কোরাকাগজের খেরোখাতা
আমাদের বাসার বর্ণনা আগেই কিছুটা দিয়েছি। সামনে বিশাল উঠান, তবে ডাবল বেডমিন্টন কোর্ট বানাতে সামান্য কারচুপি করতে হয়। আর পেছনের উঠান আরও বড়, গাছপালায় ভরা উঁচু নীচু জমি, তাতে দৌড় ঝাপ বা অন্যরকম কিছু খেলা সম্ভব হলেও ব্যাডমিন্টন খেলা সম্ভব নয়। মাঝখানে পাকাঘর, যা একতলা বানিয়ে ১৯৬৮তে আমরা এখানে পদার্পন করি। কিন্তু পরে ৭৩ সালে ২য় তলা এবং ৭৭/৭৮ সালে ৩য় তলা নির্মিত হয়। শুনেছি বাড়ি উপরে উঠতে উঠতে আমার মা অলঙ্কারহীন হয়ে যায়। আমরা নীচতলাতেই থেকেছি। উপরের ঘরগুলো নির্মাণ শেষে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। বাসার পশ্চিমে একটা চওড়া পথ পেছনের উঠানকে সামনের সাথে যুক্ত করে। আম্মার সাথে বেশি ঘনিষ্ট গৃহকর্মীরা বা সমস্যাজর্জরিত প্রতিবেশিনীরা এই পথ দিয়ে সোজা পেছনের দরজায় গিয়ে আম্মার সাথে সংক্ষেপে গোপনে আলাপ পরামর্শ সেরে নিতো, সাহায্যও তারা পেত সাধ্যমতো। মা বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরেই থাকতেন, তাই পেছনের সেই দরজা সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত খোলা থাকতো। বাসার সামনে বিশাল খোলা বারান্দার সাথে ২টি দরোজা। উত্তরপাশে যে দরজাটি সবসময় খোলা থাকে তাকে আমরা ডাকতাম সামনের দরজা। আর পূর্বপাশের দরজা প্রায়শ: বন্ধ থাকতো, যা দিয়ে ঢুকলেই দক্ষিণ রুম—এতে থাকতেন বড় বাবা আর ছোট বাবা। আমাদের অনেকটা খেলার সময় এখানে কাটতো, বিশেষত ছোটবাবার সাথে। এই রুমে থেকেই আমার এই দুই চাচা তাঁদের পড়ালেখা শেষ করেছিলেন। বড় বাবা কবে তাঁর বিএসসি পাশ করেছিলেন তা আমার মনে নেই। তবে, তিনি পাশ করে স্বাধীন দেশে স্বাধীন জীবন যাপনের লক্ষ্যে ওষুধের দোকানের সাথে যুক্ত হন। কথা ছিল ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে থাকবেন বন্ধুর বিনিয়োগের ওষুধের দোকানে—হাজারী গলিতে ওঁদের বেশ চালু দোকান ছিল। নিজের ব্যবসা মনে করে এই দোকানদারী করে তিনি বেশ রাজসিক জীবন যাপন করতেন। প্রতিদিন গভীর রাতে বেবিট্যাক্সি নিয়ে সোজা গহিরা চলে যেতেন, আবার প্রত্যুষে দোকানে ফিরতেন। পরে অবশ্য বন্ধু তাকে ব্যবসায় কানাকড়িও শেয়ার দেননি এবং একটি দুর্বিসহ জীবনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বড়বাবা গ্রামে চলে যাবার পরে তাই তখন থেকে এই দক্ষিণ রুমটি ছোটবাবার একার দখলে ছিল। মাঝে মাঝে অন্য আত্মীয়রাও রাত্রি যাপন করতেন। সামনের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে একসেট সোফা আর একটি সিঙ্গেল খাট দিয়ে সাজানো ছিমছাম ড্রয়িং রুম। প্রায় ভাবতাম, এই রুমে কি ছবি আঁকতে হয়? নাকি রুমটিকে ছবির মতো রাখতে হয়! তাহলে আমাদের যতোসব খেলনা কোথায় রাখবো! খেলনা বলতে অবশ্য খালি ওষুধের শিশি, স্নো-পাউডারের পরিত্যক্ত ডিব্বা, কদাচিৎ পেয়ে যাওয়া এলুমিনিয়ামের খেলনা ডেকচি ইত্যাদি। ড্রয়িং রুমের উত্তরদিকে বেডরুম বা শোয়ার ঘর, আর পূর্বে ডাইনিং রুম যা আবার ছোটবাবাদের ঘরের সাথেও যুক্ত।