কোরাকাগজের খেরোখাতা
বর্ণমালার হাতেখড়ি বাবার হাতেই? না কি মা’র? মনে নেই। মনে তো কিছুই নেই। তবে, একথা সত্য যে বাল্যশিক্ষা কিংবা ইদানীংকালের নার্সারি বা প্লে-গ্রুপ এইসব শ্রেণীতে বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণ করা আমার হয়ে ওঠেনি। আর খুব শৈশবেই ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘ভোর হোল দোর খোল মায়ের মুখে মুখে শিখে ফেলেছিলাম। এই ছন্দ আমাকে সেই তখনই আনন্দিত করে তুলতো। বইয়ের ছবি দেখে দেখে কবিতা আওড়ানো নিত্যদিনের খেলায় পরিণত হয়েছিলো। আমার মায়েরই ছিলো বেশি উচ্ছ্বাস। বাবা গম্ভীর মানুষ, তবে শুনেছি আমাকে শৈশবে ছাদে নিয়ে যেতেন এবং আমি তাঁর পায়ের উপর বসে বিশাল বুড়া আঙ্গুলকে স্টিয়ারিং বানিয়ে গাড়ি চালানোর খেলা খেলতাম।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আমাদের এই চন্দনপুরার বাসা তখন একতলা ছিল। কেউ যদি চকবাজার থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোড দিয়ে দক্ষিণে এগুতে থাকে প্যারেড ময়দান, চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চাৎ দিক, গুলএজার বেগম গার্লস স্কুল, পেঁচুমিয়ার গলি পার হলে চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ‘হামিদিয়া তাজ মসজিদ’ যা সর্বজনে চন্দনপুরা বড় মসজিদ নামে পরিচিত। তারই পূর্বপাশে ফায়ার ব্রিগেড বা দমকল বাহিনীর প্রাচীন লাল দালান। পার হয়ে আরও দক্ষিণে এগুলে হাতের বামে পূর্বমুখী আঁকাবাঁকা চিকন গলি, মনুমিয়াজী লেইন; লোকে বলে ‘মনুমিজ্জির গল্লি’। গলির শেষ মাথায় মনুমিয়াজীপ বংশধরদের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নিবাস। শুনেছি ওরা বাঁশখালীর জমিদার বংশ। তাদের নামেই তাই গলির নামকরণ। এই গলিতে যারা আদিবাসী তাদেরকে আম্মা ডাকেন ‘শউরগা’, মানে শহুরে। একটা অদ্ভুত বিষয় সেই সেদিনও আমার কান এড়ায়নি। তা হলো, এদের ভাষা আর আমাদের ভাষায় কিছু তফাৎ রয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষায় আমরা ‘আসবো’ বলার সময় বলি ‘আইস্স্যুম’, আর এরা বলে ‘আইচ্ছ্যুম’। করেছি বলার সময় আমরা বলি ‘গজ্জি’, আর এরা বলে ‘খজ্জি’। তাই আমি এদেরকে মনে মনে ‘আইচ্ছ্যুম’ ডাকতাম। অনেক পরে জেনেছিলাম মানুষের মুখের বুলি আর রান্না কিছু দূরত্বের পরে পরে পাল্টে যায়।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
যাই হোক, গলিতে ঢুকার মুখে হাতের বামে একটা অফিস, সরোয়ার হোসিয়ারি এন্ড থ্রেড; আর ডানপাশে ছিল জাকির হোসেনের আলমিরার দোকান। সেই দোকানের পাশেই ঐতিহ্যবাহী মোহনবাঁশী নাপিতের দোকান, আজকাল যাকে ‘সেলুন’ বলে চেনে। মোহনবাঁশী শহরের অনেক গন্যমান্য ব্যক্তির চুল কাটার বর্ণনা দিতে দিতে বহুবার আমার চুল কেটেছিলেন। মোহনবাঁশীর সাথে তাঁর ছেলেরাও চুল কাটতেন। আমার চুল এতো বেশী ঘন ছিলো যে, নাপিতের হাত ব্যথা করতো বলে তাদের অভিযোগ ছিল, এবং সেই শৈশবে তারা আমার মাথায় চাটি মেরে মেরে প্রায়শই ক্ষোভ প্রকাশ করতো। মোহনবাঁশী মারা যাবার পরে তার ছেলেরা এই চুলকাটা চালিয়ে গিয়েছে। পরে সিরাজউদ্দৌলা রোড সম্প্রসারণের সময় দোকান ভেঙে গেলে বড়ছেলে কালু নাপিত সরোয়ার কোম্পানির পেছনে একটি অতি ক্ষুদ্র কক্ষে এখনও তার পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
গলির ভেতরে একটু ঢুকতেই একটি খালি জায়গার মাঝখানে একটি বর্ত্তা গাছ বেশ ফলবতী ছিলো। এই গাছ থেকে বহুবার বর্ত্তা পেরে পেরে খেয়েছি। পরে আশির দশকের শেষ দিকে হঠাৎ সেখানে একটি লালসালু মাজার জেগে ওঠে। শুনেছি, জাকির হোসেন মামা স্বপ্নে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে জায়গাটি ঘিরে মাজারের রূপ দিয়েছেন। নাম ‘হযরত আজী জুম্বল শাহ মাজার’। তাঁকে আমরা মামা ডাকতাম, কারণ এলাকার প্রায় সকলেই হয় আমার বাবাকে দাদা অথবা আমার মা’কে আপা বা বোন ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে যায়; সেই সূত্রে এলাকার বড় সকলেই হয় মামা নয় চাচা।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
