আমি প্রায়ই দেখতাম তাকে বিমর্ষ মনমরা ঝরে যাওয়া শিউলি ফুলের মতো বসে থাকতো বারান্দায়, চৌপায়া টুলের ওপর- সামনে তার ঠেস দিয়ে হাঁটার চারপেয়ে যন্ত্রটা- ওয়াকিং ফ্রেম; তাও বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতো তার মতোন। সে বসে বসে দেখতো রাস্তার হেঁটে যাওয়া মানুষ অজস্র- হরদম আসে যায়, থামে জুতার ফিতাটা টাইট করে নেয়, বাচ্চারা অবিরাম দৌঁড়ে যায়, রিকশাগুলো তিনপায়ে ধুঁকেধুঁকে চলে মানুষের পায়ের জোরে; সব। হয়তো অবসর হলে রাস্তার কেউ আজব বস্তু দেখবার মতো চোখে তার দিকেও দ্যাখে, সে অনভ্যস্ত চোখে চোখ পড়ায় সরিয়ে নিতো দৃষ্টি- লজ্জ্বা পেতো, অসহায়বোধ করতো, বিরক্তির কোনো চিহ্ন তার মুখেচোখে দেখিনি কোনোদিন।
শুকনো মরশুমে চারপেয়ে যন্ত্রটা সাথে নিয়ে বেরোতে রাস্তায়- ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আহত শাবকের মতো চলতে দেখেছি তাকে। পিচ উঠে গিয়ে নেড়ি কুকুরের অস্বচ্ছন্দ চামড়ার মতো জায়গায় জায়গায় আমাদের সেই রাস্তা- ওইসব জায়গা পেরোতে রীতিমতো ঝক্কি সামলাতে হতো তার- তবু দেখিনি কোনো লোকের সাহায্য চাইতে- কেউ আসেও নি- হয়তো সে চাইতো এতটুকু সময় সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে- বাসার কড়া নজরদারির বাইরে।
বর্ষাকালে মফস্বলি রাস্তায় জল ভরে যেতো, কাদারা গড়াগড়ি করতো- ওয়াকিং ফ্রেমের কার্তুত কাজ করতো না তখন। বাধ্যতামূলক ঘরে থাকতে হতো তার- ফের হাঁসেদের মতো জেগে জেগে ঝিম ধরে চারপেয়ে হাতলওয়ালা যন্ত্রটা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো বারান্দায়- খরার অপেক্ষা; একখানি কাঙ্ক্ষিত খরা ধুলাবালিময়- বারান্দায় বসে বসে পুরো বর্ষাটা- আবার সেই রাস্তার ক্ষতগুলো দেখে দেখে- লোকজন, হল্লা- ছাতাময় ঢেকে যাওয়া মাথাগুলো। লোককে কানাকানি করতে শুনেছি-"বাপটা উকিল, বাপের বেহক পাপের টাকার কারনে একমাত্র ছেলেটার এই দশা; অটিস্টিক"।
দেখতাম এক নাগাড়ে সে একই রকম চেয়ে আছে- একই ঢঙ, রকমফের নেই, কোনো বিশেষ অভিব্যক্তি নেই- কেমন নিষ্প্রাণ, নির্জীব- কাকের নিরব চোখের মতো বিষন্ন কালো ভর করে থাকতে দেখেছি সেই চোখে- মুখময় মাখনের মতো একটা মেলানকোলিক প্রলেপ আলতো লেগে থাকতো পুরো বর্ষা জুড়ে- সারাদিন মনোটোনাস ফোঁটাগুলো টিপটিপ বাজতো তার কানের টিমপ্যানিক পর্দায়। সে তাকিয়ে থাকতো এক নাগাড়ে, তারপর ক্লান্ত হয়ে আবার সেই একই তাকিয়ে থাকা, উপযুক্ত কোনো চাকরি নেই পৃথিবীতে যেন- রাস্তার জমা অপরিচ্ছন্ন জলে ঝুপঝাপ বৃষ্টির ট্রান্সপারেন্ট ফোঁটাগুলো মিলেমিশে ঘোলা হয়ে যায়, রঙ পাল্টায়- ক্যামন অদ্ভুৎ বুদবুদ হয়ে ওঠে, সে বারান্দায় বনসাইয়ের মতো ঠায় বসে থাকে।