ডাইনিং রুমের পরে রান্নাঘর, আর তার পেছনে ছোটবারান্দা। এই ছোটবারান্দা ছিল মোড়াতে বসে বা পিড়িতে বসে গৃহকর্মীদের বা সাহায্যপ্রার্থীদের সাথে আম্মার আলাপ আড্ডার জায়গা। পেছনে কলতলায় হাত পা ধুয়ে ঠিকা গৃহকর্মীরা ঘরে ঢুকতো। আমাদের ঘরে পাঠ্য-বই যেমন খুব বেশী ছিল না, অপাঠ্য অর্থাৎ অকাজের বইও বেশী ছিল না। তাই মায়ের স্মৃতি থেকে অনেক ছড়া আমরা আওড়েছিলাম। একটা ছবিসহ ছড়ার বই ছিল, যাতে পশু প্রাণীদের নাচের ছবি ছিল। একটি পশু বা প্রাণীকে আমি চিনতে পারিনি। তাই দু’ভাইবোন মিলে ছড়া কাটছিলাম—
ঘোড়া নাচে ডিং / হাতী নাচে ডিং / ‘ইবা’ নাচে ডিং
—এই ‘ইবা’ (অর্থাৎ এইটা) বলে তাল মিলিয়ে পড়ে যাওয়ায় আমার মায়ের খুব মজা লেগেছিলো। সেই তখন থেকেই যেকোনো কথায় একটা মিল তৈরি করতে আমার বেশ ভাল লাগতো। আব্বাও তাল মিলিয়ে কথা বলতেন। যেমন লীনাকে পাইপের গলির বাচাইয়া ভয় দেখাতো প্রায়ই। আমিও ভীত হতাম। তখন আব্বা ছড়ার প্যারোডি করে বলতেন “শালিক বলে চড়াই, বাচাইয়া দেখে ডরাই”। লক্ষণীয় যে, ‘চড়ুই’ পাখি অবলীলায় ‘চড়াই’ হয়ে গেল। অবশ্য চাটগাঁইয়া ভাষায় আমরা ‘চরই পাখি’ বলতে অভ্যস্ত।
আব্বার মুখে সম্ভবত বেশী শুনেছি “আগডুম বাগডুম ঘোড়া ডুম সাজে / ঢাক ঢোল ঝাঁঝর বাজে”, আম্মা সকালে “ভোর হোল দোর খোল” সুর করে বলে বলে আমাদের ঘুম ভাঙাতেন, তবে ‘খুকুমনি’ পাল্টে গিয়ে ‘খোকাখুকু’ ওঠ রে বলে যখন শব্দ প্রতিস্থাপন করতেন, তখন বুঝিনি, এখন ভাবি, ছন্দের এই দোলা মানুষের অন্তরের অভ্যন্তরে অন্তর্নিহিত থাকে নিশ্চয়। আম্মা একটা গান খুব গেয়ে শোনাতেন — “প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা”, বিশেষত কোনো প্রজাপতি উড়ে গেলে। আর তখন তো করতেনই, এখনও মুখের সামনে হাত রেখে রেলগাড়ির শব্দ করেন অবিকল সত্যের মতোন——এখনও আমার মেয়েরা আম্মার হাত ও মুখের কারসাজিতে রেলের শব্দ শুনতে চায় এবং অনুকরণ প্রয়াসীও হয়ে পড়ে।
আমার জীবনের প্রথম দিকে একজন গৃহকর্মীর নাম ছিলো সিদ্দিক। কৈশোরটা সে এ ঘরেই কাটিয়ে কিছুটা বড় হতেই জীবন জীবিকা ও মুক্তির সন্ধানে অন্যত্র চলে যায়। তবে সে নিয়মিত আম্মাকে দেখতে আসতো। আমি ডাক্তারি পাশ করার পরেও তাকে বাসায় আসতে দেখেছি। তবে ধীরে ধীরে তার আসার ফ্রিকোয়েন্সি কমতে কমতে কোন্ সময় যে সিদ্দিক আসা বন্ধ করে দিলো, কী হলো, কেমন আছে——কিছুই বুঝতে পারিনি, জানতে পারিনি। আরেকজন গৃহকর্মীর নাম ছিল আলী আহমেদ। তার চেহারা আমার মনে নেই। তবে তার নাম করে আম্মা আমাদের প্রায়শই নাকাল করতেন, ভেঙাতেন। আলী আহমেদ কবে কতদিন কাজে ছিল মনে নেই, জানিও না। শুধু জানতে পারি, সে চলে যাবার সময় আমরা দুভাইবোন গেটের বাইরে এসে যতোক্ষণ তাকে দেখা গিয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে নাকি বলে গিয়েছিলাম “আলী আহমেদ আসসালামালাইকুম”। আলী আহমেদ আর ফেরেনি। কিন্তু কথা থেকে যায়। এখনও কাউকে সালাম জানাতে না দেখলে মা আমার খোঁচা দিয়ে বলে, তখন আলী আহমেদকে সালাম দিতে দিতে অস্থির হয়ে গেলে, আর এখন সালাম মুখে ওঠে না।
আমাদের একান্ত শৈশবের আনন্দের মাঝে হঠাৎ আম্মা একটি খেলনা নিয়ে এলো। একটি ছোট্ট পুতুলের মতো শিশু। আমি আর লীনা শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম। আমাদের ছোট ভাই জিয়ার জন্ম ১৯৭২ সালের ৯ অক্টোবর। আসলে আট তারিখের মধ্যরাতের পরে বা রাতদুপুরে। বাংলা নিয়ম মানলে অবশ্য আট তারিখেই ধরতে হতো, কারণ বাংলা দিনের সূচনা হয় অর্থাৎ প্রভাত হয় সূর্যোদয়ের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের শৈশব থেকেই এবং এখনও বাংলা পঞ্জিকা বাংলাদেশে কেবল পহেলা বৈশাখ আর পূজা-আর্চা ছাড়া আর কোনো কাজে ব্যবহার হতে দেখিনি। এখন তো বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা তারিখেও ভেদ হয়ে গেছে। বাংলা সনের এই সংশোধনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সাথে তাল মেলানোর জন্যে। কারণ, শৈশব কৈশোরে দেখেছি একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন হতো কোনো বছর ৯ ফাল্গুন আবার কোনো বছর ৮ ফাল্গুন। অথচ ইতিহাস বলে ৫২ সালের সেদিন ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। আমি একবার ইশকুলে এক স্যারকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমরা ৮ই ফাল্গুন পালন না করে ২১শে ফেব্রুয়ারি কেন পালন করি। প্রাইমারি শিক্ষক কী যে বলেছিলেন তার আগামাথা কিছুই বোধগম্য হয়নি সেদিন। তবে বুঝেছিলাম, আমরা স্বাধীন হয়েছি ভূমির দখলে, তবে আমাদের মনের দখল ইংরেজরা ছেড়ে যায়নি। এমনকি দিনতারিখও এখনও আমরা খ্রিষ্টিয় ক্যালেন্ডারে গণনা করি।
তখন তো এতো কিছু বুঝতাম না, এখন বুঝি, এই ইংরেজি সাল আসলে গ্রেগরিয় ক্যালেন্ডার যা মূলত খ্রিষ্টিয়। অথচ বাংলা ক্যালেন্ডার বাংলার ক্যালেন্ডার। কিন্তু এই বাংলা ক্যালেন্ডারের সাথে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততায় বাঙালি সনাতনধর্মীগণ তাঁদের পূজা আচারাদি মিলিয়ে নিয়েছিলেন সেই আকবরী শাসনামল থেকে। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান কেন জানি এই ক্যালেন্ডারকে তেমন করে গ্রহণ করতে পারেনি হয়তোবা। আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটি শিক্ষিত উদার বাঙালি সমাজকে বাঙালি সংস্কৃতি মনস্ক করলেও, বাংলা নববর্ষ পালন ব্যতীত এই ক্যালেন্ডারকে আর কোনো কাজে ব্যবহার হতে বাঙালি মুসলমান সমাজে দেখা যায় না। এর ফলে সবাই তখনও যেমন এখনও তেমনি ঝুঁকে আছেন গ্রেগরিয় ক্যালেন্ডারের দিকে। বরং দিনে দিনে ৩১ ডিসেম্বর পালনের পশ্চিমী আড়ম্বর অর্থবিত্ত বৃদ্ধির সাথে সাথে রমরমা হয়ে উঠছে। যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত অনেকটা গেয়ে ফেললাম। বলছিলাম আমাদের কনিষ্ঠতম ভ্রাতা জিয়ার জন্ম প্রসঙ্গে।
আরও একটু পেছনে ফিরে যাই। এর মধ্যে লীনা ২/৩ বছর বয়সী হবার পর থেকেই নানারকম পুতুলেও আগ্রহী হয়ে ওঠে, মেয়েরা যেমনটি হয়। আমিও একমাত্র বোনের সাথে পুতুল খেলায় অনেক মেতেছি। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল লীনা জ্যান্ত পুতুল চায় খেলার জন্যে। মানুষের কোলে কোনো নবজাতক শিশু দেখলে তার খুব সখ হতো, একটু কোলে নিয়ে খেলবে। আম্মাকে প্রায় জ্বালাতন করতো একটি জ্যান্ত পুতুল বা বাচ্চা শিশু এনে দেবার জন্যে। এরমধ্যে আমরা মায়ের কাছে গল্প শুনে জেনে গেছি, আব্বা আম্মা আল্লার কাছে চেয়েছিলেন বলে, আল্লা আসমান থেকে একে একে আমাদের ফেলে দিয়ে গেছে আম্মার কোলে, অনেকটা হেলিকপ্টারে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের মতো। অতএব, লীনার দারুণ আকুতি, আম্মা কেন আরেকটা বাচ্চা পাঠানোর জন্যে আল্লাহকে বলছে না ইত্যাদি ইত্যাদি ঘ্যানর ঘ্যানর চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে।
আমি আর লীনা খেলাধুলার এবং নানারকম বাৎসল্যের কারণে কামালদের বাসায় প্রায় যেতাম এবং অনেকটা সময় কাটতো। শেলী আপা মনি আপার স্নেহ আমরা যেমন পেতাম, খালাম্মাও বেশ যত্ন নিতেন। একবার কামালের এক ফুফু এসেছিলেন তাদের বাসায়, ছিলেনই বেশ ক’দিন। লীনা তখন সে বাসায় সারাক্ষণ পড়ে থাকতো বাচ্চাটি নিয়ে খেলার জন্যে। কতো আকুতি করে কাকুতিমিনতি করে সে বাচ্চাকে কোলেও তুলে নিয়েছিল কয়েকবার। তারপর হঠাৎ আবদার জুড়ে বসেছিলো, বাচ্চাটি তাকে একেবারে দিয়ে দেবার জন্যে। সেই ফুফু হাসিচ্ছলে তাকে বাচ্চাটি দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। পরে যেদিন সেই ফুফুটি বাচ্চা-সমেত বিদায় নিলেন, লীনার সে কী কান্না তা’ আজও আমার স্মৃতিপটে জ্বাজ্জল্যমান। মনে হয় তারপরই আব্বা আম্মা আল্লাহকে একটি বাচ্চা পাঠিয়ে দেবার আর্জি করেছিলেন। মায়ের কোলের শিশুটি একান্ত আমাদের ঘরের, লীনা তা খুব ভাল টের পেয়েছিল। সে খুব নির্ভার ও নিশ্চিন্ত ছিলো যে এই পুতুলটা কেউ নিয়ে চলে যেতে পারবে না। সেই থেকে আমাদের নতুন করে পুতুল খেলা শুরু।