এই লালসালুতে কতো লোক মোমবাতি আর অর্থকড়ি রেখে যায়, কেউ কেউ তো কেঁদেরেঁধে সিজদাও ঠুকতে দেখেছি। মাজারের পেছনে ‘শউরগা’দের টীনের ছাউনি কিছু বেড়ার ঘর ছিলো—মিয়া, সফি সহ আরও বেশ ক’জন বন্ধুর বাড়ি। সফি’র বাবা হঠাৎ এই মাজারের মোতোয়াল্লি হয়ে যায়। আর এই মাজারের জন্যে রিকশাচালকদেরকে গলি চেনানো সহজ হয়ে যায়। আগে বলতে হতো চন্দনপুরা মসজিদের আর ফায়ার ব্রিগেডের পরে হাতের বাম গলির ভেতরে সামান্য যেতে হবে। তারপর এইভাবে বলার পরে দরদাম করতে করতে বিরক্তি ধরে যেতো। দুই তিনজন রিকশাচালককে বলতেই জিহ্বা বেরিয়ে আসার যোগাড় হয়। এখন ধীরে ধীরে গলিটি লোকমুখে ‘মাজার গলি’ নামে পরিচিত হয়ে যায়।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
সফির ছোটভাই পরে পরে তস্করের পেশা বেছে নেয়। আবার একঘরের দুইবোনকে একত্রে বিবাহ করে সংসারও পাতে। সে এই মাজারের মোমবাতি আর টাকা প্রায়শ গায়েব করে ফেলতো শুনেছি। অবশ্য তাদের বাবার মৃত্যু হলে সেই তস্করই এখন মাজারের সার্বিক দায়িত্ব পালন করাতে, সে অর্থ এখন তার হক এবং হালাল হয়ে যায়।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
তাদের বাড়ির পরে একটি বিশাল পুকুর ছিলো গলির দক্ষিণপাশে। সবুজ শ্যাওলার কারণে জলের রং সবুজ দেখাতো বলে এই পুকুরটিকে ‘কউচ্চ্যা প্ফইর’ [সবুজ পুকুর] বলা হতো। হাতের বামে জামালদের বাড়ির পরের বাড়িটাই জাকির হোসেনদের বাড়ি। তারা তিন ভাই। রবিউল হোসেন, আহমদ হোসেন, এবং জাকির হোসেন। পরে একটি তিনতলা পাকা বাড়ি করেন তারা। জাকির হোসেন মামা আমার শৈশবে আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন দেখেন, আমি লম্বা পাউডারের টীনের ভেতর একটি চিকন বাঁশ ঢুকিয়ে নাটাই বানিয়ে দৈনিক পত্রিকার কাগজ আর নারকেল পাতার শলাকা দিয়ে ঘুড়ি বানিয়ে খেলছিলাম, পরেরদিন এসে আমার হাতে একটি সুন্দর সত্যিকার নাটাই ধরিয়ে দেন। তার সেই স্নেহবাৎসল্য মনে থাকায় তাঁর লালসালুর স্বপ্নগল্পও আমার প্রায় সত্যি মনে হতে থাকে কখনও কখনও। তাঁদের পরেই বিশাল বনেদী বাড়ি— জমিদার বাড়ির মতোন—গোলাম রাসুলদের বাড়ি। বিশাল পাকা তোরণ দিয়ে ঢোকার পরে সেখানে যেন এক রহস্যময় জগতে পা দিতাম। তোরণের পরেই একটি পুকুর; এই পুকুরটিকে গোলামরসুলদের পুকুর বলেই ডাকতো সকলে। আমাদের গলির ভেতরে এবং আশেপাশে সাত-আটটা পুকুর ছিলো। আমরা সাধারণত এক পুকুরের জলে পরপর দুইদিন সাঁতার কাটিনি, বা কাটতে পছন্দ করতাম না। সবসময় পুকুর পাল্টে পাল্টে সাঁতরাতাম। গোলাম রাসুলদের পুকুরের পেছনে সারবাঁধা বেশ ক’টি বাড়ি, যাদের কারও কারও অবস্থা পড়তির দিকে ছিলো। গোলাম রাসুলদের একটা চা দোকান ছিল চন্দনপুরা মসজিদের বিপরীত দিকে। খুব চালু দোকান, আমিও দেখেছি। আর বিস্তর জায়গাজমি। গোলাম রাসুলদের বাড়ির পরে পুকুরটির পূর্বদিকে একটা বাউন্ডারির ভেতরে কামাল আর মনিরদের বাসা। কামালদের বেড়ার ঘরটিতে ছিলো আমাদের নিত্য গতায়াত। কামালদের ঘরের পরে বিশাল উঠান পার হয়ে মনিরদের বাসা। এই বিশাল উঠানের মাঝখানে একটি বিশাল পেয়ারা গাছ অনেক শাখা প্রশাখা মেলে বহু উঁচুতে উঠে গেছে। আমরা সেই পেয়ারা গাছ বেয়ে বেয়ে কতো রকম খেলাতে মগ্ন হতাম, আর কাঁচা পাকা পেয়ারা সেই গাছে বসে বসেই খেয়ে নিতাম। তাদের পরেই আমাদের বাসা। আমাদের পূর্বে একটি বড় নালার ওপারে