজ পেরিয়ে কতোবার করে ছুটে গিয়েছি ডি.সি.রোডে ঘুড়ি, সুতা, নাটাই এসব কিনে আনার জন্যে। যখন কিছুটা বড় হয়ে একা একা এই খাল পাড় ধরে হেঁটে যেতাম ভর দুপুরে ঘুড়ি কেনার জন্যে, যখন আব্বা দিবানিদ্রায় মগ্ন, তখন ভরা জোয়ারে ইট বিছানো পথটি ডুবে যেত। আমি লুঙ্গি উপরের দিকে তুলতে তুলতে একসময় বুক পানিতে নেমে গেলে লুঙ্গিটা মাথার উপর তুলে ধরতাম, আর ঝাণ্ডা উড়িয়ে ওপাশে পৌঁছালে আবার নামিয়ে নিতাম ধীরে ধীরে। অথচ আজ চাক্তাই খালে জমে আছে থ্যাকথেকে কাদা। যেখানটায় খালটি নদীতে মিশেছে সেখানে ভীড় করে বসে থাকে কিছু সাম্পান। এই সাম্পান চট্টগ্রামের ঐতিহ্য— অনেকটা ভেনিসের গন্ডোলার মতো, কিংবা কাশ্মীরের শিকারা। কিন্তু সাম্পান নিয়ে তো আমাদের মাঝিভায়েরা চলে যায় গভীর সমূদ্রে মাছ ধরতে।
সম্প্রতি এই জরাগ্রস্থ চাক্তাই খালে শ্যাওলা জমে ওঠা কিছু সাম্পান দেখে একটি কবিতা লিখেছিলাম “আমাদের গন্ডোলারা” শিরোনামে—
আমাদের গন্ডোলারা চাক্তাই খালের কালো জলে
দিবারাত্র ঘষটে ঘষটে চলে
হয়ে পড়ে ঘনকৃষ্ণ এবং ফ্যাকাশে
ভেবেছি সমূদ্র যাত্রা শুরু করি একদিন ক্লান্তিজ্বরা শেষে
অথচ নদীর নাব্যতায় আজ সুতীব্র ঘাটতি
চকচক করে না আর গন্ডোলা বা মুদ্রার চাকতি
তবু এক অনন্তের নিত্য আবাহনে
কোনো দূর দিগন্তের পানে
সকলেরই যেতে হবে অন্য কোনোখানে
জীবনের স্রোতের উল্লাসে অথবা ভাটার টানে
আমাদের গন্ডোলায় জমে শ্যাওলা আর নর্দমার পাঁক
জল মজে থ্যাক থ্যাক করে মরে গেছে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ
গন্ডোলার ফুটোগুলি কালো শামুকের অযাচ দখলে
তবু ভাবি একদিন যাব — যাব, সুদূর সমুদ্রে চলে মহাকালে
(আমাদের গন্ডোলারা / জিললুর রহমান / অগ্রন্থিত / রচনাকাল: ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সকাল ১১:০০)
প্রাইমারী স্কুলের খুব বেশি স্মৃতি মনে নেই। তবে যে বেদনা আমি কোনোদিন ভুলি না, তা হচ্ছে মনির স্যারের প্রতারণা। আমি ক্লাস ওয়ান থেকে টু’তে ওঠার সময় সম্ভবত দ্বিতীয় হয়েছিলাম। কিন্তু টু থেকে থ্রি’তে যাবার বার্ষিক পরীক্ষা যখন আসে তখন একদিন অংক পরীক্ষা শুরু হবার আগে আগে পরীক্ষার হলেই মনির স্যারকে বলতে শুনি— সিএন্ডবি-র অফিসারদের ছেলেমেয়েরাই প্লেস করা উচিত— ওদের স্কুল, অথচ বাইরের ছেলেরা সব প্লেস নিয়ে নিচ্ছে। এসব কথা, কথার কথাই ভেবেছিলাম। কিন্তু অংক পরীক্ষার সব উত্তরগুলো যখন লেখা শেষ করে খাতা জমা দিচ্ছি হঠাৎ মনির স্যার এসে বললেন— দেখি কী লিখেছ? বলে খাতা উল্টাতে লাগলেন। দেখতে দেখতে হঠাৎ বললেন, “এসব কী করেছো! সব নামতা ভুল!” আমি বিস্মিত হলেও স্যারের মুখের উপর কোনো কথাই বলতে পারিনি সেদিন। এই ভীরুচিত্ততা আমাকে আজীবন নানা যন্ত্রণায় ফেলেছে। তারপর স্যার আমার পাশে বসে পরম সুহৃদের মতো বললেন, “এগুলো কেটে আবার লিখ”। আর তিনি ডিকটেট করলেন দু’দুটো নামতা। আমি সঠিক উত্তর কেটে স্যারের কথামতো ভুল করে নামতা লিখলাম। নিজে বুঝতে পারছিলাম ভুল লেখানো হচ্ছে, কিন্তু ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনি। এই ভয় আমার যেন জন্ম জন্মান্তরের ভয়। ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকি কিন্তু মুখে কোনো শব্দ না। এই কারণেই হয়তো বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে অসন্তোষ নিয়েও বেঁচেবর্তে যাই, টিকে থাকি দারা কন্যা নিয়ে স্থবির বৃক্ষের মতন— তাল ঠুকে ঠুকে চাকরিটাও মুখ বুঁজে করে যেতে পারছি।
বাড়ি ফিরে বাবাকে বললাম স্যারের এই অদ্ভুত ঘটনা। তিনি বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন, “কোনো শিক্ষক এমন কাজ করতে পারে না”। আমি মনের দুঃখ মনেই চেপে রাখলাম। বার্ষিক পরীক্ষায় আমি তৃতীয় স্থানে নেমে গেলাম। রেজাল্ট পেয়ে বাবাকে আবার বললাম। বাবা স্কুলে গিয়ে খাতা দেখতে চাইলেন। তিনি সত্যতার প্রমাণ পেয়ে প্রধান শিক্ষককে বললেনও। কিন্তু তাঁকে বলা হলো, ছাত্র সঠিক উত্তর কেটে নিজ হাতে ভুল উত্তর লিখেছে। কিছুই করার নেই। মনে পড়ে, বাবা ফিরে এসে খুব হতাশ হয়ে বললেন— “অথচ এই মনির আমার ছাত্র ছিল!” তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তাঁর কোনো ছাত্র এমন কাজ করতে পারে। হায়! প্রতিদিন প্রশ্ন ফাঁস ও আরো নানারকম শিক্ষা দুর্নীতির যেসব সংবাদ পাচ্ছি, মনে হচ্ছে সারা দেশটাই মনির স্যারে ভরে গেছে। সেই মনির স্যার পরে বেশ কিছুদিন আমাদের গলিতেই থাকতেন। কিন্তু কোনোদিন তাঁকে সালাম দিতে ইচ্ছে জাগেনি, সালাম দিইনি। তিনি হয়তো কোনোদিন ব্যাপারটি টের পাননি; কিংবা সে বোধ ওনার ছিল না যে, একটি শিশুও কতো গভীরে তার দুঃখ পুষে বড় হয়। স্যার একদিন চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং আমাকে খবর দিয়েছিলেন। আমি দেখতে গিয়েছিলাম, কর্তব্যরত চিকিৎসককে যত্ন নেবার অনুরোধ করলাম। সবকিছুর খোঁজখবরও নিলাম। কিন্তু কোথা থেকে যেন শ্রদ্ধার তারটি ছিড়ে গেছে। আমাদের যেসব শিক্ষক এধরনের অপকর্ম করেন, তারা কি ছাত্রদের চিত্তজয় বা সম্মানের চেয়ে অর্থবিত্তের পেছনেই বেশি ঘুরে বেড়াবেন? আবার চিত্তের উদার মুক্তির জন্যে সামান্য যে বিত্তের প্রয়োজন তা যদি বেতন কাঠামো থেকে না জোটে, কিছু শিক্ষক তো বাঁকা পথে হাঁটবেনই, এতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে, আমার শৈশবের সেই যন্ত্রণাবোধ যা এখনও মাঝেমধ্যে আমাকে অস্থির করে তোলে, সেরকম কতো ছাত্রের জীবন শিক্ষকের অবহেলায় বিপর্যস্ত হয়, তার একটা সমাধান তো দরকার।