তার সামনেই চলে যায় ম্যাদা মারা মেঘলা দুপুর, চলে যেতো বিষন্ন বিকেল আসতো একঘেয়ে রাত্রি। রাত্রি এলে তাকে বাধ্যতামূলক রুমে ঢুকতে হতো, হয়তো বিরক্তি লাগতো তার- রোজকার টিপটপ ঘরটাতে বিশেষ কোনো নতুনত্ব নেই। সেই ছোটবেলা থেকে একটা কামরা কামড়াতে কামড়াতে তাকে গিলে নিচ্ছে যেন। সে নিরব পড়ে থাকতো, তাকিয়ে দেখতো চারপেয়ে যন্ত্রটা, যদি ম্যাজিক রিয়েলিজম এর মতো করে ওয়াকিং ফ্রেম বলে ওঠে কথা- যেটায় ভর দিয়ে ধরে হাঁটতো সে, কখনো কথাও বলেছে তার সাথে, জবাব আশা করেনি। সে প্রার্থনা করতো খরার, হয়তো মৃত্যুরও।
পুনশ্চ - বৃষ্টির ঝিমঝিম শব্দ শুনতে শুনতে ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে রাস্তার হর্নের আওয়াজে জেগে উঠতো পৃথিবীতে, মশারা কানের কাছে গান শোনাতো, পায়ের সংজ্ঞাহীন অংশগুলোয় বসে টিপেটিপে রক্ত চুষে নেয়া, মাছিরা ডানায় দুদুকের গম্ভীর প্যাঁপু তুলে পাক খেতে খেতে এসে বসতো তার তেলচুপচুপ মাথার চুলে , বারান্দার দেয়ালে টিকটিকিটা চকচকে চোখে টিউবলাইট জ্বেলে চেয়ে থাকতো মাঝেমাঝে চুকচুক শব্দ তুলে ধারালো জিহ্বায় -যেন আপসোস! একমনে বহুদিন এই টিকটিকির সংসার দেখেছে সেও- কি আশ্চর্য তাদের মিলন- কি পৌরুষময়! টুটি চেপে ধরে শীতল পিঠ বেয়ে ওঠা, দেখলে নির্মম মনে হবে। কিছুদিন পরে ডিমে পেট ভরে ওঠে মাগীটার- সেদিকে তাকালে চট করে দৌড়ে সরে যায়- কি সতর্ক! সজাগ! এমনই কেটে যায়- গর্ভবতী টিকটিকি ডিম পাড়ে- বাচ্চা ফোটে- বাচ্চারা বড়ো হয়ে ওঠে- তারাও মেতে ওঠে সংগমে, সংসার বেড়ে ওঠে- বর্ষা যায়, শীত আসে, হেমন্তের ম্লান রোদ রূপশালী ধানের শরীরে যেমন শুয়ে পড়ে তেমনি তার চোখের আস্তিনে নরোম হয়ে আসে- খরা আবার চলে আসে- রাস্তাগুলো আবার শুকিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে- আমিও চলে যাই হাইস্কুল থেকে কলেজ; অন্যশহর।
পাঁচ বছর পরঃ
সেবারের বর্ষায় আমি যখন মফস্বলে ফিরলাম- তার বারান্দার সামনে থেকে যেতে বেশ কবার লক্ষ্য করলাম কেউ নেই বারান্দায়, অস্বস্তিবোধ হলো- এই বারান্দায়ই মাছের মতো অবশ ঘোলাচোখে বসে থাকতো সে- একটা উজ্জ্বল টিশার্, ফ্যাকাসে মুখ, চারপেয়ে ওয়াকিং ফ্রেম- কিছুই আসে না চোখে। এক পরিচিতকে ডাকি, জিজ্ঞেস করি, অস্বস্তি লাগছিলো জিজ্ঞেস করতেও- ভাব করি নেহাত কৌতুহলবশত তাই।
সে উত্তর করে- গত বর্ষায় এমন একদিনে তেতলার বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে মরে গ্যাছে ছেলেটা। তাকে ধন্যবাদ দিই, বিদায় জানাই, আমার মনে পড়ে আত্মহত্যা আর্ট, মানুষ আর্টিস্ট এক অথবা পড়ে গিয়েই হয়তো দুর্ঘটনা হবে! যাবার আগে লোকটা বলে- "সবই পাপের ফল, নইলে বাপের এতো টাকা, একটামাত্র ছেলে তাও জন্মপঙ্গু ছিলো"।
আমি আবারো তাকে বিদায় জানাই, সে চলে যায়, বিরক্ত হয়। আমি বারান্দায় উঁকি দিই, তার বিষন্ন ক্লান্ত ওয়াকিং ফ্রেম চোখে পড়ে না, টিকটিকি, মশা-মাছিও না- হঠাৎ তারাও কোথায় যেন উবে গ্যাছে- ন্যাপথার মতো- যেন রুম জুড়ে নিউক্লিয়ার শীতের নিরবতা। হঠাৎ ঝিরিঝিরি বালির মতো অবসন্ন বিকেলের মেঘেরা ষড় করে বৃষ্টি নামে, রাস্তায় ঘোলাজল জমতে শুরু করে। আমি বিষন্ন কালো ছাতাটা খুলে নিই, মাথায় ধরি, তারপর বারান্দার দিকে পাছ ফিরে বাজারের পথ হাঁটি।
মন্তব্য