একটি বিশাল পাড়া, যেখানে কিটু, বাচ্চু, দেড়-ব্যাটারিদের ঘর। শুনেছি আমার নানা কিটুর বাবা-চাচাদের উকিল ছিলেন। আমাদের বাসার জায়গাটি একসময় গোলাম রাসুলদের সম্পত্তি ছিলো। কিন্তু খাজনা পরিশোধ না করায় জমি নিলামে ওঠে। এবং আদালত পাড়াতে ঘোরাঘুরি করা লালমিয়ারা জায়গাটি নিলামে কিনে ফেলেন। পরে পাড়ার সালিশ মধ্যস্থতায় আমাদের জায়গাটি গোলাম রাসুলদের হাতছাড়া হয়। লালমিয়াদের নগদ টাকার দরকার, তারা অভাবী মানুষ। তারা দলিল নিয়ে আমার নানাকে দিয়ে জায়গাটি বেচে দেবার অনুরোধ করেন। নানা তখন আমার আব্বাকে জায়গাটি নিতে বলেন। সেই সাড়ে ৫ গন্ডা জায়গা একা কেনার সাহস মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আব্বার ছিলো না। তিনি বললেন, নানা সহ কিনলে উনি নেবেন। পরে নানী বিগড়ে বসেন এই বলে যে শশুর জামাই এক জায়গায় থাকা উচিত নয়। তখন আব্বার কলিগ প্রফেসর ইদ্রিস সাহেব পেছনের দেড় গন্ডা, আর আব্বা মাঝখানের ৩ গন্ডা নিলেন, সামনের ১ গন্ডা জায়গা আইয়ুব খানের মাস্টার প্ল্যানে রাস্তা সম্প্রসারণের আওতায় পড়বে দেখে আব্বা নেননি। পরে অবশ্য ইদ্রিস সাহেব এতো অল্প জায়গায় বাড়ি করার প্ল্যান সিডিএ পাশ না করায় বাধ্য হয়ে আব্বাকেই জায়গাটি বিক্রি করে বিদায় নেন। এদিকে আমাদের সামনের বাউন্ডারির বাইরের ১ গন্ডা জায়গা ধীরে ধীরে আবর্জনা ফেলার প্রকৃষ্ট স্থানে পরিণত হয়। একদিন সেখানে কিছু বেড়া আর বাঁশ এনে রাখে কেউ একজন। পরে দেখি আব্বা খুব উত্তেজিত উৎকন্ঠিত। এরপর প্রতিদিন কী সব কাগজপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। বেশ কিছুদিন পরে জানতে পেলাম জায়গাটা আমাদের হয়ে গেছে। কী সব মামলা নাকি করে মামলা জিতে আব্বা জায়গাটি কিনেছেন, তখন বোধহয় আমি তৃতীয় কী চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। তারপর একদিন আমাদের সীমানা দেওয়াল প্রসারিত হয়ে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে যায়। আমরা একটি বড় উঠানে খেলার দৌড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাই। আমার মা সামনের এই উঠানে দেওয়াল ঘেঁষে হাস্নুহানা, বেলি, রডোডেনড্রন গাছ লাগান। এসব ফুলের গন্ধে সারা বাড়ি যেন মৌ মৌ করতো এক স্বর্গীয় সৌরভে। বিশেষ করে হাস্নুহানার ঘ্রাণ আমাকে পাগল করে দিতো। চাঁটগাঁর স্বরে মা বলতেন ‘হাস্নুহেনা’। আমার মা সন্ধ্যায় ঈষৎ চন্দ্রালোকে উঠোনে হেঁটে বা দরোজায় বসে সেই ঘ্রাণে শ্বাস নিতেন বিভোর হয়ে। ১৯৯১ সালের ঘূর্নিঝড়ে সেই অদ্ভুত গন্ধ ছড়ানো হাস্নুহানা গাছটি ভেঙে পড়ে যায়। সেই থেকে আমাদের বাড়ির উঠোনে সেই প্রাণ আর ফিরে আসেনি। এই হাস্নুহানা ফুলের সৌরভ নিয়ে আমার একটি কবিতা সম্প্রতি রচিত হয়েছে। এখানে কবিতাটি তুলে দিচ্ছি:—
হাস্নুহেনা কোন্ মাসে সুবাস ছড়ায় মা আমার ভুলে গেছে
সত্তুর পেরিয়ে গেলে কেউ কেউ ভোলে ফুলগাছ
যেদিন ঘূর্ণির তোড়ে গাছটি মটকা মেরে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়
সমস্ত পাড়ায় তবু ছড়িয়েছে ফুলগন্ধ নালা-নর্দমায়-কাদায়-জংলায়
তারপর জলের ভীষণ টানে
ফুল-পাতা ভেসে গেলো চাক্তাই খালের জোয়ারের জলে
ওখানে সুবাস খুব প্রয়োজন ছিল পাঁকের জঙ্গমে
হাস্নুহেনা ভেসে গেলে জোছনার চাঁদ লেম্পোস্টের বাতি ছাড়া কিছু নয় আর
ম্লান ফিকে স্বাদহীন গন্ধহীন জোছনাকে কোনোদিন চাইনি জীবনে
সেই যে প্রথম বোধ যে সন্ধ্যায় রূপালী উঠোন জুড়ে
জোছনার মায়াচাঁদ আর হাস্নুহেনা গন্ধ বিলিয়ে অমল
আউলা ঝাউলা করে আলুথালু করেছে শৈশব
মা আমার এক রাতে সে উঠোনে চুল খুলে ছেড়ে দিলো
চন্দ্রালোকে হাওয়ার মাতমে
সেদিন সুতীব্র ঘ্রাণে বারবার টেনেছি নি:শ্বাস—চুলের, হাস্নুহেনার...
