কবিতা এবং কবির সম্পর্কে নানান তালের আলাপ জারি আছে জগৎজুড়ে। কবিতা কী? কবি কে? ইত্যাদি। এইসব আলাপের কুল-কিনারার ফাঁক-ফোকরে আরো একটা আলাপ উঁকি দেয় স্বাভাবিক নিয়মে। আলাপটা, গণমানুষের কবিতা এবং গণমানুষের কবি সম্পর্কিত। অর্থাৎ গণমানুষের কবিতার চরিত্র এবং গণমানুষের কবির চরিত্র কেমন হওয়া উচিৎ, এইসব।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
প্রকৃতপক্ষে ‘গণমানুষের কবিতা’ এবং ‘গনমানুষের কবি’ শব্দবন্ধের মধ্যেই এদের সংজ্ঞা বা সারমর্ম হাজির। তবে যেটা আরো প্রকটভাবে হাজির সেটা হলো শব্দবন্ধদ্বয়ের অর্ন্তনিহিত অর্থের ভূল ব্যাখ্যা। মানে ব্যাখ্যাদানকারীগণের ব্যর্থতার কথাই বলছি। তো প্রথমেই আমরা আলোচ্য শব্দবন্ধদ্বয়ের প্রথমটি অর্থাৎ ‘গণমানুষের কবিতা’র উপর আলো ফেলতে পারি। গণমানুষের কবিতা বলতে এখানে গণমানুষের পাঠযোগ্য বা পাঠ অযোগ্য কবিতার কথাই বলা হচ্ছে, গণ মানুষকে উপজীব্য করে লেখা কবিতার কথা বলা হচ্ছে না। মূলত, গণমানুষের কবিতা বিষয়টিই ভ্রান্তিতে ভরা। কবিতা নিজেও এ ধরনের শ্রেণি বিন্যাসকে গ্রাহ্য করে না, করলে ‘নির্যাতনকারী মানুষের কবিতা, সুখি মানুষের কবিতা, দুখী মানুষের কবিতা, সুস্থ মানুষের কবিতা, অসুস্থ মানুষের কবিতা’ সহ আরো হরেক কিসিমের কবিতার শ্রেণিরূপ থাকতে পারতো। থাকে নাই যেহেতু, সেহেতু গণমানুষের কবিতা বলেও আলাদা কোন টার্ম থাকার কথা না। তথাপি শিল্পাঞ্চলে গণমানুষের কবিতা বিষয়ক আলোচনার প্রচুর কদর এবং গণমানুষের কবিতা কী রকম হবে সে সম্পর্কিত মতামতও প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। যেমন, গণমানুষের কবিতা অশ্যই সহজ সরল হতে হবে। গণমানুষের বোধগম্য হতে হবে, এম সি কিউ টাইপের হতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু গণমানুষ বিশেষজ্ঞদের এইসব আলাপের আড়লে বিশেষজ্ঞদের ব্যর্থতাই প্রকট হতে দেখা যায়। অর্থাৎ গণমানুষের চেতনা তৈরির দায়িত্ব কাঁধে নেয়া বিশেষজ্ঞগণ গণমানুষের বোধের উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে তাদের বোধহীন সত্ত্বাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। নিজেদের ব্যর্থতার তাত্ত্বিক দায় তারা চাপিয়ে দিতে চান কবি এবং কবিতার উপর; যা প্রকৃতপক্ষে গণমানুষের দূরদর্শিতার পথকেই রুদ্ধ করে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
বস্তুত, একটা দেশের পরিবর্তনকামী জনগোষ্ঠীকে, গণমানুষকে, সে দেশের অর্থনীতির ভাষা, রাজনীতির ভাষা, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভাষা সহ আরো অনক জটিল সমীকরণ অনুধাবন করতে হয়, যা মোটেও সহজসাধ্য নয়। তো যারা এতকিছু অনুধাবন করার যোগ্যতা রাখবে তারা কিঞ্চিৎ পরিমানে কবিতা অনুধাবন করতে পারবেনা এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্যভাবে বললে, যারা সামান্য পরিমানে কবিতা অনুধাবন করার যোগ্যতা রাখবে না তাদের পক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্রের জটিল সব হিসেব-নিকেশ বোঝাও সম্ভব নয় এবং তাদের পক্ষে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাও বৃথা। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, গণমানুষের কবিতা বলে পৃথক কোন টার্ম কবিতার জগতে নেই। তবে গণমানুষের কবিতা না থাকলেও গণমানুষের কবি থাকতে কোন সমস্যা নেই।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
গণমানুষ অর্থাৎ অবহেলিত বা অভিমানী মানুষ। এই শ্রেণিকে সুযোগ বুঝে সুবিধাবাদী বা সুবিধাভোগী শ্রেণি নানা সময়ে নানা ভাবে বিক্রি বা বিক্রিত করে থাকে। শিল্প সাহিত্যের কাঁচামাল হিসেবে এদের জীবনকে ব্যবহার করা হয় ইচ্ছেমতো। যারা ব্যবহার করে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার গণমানুষের কবি বা শিল্পীর মেডেল গলায় ঝুলিয়ে করে-মিলে খায়। গণমানুষের পক্ষে এদেরকে ধরা-ছোঁয়া বা এদের ছলচাতুরী বোঝা তো সম্ভব নয়ই, উপরন্ত গণমানুষ বিশেষজ্ঞরাও তাত্ত্বিক দুর্বলতার কারনে এদেরকে আপন ভেবে থাকে। ধোঁয়াশাটা তৈরি হয় মূলত আরেকটু দূর থেকে অর্থাৎ শিল্পীর ব্যক্তি সত্ত্বাকে অস্বীকার করে শিল্পী সত্ত্বাকে স্বীকার করে নেওয়া হয় তখন। শিল্প যখন শিল্পীর প্রতিছায়া তখন ছায়া যদি শরীরকে অস্বীকার করে একটু এদিক-সেদিক সরে যায় তাহলে বুঝতে হবে শিল্প কিছুটা তৈরি হয়েছে বটে তবে গোড়ায় খানিকটা গলদ রেখেই। ছদ্মশিল্পীর এই গলদকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে তাকে আরো মহান করে তোলা হয় বা মহামানবের গলদ জ্ঞানে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয় বা পুরস্কৃত করা হয়। যেভাবে এক বস্তা চাল চুরির অপরাধে একজন অভাবী মানুষকে চোর আখ্যা দিয়ে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয় আর এক লক্ষ বস্তা চাল চুরিতে অবদান রাখায় একজন স্বভাবী চোরকে সেলুট দেওয়া হয় বা সংবর্ধিত করা হয়। ঠিক একইভাবে আমরা সংবর্ধিত করি গলায় গণমানুষের কবির মেডেল ঝোলানো ছদ্মকবিকে। বিষয়টাকে আরেকটু খোলাসা করা যাক।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
ধরা যাক, একজন কবি তার কবিতায় গণমানুষের অধিকার, দুঃখ-বেদনার চিত্র এঁকে সাড়া ফেলে দিলেন। শিল্পাঞ্চল তাকে গণমানুষের কবি হিসেবে চিহ্নিত করে ফেললো। তাতে সমর্থন দিলেন গণমানুষ বিশেষজ্ঞরা। এরপর বুর্জোয়া মিডিয়া বা শোষক শ্রেণি, যাদের কারণে মূলত গণমানুষ নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, লাঞ্চিত হয় পদে পদে, তাদের কাছ থেকে পদক বা পুরস্কার নিলেন আমাদের তথাকথিত গণমানুষের কবিটি। তাহলে দেখা যাচ্ছে গণমানুষের ছদ্মকবিটি প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই গণমানুষের বিপক্ষের শ্রেণিকে শোষণের ন্যায্যতা দিয়ে যাচ্ছেন, যার ফলে আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে গণমানুষের কান্না। অর্থাৎ যাকে এতক্ষণ আমরা গণমানুষের কবি হিসেবে জানতাম সে গণমানুষের কবি তো নয়ই বরং সে শোষক শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করছে। মূলত যে কবি গণমানুষের পক্ষের না, তার কবিতাও গণমানুষের পক্ষের হতে পারে না।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
প্রকৃতপক্ষে যিনি গণমানুষের কবি, তাঁর কবিতায় গণমানুষের কথা আছে কী নেই সেটা বড় কথা নয়, কথা হচ্ছে তিনি গণমানুষের অধিকার আদায়ের স্বপক্ষে কী না। স্বপক্ষে হলে তিনি গণমানুষের কবি, স্বপক্ষে না হলে তিনি গণ মানুষের কবি নন। কারণ যিনি কবিতা লেখেন তিনি মূলত কবি, তিনি কী ধরনের কবিতা লেখেন সেটা মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে তিনি কবিতা লেখেন এবং তিনি কবি। এরপর তিনি সোসাইটিতে যে ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছেন অর্থাৎ তার ভূমিকার উপর ভিত্তি করেই সোসাইটি তার পক্ষপাতিত্বের দিকটি চিহ্নিত করবে।
মন্তব্য