স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় অর্জনের এক বছরও যায়নি তখনও, আমাদের ঘরে এই শিশুটি এসেছে। আব্বা তখন মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডারের নামের সাথেই হয়তো মিলিয়ে নাম রাখলেন জিয়াউর রহমান। কে জানতো, পরবর্তীতে সেই প্রাক্তন সেক্টর কমান্ডার দেশে সমরতন্ত্র জারি করবে আর যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্রয় দেবে? তবে, আমার ভাইয়ের নাম জিয়া হলেও সে মোটেই তেমন চরিত্রের হয়ে গড়ে ওঠেনি। জানি না, পরে পরে একসময় আমার ধারণা জন্মেছিলো, জিয়া নামটির সাথে স্বৈরতন্ত্রের নিবিড় সংযোগ। ধারণা হবে না-ই-বা কেন? এদিকে জিয়াউর রহমান, আরেক দেশে জিয়াউল হক স্বৈরশাসনের কষাঘাতে দুইটি পৃথক দেশে সাধারণ্যের জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলো। অবশ্য আমার সেদিনের জ্ঞান তো সেই বাবা-মায়ের আলাপ, দৈনিকের পাতার কিছু খবর আর মাঝে মাঝে টু-ইন-ওয়ানে বিবিসি’র বাংলা খবরের আওয়াজ।
কামালদের বাসার প্রসঙ্গ যেহেতু এসেছিলো। একটু এই পরিবারটির সাথে আমাদের সখ্য ও দীর্ঘ সম্পর্কের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে। অন্যথা এই প্রসঙ্গটি হয়তো লেখাই হবে না। কামালের বাবা আমিরুজ্জামান সাহেবকে আমরা খালু ডাকতাম। কারণ, কামালের আম্মাকে খালাম্মা আগেই ডেকে ফেলেছি মায়ের নির্দেশে। আমিরুজ্জামান সাহেব বিমান বন্দরে কাস্টমস সুপারেন্টেন্ডেন্ট-এর চাকরি করতেন। তাঁর চার ছেলে এবং তিন মেয়ে। খালুর যে চাকরি ছিলো, তাতে তাঁর পক্ষে দু’চারটি দালান থাকাই সমাজের কাছে স্বাভাবিক মনে হতো সে সময়। এখনও অবস্থা পাল্টায়নি। কিন্তু আমাদের এই খালুটি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু এবং সৎ ব্যক্তি। তিনি যেদিন মৃত্যুবরণ করেন, তাঁদের টিনের ছাউনি বেড়ার ঘরটির দিকে আমি একবার তাকিয়েছিলাম। চালের ফুটো তো আছেই, বেড়ার দেয়ালগুলোর তলাও ভেঙে ভেঙে অনেক ঘুলঘুলির বিকাশ ঘটেছে, যেসব ফোকর দিয়ে বড়সড় ইঁদুর চিকা তো বটেই ছোট খাট বিড়ালও অনায়াস পারাপার করতে পারতো। আব্বা ও প্রতিবেশীদের মধ্যে মরহুম আমিরুজ্জামান সাহেবের সততার অনেক গুণগান এবং অনেক অভিজ্ঞতা, ঘটনার সম্মুখীন হয়ে সততার প্রমাণ পাবার আলাপ সেদিন আমি শুনতে পেয়েছিলাম।
কামালের সবার বড়ভাই ছিলেন বদর ভাইজান। বদর ভাইজান খুব সাদামাটা মানুষ, চাতুর্য জিনিষটা এই লোকের জন্যে যেন আসেইনি। তিনি অবশ্য তেমন মেধাবী বা উজ্জ্বল কোনো চরিত্রের মতো আমার সামনে আসেননি। বরং শৈশবে মুগ্ধ হতাম মেঝভাই শামসুজ্জামান বা শামসু ভাইয়ের কাজে কর্মে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছবি আঁকতেন। সে যুগে আজকের মতো ভিউকার্ড বা গ্রিটিংস কার্ডের দোকান বা এইসব কার্ডফার্ড দেওয়ার চল ছিলো না। হাভাতে বাঙালি তখনও এতো সৌজন্য বিনিময় শিখে ওঠেনি। সেই সময়ে দেখেছি, রমজান মাসের শুরু থেকে শামসু ভাই আর্ট পেপার কেটে ছোট ছোট ভাঁজ করা কার্ড বানাচ্ছেন। তার কভারে এঁকে দিচ্ছেন নানা বর্ণের