সেই থেকে যতো প্রেম ওই হাস্নুহেনার সাথেই
সকালে কুড়িয়ে নিয়ে ঝরে পড়া সেই ফুল যত্নে মমতায় রাখি
নরোম করতলের আদরে আহ্লাদে
যে রাতে মা চুলখোলা চাঁদের তলায় বসে
হাস্নুহেনা ঘ্রাণ হা করে টেনেছে
নারীর সৌন্দর্য বুঝি আমার প্রথম আবিষ্কার, প্রেমেরও প্রথম!
(হাস্নুহেনা ও মা / জিললুর রহমান / অগ্রন্থিত/ রচনাকাল—২০ জুন ২০২০; পূর্বাহ্ণ ১টা)
আমাদের পেছনের জায়গাটা যেহেতু ইদ্রিস সাহেব আব্বাকে ছেড়ে দিয়ে যায়, আমাদের পেছনের উঠান অনেক বড়। আম্মা এই পেছনের উঠানে আর বাসার পশ্চিম পাশের চওড়া পথটিতে নারকেল—সুপারি—বড়ই—কাঁঠাল—আম —শরিফা গাছ লাগিয়েছিলেন অনেক। জামগাছ ছিল সামনের উঠানে পূর্বদিকে সিঁড়িঘরের কাছে। আমাদের বাড়িতে ঢুকার জন্যে একটি লোহার বড় গেইট ছিলো, যা তালাবদ্ধ থাকতো। তার আবার ছোট একটা দরোজা ছিল সর্বক্ষণ খোলা। মনে পড়ে আমাদের সামনের উঠানটি একটু নীচু ছিলো এবং বর্ষাকালে যখন টানা পাঁচ-সাতদিন তুমুল বৃষ্টি পড়তে থাকতো, আমি আর লীনা (ছোটবোন) কাগজের নৌকা ভাসাতাম। প্রথম প্রথম নৌকা বানাতে জানতাম না। এমনি কাগজ ছেড়ে দিতাম। আর সে কাগজ ভাসতে ভাসতে একসময় ভিজে চুপসে গিয়ে তলিয়ে যেতো। একদিন আম্মা আমাদের নৌকা বানিয়ে দিলে আমরা সে নৌকা ছেড়ে খুব মজা পেয়েছিলাম। তারপর প্রতিদিন নৌকা বানিয়ে দেবার জন্যে বিরক্ত করে তুললে, কোনো একসময় আম্মার কাছ থেকে নৌকা বানানোর কৌশল শিখে ফেলি। তখন কতো কাগজ যে ছিঁড়ে ছিঁড়ে এরকম নৌকা ছেড়েছি জলে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মধ্যে কাগজের উড়োজাহাজও বানাতে শিখে ফেলি। তা’ও ওড়াতে থাকি ঘরে ও উঠানে। একান্ত শৈশবে আমি আর লীনা কেবল মেশার সুযোগ পেতাম পাশের বাসার কামাল আর মনিরদের সাথে। মনিরের বোন মুসলিমা, জাহেদা আর রুহিনাও আমাদের দৌড়ঝাপ থেকে মালাপাতি পুতুলবিয়ে খেলার সঙ্গী হয়েছে। কামাল ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তাই কিছুটা বড় শেলিআপা মনিআপারা আমাদের আদর শাসন করতেন, কিন্তু আনন্দের সঙ্গী হতেন না।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আমাদের বাড়ির দক্ষিণপাশে, মানে গেটের বিপরীতে রাস্তার উল্টাপাশে একটা বিশাল বনেদী বাড়ি—হাজী মহম্মদ বক্সের বাড়ি। যখন আমাদের প্রথম বুদ্ধি ফোটে তখনই এই লোক বেশ বুড়ো, প্রায় আশি নব্বই বছর বয়স। তবে স্বাস্থ্যবান ছিলেন। তাদের বাড়ির লোক তো বটেই, পাড়ার সবাই তাঁকে সমীহ করেই চলতো। হাজী মহম্মদ বকশ শুনেছি চট্টগ্রামের প্রথম সাইকেল আমদানীকারক। সাইকেল ব্যবসা ছিল তাঁর সিরাজদ্দৌলা রোডে গুড সাহেব রোডে উঠার মোহনায় একটি দোকান ছিলো। আমরা তাঁকে সাইকেল চালাতেও দেখেছি। তাঁর দুই ছেলে মকবুল সওদাগর ও সুলতান। আম্মার খালু সম্বোধন হেতু তাঁরা আমার নানা। মকবুল সওদাগর আমার মা’কে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। তাঁদের বাড়ির ভালমন্দ রান্না নিয়মিত আমাদের বাসায় চলে আসতো। মকবুল নানার সাত সন্তান। এরা সবাই আমার মামা খালা ছিলেন এবং আমার আব্বাকে দুলাভাই ধরে নিয়ে আব্বার কৃষ্ণরং সম্পর্কে নানারকম কু’কথা আমাকে বলে উত্তেজিত করা তাঁদের বিনোদন ছিলো। বিশেষত মকবুল নানার ছেলে নুর মহম্মদ, পেয়ারি, রাজু মামারা। শেরু মানে শের মহম্মদ ছিলো আমার ২/১ বছরের বড়, তাই বন্ধুস্থানীয়। আর জুয়েল-রুবেল আমার ছোটভাই জিয়ার বন্ধুস্থানীয়। বড় মেয়ে রুমার মা’কে বেগম আপা ডাকেন আমার