কবি উৎপলকুমার বসু আমার প্রিয় কবি। বোধ করি সবচেয়ে প্রিয় কবি! মনে পড়ে ২০০৩ কী ২০০৪ সালে আমি প্রথম তাঁর লেখা পড়ি। লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণই আলাদা। আমার বার বার মনে হচ্ছিল কবিতা যেন কথা বলছে। মনে হচ্ছিল উৎপল আমার সামনে বসে কথাগুলো বলছে। এই যে কবিতার সাথে একটা সংযোগ এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সত্যি বলতে কী এর আগে কখনোই আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। বহুবার এমন হয়েছে যে. একটা কবিতাই আমি বারবার পড়ছি কিন্তু ক্লান্তি আসেনি। তার কারণ অনেক পড়ে এসে মনে হয়েছে—তার কথা বলার মতো ভঙ্গি। আরেকটা গভীর বিষয় লক্ষ্য করেছি তাঁর লেখায় সমাজ মনষ্কতা। কী নেই তাঁর লেখায়? গভীর অনুরাগ থেকে শুরু করে সমাজের সবচেয়ে কদাকার রূপটি পর্যন্ত কবিতায় এমন ভাস্বর এবং তা কবিতার ছন্দ, অনুপ্রাস, আকাঙ্ক্ষা , উৎপ্রেক্ষা সবকিছু ঠিক রেখেই। আরেকটা বিষয় দ্যাখেছি, অনেক জটিল শব্দ, নিমেষেই কবিতায় ফোঁটার মতো ব্যবহার করতে। এটা ভীষণ শক্তি। একটা শব্দ যে ভার বহন করে (অর্থ বোঝাতে) তা অন্য আরেকটা শব্দ দিয়ে কখনোই প্রতিস্থাপন করা যায় না। ঠিক ওই শব্দটি কবিতায় ব্যবহার করার জন্য অনেক সাধনা লাগে। পরিপূর্ণ কবি হয়ে ওঠা—শব্দের সাথে শব্দের বিশ্বরূপ নির্মাণ—যেন এক অসমাপ্ত গান, বার বার বেজে ওঠে। প্রতিনিয়ত উৎপল যেন তার চারপাশের জগতকে শব্দের রূপ দিয়ে যাচ্ছে। পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে যেন এক সিনে রিল। প্রায়শই তাঁর কবিতা আমাকে দৃশ্যরূপে নিয়ে যায়। আমি যেন দেখতে পাই—ভাবনায় অতি সুক্ষ্মভাবে তা স্থায়ী হয়। অবলীলায় লিখতে পারে—
আমার চেতনা শুধু শব্দের করস্পর্শে ভেঙে যায়।অথবা তাকেই আমি খুঁড়ে ফেলি যেন উদ্বেলিতছায়া-গন্ধ-ঝরা গাছ খুঁড়ে ফেলে বীজের আশায়সূর্যের আন্দোলনে মাঠে মাঠে যা-কিছু নিহিত।এ-শ্রমের অন্ত কবে? শুরু বা কোথায়? পূর্ণপুরুষেরমতো প্রেমে অবরোহ কবে যা গিয়েছে জানাঅর্ধেক উদর তার—বাকি সব লজ্জারুণ ঘের,যৌনপ্রহারের শব্দ নিশীথের অন্ধকারে টানা।(দুঃসময়)
কতটা সাবলীল শব্দ ব্যবহার আর বাস্তবতা কবিতায় তুলে ধরতে। এটাই কবির গভীরতা। কবি তার বেদনা-আশঙ্কা তুলে ধরছে, যেন নিজেকেই ছিঁড়ে ফেলছে! “আমার চেতনা শুধু শব্দের করস্পর্শে ভেঙে যায়।”- এতো মহৎ হতে পারে অভিব্যক্তি! প্রথাগত শব্দ ব্যবহার না করেও কত সহজে সংযোগ করতে পারে। সকল প্রকরণ ও শব্দের কারসাজি উৎপল-এর কাছে এসে নত হয়। জীবনকে দেখার এক অতি মানবিক দৃষ্টি তাঁর ভেতরে যেন বয়ে গ্যাছে অবিরাম। প্রতিটি কবিতায় উৎপল যেন নতুন করে ভাবায়। কবিতায় এমন সামর্থ্য আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে বিরল। এতো এতো দীর্ঘ কবিতা উৎপল লিখেছেন, কিন্তু কখনো মনে হয়নি পুনরুক্তি করছেন। এটাই আমাকে তার কবিতার প্রতি আমার অনুরাগী করে তুলেছে, মগ্ন করেছে।
না হয় জালের ফাঁকে জেগে ওঠো কালো স্থপতিরবিষাদকরুণমাখা ভাঙা হাতিয়ার আর লোহার তর্জনী,না হয় জালের ফাঁকে জেগে ওঠো গতি-অগতিরআত্মশাসনমুক্ত লোভে ছেঁড়া দ্রৌপদীর বেণী।ধৈর্য্যই আমার নাম—চতুর্দিকে তুলেছে দেয়াল,যখন আঘাত এসে পড়ে শুধু শব্দের-ক্ষতির।(দুঃসময়)
মন্তব্য