রঙের সমাহারে এক উজ্জ্বল কোনো একটা কিছু, ফুল পাতা জাতীয় ব্যাপারগুলো বুঝতে পারলেও কিছু ছবির লেজমাথা কিছুই বুঝতাম না——জিজ্ঞেস করলে বলতেন, এসব এবস্ট্রাক্ট। এই অদ্ভুত শব্দ প্রথম শুনেছিলাম তাঁর কাছেই। সারা রোজার মাস তিনি এই ভাবে কার্ড তৈরি করতেন। সারা ঘরে দড়ি বা সুতলি টাঙিয়ে অয়েল পেইন্ট করা ওসব কার্ড ঝুলিয়ে শুকোত দিতেন। যেগুলো তেমন ভালো হতো না, সেগুলো আমাদের দিয়ে দিতেন খেলার জন্যে। আমরা খুব যত্নে সেসব জমিয়ে রাখতাম। শামসু ভাই সেকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঈদ কার্ড বিক্রয় করতেন একটাকা / দুটাকা মূল্যে। কিনে নিতো তখনকার তরুণ তরুণী প্রেমিক প্রেমিকারা। কিছু কার্ড নিজেও বিভিন্ন জনকে উপহার দিতেন বলে শুনেছি। একদিন জানতে পারলাম শামসু ভাই পলিটিক্স করেন! কামাল জানালো, উনি কাজী জাফরের দল করেন। আগে নাকি ন্যাপ করতেন, এখন ইউপিপি না কী যেন একটা দল করেন। মনে পড়ে, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এসব দল করে কী লাভ! কামাল সম্ভবত শামসু ভাইয়ের কাছে জেনেছিলো যে, কাজী জাফর যেখানেই যাক না কেন তার কর্মীদের তিনি খুব ভালোবসেন। সবার কাজকর্ম চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। তখন এতো কিছু বুঝতাম না। তবে, একথা বুঝলাম রাজনীতি করলে নেতার হাত ধরে ভবিষ্যতে আখের গুছানো যায়। আর শামসু ভাইকে যে নায়কোচিত মনে করে দেখছিলাম, তাতে যেন কেমন একটা ভাটা পড়ে গেল। এই পরিবারটি পরে এই লোকের সুবিধাবাদিতা এবং স্বার্থপরতার খেসারত দিকে গিয়ে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। এমনকী একটা সময়ে এই বাড়ি জায়গা বিক্রি করে এলাকা থেকেও চিরতরে সরে যায়। তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ অবশ্য এখনও টিকে আছে ফোনালাপে। আমার মা আর কামালের মায়ের মধ্যে যে হৃদয়ের বন্ধন দেখেছিলাম, তা হয়তো সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এ বাড়ির রান্না যেমন প্রতিদিন ও বাড়িতে যেতো, ও বাড়ি থেকেও তেমনি এসেছে প্রতিদিন। খালাম্মা অবশ্য গত হয়েছেন অনেক দিন আগেই। খালাম্মার ছিলো পিত্তথলির পাথর। কিন্তু তিনি অপারেশন করতে নারাজ। তাই প্রায়শ দেখতাম বিছানায় শুয়ে দুর্বিসহ ব্যথায় কাতরে যাচ্ছেন, চিৎকারও করতেন কষ্ট সামলাতে না পেরে। সেই খালাম্মার বিদায়ও দেখেছিলাম বড় বেদনার্ত হৃদয়ে। আর দেখেছি, একজন উচ্চাভিলাষী ভাইয়ের অবাস্তব স্বপ্নচিন্তায় একটি বিশাল পরিবার কেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পরে নানা দিকে দেশে দেশান্তরে। শেষপর্যন্ত জায়গাটিও তাদের সকলকে ছেড়ে যেতে হয়। অবশ্য এই পৃথিবীই তো আমরা একদিন ছেড়ে যাবো। কী লাভ মায়া বাড়িয়ে শুধু শুধু।
১১:৪৯
১৯ জুলাই ২০২০
মন্তব্য