আম্মা। আসলে দুজনের বয়স কাছাকাছিই। দুজনেই একে অপরকে আপা ডাকেন। রুমা ছিলো লীনার বয়সী, বান্ধবী। সাজু খালা ছিলেন ওদের মধ্যে সুন্দরী ও সাহসী। ওদের পরিবারে নারীদের উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু সাজুখালা লুকিয়ে স্কুলে যেতেন। তাঁদের বাবা বা দাদার সাথে পথে দেখা হবার উপক্রম হলে চট্ করে আমাদের বাসায় এসে আশ্রয় নিতেন। আমি খুব বিস্মিত হতাম, পড়ার জন্যে মানুষকে এতো ধকল পোহাতে হয়! লিলিখালাও ছিলেন খুব সুন্দরী।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
রুণু একটু মেধায় দুর্বল ছিলো এবং একসময়ে আমার সহপাঠীও হয়ে যায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে। রুবিনা লীনার বন্ধু। রুবিনার আসল নাম জুলেখা। আমাদের পাঠ্যবইয়ে একটি গল্প ছিলো। যে গল্পের প্রথম লাইন ‘জুলেখা বাদশার মেয়ে’। এই লাইন পড়ার সময় আমি এবং লীনা দুজনেই খুব উচ্চস্বরে পাঠ করতাম, যাতে ওদের বাড়িতে শব্দগুলো ছুটে যায়, উড়ে যায়। এই পরিবারটিতে আম্মার হাত ধরে বহুবার যেতে হয়েছে। এটি আমাদের বিকল্প নানার বাড়ি যেন। বাড়ির সদর দরজা পেরুলে একটি বড় উঠোনের পরে একটি দেউড়ির পেছনে ভেতরের উঠোন; তারপরেই বেশ উঁচু ভিটার ওপর বনেদী ঘর। তারও পেছনে গরুর গোয়ালঘর বামে এবং বিশাল রান্নাঘর ডানে। আর রাস্তার দক্ষিণপাশে সিএন্ডবি’র দেওয়াল পর্যন্ত বিশাল বাঁশবাগান। একটি মোটা তারের ঘেরা দেওয়া। বাঁশবাগানের বাঁশগাছগুলো বাড়তে বাড়তে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসে ক্রমাগত। হাজী মহম্মদ বকশ প্রতিদিন বাঁশবাগানের পরিচর্যা করেন, আর তারের বেড়া একটু একটু করে ঠেলে দেন রাস্তার দিকে। আর এভাবে সরু গলিটি আমাদের ও ওনাদের গেটের পর থেকে আরও আরও কৃষকায় হয়ে যায়। অথচ ওনাদের পরেই প্রশস্ত রাস্তা। তবু এই বাঁশবাগান আমার বড় প্রিয় ছিল। আমার মা যখন সুর করে করে পড়তেন ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই’, তখন পুরো কবিতাটি আমার চোখে ভাসতো। থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলাও দেখেছি সেই বাঁশবাগানের ফাঁকে ফাঁকে। কেবল কাজলাদিদিকে দেখার জন্যে মায়ের বুকের ভেতর স্বপ্নে বিভোর হতে হতো।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
বাঁশবাগানের পেছনেই একটা বিশাল পুকুর অনেকদূর বিস্তৃত হয়ে শেরুদের বাড়ির শেষ সীমানা পর্যন্ত চলে গেছে। এই পুকুরেই আট ন’বছর বয়সে আমি বন্ধুদের সাথে সাঁতার শিখেছিলাম। সে কী কাণ্ড! লুঙ্গির নীচে গিট্টু মেরে কোমরের গিট খুলে বাতাস ঢুকিয়ে লুঙ্গি ফোলানো, তারপর কোমরের গিঁট মেরে পুকুরে নেমে পড়া; তারপর কারও হাত ধরে একটু গভীরে গেলে তারা হাতটা ছেড়ে দিতো,আর আমি পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে হাবুডুবু খেতাম। কে যেন বলেছিল পোক্কাইয়া (পোকায় খাওয়া বা ছিদ্রযুক্ত) চনাবুট (ছোলা) খেলে সাঁতার পারে। চনাবুট নিয়ে ছিদ্র খুঁজে খুঁজে অনেক খেয়েছি। পিঁপড়া খেলেও সাঁতার পারে বলে কেউ একজন বলেছিলো, কিন্তু সাহস হয়নি পিঁপড়া খাওয়ার। তবে লুঙ্গি ব্যবস্থাতেই অল্প ক’দিনের মধ্যেই সাঁতার শেখা হয়ে যায়। সাঁতার শেখার পরে বড়দের শাসন ছাড়া পুকুর থেকে ডাঙায় ওঠা সহজে হতো না। এরপরে যখন একটু লায়েক হয়ে উঠি, মনুমিয়াজীদের পুকুর, পেঁচুমিয়াদের সচ্ছসলিলা পুকুর, দমকলবাহিনীর পুকুর, কউচ্চা পুকুর, ডা. ছমিউদ্দিনদের পুকুর, ফেরদৌস মিয়াদের পুকুর সব পালা করে সাঁতার দিয়ে যেতাম। একদিন পাশের গলিতে পেঁচুমিয়াদের পুকুরে যাবার যে চোরাপথ দিয়ে আমরা ঢুকতাম, সেই সরু পথটিতে গিয়ে দেখি, বড়ই গাছের অনেকগুলো ডাল কেটে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে আমরা আর যেতে না পারি। সেদিন থেকে এই পুকুরটায় সাঁতার কাটতে না পারার আফসোস এখনও যায়নি মন থেকে। এত সুন্দর টলটলে জল, তলা পর্যন্ত দৃশ্যমান হতো। জলের ভেতর সাঁৎরে বেড়ানো মাছগুলো যেন আমাদের সাথে চোরপুলিশ খেলতো। সময় পেরিয়ে গেলে পুকুরগুলো একে একে ভরাট হতে থাকে। ফেরদৌস মিয়াদের যে পুকুরের ঘাটের খোড়ল থেকে একদিন তেলাপিয়া ধরে ভেজে খেতাম, সেই পুকুরের উপর এখন ব্যস্ত কমিউনিটি সেন্টার, মাছ এখনও সেখানে ভাজা হয়, তবে বাজার থেকে কিনে। পুকুরে সাঁতার কাটা নিয়ে আমার ‘সাঁতার কবিতাটি এখানেই রেখে যাই তবে—
সাতটা পুকুরে পালা করে সাঁতার এখনো কাটি মনের গুমরে
বাঁশডুঁয়াদের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে চাঁদের প্রশ্রয়ে বুইজ্জার পুকুরেই তোলা ঝড়
পোনামাছগুলো কাঁচুমাচু ভয়ে সরে যেতো খোঁড়লের দিকে
কউচ্চা পুকুরে পানাদের দল বারবার তেড়ে আসে তাই
এ পুকুরে মজা নেই পুকুরটাই মজা হয়ে যায় কালে কালে
ফায়ারের পুকুরে সাঁতার দিলে তেড়ে আসে খাঁকি পোষাকের দল
লম্বা লম্বা নলে টেনে তোলে টনে টনে জল গাড়ির ভেতর
তারপর সে কি ত্রাহি হরণ ছুটিয়ে কোথা যায় কেন যায়
আমরা জানিনে
শুনেছি আগুন নাকি কোথা আজদাহা সাপের মতন খেয়ে যায়
বাড়ি ঘর দোর, সেটাই নেভাতে ছোটে সামান্য পিঁপড়ার মতো লাল গাড়িদের দল
মনুমিজ্জিদের পুকুরে ভীষণ ভীড় জমে বেকার বয়স্কদের
খেজুরে আলাপ জুড়ে বগলে সাবান ডলে ঘন্টা জুড়ে আড্ডার বাহার
কাজকর্ম জোটে নাই, মেসে থাকে অথবা লজিংয়ে, কেউ কেউ
প্রাচীন বংশের নি:স্ব সন্তানের মতো বিড়ি ফুঁকে সুখটান মারে
কেউবা কাতল মাছের মতো ঝুপ করে ডুব মেরে উঠে যায়
চুলাতে চড়ানো ভাত পুড়ে যাচ্ছে সে আফসোসের তুলে খেই
হেলেনের বাপের বাড়ির পেছনের খৈয়াটাতে না পারতে দিয়েছি ডুব
অনিচ্ছায়, কাদায় কাদায় কদাকার হয়ে যেতে কার অতো ভালো লাগে
দেড়-ব্যাটারির ঘরের পেছনে যে পুকুরে বাসন কোসন ধুতো
কোনোদিন জাগেইনি সাধ এমনকি পঞ্চমীর চাঁদ যখন বাড়িয়ে হাত ডেকেছিলো
ফেরদৌস মিয়ার পুকুর সে ছিল জীবন্ত খুব সারাক্ষণ মাছেদের ঘাই
আমরাও সারামাঠ বল খেলে ধুলোকাদা যথেষ্ট মেখেই গায়ে
ঝপাঝপ লাফ দিই ঘাটের উপর থেকে কেউ লুঙ্গি গোছ মেরে
কেউবা উলঙ্গ নামি, অনন্ত কালের সেই বেশুমার দাপাদাপি
ওপাড় যাবার যতো প্রতিযোগিতার ছলে দলে দলে
পুকুর অশান্ত করে কালোজল ঘোলা থেকে ঘোলা করে যাই
ওপারে ডাবের গাছ দু’চারিটি পেড়ে খাই শীতের বড়ই থোকা থোকা
যখন শরীরে আর একরত্তি বল নেই ঘাটের ফোঁকর থেকে ধরে নিই তেলাপিয়া কিছু
পাশেই ছুট্টুর ঘরে ভেজে খেয়ে মুখ মুছে বাড়ি ফিরি মাসুমের মতো।
একটাই খেদ, কেবল দুবার গিয়ে আর যেতে পারি নাই
কী সুন্দর টলটলে পরিষ্কার সেই জলে মাছ চড়ে জলপরীদের মতো
তলার পাথর থেকে জলজ উদ্ভিদ সব খালি চোখে দেখেছি উপর থেকে
আমাদের হট্টগোলে পুকুরে যাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে দুর্জন
এখনও স্বপ্নের ঘোরে পেঁচুমিয়াদের সে পুকুরে জলপরীদের সাথে
হাজার বছর আমি সাঁতরে চলি, কেবল
বন্ধুদের সেই দল ব্যস্ত হয়ে গেছে, সাঁতার দেবার ছলে কেউ তো আসে না ...
(সাঁতার / জিললুর রহমান / অগ্রন্থিত / রচনাকাল— ১০ জুন ২০২০; রাত ৭:২৫)
আমাদের সেই শৈশবে শহর চট্টগ্রাম ততোটা ‘ইটের পরে ইট মাঝে মানুষ কীট’ হয়ে ওঠেনি। আমাদের বাসাটাই এই গলির প্রথম তেতলা দালান ছিলো। তাও তার বেড়ে উঠতে সময় লেগেছে ৭৭ সাল পর্যন্ত। ভোর হতো পাখির কিচিরমিচির, আর রাত হলে জোনাকের আলোর সাথে ঝিল্লি রবে মুখরিত হতো বাঁশবাগানের আশপাশ। আর দূর থেকে ভেসে আসতো শেয়ালের ‘হুক্কা হুয়া ডাক’। পাড়ায় কুকুর বেড়ালও ছিলো। আমাদের বাসার পেছনে দেওয়ালের পরেই ফায়ার ব্রিগেডের পুকুরটি আর বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর। রাত গভীর হলে ফায়ার কর্মীদের কেউ একজন বাঁশীতে ধরতো মন উদাস করার সুর। লোক-সংগীতের সুরের মূর্চ্ছনায় আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁশরিয়াকে খুঁজতে চাইতাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেতাম না। হয়তো তিনি লাল বিল্ডিংয়ের ছাদে বসে বাঁশিতে সুর তুলতেন, হয়তোবা পুকুরের অন্য পারে নারকেল গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে বাজাচ্ছেন। আমাদের সে ছটফটের দশা যেন সেই কৃষ্ণের বাঁশিতে রাধার অস্থিরতার মতো। পরে পরে যখন রবিঠাকুরের গানে পাই “মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে যে সে” — তখন মনে পড়তো এই ফায়ারকর্মীর বাঁশির সুর। স্মৃতি আমাকে কাতর করে মাঝে মাঝে। সেই বাঁশির স্মৃতিকাতরতায় সেদিন লিখেছিলাম ‘সেই বাঁশি’ কবিতাটি:—
দমকল বাহিনীর সে লাল বিল্ডিং থেকে
ভেসে আসা সেই সুর সেই বাঁশি কে বাজায়!
এখনো আমাকে ডাকে হেমন্ত বাতাসে
হাড় কালা করে, দেহ কালার দুরন্ত পরবাস ...
ফায়ারের বিশাল পুকুর থেকে
ফাল পাড়ে বড় ছোট জলপরী মাছেদের ঝাঁক
সুপারী গাছের মাথা ঝুঁকে পড়ে জোছনার চাপে
কার পাপে মন এতো কাঁদে, কার জন্যে বয়ে যায় বায়ু ...
রাত্তির গভীর হলে বাঁশির বিষণ্ন কান্না
মায়াচাঁদ ঘিরে এক কুয়াশার জন্ম দিয়ে চলে,
লাল বিল্ডিংয়ের ছাদ ধ্বসে ঘন্টাধ্বনি সময় জানায় ,
নিলীমা বিধ্বস্ত হয়ে বুকের পাঁজরে ভরে জল।
সেই বাঁশী এখনো তেমনি বাজে হু হু ...
দু’কান পেতেই থাকি অনন্ত ইথারে—
ভেবেছিলাম কোথাও যাবো না, ঘরেই রবো,
ঘর কোথা উড়ে গেলো চন্দনের বনে ...
(সেই বাঁশি / জিললুর রহমান / অগ্রন্থিত / রচনাকাল: রাত ১১:০৯টা, ২৬ মে ২০২০)
আমাদের পাড়ায় সেকালে সবচেয়ে মজা লাগতো সকালবেলায় হকার এসে ডাক দিয়ে যেত “এই পে..পা...র”, কিংবা একটু বেলা বাড়লে পুরনো জিনিষ কিনতে আসতো কিছু ফেরিঅলা “এ..শিশি বোতল পুরানা কাগে...জ” আর ততক্ষণে পাড়ার পুরুষ লোকেরা যেহেতু বেরিয়ে পড়েছে কাজেকর্মে, মায়েরা বধুরা এগিয়ে এসে পুরনো শিশি বোতল কাগজ বিক্রি করে যৎসামান্য অর্থ পেয়ে শাড়ির আঁচলে গিট দিয়ে রেখে দিতো। আবার দুপুরের দিকে কিছু ফেরিঅলা আসতো লেইস ফিতা নিয়ে — তা’ও মেয়েদেরকেই টার্গেট করে আসতো। কিছু ফেরিঅলা আসতো পুরনো ডেকচি পাতিল দিয়ে নতুন ডেকচি নেবার ব্যবসা নিয়ে। মাঝেমাঝে দেখেছি পুরনো শাড়ি জামার বিনিময়েও আম্মা কিনে নিচ্ছেন এলুমিনিয়ামের নতুন কড়াই বা ডেকচি। আমাদের জন্যে কটকটিঅলা আর শোনপাপড়িঅলাও হেঁকে যেতো বিভিন্ন সময়। আমাদের কাজ ছিল মায়ের নির্দেশে দূর থেকে হাঁক শুনে সেই ফেরিঅলাদের চিৎকার করে করে ডেকে আনা। আরেক ফেরিঅলা আসতো রোজার মাসে সেহেরির সময়। আর কী মধুর স্বরে ডাকতো “এই মা-খে-ন”। প্রথম দিকে বুঝতাম না, কী মাখতে বলে এই লোক। একদিন বাবা কিনে আনলেন কলাপাতায় মোড়ানো কিছু একটা জিনিষ—দেখি ওটা ভাতের সাথেই মেখে মেখে খেতে হয় ক্রিম বা দইয়ের মতো কিছু। বুঝলাম, মাখতে বলার যে ধারণা মনে মনে মনের ভেতরে গেঁথে নিয়েছি তা অতো ভ্রান্ত নয়। বাবা বুঝিয়ে দিলেন, এটার নাম ‘মাখন’—এক ধরনের দুগ্ধজাত পদার্থ। এইরকম কতো ফেরিঅলা যে আসতো! আমার মায়ের কান সবসময় খাড়া থাকতো। সব্জিঅলাও হাঁক দিয়ে যেতো প্রতিদিন।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
সকাল ১০টা/১১টার দিক থেকে শুরু হতো ভিক্ষুকদের আনাগোনা। একটা বাটিতে মা পয়সা রেখে দিতেন। আমি আর লীনা, কে আগে সেই পয়সা ভিক্ষুককে দেবো তার প্রতিযোগিতা চলতো। কখনো সখনো ভিক্ষুক দুজনের হাত থেকেই নিয়ে যেতো মুদ্রার চাকতি। দুপুর হয়ে এলে ভিক্ষুকদের আবদার বেড়ে যেতো। তারা একথালা ভাত চেয়ে হাঁক দিতো। আম্মাকে দেখেছি প্রায় প্রতিদিন একজন ভিক্ষুককে ভাত খাইয়ে দিতেন। ভিক্ষুকেরা সেই আহার তৃপ্তির সাথে শেষ করে বিশাল লম্বা মুনাজাত ধরতেন; আমাদের জন্যে কতো কতো দোয়া করতেন! অনেকে সারাদিনের ক্লান্তির শেষে আহারের পর খানিকটা জিরিয়ে নিতেন আমাদের প্রশস্ত খোলা বারান্দায়। তবে, বেলা একটু বাড়লে আব্বা ঘরে ফিরতেন, এবং আব্বার প্রবেশের সাথে সাথে ভিক্ষুকদের এই বিশ্রাম বা মেলা বা আসর চুপসে গিয়ে ধীরে প্রস্থানোদ্যত হতে দেখেছি প্রতিবার। প্রতি শুক্রবারে একদল ভিক্ষুক নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে আসতো। আমার মা যেন এদের জন্যে প্রতীক্ষাই করতেন। এদের সবাইকে যেন তাঁর অনেক দিনের চেনা। এরা সপ্তা’র অন্যদিনে ভিক্ষা করতো না। এদের হাতে আম্মা তুলে দিতেন একটু বেশি অর্থ কিংবা পূর্বে মানত করা কোনো ছদকা’র চাল। ছদকা দেবার সময় আবার প্রতিবেশীদের কথাও মনে রাখতেন আম্মা। আমাদের আশেপাশে বেশ কয়েক ঘর খুব অভাবী প্রতিবেশী ছিল। আম্মা তাদের বাড়ির জন্যে আলাদা করে রাখতেন কিছু অর্থ চালডাল এমনকি পুরনো জামাকাপড়।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
মাঝে মাঝে ঘরে হয়তো কোনো মেহমান এলেন হঠাৎ তখন ভিক্ষুক ভাত চাইলে বলতেন ‘আজ ভাত বরকত’। আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না এই বরকত কী জিনিষ। আরেকটু বড় হয়ে শুনি বরকত একজন ভাষা শহীদের নাম। আর বরকত মানে বেশী। আরও বড় হয়ে বইতে পড়ি “ভাত বাড়ন্ত”। অভাবের ঘরে ভাত কমন্ত না হয়ে কেন যে বাড়ন্ত হয়েছিল, না বুঝে আম্মার শরণাপন্ন হয়েছিলাম একদিন। জানতে পেলাম, এটা একটা রীতি, অভাবের কথাটা উল্টা করে বলা। কম’কে বাড়িয়ে বলা। যখন আরও বড় হয়েছি, দেখলাম আমরা এমন এক অদ্ভুত জাতি— সবকিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলি। কারও জ্বর নেই কিন্তু জ্বরের মতো অনুভূতি হলো — বলে জ্বরজ্বর লাগে। এতোটা শীত লাগছে না, তবে কিছুটা ঠাণ্ডা— বলে শীতশীত লাগে।
বিকাল ৪:১৮
৩১ মে ২০২০
শৈশব ফিরে পেলাম যেন।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনশৈশব ফিরে পেলাম যেন।
উত্তরমুছুনমনুমিজ্জি গলির এই পথ বেয়ে কতই না গেছি এই বাসায়। মাতৃস্নেহে খালাম্মা আমাদের সকল যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করেছেন। রাশভারী খালুকে পেয়ে যেতাম সামনের রুমে, সামনে সব সময় খবরের কাগজ বা কোন বই থাকতো। আমরা সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়ালে দুই এক কথায় কুশল জিজ্ঞাসা করতেন; আমাদের উদ্দেশ্য থাকতো কত দ্রুত বাসার ভিতরে ঢুকে পড়া যায়।
উত্তরমুছুনকবির স্মৃতিকথা তাই পরিপার্শ্বের সাথে আছে কবির কবি হয়ে ওঠার মনোমুগ্ধকর বয়ান।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় আছি।