পাবে আমাকেও। বাদার জঙ্গলেএক পোর্তুগিজ অশ্বতর তোমাকে দেখাবেআমি ও হেঁতাল কাঁটা ও-পশুর মাংসে বিঁধে আছি।লৌহকণার গান শুনে যাও। শ্বেতকণিকার ক্ষিপ্ত নৃশংসতা শোনো।বিষণ্ণ যার চোখ নেই, বৃদ্ধি আছে, খসে-পড়া আছে,নেই ত্বক, শুধু ঝুলন্ত প্রদর আছে, পুঁজ আছে,এঁকে নমস্কার করো।(উৎপলের কাব্য-সংগ্রহের ‘ভূমিকা’)
উৎপলকুমার বসু কবি, অনেকে হাংরি জেনারেশানের সাথে তার নিজস্বতাকে মেলাতে চাইলেও তিনি ঠিক সেই ধাতের যে ছিলেন না তা পরবর্তীতে কবিতাতেই তিনি বোঝাতে পেরেছেন পাঠক হিসেবে এ-ই অভিমত আমার একান্ত। তিনি কি ছিলেন এই প্রশ্নের সমকোণে আদৃত প্রশ্নটি হলো তিনি কি ছিলেন না।
সিন্ধু জনপদে বিস্মৃত প্রেম নিয়ে যেই উৎপল কাতর হন ভারতবর্ষে বসে, সেই একই উৎপল ছবি আঁকতে আঁকতে কবিতার ভিতর দিয়ে লোকসমাজ হতে মুচকি হেসে মহাভারতে চলে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে, এ-ই বাকবিভূতিকে অভূতপূর্বই বলতে হবে বাংলা কবিতার প্রেক্ষিতে। জীবনানন্দের একক জৈবনিক বোধের সারাংশ যেমন নয় বিনয়ের একাকীত্বের পরাকাষ্ঠাকেও তেমন দরকার পড়েনি উৎপলের। উৎপল বরাবরই অলরাউন্ডার, বাংলা কবিতার অলরাউন্ডার, একই সময়ে আল মাহমুদের লৌকিক রোদ- রাহমানের নাগরিক ইল্যুশন- সুনীলের রোমান্টিসিজম-শক্তির উন্মাদনা সবকিছুকেই এনগালফ করে কবিতাকে দিয়ে গেছেন বিশ্বকৃতি, সেই দিক দিয়ে বাংলাদেশের মান্নান সৈয়দের কবিত্বশক্তির সমান্তরালে লিখে গেছেন এই ম্যাজিশিয়ান। পুরি সিরিজ থেকে সলমা জরির কাজ বা সুখ দুঃখের সাথী- যেখানেই যাব আমরা উৎপলের কবিতায় পাবো সমগ্র ভারতবর্ষের মুখ। ইতিহাস আর স্মৃতি একজন মহৎ কবির টু দি পয়েন্ট টুলস, উৎপল এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইউজ দেখিয়ে যেতে পেরেছেন কবিতায়, যা তাকে অনন্য করেছে।
কবি একটা পূর্ণ জীবন নিজের খেয়ালে কাটিয়ে দেবার পর তাঁর ব্যক্তিক অভিরুচির প্রসঙ্গকে তাঁর কবিতারাই নেগোশিয়েট করে আসলে। কোথাও উৎপল বলেছিলেন ‘কবিতা জীবনের অংশ, কবিতাই জীবনের সর্বস্ব নয়’, তো এই দিক থেকে এই কবিকে একই সাথে নিবিড় পাঠক, মনোযোগী দর্শক, ভাবুকবৃত্তি তাড়িত হিসেবে তাঁর কবিতাতেই পেয়ে যাই আমরা। এইটা গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার খাতিরে একটা কাঠখোট্টা বা গুরুগম্ভীর বা শো অফ জাতীয় মঞ্চপ্রীতি এড়িয়ে যথারীতি সাবলীল ব্যক্তিজীবন তিনি কাটিয়ে গিয়েছেন। ইউরোপে কিছুদিন থাকার সুবাদে নিজের কবিতাকে ইউরোপীয় ধাঁচ দেবার শৃঙ্খল থেকে সজ্ঞানে মুক্ত ছিলেন, এই একটি কবির সাথে দেখা না হবার আক্ষেপ আমাকে মরমে মারবে আমৃত্যু।
আমার লেখায় আপনি দেখবেন যে কনটেন্ট-সচেতনতার চেয়ে ফর্ম-সচেতনতাটা বেশি। আমি ফর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। সেটা হয়তো এ কারণেই যে লেখায় আমি কনটেন্ট-এর দিক থেকে আসিনি, এসেছি ফর্মের দিক থেকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত একটা লেখাকে আমি ভিসুয়ালাইজ করতে পারি যে পাতায় কেমন দেখাবে, ছাপায় কেমন দেখাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার নিজের পক্ষে লেখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
এক জায়গায় উৎপল এ কথা বলেছেনও, মূলত ছবি আকারে অক্ষর সন্নিবেশ উৎপলের একটা রোমান্টিক গেম ছিলো, ফর্ম বা আঙ্গিক বা ফ্রেম তাক করে অক্ষর সাজানোর কাজটাই তাঁর কবিতার খেলা আছিলো তাঁর নিজ ভাষ্যে। আবার এও সত্য যে আধুনিক কবিতাকলা সম্পর্কে মিনিমাম ধারণা না থাকলে উৎপলের কবিতায় প্রবেশ সহজ কম্মো নয়। এই এক কবি যিনি একাধারে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের বাঙালি কবি। তাঁর সময়ে বাংলাদেশে আল মাহমুদ-শামসুর রাহমান-সৈয়দ হক যেখানে জাতীয়তাবাদের সংস্কৃতিতে সিদ্ধহস্ত তখন এখানকারই মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হকের সমান্তরালে তিনি আন্তর্জাতিক। খুব কম বলা হলো আসলে। তবে কিছু সূত্রপাত রেখে যাবার ইচ্ছা হেতু এই অব্দি থামা যায়ই আজ।
মন্তব্য