যতদূর মনে পড়ে ঊষা দিদি নামে একজন এবং রুবি আপা নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। কাজী স্যার নামে একজন স্যারও ছিলেন। তবে ভর্তি হবার সময় যিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তাঁর নাম ভুলে গিয়েছিলাম। তিনি সম্প্রতি আমাদের গলিতে যখন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করলেন, তখন আমি চিনতে পেরেছিলাম— পাড়ার লোকের কাছে সাত্তার মাস্টার নামে পরিচিত। তাঁর এক কানে একটি রিং পরার ছিদ্র ছিলো, যা তাঁকে আজীবন মনে রাখতে সাহায্য করেছে। পরবর্তীতে তিনি মুসলিম হাই স্কুলে চলে যান এবং সেখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। আমি নিজেই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি আবুল কাসেম ইশকুলের হেড স্যার ছিলেন কি না। এভাবে নতুন করে পরিচয়ে নতুন বন্ধনের সৃষ্টি হয়। আমার আব্বার সাথে তিনি মসজিদের নিত্য সহচর হয়ে ওঠেন, ঈষৎ বন্ধুত্বেরও আভাস দেখেছিলাম।
আমরা যখন সম্ভবত দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র, তখন ইশকুলে দুধ পাউডার দেওয়া হতো। হেড স্যার নিজ হাতে দিতেন। প্রথম দিন যখন দিলো, সেদিন আমি কোনো পাত্র নিইনি বলে শুধু দু’হাতের মধ্যে যতোটুকু আঁটে ততোটুকু দুধ পাউডার পাই। সারামুখে খাওয়া দুধ পাউডারের অবশেষ লাগিয়ে ঘরে যখন ফিরেছি, তখন আম্মা আমাকে দেখে খুব হেসেছিলেন। পরের দিন, আম্মাকে অনেক অনুরোধ করে একটা ছোট্ট পাত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই পাত্র ভরে দুধ পাউডার নিয়ে ফেরার সময় অল্প অল্প মুখে দিয়ে খেতে খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আর মনে মনে খুব দুঃখবোধ এসে গ্রাস করছিলো যে আরেকটু বড় পাত্র নিলে আরও বেশি দুধ পাউডার আনতে পারতাম। পরের দিন আরও বড় পাত্র নিয়ে গিয়েছিলাম কি না আজ মনে পড়ছে না। তবে, সম্ভবত চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় নতুন হেডমাস্টার আসেন; তাঁর নাম নিতাই স্যার। নিতাইয়ের পরে কি দাস? না কি শর্মা লেখা ছিল? সম্ভবত শর্মা। নিতাই স্যারের মেয়েও আমাদের সাথে পড়তো। তিন অক্ষরের নাম, কিন্তু নাম ভুলে গেছি। আমার বউ হয়তো সত্যি অভিযোগই করেন যে, আমি বিন্দুমাত্র রোমান্টিক নই। যদি হতাম, নিশ্চয় ক্লাসের মেয়েদের নাম এভাবে ভুলে যেতাম না। তবে, একজনের নাম আমি হয়তো ভুলিনি। তার নাম শীলা। শীলাকে তার রূপমুগ্ধ হয়ে মনে রাখিনি। মনে আছে কারণ, এই নামটির সাথে অপমানের স্মৃতি এখনও খোঁচায়। তখন সম্ভবত আমি ক্লাস টু’তে উঠেছি। রেজাল্টও ভাল, ২য় হয়েছি। প্রথম হয়েছিলো মৃত্যুঞ্জয়। যদিও সে মৃত্যুকে জয় করতে পারেনি। আমাদের মধ্যে সবার আগেই ঝরে গিয়েছিল। ওর কথা পরে বলছি।
(প্রাথমিক রচনা : ১১ মে ২০২০ রাত ১২:২০। পরিমার্জন : ১১ আগস্ট ২০২০)
আমি ঘোর কাটাতে পারছি না, মনে হচ্ছে সব ছবির মতো চোখের সামনে ভাসছে। কি স্বাদু গদ্য আর কি চমৎকার লেখনী। কবিকে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন