মেয়েটি স্নব খুব। কথা বললেও সহজে উত্তর দেয় না। সারাক্ষণ নিজেকে নিয়েই মত্ত। উদ্ধত গ্রীবা আর কাজলকালো চোখ দু’টোর ভেতরেই এক অদ্ভুত নার্সিসিজম। ঘুরে ফিরে নিজেতেই মগ্ন। বহির্জগৎ পাত্তা পায় না তার কাছে। তবে তুই কেন ফিরে ফিরে যাস তার কাছে? তুই কি বুঝতে পারিস ওকে? ওই অচেনা মায়াকাজল তোকে কোন সিন্ধুতরঙ্গের ইশারায় মুগ্ধ করে রাখে? পরিচিত বৃত্তের এই সব নানাবিধ প্রশ্নাবলীর উত্তরে আমি শুধু এটুকু বলে উঠতে পারি, ওই রহস্যময়তা ওই আলোআঁধারি ওই আপাত দুর্বোধ্যতা আমার ভালো লাগে। আমাকে আকৃষ্ট করে এক চিরন্তন দুর্নিবার টানে। নিরাপদ হৃদয় ওই সব সমূহ বিপন্নতা, মায়ারাত্রির কলরোল থেকে মুক্ত রাখে আমায়। গুহাসঙ্কেতলিপির সেই পূর্বলিখিত রৌদ্রকুচির মতো আলো আমাদের নিয়তিতাড়িত জীবনে সেই স্নব মেয়েটি এক অমোঘ আকর্ষণে অন্যতর অভিজ্ঞতাবাহিত সকালের মতো উজ্জ্বল। আমি ফিরে আসি বইয়ের তাকে। একটি-দুটি কৃশ গ্রন্থ, মহান গ্রন্থরাশির পাশে রেখে লবণাক্ত সিন্ধুতরঙ্গের পরাক্রমী আঘাত থেকে নিজেকে আড়াল করি। পরক্ষণেই চিৎসাঁতারে, ভাসিয়ে দিই নিজেকে ওই দুর্নিবার ঢেউয়ে, স্রোতে, হীরাকুচিময় ফেনায়।
পাতালসিন্ধু থেকে উঠে আসে জলদেবী৷ ত্রিচূড় মুকুট তারআলোকফলনে জ্বলমান৷ যেন ভোর হল৷ অপেক্ষায় থেকে থেকেডুবে গেছে ত্রিযামা রাত্রির তারা৷ আকাশ নির্মল৷ আমিও কিকারো অপেক্ষায় আছি? দিন শুরু হল--- এই কি যথেষ্ট নয়?(সৌরলতা)
যখন রাগ বিরক্তি কান্না হিংসা অভিমান অভিযোগ দুঃখ অনুযোগ হাসিঠাট্টার কফি-সিগারেটের কল্লোলিত ধূম থেকে, আড্ডার শশব্যস্ত স্তূপ থেকে ক্রমশ ছিটকে গিয়ে হয়ে যাচ্ছি একা, পড়ন্ত বিকেলের তামাকভারি কমে আসা আলোয় প্রস্তুতিবিহীন কেরিয়ার-চিন্তা আমাদের এক একটা বিচ্ছিন্ন মায়াবী দ্বীপের মতো বন্ধ করে রাখছে ছোটো ছোটো টেবিলের ভিড়ে, ওই সব দিনে, আশ্চর্য, প্রিয়তম অ্যান্থেমের মতো, মন্ত্রোচ্চারণের মতো, বাল্যকাল পেরনো কতিপয় সদ্যকিশোর সমস্বরে, উচ্চারণ করতো সেই পংক্তিগুলি, তাদের অন্তর্গত সম, যতি ও শূন্যতাকে মান্য করে।
যতদিন কালুবাবু জীবিত আছেন চিন্তা নেই বুঝে নেব রক্তকরবীকখনো না কখনো নিচু গলায় ওঁকেই বলতে শুনবো ধন্যবাদ আজহস্তচালিত প্রাণ তাঁত সেই আধোজাগ্রত মেশিনলুম আমাদের হুর রেআজ গন্ধক মেশানো জলে স্নান করে জেলঘুঘুদের আত্মা
অথবা,
নিরক্ষর বেশ্যাদের চিঠিগুলি লিখে দিচ্ছি এই ফাঁকা তেষট্টিতে, মরিয়ম তোমার বাগানে, তোমাদের কার্পাসবাগানে, ঈশ্বরপ্রদত্ত গাধা চরছে একাই, নিরক্ষর বেশ্যাদের চিঠিগুলি আমি লিখে দিচ্ছি অতিপুরাতন বাবু ও দালাল ছাড়া এই ফাঁকা তেষট্টির খেতজাঙালের পাশে আমার হাস্যকর পাঠপ্রচেষ্টার খেলা আর কেউ দেখছে কি আমার দ্বিধাবিভক্তির টান আর কেউ বুঝে ফেলছে না তো, মরিয়ম, ভোরবেলা জানালার পাশে শুনি রাজহাঁস ডাকছে নালায়, শাদা আমার চাদর দেখে রাজহাঁস খুঁটে দেখছে নিজের পালক, কার্পাসবাগানে ঈশ্বরপ্রদত্ত গাধা চরছে অমনই, আমার দু’খানিই পা ক্রমশই বিদ্যুৎলতায় জড়িয়ে পড়ছে এবং চকিতে আমি দেখে নিচ্ছি ঐ অধিদেবতার মল পড়ে আছে বনে, পুরুষেরই মতো ওরা পুনর্জন্মভীরু তবু পুনর্জন্ম নয় আমি ব্যক্তিগত প্রেত দেখে কেঁপে উঠি স্বপ্নে, নালায়...
এবং
দূরবীক্ষণ তুমি, চেয়ে আছ, ঝঞ্ঝার মেঘে, ঐ নিলীমাবিথারেসমস্ত সন্ধ্যা ভরে লুব্ধকের পিছু পিছু আরো বহু তারা---বনকুকুরের সারি জঙ্গলের মর্মে ছুটে চলে---সমস্ত সন্ধ্যা ভরে লুব্ধকের পিছু পিছু দেখা যায় সমুদ্রমন্দিরটানো তুমি, এখন সন্ধ্যা ভরে অদ্ভুত জোয়ার এল, বসন্তও সমাগত ঐতোমার বিশাল বাড়ি ভেঙে ফেলে লাখো লাখো জানালা উঠেছেবসন্তকর্ণিক হাতে কারিগর পুরুষ এনেছি।(পুরী সিরিজ)
এইসব অন্তর্বর্তীকালীন অন্বেষা ও আত্মক্ষয় ক্রমাগত ঠাহর করতে করতে দেখি আলোবাতাসের অনিবার্য ঘনিষ্ঠতার নিরাপদ দূরত্ব থেকে চেনা বৃত্তের অপর পৃষ্ঠা থেকে উচ্চারিত এক অন্তর্গত বাকরীতি, তাঁর নিজের কথায়, ‘লিখনভঙ্গিমা’, তাঁকে ক্রমাগত করে তুলেছে পৃথক, আলাদা। অথচ তাঁর, উৎপলকুমার বসুর এই নিভৃত ভ্রমণপথে সঙ্গী ছিলেন আরও দুইজন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিনয় মজুমদার। যাপনের বিড়ম্বনার চেয়েও দুই সুউচ্চ শিখরের মধ্যবর্তী উপত্যকায় দুপুরের প্রবল রৌদ্রের মধ্যেই, রৌদ্রালোকের আলোকিত বাস্তবের প্রচ্ছন্ন দৃশ্যমানতার মধ্যেই প্রবল বৃষ্টিধারার আচমকা প্রপাতময়তার মতোই সেই লিখনভঙ্গিমা নিজেকে পৃথক করেছে। এই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ উচ্চারণ প্রক্রিয়ায় অঘোর চিন্তন ও চেতনার সঙ্গে ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা ও তত্ত্বের নানান অভিজ্ঞান যুক্ত হয়েছে। জীবনানন্দ, কমলকুমার (মজুমদার), এমনকী রবীন্দ্রনাথও রাতচটি পায়ে এসে দাঁড়ালেন সেই নাতিদীর্ঘ ঝুলবারান্দায়। বিস্মিত আবেগ নিয়ে অনুজ প্রজন্মেরা খুঁজে ফিরে দেখে ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’, ‘পুরী সিরিজ’, ‘আবার পুরী সিরিজ’, ‘লোচনদাস কারিগর’, ‘নাইটস্কুল’, ‘মীনযুদ্ধ’, ‘টুসু আমার চিন্তামণি’, ‘সুখ-দুঃখের সাথী’, ‘সৌরলতা’ প্রভৃতি আপাত কৃশকায় গ্রন্থাবলী৷ অনতি উচ্চকিত এক স্বপ্নময় ঘোরের মধ্যেই যেন এক অদ্ভুত মোহগ্রস্ততা। অসম্পূর্ণ নার্সিসিজম্নী। লিমাবিস্তারী সেই অনন্তের মুখোমুখি এক ব্যক্তিগত মগ্নচৈতন্য, সংক্রামক ও ভয়ঙ্কর রকম প্রভাবশালী৷ এই কী সেই আলেখ্যের ভাষা! এই কী সেই উদ্ধতগ্রীবা ও কাজলকালো চোখের সিন্ধুতরঙ্গের লবণাক্ত ইশারা! নিরন্তর নিয়তিতাড়িত এই কলোনিজীবনে উৎপলকুমার বসুর এই লিখনপ্রক্রিয়া আমাদের কাছে ঘাসের জঙ্গলে পড়ে থাকা সেই ‘ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি’। কারণ, আমরা, তাঁর কবিতার পাঠকেরা শুধুমাত্র এই কথাটুকুই বুঝতে চেয়েছিলাম, দীর্ঘকালীন নিদ্রাহীনতার পরই ধূসর জলের পাশে ফিরে আসে যৌবন, কার্নিভাল, ‘সৌরভের, নিষেধের’, আর ‘বসন্তকর্ণিক হাতে কারিগর পুরুষ’, যে সদ্য এসেছে, সে-ও জানে, ‘এখন সন্ধ্যা ভরে অদ্ভুত জোয়ার এল, বসন্তও সমাগত ঐ’, দ্রুত হাতে সর্বজ্ঞ মেধাবীর মতো অপ্রেম সরিয়ে এসে দাঁড়াতে হবে সেই নির্জনতার কাছেই।
আমি জলের ভিতর ডুব দিয়ে যে-সব মাছগুলিকে দেখতে পাইতাদের নাম জানি না--- কিন্তু জানি তুমি বহুদিন দেশ ছেড়ে চলে গেছজলের উপর ঝরছে পাতা--- তার উপর ভাসছে মাছ--- তার উপরে উড়ছে নিশাননিঃসঙ্গতায় এবং তোমার অনুপস্থিতির সুযোগে।
‘খণ্ড বৈচিত্র্যের দিন’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখে রাখলেন উৎপল এই কথাগুলি৷ বিষাদময় এবং অনাড়ম্বর। বাস্তব আর কল্পনার এক অনন্য মিশেল স্পন্দিত তাঁর চেতনায়। এই বস্তুজগৎ, তার অন্তর্গত পর্যবেক্ষণ একটা অপর দৃষ্টিকোণ তাঁর চেতনা ও চিন্তনকে দাঁড় করিয়েছে। শব্দচয়ন আর নির্মিত কল্পলোক, যা আপাত আচ্ছন্ন এবং রহস্যময়--- তাঁর কবিতার প্রকৃত বুনন৷ দ্বিধাহীন উচ্চারণে অসামান্য সব ইমেজারির ক্রম-ব্যবহার চিরন্তন পুরাণ ও ইতিহাসচেতনার বিপ্রতীপে সমাজ সংক্রান্ত নানা বিষয়ও তাঁর কবিতায় খুব স্বভাবগত ও প্রাসঙ্গিক কারণেই একাত্ম হয়েছে। শব্দচয়ন ও প্রয়োগের পরিশীলিত যে-সংযম ওই ‘লোকমাতা দেবী’ ছদ্মনামে লেখা কলামগুলি থেকে প্রথম কৈশোরে আমাদের সংক্রামিত করছিল, ওই ‘কুয়োতলা’ থেকেই তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয়। কবিতায় এক ভিন্নতর চিন্তন, ভাষাবিন্যাসে ব্যাপ্ত আন্তর্জাতিকাবোধ, কখন যেন তথাকথিত লৌকিক ও অ-লৌকিকের গণ্ডি পেরিয়ে যায়। খররৌদ্রের গ্রীষ্মদুপুর অথবা শীতার্ত মধ্যরাতে অঝোর ধারাপাতের ব্যক্তিগত বন্দিদশার অনন্ত স্তব্ধতা এসে স্পর্শ করে নিরাপদ আড্ডাময় ওই লিখনভঙ্গিমাকে।
সমূহ তখনও পর্যবেক্ষণে। নানাবিধ নতুনত্ব ও মৌলিকতা অন্বেষণের অর্জিত আর্তি তাঁকে, উৎপলকুমারকে, অংশত আচ্ছন্ন রেখেছে আজীবন। জটিল জিজ্ঞাসা থেকে হাসি-ঠাট্টা এমনকী আশ্চর্য কৌতুক শেষাবধি তাঁর লেখার পরতে পরতে। ওই গমকের জটিল প্রাবল্যের মতোই সেটুকু পেরোতে পারলেই পরমানন্দ।
১.
এখনো জাগিনি যেন ঘুম থেকে--- এখনো চাটছি ঘুমের মাংসখন্ড,বুঝি এ-শ্বাপদ চিরদিন ক্ষুধার্তই রয়ে যাবে সামান্য নিদ্রার জন্য৷দু-থাবায় জড়িয়ে ধরবে শত্রু নিদ্রাহাড়--- দুপুরে গাছের ছায়ায় বসেঝিমোবে অনন্তকাল--- কখনো কখনো জেগে উঠবে কবিতা লেখায়---স্বপ্নাকুল নিদ্রাহীনতায়।(সুখ-দুঃখের সাথী)
২.
সামুদ্রিক মফস্বলে ফিরে চলো। সস্তা ও কোমলতরিতরকারিময় ঐ দেশে। গাছের ছায়ায় বসে ভেবো এই।তোমার তর্জনী ধরে এরো বেশি যাওয়া যাবে, শিশুর তর্জনীআরো দূরে টেনে নাও, এমন-কি যে-দেশে এবারঅনাবৃষ্টি, অসম্ভব মহামারী, বেকারবিপ্লব,চাষীদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাদ্যরত রাজনীতিজ্ঞের দলেভিড়ে যাই, চলো, সময় বড়ই অল্প, তা’ছাড়া যত দিন যায়সময় ক্ষুদ্রতর, সে বামন, লাফিয়ে পিঠেরউপরে আরূঢ় হই, চলো, নইলে অনেক ছোট, মূর্খ ম্লান হয়েযাবে সে-ও। বামন ঘোড়ার পিঠে ন্যস্ত হয়ে কবিতার ব্যখ্যা চেয়ো নাসস্তা ও কোমল তরিতরকারিময় দেশে ভালমন্দ খাও দাওতোমার পিছনে কোনো গোয়েন্দার চোখ নেই। শুধু কবিতারযে-কোনো ব্যবস্থা তুমি করে যাও। অন্তত এসব লেখাব্যবহারযোগ্য কিনা, বসবাসযোগ্য কিনা, না জানালেকৌতূহল থেকে যায়। না হয় মফস্বলে সামুদ্রিকমাছের সম্পাদনা তুমি কোরো। আমার ঘোড়াটি চাই।(পুরী সিরিজ)
১৯৬৪-তে প্রকাশিত ‘পুরী সিরিজ’ কাব্যগ্রন্থের ৮নং কবিতা উপরে উদ্ধৃত দ্বিতীয় কবিতাটি। এই কবিতাটি পড়বার পাশাপাশি উৎপলকুমারের বহুচর্চিত তৎকালীন জীবনপ্রণালীর দিকে একটু ফ্ল্যাশব্যাক জরুরি। অনুসন্ধিৎসু পাঠক জানেন, লেখালেখির শুরুর পর্যায়ে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সঙ্গে উৎপলকুমারের যোগ, ফলশ্রুতিতে কলেজের চাকরি খোয়ানো এবং পারীতে বন্ধু শিল্পী যোগেন চৌধুরীর কাছে চলে যাওযা। পরবর্তীতে সস্ত্রীক লণ্ডনে পড়ানোর চাকরি নিয়ে থিতু হওয়া এবং বাংলা কবিতা থেকে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। যদিও এই দীর্ঘকালীন বিদেশযাপন পর্বেই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিনি বুকের জন্য গদ্যরচনা এবং ১৯৭০-এ প্রথম গদ্যগ্রন্থ মিনি বুক ‘নরখাদক’ প্রকাশ। এইসব তথ্য পাঠকের জানা। তবু এইখানে এই কয়েকটি কথা উল্লেখের কারণ প্রেক্ষিতটা বুঝবার জন্য। ১০ জুলাই ১৯৭০-এ উৎপল লন্ডন থেকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতে লিখেছেন: ‘... আমেরিকায় অ্যালেনদের (অ্যালেন গিন্সবার্গ) ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ফ্লপ করেছে।’ অথবা, ‘আপনার (সন্দীপনের) আনন্দবাজারে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে--- এটা ভালো খবর।’ এই মন্তব্যগুলি থেকে বোঝা যায় কেন তিনি লিখছেন, ‘...বামন ঘোড়ার পিঠে ন্যস্ত হয়ে কবিতার ব্যাখ্যা চেয়ো না / সস্তা ও কোমল তরিতরকারিময় দেশে ভালোমন্দ খাও দাও / তোমার পিছনে কোনো গোয়েন্দার চোখ নেই৷’ অথবা, ‘অন্তত এসব লেখা / ব্যবহারযোগ্য কিনা, বসবাসযোগ্য কি না, না জানালে / কৌতূহল থেকে যায়।’ প্রসঙ্গত, ‘আবার পুরী সিরিজ’ কবিতাগ্রন্থটি উৎপল উৎসর্গ করছেন, ‘পরবর্তী নতুন কবিকে’। এই বাক্যবন্ধে ‘পরবর্তী’ এবং ‘নতুন’ এই শব্দদুটি বিশেষভাবে দ্যোতনাময়।
কেবল পাতার শব্দে আমি কাল জেগেছি সন্ত্রাসে।ভেবেছি সমস্ত দিন এত লেখা, এত প্রশ্ন, এ-কথনতারও পিছে কোটি কোটি চিহ্ণ-তীর শস্যের শিখরেউঠেছে চাষের গান, স্বপ্নে দেখা মায়ের মতন।আজ বসে আছি ভোরবেলা রৌদ্র ও হিমসকালেরআবরণ উদ্ঘাটনে। এ-প্রহর বাজে না চকিতেকেবলই বুকের তলে ক্ষয়ে যায় অজ্ঞান, অলক্ষ্য যাত্রায়,হলুদ পাতার ঝড়ে, নেমে আসা বাৎসরিক শীতে।অথবা পূর্বে এসে দাঁড়িয়েছি। খামারের লোহার শিকলঅব্যবহৃত তাই খোলে না বা খুলিনি কি ভুলেঅথবা শিশির তাকে এতদূর গ্রাস করে--- দৃষ্টির অতলসীমাহীন কুয়াশায় তেমনই উঠেছ কেউ আমার মতনভয়ে, দুঃখে, মায়ের হাসির শব্দে! দুয়ার না খুলেশুনেছ সমস্ত দিন নীলিমায় গৃধিনীর অনন্ত পতন।’(আবার পুরী সিরিজ, উৎসর্গ কবিতা)
‘সীমাহীন কুয়াশায় তেমনই উঠেছ কেউ আমার মতন’--- অত্যন্ত সচেতন ও সৎ উচ্চারণ৷ ওই পরবর্তী নতুন কবির জন্যই তাঁর যাবতীয় কাব্যযোজনা, আজীবনেব চির-অন্বেষণ। মেধা ও মনন, চেতনা ও চিন্তন কোন লৌকিক থেকে চিরায়ত অব্যবহৃত অ-লৌকিকের দিকে তাঁর সেই অভিযাত্রাকে ঠেলে দেয়, যা এই ‘সস্তা ও কোমল তরিতরকারিময় দেশে’ বিরল! প্রায় একক। কী প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য, নিজেকে নিয়েই তিনি করতেন৷ আদৌ তাঁর সেইসব লেখা ‘ব্যবহারযোগ্য’ অথবা ‘বসবাসযোগ্য’ কিনা নেহাতই কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তা জানা প্রয়োজন৷ কারণ যাবতীয় নির্বাচন, বাছাই, সম্পাদনা পর্ব সকলই অন্যের জন্য। তাঁর, উৎপলকুমারের শুধু, ‘আমার ঘোড়াটি চাই।’
ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি বিখ্যাত কবিতার নাম, ‘Lines written in March’, সকালে ঘুম ভেঙে প্রকৃতির সৌন্দর্যময়তার ঘোরে আবিষ্ট ওয়ার্ডসওয়ার্থীয় উচ্চারণ, 'চৈত্রে রচিত কবিতা'। উৎপলকুমারের এই উচ্চারণও শুধুমাত্র সেই মোহের আবেশ! পাঠক, আপনাকে আরও অনুসন্ধিৎসু হয়ে খুঁজতে হবে সেইসব ইশারা উৎপলকুমারের কবিতায়। কারণ, এই বসন্তও কিন্তু উৎপলকুমার বসুর কবিতায় নানাভাবে এসেছে, নানান সময়ে, ঘুরে ফিরে। এমন অভিযোগও নাকি ছিল, তিনি নিজে লেখার পরিবর্তে বহু বিদেশী কবিতাকে নাকি অনুবাদ করে চলেছেন। এই রকম হাস্যকর অভিযোগের পাশাপাশি তিনি ছন্দ জানেন না বলেও একসময় প্রচার করা হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে তিনি নিজেই কৌতুক করে লিখেছেন অনেকবার। এমনকী কবিতাও।
কবিতায়, আগ্রহাতিশয্যে, আমি আরো অনেকের মতোদু-চারটে ভুল-টুল করে ফেলি৷ ছন্দের ব্যাপারে ততঅবহিত নন উনি--- কোনো মাস্টার বলেছিল।শিক্ষার অভাব আছে--- এমনও শুনেছি। সব কিছুঔদাসীন্যে মেনে নিই। কারণ, সকালে, বাজারের পথে,সব্জির দোকানে, আড়াচোখে লেটুস পাতাটিদেখেছি এবং ভেবেছি যদি ওর মতো লজ্জায়কুঁকড়ে যেতে পারতাম--- জলের অভাবে যদি শুকাতাম---খুঁড়ে নেবার কিছুক্ষণ বাদে যদি বেঁকে যেতাম, ছিঁড়েপড়তাম স্তব্ধতায়, হলুদ-সবুজ স্যালাডের প্লেটে।(সুখ-দুঃখের সাথী)
এবং
ফিরে এসো লেখার টেবিলে। এইখানে জন্মেছিলে৷এখানেই শেষ দেখে যেও।যারা বোধি নিয়ে কথা বলে, বোধবুদ্ধি নিয়েহাসিঠাট্টা করে, তারা হে কেমন লোক?যে-প্রাণ নিভৃত হয় তাকে সখা আমিও দেখছি।লেখার টেবিল যেন, পড়ে আছে ভাঙাচোরা সন্ধ্যার বাগানে।(সৌরলতা)
মনখারাপ করে দেওয়া উপরের এই কবিতাদুটি, এই উচ্চারণ জীবনানন্দের ‘সমারূঢ়’ কবিতাটির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। জীবনানন্দের কবিতাটির মতো একই রকম মানসিক যন্ত্রণা থেকে উচ্চারিত দুটি কবিতাই। ‘সস্তা ও কোমল তরিতরকারিময় দেশে’ এটাই খুব স্বাভাবিক। ওইসব 'ছায়াপিণ্ড'-দের ডিনার প্লেটে মনোমুগ্ধকর স্যালাডের মতো সহজপাচ্য যদি হতো জীবনানন্দ অথবা উতপলের কবিতা! এও যেন এক অস্তিত্ব-নিগ্রহের লড়াই। নিজের বিরুদ্ধে নিজের। যে-কোনও আপোষকে অস্বীকার। কারণ, কবিতার সঙ্গ পাওয়ার জন্যই শেষাবধি পেরিয়ে যায় কতো ঘুমহীন স্বপ্নাকুলতা, ‘কখনো কখনো জেগে উঠবে কবিতা লেখায়’...।
যদিও ওয়ার্ডসওয়র্থের ওই ‘Lines written in March’-এর সঙ্গে উৎপলকুমার বসুর ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’র নামকরণে আমি মিল খুঁজে পাই। এটুকুই। এ-ও হয়তো কবির ‘লিপিকার হয়ে-ওঠার প্রথম সংস্করণ’। প্রথম থেকেই তিনি, উৎপলকুমার বসু, প্রথাগত অথবা বলা ভালো প্রচলিত কাব্য-ধারনার উলটো পথে হাঁটতে চেয়েছেন সচেনতভাবেই। প্রকরণগত ভাবে যে ধারণাটিকে জটিল, দুর্বোধ্য ও রহস্যময় বলে এমনকী তাঁর সমসাময়িক কেউ কেউ আখ্যায়িত করেছেন। অথচ তাঁর আকাঙ্ক্ষিত ওই ‘পরবর্তী নতুন কবি’-রা খুঁজে নিয়ে পড়েছেন তাঁকে, তাঁর বিস্তীর্ণ কবিতাগুচ্ছকে। কবিতা সম্পর্কে তাঁর নিজের ভাবনাটিও এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য, ‘কবিতা, আমরা জানি, কোনও স্বয়ংসম্পূর্ণ বস্তু নয়। কবিতা, পাঠক এবং কবির মধ্যে এক প্রতিক্রিয়া-সৃষ্টিকারী পদ্ধতি। এই পদ্ধতিকেন্দ্রিক চরিত্রের জন্য কবিতায় ব্যাকরণ, শৈলী এবং নশ্বরতা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে, প্রতিক্রিয়ার জন্মদাত্রী বলে কবিতায় প্রাণ আরোপিত হয়। কবিতায় আমরা প্রায়শ শ্বসিত বস্তু বা ‘অরগ্যানিক’ অস্তিত্বের চিহ্ণ দেখে থাকি। এই দুই কেন্দ্র--- অর্থাৎ বস্তু ও প্রাণ, ব্যাকরণ ও বিদ্রোহ, শৈলী ও প্রথামুক্তিকে জুড়ে রয়েছে এক সেতু যার নাম নশ্বরতা। কবিতার মৃত্যু হয়। লুপ্ত হয় তার ভাষা, সংকেত, উপদেশ ও কলাকৈবল্য।’ কী অসম্ভব তীক্ষ্ণ অনুভব আর পর্যবেক্ষণ। শাশ্বত, চিরন্তন, অবিনশ্বরতার কলাকৈবল্যবাদী দাবিকে অসম্ভব মার্জিত ও পরিশীলিত ফুৎকারে এভাবে অস্বীকার উৎপলকুমারের পক্ষেই সম্ভব। ওই স্নব ও জটিল মেয়েটিকেই তাই চাই।
আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, যোগিন্দর, সময় আমার সময় তা কি গাছের মতো, বলতে চাই গাছের কাছে আলাদা এক সময় যেমন নদীর আছে আলাদা এক সময়রেখা যা-কেবলই পারাপারের, যাত্রী জানে, জানে শ্মশানঘাটের ফটোগ্রাফার, আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, আমার সময় মাঝবয়েসী, ক্লান্ত কিছু, চমকে উঠছে নানান ডাকে, সমাজপতি বলছে এসো দু’কথা বলো না-হয় কিছু পাঠ করে যাও, এমনিভাবে সময় আমার মাঝামাঝি সরল একটা পথ চিনে নিক।(তীর্থ, লোচনদাস কারিগর)
মন্তব্য